প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক বিজ্ঞানীর নাম হিপারকাস। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, প্রাচীন গ্রীসের সবচেয়ে সফল জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিপারকাস। দুই সহস্রাধিক বছর আগে, যখন প্রযুক্তি বলতে ছিল না কিছুই, তখন পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব মেপেছেন এই জ্যোতির্বিদ। যখন বর্ষপঞ্জি পরিবর্তিত হতো ঘন ঘন, তখন বছরের দৈর্ঘ্য প্রায় সঠিকভাবে পরিমাপ করে বর্ষপঞ্জিকে স্থায়িত্ব দেন এই বিজ্ঞানী। যখন গণিতবিদেরা শুধু জ্যামিতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন সারাক্ষণ, তখন ত্রিকোণমিতি নামক গণিতের এক নতুন শাখার সৃষ্টি করেন এই গণিতবিদ। শুধু কি তা-ই? তার ত্রিকোণমিতি বিষয়ক ‘কম্বিনেটরিকস’ ১৮৭০ সাল পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কাজ ছিল। আট শতাধিক তারার এক তালিকাও তৈরি করেছিলেন হিপারকাস। অথচ তার এই তালিকা ব্যবহার করে (অন্তত অধিকাংশ ইতিহাসবিদ তা-ই বিশ্বাস করেন), কিছু গাণিতিক সমীকরণ প্রয়োগ করে, প্রায় ১,৫০০ বছর জ্যোতির্বিজ্ঞান শাসন করেছেন ক্লডিয়াস টলেমি।
হিপারকাস খুব সম্ভবত ১৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রীসের নাইসিয়া নামক এক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তুরস্কের ইজনিকে সে শহরের ধ্বংসাবশেষ এখনো দেখতে পাওয়া যায়। হিপারকাসকে অনেক সময় ‘হিপারকাস অব রোডস’ বলেও পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। কারণ জীবনের একটা বড় সময় তিনি গ্রীসের রোডস দ্বীপে কাটিয়েছেন। আজ অবধি তার টিকে থাকা কাজগুলো পর্যালোচনা করতে গেলে আফসোস করতে হয়। কারণ যে সকল গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন, সেগুলো তার মোট কাজের অর্ধেকেরও কম! হারিয়ে যাওয়া কাজগুলোও যে খুবই উৎকৃষ্ট মানের ছিল, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ সে কাজগুলো হারিয়ে গেলেও সমসাময়িক অনেক বিজ্ঞ পণ্ডিতের লেখায় সেগুলোর উদাহরণ পাওয়া যায়। তার নিজ শহর নাইসিয়া তাকে নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত ছিল। ১৩৮-২৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাইসিয়ায় যে মুদ্রা প্রচলিত ছিল, সেগুলোয় হিপারকাসের ছবি ছিল। তবে সে মুদ্রার ছবি যে অবিকল তারই, সেটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কারণ এই মুদ্রাও প্রথম প্রচলিত হয় তার মৃত্যুর প্রায় আড়াইশ বছর পর। তিনি ১২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোডসে মৃত্যুবরণ করেন।
জ্যামিতিতেই হিপারকাস তার প্রথম বড় সাফল্য পান। হিপারকাসের পূর্বে অনেক বিখ্যাত পণ্ডিতের হাত ধরে গ্রীক, মিশরীয় আর ব্যাবিলনীয় সংস্কৃতির মিশেল ঘটেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানেও এই তিন সংস্কৃতি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল ছিল। হিপারকাস এর মধ্যে ব্যাবিলনকেই বেছে নিলেন। বিশেষ করে বৃত্তকে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি ব্যাবলনীয় ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করার পদ্ধতিই গ্রহণ করলেন। পাশাপাশি প্রতি ডিগ্রিকে হিপারকাস ভাগ করলেন ৬০ মিনিটে। আর আমাদের সকলেরই জানা আছে যে, তার এই পদ্ধতি এখনো প্রচলিত আছে! অন্যদিকে ত্রিকোণমিতি হচ্ছে ত্রিভুজ সংক্রান্ত গণিতেরই সরল রূপ। ত্রিকোণমিতি ব্যবহারে জোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় হিসাব নিকাশ বেশ সহজ হয়ে যায়। হিপারকাস ত্রিকোণমিতি আবিষ্কার করেন এবং বিভিন্ন কোণের জ্যা এর একটি সারণী তৈরি করেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে ‘প্যারালাক্স’ বা লম্বন বলে একটি শব্দ আছে। লম্বন বলতে বোঝায় কোনো বস্তু বা অভিমুখের আপেক্ষিক অবস্থান দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন দেখতে পাওয়া। উদাহরণ পেতে চাইলে এক হাতে নিজের এক চোখ বন্ধ করে অপর হাতটি একটু দূরের কোনো বস্তুর সাপেক্ষে উঁচু করে ধরুন। এবার হাত একই অবস্থায় রেখে, প্রথম চোখ খুলে দ্বিতীয় চোখটি বন্ধ করুন। কী দেখতে পাচ্ছেন? বস্তুটির অবস্থান ভিন্ন মনে হচ্ছে কি? নিচের ছবিটিতে বিষয়টি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবেন।
লম্বনের ক্ষেত্রে একটি কথা মাথায় রাখা জরুরি, আর তা হচ্ছে, আপনার চোখ থেকে বস্তুর দূরত্ব যত বেশি হবে, লম্বন তত কম হবে। তবে চাঁদের ক্ষেত্রে লম্বন অগ্রাহ্য করার মতো নয়। আর যদি কোনো মহাকাশীয় বস্তু (চাঁদ, তারা, সূর্য ইত্যাদি) মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিমাণ লম্বন দেখায় তাহলে জ্যোতির্বিদরা তার দূরত্ব জ্যামিতির সাহায্যে পরিমাপ করেন। কিন্তু হিপারকাস লম্বন ব্যবহার করেই চাঁদের দূরত্ব নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। এই পদ্ধতিতে তিনি দুবার দুটি ফলাফল পান। প্রথমবারের পরিমাপে চাঁদের দূরত্ব নির্ণয় করেন ৭৭ রেডি (রেডি হচ্ছে রেডিয়াসের বহুবচন)। দ্বিতীয়বারের পরিমাপে সংখ্যাটা ৬৭১/৩ নির্ণয় করেন। তবে এই পরিমাপে হিপারকাস মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি এটা নিয়ে আরো কয়েক মাস পর্যবেক্ষণ এবং হিসাব নিকাশ করে অবশেষে ৬০.৫ বা ৬১ বলে ঘোষণা দেন। আধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা নির্ণিত সংখ্যাটা ৬০ রেডি। ব্যবধান মাত্র .৫-১। এর মানে দাঁড়ালো যে, ২,০০০ বছর আগে আজকের আধুনিক প্রযুক্তিকে টেক্কা দিয়েছেন হিপারকাস।
সে সময় বর্ষপঞ্জিগুলো বছর বছর পরিবর্তিত হতো। কোনো বর্ষপঞ্জি নিখুঁত হচ্ছিল না বলেই এমন হয়। আর বর্ষপঞ্জি নিখুঁত হবার প্রথম শর্তই হচ্ছে বছরের দৈর্ঘ্য সঠিকভাবে নির্ণয় করা। তিনি প্রায় এক বছর গবেষণা এবং জটিল সব হিসাব নিকাশের পর সৌরবর্ষের যে দৈর্ঘ্য নির্ণয় করলেন, তা আধুনিক গণনা থেকে মাত্র ৬ মিনিট কম ছিল!
গণিতের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে ‘কম্বিনেটরিকস’ বা সংযুক্তকারিতা। কম্বিনেটরিকস মূলত কোনো বস্তু সর্বোচ্চ কত উপায়ে সাজানো যেতে পারে, এ ধরনের গণিত নিয়ে কাজ করে। পরিসংখ্যানগত পদার্থবিদ্যা, কম্পিউটার সায়েন্স, সম্ভাবনা এবং বিশুদ্ধ গণিতে কম্বিনেটরিকস কাজে লাগে। কম্বিনেটরিকসে হিপারকাসের কাজ আলোচনা করতে গেলে তাকে অবশ্যই এই গণিতের ‘মাস্টার’ মানতে হবে। তার সমকালীন একজন গণিতজ্ঞ বলেছিলেন যে, ১০টি বস্তুকে ১০ লক্ষাধিক উপায়ে সাজানো যেতে পারে। কিন্তু হিপারকাস এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন এবং ১০৩,০৪৯ উপায়ে সাজানো যায় বলে দাবি করেন।
ব্যাপারটি সহজ করার জন্য একটি সহজ উদাহরণ দেয়া যাক। মনে করুন আপনার কাছে তিনটি সংখ্যা ১, ২ ও ৩ আছে। এগুলোকে আপনি সর্বোচ্চ ৬ উপায়ে সাজাতে পারবেন- ১২৩, ১৩২, ২১৩, ২৩১, ৩১২ ও ৩২১। একইভাবে ৪টি বস্তুকে ১১ উপায়ে, ৫টি বস্তুকে ৪৫ উপায়ে সাজাতে পারবেন। ঠিক তেমনি আপনার কাছে ১০টি সংখ্যা বা যেকোনো বস্তু থাকলে সেগুলোকে ১০৩,০৪৯টি পৃথক উপায় সাজাতে পারবেন। অথচ এরকম কম্বিনেটরিকসের সমাধানের সূত্র আবিষ্কৃত হয়েছে ১৮৭০ সালে। ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে ২,২০০ বছর আগে এই জটিল হিসাব কোনো গণনাযন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই সমাধান করেছিলেন হিপারকাস!
ঘূর্ণায়মান লাটিম তো দেখেছেন অবশ্যই। লাটিমের ঘূর্ণন যত কমতে থাকে, লাটিম তত দুলতে থাকে, বা অন্য কথায় টলতে থাকে। একইরূপ ঘটে পৃথিবীর ঘূর্ণনের ক্ষেত্রে। পৃথিবী এর অক্ষের উপর দিয়ে ঘোরার সময় লাটিমের মতো ঘুরতে থাকে এবং কিছুটা টলতেও থাকে। তবে পৃথিবীর এই লাটিম সদৃশ দোলন অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমাণে ঘটে। একে বলে অয়নচলন। ফলে নির্দিষ্ট সময় পরপর পৃথিবীর ভৌগোলিক উত্তর মেরু এর মূল অবস্থান থেকে সরে যায়। তবে একটি সম্পূর্ণ অয়নচলন চক্র সম্পন্ন হলে পৃথিবীর উত্তর মেরু তার স্ব-অবস্থানে ফিরে আসে। এই একটি চক্র শেষ হতে সময় লাগে ২৬,০০০ বছর। এর অর্থ দাঁড়ালো যে পৃথিবীর উত্তর মেরু প্রতি ১০০ বছরে মাত্র ১.৪° ডিগ্রি সরে যায় কিংবা বিপরীতক্রমে আগের অবস্থানের দিকে ফিরে আসে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এরকম জটিল একটি ব্যাপার যে ব্যক্তি প্রথম লক্ষ্য করেন, তিনি হিপারকাস। তিনি তার জন্মের ১৬০ বছর পূর্ববর্তী গ্রীক বিজ্ঞানী টিমোয়ার্কাস এর কিছু তারার পর্যবেক্ষণের সাথে নিজের সময়ে সেই একই তারাগুলোর পর্যবেক্ষণ তুলনা করেন। এই পর্যবেক্ষণগুলো ছিল কেবল বছরের দুটি নির্দিষ্ট দিনের, যে দিনগুলোতে দিন এবং রাতের দৈর্ঘ্য সমান হয়। হিপারকাস দেখেন, তারাগুলোর অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এই সরে যাওয়ার পরিমাণ (অয়নচলন) প্রতি শতকে ১ ডিগ্রি। কোনোরূপ প্রযুক্তি আর জটিল সমীকরণ ছাড়া এই ভবিষ্যদ্বাণীকে বিস্ময়কর বলা চলে।
১৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিপারকাস ৮৫০টির মতো তারার একটি সারণী তৈরি করেন। এই সারণীতে তিনি তারাগুলোর অবস্থানাঙ্ক এবং ১-৬ মাত্রায় আপেক্ষিক উজ্জ্বলতা উল্লেখ করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে তার এই আপেক্ষিক উজ্জ্বলতা লেখার পদ্ধতি জোতির্বিদদের এতই পছন্দ হয়েছে যে, বর্তমানে এই ১-৬ স্কেলেই তারার উজ্জ্বলতা মাপা হয়। উল্লেখ্য, ১ হচ্ছে উজ্জ্বল তারার মান যা খুব সহজে দেখা যায়। আর ৬ হচ্ছে কম উজ্জ্বল তারার মান যা দেখাই যায় না প্রায়। হিপারকাস আকাশের স্থায়ী তারাগুলোর স্থায়ীত্ব সম্পর্কে দ্বিধান্বিত ছিলেন। যেহেতু তিনি অয়নচল লক্ষ্য করেছিলেন, সেহেতু তিনি এটাও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, আকাশে ‘কনস্টেলেশন’ বা তারকামণ্ডলীর আকার ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। এ ব্যাপারটি তিনি নিজে প্রত্যক্ষ করতে না পারলেও, তার পরবর্তী প্রজন্ম পারবে বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন। তার বিশ্বাস প্রথম সত্য প্রমাণ করেন অ্যাডমান্ড হ্যালি।
হিপারকাসের অনেক বিস্ময়কর কাজ সম্পর্কে আমরা জানলাম। এগুলো জানবার পর দুটি আফসোস থাকতে পারে। একটা তার ঘটনাবহুল জীবনী সম্পর্কে আরেকটু বেশি যদি জানার আফসোস। অপরটি হচ্ছে তার সবগুলো কাজ অক্ষত না থাকার আফসোস। সবগুলো কাজ আজ অবধি অক্ষত নেই, তারপরও তার কাজের পরিধি দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। আর সব পাওয়া গেলে কী হতো!
ফিচার ছবি: Fine Art America