বিল গেটস; এ নামটির সাথে কি আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোনো দরকার আছে? বোধহয় নেই। প্রায় গত এক দশক ধরেই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে তার নামটি আমাদের সবার জানা আছে। তাও লেখা শুরুর সুবিধার্থে চলুন তার সাথে একটু পরিচিত হয়ে নেয়া যাক। বিল গেটস বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পড়াশুনা করেছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, যদিও বেশীদিন চালিয়ে যাননি; প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা ছেড়েছুড়ে মনোযোগ দিয়েছেন ব্যবসায়। আর সেখান থেকে কালক্রমে আজ পরিণত হয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে।
হালের মোটিভেশনাল স্পিকারদের কল্যাণে বিল গেটসের এই হার্ভার্ড ড্রপ-আউট হওয়ার গল্পটাও আমাদের সবার জানা। হারহামেশাই শোনা যায়, “বিল গেটস যদি ইউনিভার্সিটি ড্রপ-আউট হয়েও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারেন, তবে তুমি পারবে না কেন?” এ ধরনের কথাগুলো হয়তোবা অনুপ্রেরণামূলক; কিন্তু এসব কথায় খুব সযত্নে কিছু সত্য গোপন করে রাখা হয়।বক্তারা এড়িয়ে যান যে, বিল গেটস স্রেফ একজন ‘ড্রপ-আউট ছাত্র’ ছিলেন না, তিনি ঐ বয়সে সেসময়কার প্রোগ্রামিং দুনিয়ার একজন জিনিয়াস ছিলেন। বিল গেটস পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে বা হতাশায় ভুগে হার্ভার্ড ছড়েননি, তিনি ভালো গ্রেড পাওয়া সত্ত্বেও নিজের ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য হার্ভার্ড ছেড়েছিলেন।
আজকের লেখায় বিল গেটসের সেই প্রোগ্রামিং জিনিয়াস হয়ে উঠার গল্পই বলা হবে, জানানো হবে কৈশোরে তার সেই অক্লান্ত পরিশ্রমের গল্প, রাতজাগা সময়গুলোর গল্প; যে সময়গুলো তিনি প্রোগ্রামিংয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন; যা তাকে এগিয়ে দিয়েছে আজকের বিল গেটস হওয়ার পথে।
বিল গেটস জন্মগ্রহণ করেন ২৮ই অক্টোবর, ১৯৫৫। তার বাবা ছিলেন সিয়াটলের একজন ধনী আইনজীবী, মা এক সম্পদশালী ব্যাংকারের কন্যা; তাই বলা যায় বিল নিজেও ধনী পরিবারেই জন্মেছিলেন। ছোটবেলায় গৎবাঁধা পড়াশুনায় অল্পতেই বিরক্ত হয়ে পড়তেন তিনি, তাই সেভেন্থ গ্রেডে থাকার সময় তাকে পাবলিক স্কুল থেকে এনে সিয়াটলের বিখ্যাত প্রাইভেট স্কুল ‘লেকসাইড স্কুল‘-এ ভর্তি করানো হয়। এখানে সব অভিজাত পরিবারের সন্তানরা পড়তো। এ স্কুলেই তার জীবনের টার্নিং পয়েন্টগুলোর একটি ঘটে।
এ স্কুলে অভিভাবকদের সংস্থা ‘মাদার্স ক্লাব’-এর পক্ষ থেকে প্রতি বছর স্কুলের পেছনে ব্যয় করার জন্য টাকা উত্তোলন করা হতো। বিল এখানে আসার পরের বছর মাদার্স ক্লাব থেকে একটি অসাধারণ উদ্যোগ নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় মাদার্স ক্লাবের অর্থ দিয়ে স্কুলে একটি কম্পিউটার ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হবে। সে সময়ের প্রায় তিন হাজার ডলার খরচ করে গঠিত হয় কম্পিউটার ক্লাব; গেটসদের কাছে তখন কম্পিউটার ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর একটি বস্তু।
‘বিস্ময়কর বস্তু’ কেন তা বুঝতে হলে সালটা স্মরণে রাখতে হবে। এটি ছিল ১৯৬৮ সাল; কম্পিউটার প্রযুক্তি তখন সবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোতে শিখছে। যে ধরনের কম্পিউটারের ব্যবস্থা করছিল, তা-ও সেই সময়ের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল। তারা স্কুলে একটি টার্মিনাল স্থাপন করেছিল, যা সংযুক্ত ছিল সিয়াটল শহরের মেইনফ্রেম কম্পিউটারের সাথে। তাই স্কুলে বসেই টেলিটাইপিংয়ের মাধ্যমে বাচ্চারা কম্পিউটারে কাজ করতে পারতো।
কম্পিউটারে কাজ করার এ পদ্ধতিটিকে বলা হতো টাইম শেয়ারিং সিস্টেম। এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল কেবল ১৯৬৫ সালে। এর আগে কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করতে হতো পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমে, পাঞ্চ কার্ডে কোড প্রিন্ট করিয়ে নিয়ে জমা দিতে হতো অপারেটরের কাছে। তার ওপর কম্পিউটারগুলো একবারে মাত্র একটি নির্দেশ সম্পাদন করতে পারতো, তাই নিজের প্রোগ্রাম যাচাই করার জন্য দরকার হতো এপয়েন্টমেন্ট; মোট কথা, বিশাল ঝক্কি ঝামেলার ব্যাপার ছিল।
টাইম শেয়ারিং এসে সেসব থেকে মুক্তি দেয়। এরপর কম্পিউটারে একসাথে অনেকে কাজ করতে সক্ষম হয়। মেইন কম্পিউটারের কাছে যাওয়া লাগে না, একটি টার্মিনালের সাথে সংযুক্ত করে সেখান থেকেই কাজ করা যায়। আবিষ্কারের মাত্র তিন বছরের মাথায় এমন একটি টার্মিনালই স্থাপন করা হয়েছিল গেটসদের স্কুলে।
সেই কম্পিউটার ক্লাব গেটসদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। এই ‘অদ্ভুত যন্ত্রটি’ কীভাবে কাজ করে তা শিখতে মেতে উঠেন তারা। মূল মেইনফ্রেম কম্পিউটার থেকে সময় (কম্পিউটার টাইম) কিনে নিয়ে তারা এই টার্মিনালে কাজ করতেন। অবশ্য এটি বেশ ব্যায়বহুল ছিল।
মাদার্স ক্লাবের সেই তিন হাজার ডলার ফুরিয়ে যেতে বেশীদিন লাগেনি। অভিভাবকরা আবার টাকা তুললেন, ছেলেরা আবার তা ব্যয় করতে লাগল। এভাবেই বিল গেটসের সাথে কম্পিউটারের পরিচয় হয়, আর শুরু হয় সফটওয়্যার জায়ান্ট মাইক্রোসফটের বীজ বোনা। মাইক্রোসফটের আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা পল অ্যালেনও সেই লেকসাইড স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন।
এ সময় ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের একদল প্রোগ্রামার মিলে কম্পিউটার সেন্টার কর্পোরেশন (সি কিউব) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করে। তারা একটি প্রকল্প হাতে নেয় যেটার অধীনে তাদের কিছু সফটওয়্যার পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিনিময়ে তারা ফ্রীতে ‘কম্পিউটার টাইম’ দেবে। সৌভাগ্যবশত সি কিউবের এক কর্মকর্তার ছেলে তখন পড়ত গেটসদের লেকসাইড স্কুলে। সে সুবাদে লেকসাইড কম্পিউটার ক্লাব ফ্রীতে কম্পিউটার টাইম পেয়ে যায়। স্কুল শেষে গেটসরা চলে যেতেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে, সি-কিউবের অফিসে। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতো প্রোগ্রামিং।
কিন্তু কিছুদিন পর সি কিউব দেউলিয়া হয়ে যায়। গেটসদের আড্ডা ভেঙ্গে যায়, আর তারা ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে শুরু করেন যদি কোনো সুযোগ মেলে। সুযোগও মিলে গেল, আইএসআই (ইনফরমেশন সায়েন্সেস ইনকর্পোরেটেড) নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের ফ্রীতে কম্পিউটার টাইম দেয়। বিনিময়ে তারা তাদের কোম্পানীর বেতন প্রক্রিয়া অটোমেটিক করার জন্য একটি সফটওয়্যারের ওপর কাজ করতে সম্মত হন।
এটি ১৯৭১ সালের কথা। এ বছরে আইএসআই-তে কাটানো সাত মাসের মধ্যে গেটস ও তার সঙ্গীরা প্রোগ্রামিং করেছিলেন প্রায় ১,৫৭৫ ঘন্টা। গড় করলে হিসেব দাঁড়ায় প্রায় আট ঘন্টা করে প্রতিদিন। বিল গেটস সে সময়গুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “প্রোগ্রামিং আমার প্রায় নেশার মতো হয়ে উঠেছিল। এর জন্য স্কুলে অ্যাথলেটিকসও ছেড়ে দিয়েছিলাম। কখনো কখনো রাতে গিয়ে হাজির হতাম অফিসে। প্রোগ্রামিং করে কাটাত উইকএন্ডগুলোও।”
আইএসআই-তে তাদের দিন ভালোই কাটছিলো। কিন্তু পল অ্যালেন ও গেটস একটা ঝামেলা পাকিয়ে তুললেন। তারা কিছু পাসওয়ার্ড চুরি করতে গিয়ে পুরো সিস্টেমটাকে ক্রাশ করে দিয়েছিলেন। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের বের করে দেয়া হলো। সেই গোটা গ্রীষ্মকাল আর কম্পিউটারের ধারে-কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি গেটসের। কিন্তু তারা কি আর দমে যাওয়ার পাত্র? পল অ্যালেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে ফ্রী কম্পিউটারের সন্ধান বের করে ফেললেন।
মেডিক্যাল আর ফিজিক্স বিভাগে এসব কম্পিউটার ছিল। এগুলোতে চব্বিশ ঘন্টাই বিভিন্ন কাজের শিডিউল দিয়ে দেয়া থাকতো। কিন্তু গেটসদের কপাল প্রসন্ন বলতে হবে, তারা জানতে পারলেন ভোর তিনটা থেকে ছয়টার মধ্যে এগুলোতে কোনো শিডিউল থাকে না। গেটস এবং অ্যালেন মাঝরাত্তিরে ঘুমানোর বদলে হাজির হতেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে। পরবর্তীতে তিনি মজা করে বলতেন “আমি ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের কাছে সবসময় কৃতজ্ঞ বোধ করি, কারণ তারা আমাকে প্রচুর কম্পিউটার-টাইম চুরি করার সুযোগ দিয়েছিল।”
এরপর গেটসের জীবনে আরেকটি টার্নিং পয়েন্ট আসে। টিআরডব্লিউ নামে একটি প্রযুক্তি কোম্পানী একটি বিশাল পাওয়ার প্ল্যান্টকে কম্পিউটার সিস্টেমের আওতায় আনার একটি চুক্তি করে। তারা এ কাজের জন্য উপযুক্ত প্রোগ্রামার এর সন্ধান করছিল। তাদের একজন যোগাযোগ করে আইএসআই-এর একজন প্রতিষ্ঠাতার সাথে। সে সময়ে এতটা দক্ষতা সম্পন্ন প্রোগ্রামার হাতেগোনা কয়েকজন ছিল। কিন্তু তিনি এমন কয়েকজনের সন্ধান ঠিকই জানতেন, লেকসাইড স্কুলের সেই বিচ্ছুগুলো, যারা আইএসআই-এর মেইনফ্রেমে কয়েক হাজার ঘন্টা কাটিয়ে গেছে।
বিল স্কুল থেকে একটি স্টাডি প্রজেক্ট নেন এবং এই ছুতোয় হাজির হন পাওয়ার প্লান্ট প্রজেক্টের ওখানে। সেখানে তিনি জন নর্টন নামক একজন ব্যক্তির অধীনে কোডিং করেন। গেটস পরবর্তীতে বলেন, প্রোগ্রামিং বিষয়ে তিনি অন্য যে কারো চেয়ে নর্টনের কাছে বেশী শিখেছিলেন।
এইটথ গ্রেড থেকে শুরু করে হাই স্কুলের সমাপ্তি পর্যন্ত এই পাঁচ বছরের সময়টাকে আজকের বিল গেটসের গড়ে ওঠার সময় বলা যায়। সে সময় যেসব অসাধারণ সুযোগ তার সামনে এসেছিল এবং তিনি যেভাবে সেগুলোকে ব্যবহার করেছেন, এসবই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সেই দিনগুলোর কল্যাণেই হার্ভার্ডের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা ছেড়ে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। তিনি যখন হার্ভার্ড ছেড়ে নিজের কোম্পানী মাইক্রোসফট শুরু করেন, তখন তার ঝুলিতে আছে লাগাতার সাত বছর ধরে প্রোগ্রামিং করার অভিজ্ঞতা।
বিলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, সে সময়ের পৃথিবীতে কৈশোরেই তার মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আর কতজন ব্যক্তি থাকতে পারে? তার জবাব ছিল, “গোটা পৃথিবীতে সর্বসাকুল্যে পঞ্চাশজন হতে পারে। এর বেশী হলে আমি ভীষণ অবাক হব।” কৈশোরে তার এমন অনন্য অভিজ্ঞতার ফলেই তিনি তখন বুঝেছিলেন, বাবার মতো স্রেফ সফল আইনজীবী হওয়া নয়, তার ভাগ্য আসলে লেখা আছে অন্য কোনোখানে। এ সময়েই প্রযুক্তি জগতের একজন পুরোধা হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলেন তিনি, শিখেছেন পৃথিবীকে বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখতে।
ফিচার ইমেজ- alayam.com