রাস্তা থামায়ে দিলো
রাস্তা থামায়ে দিলো
কাফেলা…
এলো দিল্লীতে নিজামউদ্দিন আউলিয়া
ধন্য ধন্য মেরা
ধন্য ধন্য মেরা
সিলসিলা…
এলো দিল্লীতে নিজামউদ্দিন আউলিয়া
একদিন হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া মুরিদদের জন্য বিশেষ ‘সামা’ মাহফিলের আয়োজন করেন। কিন্তু রান্নাবান্নার আয়োজন দেখেই হাজারখানি লোক জড়ো হয়ে গেলো সেখানে। মাহফিলের জন্য ৫০-৬০ জনের রান্নার ব্যবস্থা হচ্ছিল। হঠাৎ করে এতো লোক দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সঙ্গীরা। তবে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগাহ থেকে কেউ খালি মুখে ফেরত যাবে না এমনটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
হযরত নিজামউদ্দিন তার এক খাদেমকে ডেকে উপস্থিত সকলের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন। দশজন দশজন করে খাবারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন তিনি। খাদেমরা একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতে তিনি খাদ্যসংকট সমাধানের একটি উপায় বাতলে দিলেন। প্রতিটি রুটি চারভাগ করে একেক ভাগ একজনকে দিতে বললেন নিজামউদ্দিন। তবে রুটি দেয়ার আগে ‘বিসমিল্লাহ শরীফ’ অবশ্যই পড়ে নিতে হবে। খাদেমরা সেই নির্দেশ মোতাবেক দোয়া পড়ে সবাইকে চারভাগের একভাগ করে রুটি দিতে লাগলেন। মহান আল্লাহ্র অশেষ রহমতে উপস্থিত হাজারো ব্যক্তি তৃপ্তির সাথে খানা শেষ করলেন। বিস্ময়ের সাথে খাদেমরা আবিষ্কার করলেন অতিথিরা খেয়ে দরগাহ থেকে চলে যাওয়ার পরও রুটি অবশিষ্ট ছিল।
এমনই হাজারো সব চমকপ্রদ ঘটনার সাথে মিশে আছে একটি নাম- নিজামউদ্দিন আউলিয়া। শুরুর গানটির সাথে কমবেশি আমরা প্রায় সবাই পরিচিত। ভারতীয় উপমহাদেশে যে কজন সুফি সাধক এসে এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে সুফি মতবাদকে জনপ্রিয় করে গেছেন, তাদের মধ্যে মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন আউলিয়া অন্যতম পথিকৃৎ। তাকে অনেক সময় হযরত নিজামউদ্দিন বলেও ডাকা হয়। এই অঞ্চলে চিশতিয়া তরিকার একজন নামকরা সুফি সাধক তিনি। তার পূর্বসূরি ছিলেন ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার, কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী এবং মইনউদ্দিন চিশতী। এই পরিক্রমায় নিজামউদ্দিন চিশতী মতবাদের ‘সিলসিলা’ বা আধ্যাত্মিক ধারাবাহিকতাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান এবং এর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তোলেন বহুগুণে।
পূর্বসূরিদের পথ ধরে প্রেম বা ইশককে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার পথ হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে খোদার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে ভালোবাসলেই ঈশ্বর সবচেয়ে বেশি খুশি হন। ধর্মীয় বহুত্ববাদ এবং সকলের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে ভীষণ বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ১৪ শতকের এক ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানির ভাষ্যমতে, নিজামউদ্দিন আউলিয়া তৎকালীন মুসলিমদের উপরে এতোটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে তারা দুনিয়াবী চিন্তা বাদ দিয়ে ইবাদতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। পার্থিব বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে পারার মতো ব্যক্তিত্বের জাদু নিয়ে দিল্লীতে সুফিবাদকে জনপ্রিয় করেন এই আউলিয়া।
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া হিজরি ৬৩৬ সনে জন্মগ্রহণ করেন বলে জানা যায়, ইংরেজি সন অনুযায়ী সেটা ১২৩৯ সাল। ধর্মের প্রতি তাঁর ভক্তি ও শ্রদ্ধার জন্য তিনি ‘মেহবুব-এ-এলাহি’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। গিয়াসউদ্দিন বলবানের আমলে তাকে ‘শামস-উল-মালিক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মোহাম্মদ। বংশগত দিক থেকে তিনি হযরত আলী (রা.) এর উত্তরসূরি। হযরত মোহাম্মদ (সা) এর মৃত্যুর বেশ কিছুকাল পরে বুখারা থেকে লাহোরে চলে আসে তাঁর পরিবার। সেখান থেকে নিজামউদ্দিনের দাদা ও তাঁর ভাই, খাজা আলী এবং খাজা আরব সপরিবারে ভারতের উত্তর প্রদেশের বাদায়ুনে চলে আসেন। সেখানেই সফরের ২৭ তারিখে জন্ম হয় নাজিমউদ্দিনের।
মাত্র ৫ বছর বয়সে বাবা সৈয়দ আবদুল্লাহ বিন আহমেদ আল হুসাইনি বাদায়ুনিকে হারান তিনি। মা বিবি জুলেখার দেখাশোনাতেই বেড়ে ওঠেন নিজামউদ্দিন, মায়ের হাত ধরে চলে আসেন দিল্লীতে। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার জীবনী প্রথম উল্লেখ করা হয় ‘আইন-ই-আকবরি’ নামক একটি প্রবন্ধে। ষোড়শ শতকে এই প্রবন্ধটি লেখেন মোঘল বাদশা আকবরের উজির, আবুল-ই-ফজল ইবন মুবারাক।
বিশ বছর বয়সে নিজামউদ্দিন অযোধ্যায় চলে আসেন এবং সুফি সাধক ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার মূলত বাবা ফরিদ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। নিজামউদ্দিন অযোধ্যায় তাঁর স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেননি। দিল্লীতে ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার পাশাপাশি সুফিবাদের প্রতিও তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়ে যায়। প্রতি বছর বাবা ফরিদের উপস্থিতিতে অযোধ্যায় পবিত্র রমজান মাসব্যাপী ইবাদত-বন্দেগী করতেন তিনি। অযোধ্যায় তৃতীয় রমজান মাস অতিবাহিত করতে এলে বাবা ফরিদ তাকে নিজের উত্তরাধিকারী বা খলিফা হিসেবে মনোনীত করেন। এ ঘটনার পরপরই দিল্লীতে এসে তিনি খবর পান যে বাবা ফরিদ মারা গেছেন।
গিয়াসপুরে পাকাপোক্তভাবে বসবাস শুরু করার আগে দিল্লীর বিভিন্ন জায়গায় ছিলেন নিজামউদ্দিন। শহরের কোলাহল থেকে কিছুটা দূরে একটি ফাঁকা জায়গা খুঁজে বের করেন তিনি। এখানেই তিনি তাঁর খানকাহ নির্মাণ করেন। খানকাহ হলো এমন একটি জায়গা যেখানে সর্বস্তরের জনগণকে খাওয়ানো হয়, তাদের সেবা করা হয় এবং আধ্যাত্মিক বিষয়াদি সম্পর্কে জানানো হন। খানকাহের পাশেই নিজের থাকার জায়গার ব্যবস্থা করেন নিজামউদ্দিন। খুব শীঘ্রই তাঁর এই খানকাহটি ধনী-গরিব সব ধরনের মানুষের ভিড়ে জনারণ্যে পরিণত হয়। নিজামউদ্দিনের নম্রতা ও ধর্মভীরুতা সাধারণ মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। দূরদূরান্ত থেকে তাকে এক ঝলক দেখতে আসে ভক্তরা। সে সময়কার দিল্লীর সুলতানও তাঁর অনেক প্রশংসা করেন। চারটি বই লেখেন নিজামউদ্দিন- ‘ফাওয়াদ আল ফুয়াদ’, ‘ফাসাল ফুয়াদ’, ‘রাহাত আল মুহাব্বিন’ এবং ‘সৈয়দ আল আউলিয়া’।
তাঁর বহু শিষ্য আধ্যাত্মিকতায় উচ্চাসন অর্জন করেন যাদের মধ্যে রয়েছেন শেখ নাসিরউদ্দিন চিরাগ এবং আমির খসরু, যিনি দিল্লী রাজসভার কবি এবং প্রখ্যাত গায়ক ছিলেন। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে শুরুর ঐ গল্পটির মতো আরও অনেক গাঁথা যার অধিকাংশই সত্য বলে প্রমাণিত। জানা যায়, একবার হযরত মাওলানা ওয়াজিহুদ্দিন, হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার এক মুরিদ, যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসকরা যখন তার জীবন নিয়ে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তখন তার বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দেয় নিজামউদ্দিনের খানকাহে কয়েকদিন থেকে আসতে। শহর থেকে দূরে নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে তিনি ভালো থাকবেন বলেই মনে করেন তার বন্ধুরা। বন্ধুদের কথামতো ওয়াজিহুদ্দিন সন্ধ্যায় ইফতারের সময়ে খানকাহে গিয়ে পৌঁছান। খানকাহের এক মুরিদ হযরত নিজামউদ্দিনের জন্য মেথির লাড্ডু নিয়ে আসেন। এই সুফিসাধক তাকে নিজের সাথে বসে ইফতার করার আহ্বান জানান। সবার সাথে ওয়াজিহুদ্দিনও বসে যান ইফতার করতে। ইফতারের এক পর্যায়ে এসে তিনি সুস্বাদু ঐ মেথির লাড্ডু মুখে দিয়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে ঔষধি গুণে মেথি খুব নামকরা হলেও তার মতো শরীর গরমকারী বস্তু খুব কমই আছে। বিশেষত যক্ষ্মারোগীদের জন্য তা রীতিমতো আত্মঘাতী হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মহান আল্লাহ্ তায়ালার কৃপায় লাড্ডুর অন্যান্য ঔষধি গুণের প্রভাবে খুব দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন মাওলানা সাহেব এবং জীবনে আর কখনো তাকে এই রোগ ভোগাতে পারেনি। নিজামউদ্দিনকে যারা আল্লাহ্র অলি হিসেবে মানতে নারাজ ছিলেন, তারাও এই বিস্ময়কর ঘটনা দেখে নিজেদের কথা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন।
গতানুগতিক সুফি মতবাদের ধারা বজায় রেখে জীবনকালেই স্রষ্টার সাক্ষাৎ পাওয়া সম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন নিজামউদ্দিন আউলিয়া। অহম দূর করে, আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে সুফি মতবাদের চর্চা করলে ঈশ্বরের নৈকট্য অর্জন করা যায় বলে প্রচারণা চালান তিনি। পাশাপাশি তার পূর্ববর্তী সুফি সাধক চিশতীর বাণীগুলোও তিনি নিজের মধ্যে ধারণ করেন এবং তা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এই বাণীগুলোর মধ্যে ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক যেকোনো ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে শুরু করে নিপীড়িতদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার পূর্ণ আহ্বান।
১৩২৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ এপ্রিল সকালে ইহলোক ত্যাগ করেন মহান এই সুফি সাধক। তার খানকাহ, নিজামউদ্দিন দরগাহ, দিল্লীতে অবস্থিত। এর বর্তমান যে কাঠামোটি আমরা দেখতে পাই তা ১৫৬২ সালে নির্মিত। সব ধরনের বিশ্বাস নিয়েই লোকে এই দরগাহে আসে। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীতে সেখানে লোক সমাগম বেড়ে যায় অনেকাংশেই। নিজামউদ্দিন দরগাহে সমাধিস্থ এই আউলিয়া ও তার যোগ্য শিষ্য আমির খসরুর মৃত্যুতে সেখানে ওরসের আয়োজন করা হয়। ফকিরকে আমীর বানিয়ে দেয়া, হারানো রাজফরমান খুঁজে দেয়া, মানুষের উন্নতির জন্য খাস দিলে খোদার দরবারে দোয়া করা দিল্লীর এই মহাপুরুষ গানে, সংস্কৃতিতে, কবিতায়, মানুষের মুখে আর ভক্তদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন সহস্রকাল।