বেঞ্জামিন ক্রাউনিনশিল্ড ব্র্যাডলি ছিলেন দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সম্পাদক। তার সময়েই পেন্টাগন পেপার্স, ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডালের মতো সাংবাদিকতার ইতিহাসের সাড়া জাগানো স্কুপগুলো প্রকাশিত হয়। ২য় ও শেষ পর্বে পড়ুন তার বর্ণিল কর্মজীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলো নিয়ে।
ক্যাথরিন গ্রাহাম
১৯৬৩ সালে ব্র্যাডলির জীবন থেকে দুজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হারিয়ে যায়। সে বছরের আগস্ট মাসে ফিলিপ গ্রাহাম আত্মহত্যা করেন। বাইপোলার ডিজঅর্ডারের সাথে যুঝতে যুঝতে একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে এ পথ বেছে নেন তিনি। এরপর নভেম্বরে বন্ধু কেনেডি গুপ্তহত্যার শিকার হন। ব্র্যাডলির ভাষায়, ‘জীবন চিরকালের মতো বদলে গেল।’
ফিলিপ গ্রাহামের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ক্যাথরিন গ্রাহাম দ্য পোস্ট-এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পত্রিকার অবস্থা নিয়ে তিনি সন্তুষ্টই ছিলেন। টানা নয় বছর ধরে লাভ করে যাচ্ছে, সার্কুলেশনও নিয়মিত গতিতে বাড়ছিল; মিসেস গ্রাহাম ভাবলেন তার পত্রিকা বেশ ভালোই চলছে। পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, ও সংবাদ বিভাগের পরিচালক আলফ্রেড ফ্রেন্ডলির পরামর্শের উপর অনেকাংশে নির্ভর করতেন ক্যাথরিন।
কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারলেন তার পত্রিকার আরও বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর জেমস রেস্টন, কলামিস্ট ওয়াল্টার লিপম্যানের মতো ব্যক্তিরা মিসেস গ্রাহামকে বোঝালেন দ্য পোস্ট-এর আরও ভালো করার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে।
ফিলিপ গ্রাহামের মৃত্যুর প্রায় ঊনিশ মাস পরে ব্র্যাডলির সাথে প্রথমবারের মতো ভালো করে সম্পর্কের সূচনা হলো ক্যাথরিনের। এক ক্যাফেতে দুজনে একসাথে লাঞ্চ করেন, এসময় ব্যবসায় নিয়েও কথা হয়। এ ঘটনার আরও কয়েকমাস পরে ক্যাথ ব্র্যাডলিকে নিয়ে তার আগ্রহের কথা পত্রিকার সম্পাদক জে. রাসেল উইগিনস, ও ফ্রেন্ডলির সাথে আলোচনা করেন। তারা ব্যাপারটাকে অতটা ভালোভাবে নেননি। তাদের আপত্তি সত্ত্বেও ক্যাথরিন চেয়েছিলেন ব্র্যাডলি দ্য পোস্ট-এর ডেপুটি ম্যানেজিং এডিটর হিসেবে যোগ দিক। অনেক ঘটনার পর ১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসে ব্র্যাডলি পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে আলফ্রেড ফ্রেন্ডলির স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৬৮ সালে তার জন্য তৈরি করা নির্বাহী সম্পাদকের আনকোরা পদে যোগ দেন।
ব্র্যাডলি ও দ্য পোস্ট
ওয়াশিংটন পোস্টের মূল কার্যালয়ে যোগ দেওয়ার পরই বেন ব্র্যাডলির আসল সাংবাদিক সত্তা ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে দ্য পোস্ট ক্রমেই প্রভাবশালী পত্রিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করে।
১৯৬৫ সালে পত্রিকাটির স্টাফ সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল। সবচেয়ে পাঠক-নন্দিত লেখক ছিলেন একজন ক্রীড়া কলামিস্ট। পত্রিকাটির পেন্টাগন প্রতিনিধির সাংবাদিকতার পেশাটা ছিল পার্ট-টাইম, তিনি ছিলেন মূলত নৌবাহিনীর রিজার্ভ ক্যাপ্টেন। ওয়াশিংটনের বাইরে তেমন কোনো প্রতিনিধিও ছিল না। অর্থাৎ, পত্রিকা হিসেবে দ্য পোস্ট তখনও শতভাগ পেশাদারী হয়ে উঠতে পারেনি।
কাজে যোগ দেওয়ার পরপরই ব্র্যাডলি এসবের আমূল পরিবর্তন আনতে মনস্থির করলেন। তিনি জানতেন, ভালো একজন প্রতিবেদকের কোনো বিকল্প নেই। সে সময় তিনি দ্য পোস্ট-এর আরেক প্রতিভাবান রিপোর্টার লরেন্স স্টার্নের ওপর বেশ ভরসা করতেন। স্টার্নকে জাতীয় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন ব্র্যাডলি।
ভালো সাংবাদিকদের থেকে সর্বোচ্চটুকু আদায় করে নেওয়ার পরিকল্পনা হিসেবে ব্র্যাডলি অন্যান্য সংবাদপত্র থেকে সাংবাদিকদের নিজ পত্রিকায় নিয়ে আসতে শুরু করলেন। নিউজউইক থেকে ওয়ার্ড জাস্টকে এনে তাকে পাঠালেন ভিয়েতনামে যুদ্ধ কাভার করার জন্য। লুইসভিল কুরিয়ার-জার্নাল-এর রিচার্ড হারউডও দ্য পোস্ট-এ যোগ দেন ব্র্যাডলির আহ্বানে। এই হারউড ব্র্যাডলির সময়ে পত্রিকাটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদক ছিলেন।
এভিয়েশন উইক-এর জর্জ উইলসনও ব্র্যাডলির খুঁজে পাওয়া আরেক জাত সাংবাদিক, যিনি পরে পেন্টাগন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছিলেন। প্যারিসে থাকার সময় বন্ধুত্ব হয়েছিল টাইম ম্যাগাজিনের এশিয়া প্রতিনিধি স্ট্যানলি কার্নোর সাথে। তাকে দ্য পোস্ট-এর চীন প্রতিনিধি বানান ব্র্যাডলি। সে সময়ের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকেও ছাড় দেননি বেন ব্র্যাডলি। ডেভিড এস. ব্রডারে’র মতো দুঁদে সাংবাদিককে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এ ছুটিয়ে আনার জন্য ব্র্যাডলির বছরে ১৯০০০ ডলার খরচ করতে হয়েছিল বেতন বাবদ।
ব্র্যাডলির নিজের একটা সার্কেল ছিল দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এ। নিজের পছন্দের মানুষ, প্রিয় ও স্মার্ট সাংবাদিকদের নিয়ে এ দলটি গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ব্রডারের ভাষায়, দ্য পোস্ট-এ কাজ করাটা তার জন্য স্বর্গীয় অনুভূতির মতো ছিল। কারণ ব্র্যাডলি তার পিয়ার-গ্রুপের সাংবাদিকদের যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছিলেন নিজেদের মতো করে কাজ করার জন্য।
এই দলের বাইরে যারা ছিল, তারা বোধহয় একটু অনাদরণীয় বোধই করতেন। কারণ ব্র্যাডলি নিজেই স্বীকার করেছিলেন, নিজের পছন্দের সহকর্মীদের সাথে তিনি যেরকম বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন, অন্যদের সাথে তা আরেকটু শীতলই ছিল। তার এসব মনোভাব আর আচরণের একটা উদ্দেশ্য ছিল; যাদের কাজ গড়পড়তা ছিল, তাদেরকে বিদায় করা। ব্র্যাডলির ভাষায়, ‘এই মিসট্রিটমেন্ট করতে আমার কোনো আনন্দের উদ্রেক হয়নি, তথাপি আমাকে তা করতে হয়েছিল কিছু লোক থেকে রক্ষা পেতে, তাদেরকে বাধ্য করতে দ্য পোস্ট ছেড়ে যেতে।’ কড়া ধাঁচের লোক হিসেবে খ্যাতি ছিল ব্র্যাডলির। কিন্তু প্রাথমিক কিছু সময়ের পর তিনি আর কখনো কাউকে চাকরিচ্যুত করেননি।
সাংবাদিক পরিবর্তনের সাথে সাথে সাংবাদিকতার ধাঁচেরও পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি। তখনকার নিউজ ম্যাগাজিনগুলোর অনেক শৈলী তিনি তার পত্রিকার জন্য অনুসরণ করেছিলেন। আবার নিজেদের পুরনো অনেক সেকশন বাদ দিয়েছেন বা নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছেন। চমৎকার সব সাংবাদিক আর সাহসী, বুদ্ধিদীপ্ত কিছু সিদ্ধান্ত; দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ধীরে ধীরে সমৃদ্ধির শেখরে আরোহণ করতে থাকল।
পেন্টাগন পেপার্স
১৯৭১ সালের ১৩ জুন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হলে চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন মিথ্যাচার জনসমক্ষে প্রথমবারের মতো প্রকাশ পায়। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর পর দ্য ওয়াশিংটন পোস্টও পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে। সম্পাদক হিসেবে বেন ব্র্যাডলির জন্য অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট ছিল এ ঘটনা।
১৯৬৭ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট এস. ম্যাকনামারা ভিয়েতনামে মার্কিন কার্যক্রম বিশ্লেষণ করতে একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করেন। ভিয়েতনাম স্টাডি টাস্কফোর্স নামক ওই গবেষণা দলে ছিলেন ৩৬ জনের মতো সামরিক ব্যক্তিবর্গ, ইতিহাসবিদ, র্যান্ড কর্পোরেশন (RAND Corporation) ও ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট অফ ডিফেন্স অ্যানালাইসিস-এর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। দীর্ঘ দেড় বছরের গবেষণার পর এই টাস্কফোর্স ৪৭ খণ্ডের, প্রায় ৭০০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। এই প্রতিবেদনটিই পরে পেন্টাগন পেপার্স নামে পরিচিতি লাভ করে।
র্যান্ড কর্পোরেশনের ড্যানিয়েল এলসবার্গ নামক জনৈক কর্মী এই হাইলি ক্লাসিফায়েড প্রতিবেদনটি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক নিল শিহ্যানের মাধ্যমে গণমাধ্যমে প্রকাশ করে দেন। পত্রিকাটি তৃতীয় আর্টিকেল প্রকাশ করার পর মার্কিন প্রশাসনের টনক নড়ে। সরকার থেকে টেলিগ্রাম পায়, যাতে দ্য টাইমস-কে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল এ ধরনের স্পর্শকাতর প্রতিবেদন আর না ছাপানোর জন্য। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেনি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। ঘটনা গড়ায় আদালত পর্যন্ত।
১৬ জুন তারিখে দ্য পোস্ট-এর সম্পাদক (জাতীয়) বেন ব্যাগডিকিয়ানের সাথে ড্যানিয়েল এলসবার্গের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তার কাছ থেকে বাক্স-ভর্তি পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে পরেরদিন সকালে অফিসে ফিরে আসেন ব্যাগডিকিয়ান। মার্কিন সরকারের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতের আদেশের কারণে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস তখন তাদের প্রতিবেদন ছাপানো বন্ধ রেখেছে।
কিন্তু বেন ব্র্যাডলি ঠিক করলেন আদালতের আদেশ ভঙ্গ করবেন। সাংবাদিকতার পবিত্র দায়িত্বকে অক্ষুণ্ণ রাখতে ব্র্যাডলির দ্য পোস্ট ১৮ জুন, ১৯৭১ তারিখ থেকে পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে প্রতিবেদন ছাপাতে শুরু করে। আর সেদিন বিকেলই সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ থেকে ফোন পান ব্র্যাডলি। একই অনুরোধ; আর যেন ছাপানো না হয় পেন্টাগন পেপার্স সম্পর্কিত প্রতিবেদন, এতে নাকি জাতীয় নিরাপত্তায় ক্ষতি হবে। ব্র্যাডলি তার অনুরোধ রাখতে অপারগতা জানান। ফলাফল, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সাথে সাথে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-কেও আদালতে হাজির হতে হলো।
দ্য পোস্ট তখন তাদের শেয়ার পাবলিক করার কথা চিন্তা করছিল। ওদিকে পত্রিকাটির অধীনস্থ টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সরকারি লাইসেন্স পাওয়ার কথা ছিল। তাই পত্রিকার অ্যাটর্নি কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন যদি পেন্টাগন পেপার্স প্রকাশর কারণে কোনো অপরাধের চক্করে ফেঁসে যায়, তাহলে দ্য পোস্ট-এর সাড়ে সর্বনাশ হবে। কিন্তু সব সাংবাদিক ও সম্পাদক মত দিলেন তাদের উচিত নথিপত্রগুলো প্রকাশ করা। বেন ব্র্যাডলি তার কয়েকজন ইয়ারবন্ধুর কাছে পরামর্শের জন্য গেলেন। এদের একজন ছিলেন এডওয়ার্ড বেনেট উইলিয়ামস, বিখ্যাত উকিল। অন্যজন আর্ট বুচওয়াল্ড।
সব শুনে উইলিয়ামস বললেন, ‘বেঞ্জি, তোর এটা ছাপাতেই হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তোর কাজইতো এটা।’ এরপর ব্র্যাডলি গেলেন মিসেস গ্রাহামের কাছে। ক্যাথরিনের উত্তর ছিল, ‘লেট’স পাবলিশ।’
আদালতে সরকার বনাম সংবাদপত্রের লড়াই শুরু হলো। নিক্সন প্রশাসনের যুক্তি ছিল পেন্টাগন পেপার্সের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন ছাপালে তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। কিন্তু আদালতে তাদের যুক্তি ধোপে টিকল না। ৬-৩ ভোটে জিতল দ্য টাইমস, ও দ্য পোস্ট।
১৮ বছর পরে, সরকার পক্ষের উকিল, সাবেক সলিসিটর জেনারেল এরউইন গ্রিসউল্ড, স্বীকার করেছিলেন, জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তিটি আদতে ভাঁওতা ছিল। ১৯৮৯ সালে দ্য পোস্ট-এ লেখা এক উপ-সম্পাদকীয়তে এমনটাই দাবি করেন তিনি। ‘ওই প্রতিবেদনগুলোর কারণে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে, এমন কোনো লক্ষণ আমি কখনো দেখিনি।’ বেন ব্র্যাডলি ওই নিবন্ধটি এতটাই পছন্দ করেছিলেন যে পরের কয়েক সপ্তাহ তিনি ওই নিবন্ধটি নিজের পকেটে নিয়ে ঘুরেছিলেন।
ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল
পেন্টাগন পেপার্সের পর আরেকবার ঝড় উঠে দ্য পোস্ট-এর অফিসে। এবার কাণ্ড ওয়াটারগেটে। ওয়াটারগেট হোটেলের সিঁধেলচোরদের কয়েকজনের সাথে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ)-এর সূত্র খুঁজে পেলেন দুই তরুণ সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড, ও কার্ল বার্নস্টেইন। ব্যাস, কোমর বেঁধে নামলেন দুজনে। তাদের দৌড়ঝাঁপের দৌলতে ধীরে ধীরে আসল রহস্য উদঘাটন হলো। কিন্তু প্রথমদিকের রিপোর্টগুলোর পর প্রচুর প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে হয়েছিল বেন ব্র্যাডলিকে। তবে নিজের সাংবাদিকদের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন, তাই সবসময় উডস্টেইন জুটিকে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছিলেন বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি।
এক সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল উডওয়ার্ড আর বার্নস্টেইনের মতো দুই কাব রিপোর্টারকে (Cub: সাংবাদিকতার ভাষায় এ শব্দটি দ্বারা শিক্ষানবিশ, অনভিজ্ঞ, তরুণ সাংবাদিককে বোঝায়) কেন ওয়াটারগেট কাভার করার জন্য দিয়েছিলেন। উত্তরে ব্র্যাডলি বলেছিলেন:
একদম প্রথম থেকেই তারা সঠিক ছিল। একটা ছোট্ট ভুল হয়েছিল কিন্তু কেউ সেটাকে মিথ্যা বলে দাবি করেনি। আমরা নিয়মিতই আমাদের রিপোর্টগুলো বারবার পরীক্ষা করে দেখেছি, আর তাতে আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। কিছু সিনিয়র রিপোর্টার হয়তো ভেবেছিলেন ওদের দুজনকে কেন দেওয়া হলো স্টোরিটা। আমি তাদের বলেছিলাম, এটা তাদের অ্যাসাইনমেন্ট, তারা যখন ভুল করবে তখনই কেবল ওদের পাল্টানোর কথা ভাববো।
এক শোকস্মারকে ব্র্যাডলির স্মৃতিচারণ করেছিলেন এ দুই সাংবাদিক। তার সম্পর্কে উডস্টেইন জুটি লিখেছেন:
একজন মহৎ সেনাধিপতি, যুদ্ধের ময়দানে যিনি শান্ত, নিজ অনুগত সেনাদের জন্য যার রয়েছে স্নেহ ও ভালোবাসা, তাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হতেন যিনি, তিনিই আবার কঠোর চিত্তে তাদের পাঠাতেন যুদ্ধক্ষেত্রে।
জ্যানেট কুকের কুকীর্তি
১৯৮০ সালে জ্যানেট কুক দ্য পোস্ট-এ যোগদান করেন। সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি জিমি নামের আট বছর বয়সী এক হেরোইনাসক্ত বালককে নিয়ে একটি হৃদয়স্পর্শী ফিচার লেখেন। তার এ ফিচারটি ১৯৮১ সালের পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করে। কিন্তু পরে জানা যায় ‘জিমি’স ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামের ফিচারটি আগাগোড়া বানোয়াট ছিল।
এ ঘটনা ব্র্যাডলির সম্পাদক-জীবনে একটি কালো দাগ হয়ে থাকবে। তিনি ভাষায়:
আমি ভাবিনি যে কেউ আমার কাছে মিথ্যে বলবে। কারো পক্ষে পুরো একটি স্টোরি জাল করা সম্ভব, এটাও তখন আমার মাথায় আসেনি। যখন সব বুঝলাম ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
দ্য পোস্ট পরে এই ভুলের কথা জনসমক্ষে স্বীকার করে। জ্যানেট কুককে বরখাস্ত করা হয়। দ্য পোস্ট পুলিৎজার ফেরত প্রদান করে। পরে তা দ্য ভিলেজ ভয়েস-এর টেরেসা কার্পেন্টারকে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ব্র্যাডলির সময়ে সর্বমোট ১৭টি পুলিৎজার জিতেছিল দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
ব্যক্তিজীবনে ব্র্যাডলি
১৯৭০-এর দশকে আরেকবার নতুন করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। সোলমেট, সাংবাদিক, ২০ বছরের জুনিয়র স্যালি কুইনকে বিয়ে করেন এবার। এ বিয়ে সম্পর্কে ব্র্যাডলি বলেন, ‘মানুষজন একটু দুঃখ পেয়েছিল।’ কারণ তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে দুই দশকের সংসার থেকে সরে যেতে হয়েছিল।
দীর্ঘ সম্পাদক-জীবনে বেন ব্র্যাডলি দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে সাফল্যের সঠিক পথই দেখিয়েছিলেন সবসময়। তার হাত ধরেই বিখ্যাত হয়ে ওঠে পত্রিকাটি। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে অবসর নেন তিনি। সহকর্মীরা চোখের জলে তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানান। তবে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট কোম্পানির সাথে কখনো সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি ব্র্যাডলির। অবসর পরবর্তী জীবনে কোম্পানির ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাট লার্জ’ পদে আসীন হন তিনি।
তিনি লিখেছেন নিজের স্মৃতিকথাও। আ গুড লাইফ: নিউজপেপারিং অ্যান্ড আদার অ্যাডভেঞ্চার্স (১৯৯৬) বিক্রি করে তিনি ও তার স্ত্রী স্যালি যে অর্থ পেয়েছিলেন তা খরচ করেছিলেন চিলড্রেন’স ন্যাশনাল মেডিকেল সেন্টারের জন্য। ব্যস্ত অবসর জীবনে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার উপদেষ্টা, চেয়ারম্যান ইত্যাদি পদে কাজ করেছিলেন। ২০০৭ সালে ফরাসি সরকারের কাছ থেকে গ্রহণ করেন লিজিয়ন অভ অনার পদক। ২০১৩ সালে বারাক ওবামার হাত থেকে গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অভ ফ্রিডম।
৯৩ বছর বয়সে, ২০১৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন বেঞ্জামিন ক্রাউনিনশিল্ড ব্র্যাডলি। তিন পক্ষেরই সন্তানসন্ততি ছিল ব্র্যাডলির। এর মধ্যে প্রথম পক্ষের একমাত্র সন্তান বেঞ্জামিন সি. ব্র্যাডলি জুনিয়র কাজ করেছেন দ্য বোস্টন গ্লোব পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে।
রূপালী পর্দায় তার বর্ণিল কর্মজীবনের দেখা মেলে অ্যালান জে. পাকুলার সিনেমা অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন (১৯৭৬), স্টিভেন স্পিলবার্গের দ্য পোস্ট (২০১৭), জেসন রিটম্যানের দ্য ফ্রন্ট রানার (২০১৮)-এ। অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন-এ ব্র্যাডলির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জেসন রবার্ডস জুনিয়র। পাকুলার কাছ থেকে শুনে প্রথমে খুব আগ্রহ দেখিয়েছিলেন রোবার্ডস। বাড়িতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে গিয়েছিলেন পড়ার জন্য। কিন্তু পরদিন ফিরে এসে পরিচালককে জানালেন, ‘পারব না আমি ব্র্যাডলির চরিত্রে।’
কেন জানতে চাইলেন পাকুলা।
‘তার (ব্র্যাডলি) কাজই দেখছি শুধু ইধারউধার যাওয়া আর রিপোর্টারদের কাছে জানতে চাওয়া, ‘এখানে ছাতার স্টোরি কই?’
‘ওটাই তো দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর নির্বাহী সম্পাদকের কাজ।’ পাকুলা উত্তর দিলেন।
সে রোলের জন্য জেসন রবার্ড সে বার অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন।