গবেষণা করতে গিয়ে প্রায়ই বিজ্ঞানীদের ফলাফলে গরমিল হয়। সেই গরমিল থেকে অনেকে নতুনভাবে গবেষণা করে ফলাফল শুধরে নেন। আবার অনেকে সেই গরমিলকে নতুন আবিষ্কার ভেবে চারদিকে হট্টগোল বাঁধিয়ে দেন। যদিও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে অচিরেই তার সেই ভুল ভাঙে। কিন্তু মাঝে মাঝে সত্যি সত্যি সে গরমিল থেকে নতুন কিছুর আবিষ্কার হয়। যেমন ধরা যাক, সত্যেন বসুর বোস-সাহা সমীকরণের কথা। গণিতের হিসাবে সামান্য ভুল থেকে তিনি আবিষ্কার করেছেন পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ। তেমনি উনবিংশ শতাব্দীতে একজন পদার্থবিদ বাস করতেন, যিনি ছিলেন প্রথম দলের অন্তর্ভূক্ত। পরীক্ষাগারে সামান্য ভুল থেকে তিনি আবিষ্কার করেন এক বিস্ময়কর রশ্মির। কিন্তু সেই বিজ্ঞানী কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, তিনি নতুন কিছু আবিষ্কার করেছেন। তিনি বার বার একই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন যেন নিজের ভুল সংশোধন হয়ে যায় এবং বার বার একই ফলাফল পেতে থাকেন। একসময় তিনি ভাবলেন, হয়তো তার মানসিক ভারসাম্য ঠিক নেই। তিনি পাগল হয়ে গেছেন।
অবশ্য তার এরকম ভাবনা অমূলক নয়। কারণ, তিনি যে রশ্মি আবিষ্কার করেছেন, সেটা অনেকটা অদ্ভুত। যেমন, তা অনেক দেহের মাংস ভেদ করে প্রবাহিত হলেও, ঠিকই হাড় দ্বারা প্রতিহত হচ্ছিলো। এই অদ্ভুত রশ্মিকে তিনি তার মনের অলীক কল্পনা ভেবে ভুল করছিলেন। কিন্তু তার ভুল ভাঙলো যখন বুঝতে পারলেন, তিনি একা নন, তার স্ত্রীও একই দৃশ্য অবলোকন করছেন। প্রথম দলভুক্ত সেই বিজ্ঞানীর সেবারের গরমিল তাকে দ্বিতীয় দলভুক্তদের মধ্যে কদাচিৎ সফল হওয়া বিজ্ঞানীদের অন্তর্ভূক্ত করে দিলো। সুপ্রিয় পাঠক, আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে থাকা সেই পদার্থবিদ হচ্ছেন উইলহেম রন্টজেন। আর সেই অদ্ভুত রশ্মির নাম রঞ্জন রশ্মি বা এক্স-রে।
স্কুলের সেই পাজি ছেলে
স্কুলে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিলো সেদিন। যেখানে অন্যদিন ছাত্রদের হুল্লোড়ে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়, সেখানে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। স্কুলের মাঠে শত শত ছাত্র সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তার হাতে শোভা পাচ্ছে লম্বা একটি বেত। তার চেহারায় স্পষ্ট ক্রোধ ফুটে উঠেছে। আর ক্রোধের কারণ উইলহেম নামক পাজি ছাত্র। তাকে আজ উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে স্কুলের সবার সামনে। তাই এই অসময়ে সমাবেশের আয়োজন। উইলহেম ভয়ে কাচুমাচু হয়ে প্রধান শিক্ষকের পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। তার অপরাধ, ক্লাসের এক শিক্ষককে ব্যঙ্গ করে বোর্ডে কার্টুন আঁকা। সেদিন উইলহেমকে চূড়ান্ত শাস্তি হিসেবে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো। পড়াশোনায় কাঁচা, দুষ্টের শিরোমণি উইলহেমকে নিয়ে কারো সামান্য করুণা হলো না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যে অপরাধে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো, তার সাথে উইলহেমের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। সেটা ছিল ক্লাসের আরেক দুষ্ট ছেলের কাজ। কিন্তু মিথ্যে অভিযোগে সেদিন ফেঁসে গিয়েছিলেন উইলহেম রন্টজেন।
ক্লাসের পাজি ছেলে উইলহেমের জন্ম হয়েছিলো ১৮৪৫ সালের ২৭ মার্চ জার্মানির নিম্ন রাইন প্রদেশের লেনেপ অঞ্চলে। তার পূর্ণনাম উইলহেম কনরাড রন্টজেন। তিনি ছিলেন কাপড় বিক্রেতা পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। জন্ম জার্মান মুলুকে হলেও তার শৈশব কেটেছিলো বর্তমান নেদারল্যান্ডসের আপ্লেডুর্ন শহরে। সেখানে তাকে ভর্তি করানো হয় মার্টিনাস হার্মান ফন ডুর্নের বোর্ডিং স্কুলে। এদিকে স্কুলের পাঠে মনোযোগী ছিলেন না কিশোর উইলহেম। তার শুধু গ্রাম, অরণ্যে প্রকৃতির মাঝে মিশে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগতো। তবে পড়াশোনায় দুর্বল হলেও তিনি যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসতেন। যন্ত্রপাতির প্রতি এই ভালোবাসার কারণে তাকে ১৮৬২ সালে ভর্তি করানো হয় ইউত্রেক্তের এক কারিগরি স্কুলে। এখানে অধ্যয়নরত অবস্থায় তার বিরুদ্ধে সেই শিক্ষক অবমাননার অভিযোগ উঠেছিলো। স্কুল বহিষ্কারের মতো গুরুতর শাস্তি যেকোনো ছাত্রের শিক্ষাজীবনে ধাক্কা দিতে পারে। কিন্তু উইলহেম এসব ভুলে তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন।
উচ্চশিক্ষায় নতুন উইলহেম
উইলহেম নিজ প্রচেষ্টায় মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ইউত্রেক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন ১৮৬৫ সালে। পাঠ্যবিষয় হিসেবে পছন্দ করলেন পদার্থবিদ্যা। কিন্তু এখানে থিতু হতে পারলেন না। যখন পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে যায়, তখন তিনি এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছিলেন। তার পরিত্রাতা হিসেবে হাজির হয় বিখ্যাত জুরিখ পলিটেকনিক। জুরিখ পলিটেকনিকে ভর্তি হতে কোনো ছাত্রের পূর্ব শিক্ষাজীবনের কাগজপত্রের প্রয়োজন ছিল না। শুধু ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই সেখানে অধ্যয়নের সুযোগ মিলতো। তিনি সেখানে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন এবং উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন। তার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের সূচনা হয় জুরিখে। সেখানে তিনি যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। এখানে তিনি তার কৈশোরের যন্ত্রের প্রতি ভালোবাসাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন। তৎকালীন বিখ্যাত প্রশিক্ষক ক্লসিয়াসের লেকচারে অংশ নেওয়া শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি কুন্ড নামক এক গবেষকের অধীনে তার গবেষণা জীবনের হাতেখড়ি হয়।
কুন্ড এবং ক্লসিয়াস দুজনেই উইলহেমের প্রতিভায় মুগ্ধ ছিলেন। তাদের দুজনের প্রভাবে নিজেকে একজন দক্ষ গবেষক হিসেবে গড়ে তুলতে থাকেন তিনি। ১৮৬৯ সালে তিনি গবেষণা জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
পেশাদার জীবন
ডক্টরেট অর্জনের পর তার প্রশিক্ষক কুন্ড তাকে সহকারী হিসেবে যোগ দিতে অনুরোধ করেন। উইলহেমের জন্য এই প্রস্তাব ছিল স্বপ্নের মতো। তিনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। কুন্ডের সাথে তিনি ওয়ারজবুর্গ এবং স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলি হন এবং সেখানে দুজনেই শিক্ষকতা করেন। প্রায় পাঁচ বছর সহকারী হিসেবে কাজ করার পর তিনি তার জীবনের প্রথম স্থায়ী চাকরির প্রস্তাব লাভ করেন। স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করে। এক বছর পর তিনি স্ট্রাসবুর্গ ত্যাগ করে হহেনহ্যাম কৃষি একাডেমীর পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তবে এখানে এক বছরের বেশি কাজ করতে পারলেন না। তাই তাকে পুনরায় স্ট্রাসবুর্গে ফেরত আসতে হয়। স্ট্রাসবুর্গে তিনি এবার সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৭৯ সালে তাকে গিসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এই পদে তিনি দীর্ঘ আট বছর ধরে কর্মরত থাকেন।
কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো ওয়ারজবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৮৮৮ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে এখানে যোগদান করেন। এখানে কর্মরত অবস্থায় তিনি তার বিশ্ব কাঁপানো রঞ্জন রশ্মি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। সাধারণ উইলহেমের অসাধারণ হয়ে উঠার গল্প এখানেই রচিত হয়েছে। যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন, তখন তার ডাক পড়ে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বয়ং জার্মান সরকারের বিশেষ অনুরোধে তিনি সেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করতে সম্মত হন। জার্মানিতে জন্ম নেওয়া উইলহেম শেষপর্যন্ত ফিরে যান তার জন্মভূমিতে। কর্মজীবনের শেষটুকু এখানে কাটিয়ে ১৯২০ সালে অবসর গ্রহণ করেন এই গুণী পদার্থবিদ।
বন্ধ ঘরের রহস্য
টানা সাত সপ্তাহ ধরে নিজের গবেষণাগারের দরজা বন্ধ করে রেখেছেন উইলহেম রন্টজেন। ঠিক কী কারণে তিনি হঠাৎ এরকম আচরণ করছেন, তা বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের কারো স্পষ্ট নয়। তার স্ত্রী আনা রন্টজেন দুশ্চিন্তায় ঘুমোতে পারেন না। ‘শেষমেশ লোকটা পাগল হয়ে গেলো নাকি?’, ভাবতে থাকেন তিনি। কিন্তু এর উত্তর তার কাছে নেই। তার সকল প্রশ্নের উত্তর তখন গবেষণাগারের বন্ধ দরজার ওপারে লুকিয়ে আছে। সেখানে রাত দিন গবেষণা করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানী উইলহেম। ১৮৯৫ সালের দিকে তিনি ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তার কাজ ছিল অতিরিক্ত নিম্নচাপে থাকা গ্যাসের ভেতর দিয়ে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহিত করা। সেই বছর ৮ নভেম্বর তিনি কাজ করার সময় লক্ষ্য করলেন, গ্যাসের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার সময় কিছু রশ্মি উদ্ভূত হচ্ছে। এখানে বলে রাখা দরকার, উইলহেম রন্টজেন যে কক্ষে তার গবেষণা কাজ করতেন, সেটি ছিল আলোকচিত্রীদের ‘ডার্ক রুম’-এর মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাছাড়া যে টিউবের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হচ্ছিলো, তা ছিল বিভিন্ন অস্বচ্ছ পদার্থ দ্বারা আবৃত। তাই আলোকতরঙ্গ সেই অস্বচ্ছ আবরণ ভেদ করে প্রবাহিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, বিদ্যুৎ প্রবাহে সৃষ্টি হওয়া রশ্মি সেই পুরো আবরণ ভেদ করে দুই মিটার দূরত্বে টিউবের বিপরীত দেয়ালে রাখা বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড পর্দার উপর উজ্জ্বল প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করেছে। উইলহেম ভাবলেন, তিনি বোধহয় চোখের ভুল দেখছেন অথবা তার কাজে কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। সেই ভুল ভাঙার অধ্যবসায়ে তিনি টানা সাত সপ্তাহ একই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি ঘটান। কিন্তু প্রতিবার একই ঘটনা ঘটতে থাকে। তিনি বিভিন্ন ধাতব বস্তুর মাধ্যমে সেই রশ্মিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন এবং ব্যর্থ হন। তাছাড়া তিনি নিজেও এই অদ্ভুত রশ্মির ধর্ম সম্পর্কে দ্বিধায় ছিলেন।
শেষে তিনি তার স্ত্রী আনাকে তলব করলেন। উদ্ভ্রান্ত বিজ্ঞানী তার স্ত্রীর হাত সেই রশ্মির যাত্রাপথে মেলে ধরলেন। তখন আনার হাতের আঙুলে বিয়ের আংটি পরিহিত ছিল। অবাক চোখে উইলহেম দেখলেন, দেয়ালে একটি ভৌতিক হাতের দৃশ্য ভেসে উঠেছে। সেই হাতের মাংসগুলো স্বচ্ছ হয়ে গেছে। কিন্তু হাতের অস্থিগুলো স্পষ্ট চিত্রিত হয়ে আছে। আর বিয়ের আংটির স্থলে গাঢ় কালো রঙের ছায়া দেখা যাচ্ছে। আর এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম রন্টজেনোগ্রাম। এই দৃশ্য দেখে তার স্ত্রী আনাও ভয়ে শিয়রে উঠলেন। আর এখানেই বন্ধ ঘরের সকল রহস্য এবং অলৌকিকতার ইতি ঘটলো। উইলহেম বুঝতে পারলেন, তিনি পাগল হয়ে যাননি। তার স্ত্রীও একই দৃশ্য অবলোকন করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ রশ্মি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। আর এভাবে তিনি দেখিয়ে দিলেন, ভৌত পদার্থের উপর ক্যাথোড রশ্মির প্রভাবে সৃষ্টি হয় এক অদ্ভুত রশ্মির। যেহেতু সেই রশ্মির বৈশিষ্ট্য সবার অজানা ছিল, তাই তিনি একে নাম দিলেন ‘এক্স’ রে। অনেকে একে রন্টজেন রশ্মি হিসেবে ডাকা শুরু করে। আজ ১০০ বছর পরে রঞ্জন রশ্মির বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীদের অজানা নয়। কিন্তু তারপরেও সেই ‘এক্স’ নামটুকুর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
নতুন পদক এবং অগ্রগামী উইলহেম
রঞ্জন রশ্মির আগমন বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লবের ডাক দিলো। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হলো চিকিৎসাক্ষেত্র। যেহেতু এই রশ্মি মাংস ভেদ করতে পারলেও অস্থি দ্বারা প্রতিহত হয়, তাই এটি ব্যবহারের মাধ্যমে রোগীর ভাঙা হাড়ের চিকিৎসা করা সহজ হয়ে যায়। রঞ্জন রশ্মি রীতিমতো যশস্বী ব্যক্তিত্বে পরিণত করলো উইলহেম রন্টজেনকে। তার এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৮৯৬ সালে রামফোর্ড এবং মাতেউচি পদকে ভূষিত করা হয়। পরবর্তী বছর তিনি এলিয়ট ক্রেসন পদকে ভূষিত হন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানজনক বার্নার্ড পদকে পুরস্কৃত করা হয় উইলহেম রন্টজেনকে। কিন্তু এরকম এক ডজন পদকে ভূষিত হলেও উইলহেম রন্টজেনকে অন্যান্য পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের থেকে আলাদা করেছে এক নতুন পদক। সেটি হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মানজনক নোবেল পুরস্কার।
১৯০১ সাল থেকে শুরু হয় এই সম্মানজনক পদক প্রদান যা শতবর্ষ পরেও সমান গুরুত্বের সাথে প্রতি বছর বিভিন্ন খাতের সেরা কীর্তিমানদের সম্মানিত করে আসছে। এই পদকের প্রথম আসরে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পুরস্কৃত করা হয় রঞ্জন রশ্মির আবিষ্কারক উইলহেম রন্টজেনকে। আর এর মাধ্যমে নোবেলের ইতিহাসে নিজের নাম স্থায়ীভাবে লিখে ফেললেন এই বিজ্ঞানী।
মৃত্যু
চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর থেকে বিজ্ঞানীর উইলহেমের দিনকাল ভালো যাচ্ছিল না। তিনি নিজে অন্ত্রের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তার উপর তার স্ত্রী আনা রন্টজেন আকস্মিত মৃত্যুবরণ করায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তরুণ উইলহেমকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করার পরেও সেই ধাক্কা সামলে তিনি ঠিকই বিশ্ব দরবারে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু এবার অসুস্থ উইলহেম ক্যান্সারের ধাক্কা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না। ১৯২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ৭৭ বছর বয়সে এই মহান বিজ্ঞানীর মহাপ্রয়াণ ঘটে। পরবর্তীতে তার মরদেহ গিসেনের অল্টার ফ্রিদোফে সমাহিত করা হয়। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী, তার যাবতীয় ব্যক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক নথিপত্র ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
উইলহেম রন্টজেনের অদ্ভুতুড়ে শেষ ইচ্ছে কিন্তু পৃথিবীর বুক থেকে তার নাম মুছে দিতে ব্যর্থ হয়। উল্টো তার রঞ্জন রশ্মির কারণে এখনো কোটি কোটি মানুষ উপকৃত হচ্ছে। সেই সাথে অমর হয়ে আছে তার নাম। অবশ্য বিজ্ঞানীদের আসর ছাড়াও তার নাম আরেক স্থানে চিরদিনের জন্য অমর হয়ে আছে। সেটা হচ্ছে পর্যায় সারণী। ২০০৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী উইলহেম রন্টজেনকে সম্মানিত করে IUPAC কর্তৃক ১১১ নং মৌলিক পদার্থের নাম রাখা হয় রন্টজেনিয়াম (Rg)। এই নাম শুধু একজন বিজ্ঞানীর নাম নয়; বরং পৃথিবীর প্রতিটি ভেঙে পড়া, পরাজিত হওয়া স্বপ্ন দেখা তরুণের জন্য অনুপ্রেরণার নাম। তার অনুপ্রেরণায় পৃথিবীতে নতুন নতুন আবিষ্কার আর বিপ্লবের জন্ম হবে, এটাই প্রত্যাশা।