বিশ্বখ্যাত নরওয়েজীয় নাট্যকার হেনরিক যোহান ইবসেন ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর একজন প্রথাবিরোধী নাট্যকার। আধুনিক নাটকের জনক হিসেবে তার খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। তার বিভিন্ন নাটকে ফুটে উঠেছে সমাজের নানা অসঙ্গতি, বঞ্চনা, পুরুষশাসিত সমাজে নিষ্পেষিত নারীদের তীব্র সংগ্রাম। নারী অধিকার ও নারী ব্যক্তিত্বের উন্মেষ তার নাটকের প্রধান উপজীব্য বিষয়। তার লেখনীর মধ্য দিয়ে তিনি সেসময়ের প্রথিতযশা কবি লেখদেরকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জর্জ বার্নার্ড শ, অস্কার ওয়াইল্ড, আর্থার মিলারের মতো লেখকরা প্রতিনিয়ত তার লেখনী দ্বারা প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
জন্ম ও শৈশব
নরওয়ের উপকূলীয় স্কিয়েন নামের এক প্রাচীন শহরে ১৮২৮ সালের ২০ মার্চ ইবসেন জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নুড ইবসেন ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী এবং মা ম্যারিচেন অ্যাটেনবার্গ ছিলেন চিত্রকলা ও পিয়ানোতে বিশেষ পারদর্শী। থিয়েটার দেখার ব্যাপারে তার বেশ উৎসাহ ছিল। চার সন্তানের মধ্যে ইবসেন ছিলেন সবার বড়। ইবসেনের যখন ৮ বছর বয়স, তখন তার পরিবারে নেমে আসে ঘোর দুর্যোগ। বাবার ব্যবসায় ধ্বস নামায় আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে কাটে তার শৈশব।
শৈশবের দিনগুলোতে ইবসেন বই পড়ে, আঁকাআঁকিতে এবং জাদুবিদ্যার কৌশল রপ্ত করে সময় কাটাতেন। ১৫ বছর বয়সে ইবসেন স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেন। তখন তিনি একটি ঔষধ কারখানার শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজে যোগ দেন। দীর্ঘ ৬ বছর তিনি এই কারখানায় কাজ করেছেন। সেসময় যেটুকু অবসর পেতেন, তা আঁকাআঁকি ও কবিতা লেখায় ব্যয় করতেন। ১৮৪৯ সালে তিনি প্রথম ‘কাতিলিনা’ নামে এক নাটক রচনা করেন। নাটকটিতে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও তার সাহিত্য জীবন
১৮৫০ সা্লে ইবসেন খ্রিস্টিয়ানা শহরে চলে আসেন এবং ক্রিস্টিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। রাজধানী শহরে বসবাসের ফলে সমাজের লেখক শ্রেণী ও শিল্পমহলের সাথে তার পরিচয় ঘটে। ফলে তাদের অনেকের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা নতুন পরিবেশে নিজেকে মেলে ধরার এক সুবর্ণ সুয়োগ হিসেবে ইবসেনের জীবনে দেখা দেয়।
এই পরিবেশ তার ভীষণ পছন্দ হতে লাগলো। সাহিত্যচর্চার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠলেন ইবসেন। এইসময় তার হাতে আসে গ্রিক নাট্যকারদের লেখা নাটকের সম্ভার। নাটকগুলো পড়ে ইবসেনের সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। ফলে নাটকের প্রতি ধীরে ধীরে তার অনুরাগ বাড়তে থাকে। মনোনিবেশ করলেন নাট্যচর্চায়। তার সাহিত্য বন্ধুদের সহায়তায় প্রকাশিত হলো তার প্রথম নাটকের বই ‘কাতিলিনা’। অল্প কিছুদিনের মধ্যে রচিত হলো দ্বিতীয় নাটক ‘দ্য ভাইকিংস টোম্ব’। নাটকটি মঞ্চস্থ করার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু মঞ্চে তা খুব একটা সাড়া ফেলেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও পড়াশোনায় খুব একটা নিয়মিত ছিলেন না ইবসেন। পড়াশোনার পরিবর্তে সাহিত্যচর্চায় যেন তার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করতে গিয়ে পড়াশোনায় ছেদ পড়া শুরু হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোতে অকৃতকার্য হন। সংসার চালানোর জন্য সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত হন। এসময় সাংবাদিকতার পাশাপাশি নাট্যজগতের সাথেও পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করেন ইবসেন।
বার্গেন থিয়েটারের সুবাদে পেশাদার নাট্যমঞ্চে পদার্পণ
১৮৫১ সালে তার সাথে পরিচয় ঘটে বার্গেন শহরে ওলবুল নামের একজন বিখ্যাত বেহালাবাদকের সাথে। ওলবুল পেশাদার রঙ্গমঞ্চের সাথে ওতপ্রোতভাব জড়িত ছিলেন। তিনি ইবসেনকে বার্গেন থিয়েটারে লেখক ও ব্যবস্থাপক হিসেবে নিযুক্ত করেন। সেই থেকে বার্গেন থিয়েটারে সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন ইবসেন।
দীর্ঘ ৫ বছর ইবসেন বার্গেন থিয়েটারে কাজ করেছেন। এখানে তিনি তার রচিত নাটকও মঞ্চস্থ করেছিলেন। এখানে থাকার সময় তার সাথে অনেক বিখ্যাত নাট্যকারের এবং তাদের রচিত নাটকের সাথে পরিচয় ঘটে। নাটক, রঙ্গমঞ্চ, দর্শক বিভিন্ন বিষয়ের উপর তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং এর মধ্য দিয়ে নাটক লেখা ও মঞ্চে উপস্থাপনে তিনি বিশেষ পারদর্শিতা দেখাতে শুরু করেন।
এসব অভিজ্ঞতা ও তার সার্থক প্রয়োগ তাকে সাহিত্য জগতে অন্যতম প্রধান নাট্যকার হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। এসময় সুসলা থোরমেন নামের এক সুন্দরী নরওয়েজীয় রমণীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ইবসেন। ইবসেনের লেখালেখি জীবনের সাথে যোগ্য সঙ্গিনী হিসেবে স্বামীর পাশে ছিলেন সুসলা।
ক্রিস্টিয়ানা শহরে ফিরে আসা
একসময় বার্গেন থিয়েটারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে থাকায় ১৮৫৭ সালে ইবসেন ক্রিস্টিয়ানায় চলে আসেন। এখানে তিনি আরেকটি থিয়েটারের সাথে যুক্ত হন। এখানে ক্রিস্টিয়ানা নরওয়েজিয়ান থিয়েটার দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পান। কিন্তু কিছুদিন পরেই দলের মধ্যে ভাঙন শুরু হয়। দলের কর্মীরা তার উপর ছিল বেজায় ক্ষিপ্ত। তাদের দাবি, ইবসেন থিয়েটার পরিচালনায় অযোগ্য। ইবসেনকে দল থেকে বহিষ্কারের জন্য দলের মধ্যে চাপা গুঞ্জন চলতে থাকে। এর মধ্যে ১৮৬২ তিনি মঞ্চে নিয়ে এলেন বিবাহ নিয়ে বিদ্রূপাত্মক নাটক ‘লাভার’স কমেডি’। এই নাটক শিল্পমহলে প্রশংসা কুড়ালেও আর্থিকভাবে তেমন সফলতা আনতে পারেনি।
ইতালিতে স্বেচ্ছা নির্বাসন এবং নাট্যচর্চায় নতুন দিগন্তের উন্মেষ
ইবসেন তার ৩৫ বছর পর্যন্ত ৮টি নাটক লিখেছেন। তার এই নাট্যকর্মে শৈল্পিক ছোঁয়া থাকলেও পরিণত শিল্পসৃষ্টির প্রস্ফুরণ ঘটেনি বলে অনেক শিল্পবোদ্ধার অভিমত। আর তাই অনেকটা হতাশ হয়েই ১৮৬২ সালে ইবসেন নরওয়ে থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে ইতালিতে বসবাস করতে শুরু করেন। ইতালিতে বসে লেখেন নাটক ‘ব্র্যান্ড’। একজন যাজকের বিয়োগাত্মক ঘটনা নিয়ে নাটকটি রচিত। নাটকটি সমালোচকদের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এতদিন পর যেন তার লেখক জীবনের সার্থকতা পেতে শুরু করেন। এই নাটকের মধ্য দিয়ে তার পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতাও আসতে থাকে। তার এই নাটক স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় ব্যাপক সফলতা পায়।
দু’বছর পর প্রকাশ করেন নাটক ‘পিয়ার গিন্ট’। এই নাটকটি ইবসেনের নাট্য জীবনের অন্যতম সেরা কাজ বলে অনেকের অভিমত। গ্রিক মহাকাব্যের আধুনিক উপস্থাপন করা হয় নাটকটিতে, মঞ্চে নাটকটিতে সুরারোপ করেন জনপ্রিয় সুরকার এডভার্ড গ্রেগ। পরপর দুটি নাটকই ভীষণ খ্যাতি অর্জন করে। তিনি থিয়েটার পাগল মানুষদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন।
নাটকে গীতিনাট্যের প্রভাব ভেঙে আধুনিক গদ্যধারার প্রবর্তক
১৮৬৮ সালে ইবসেন চলে এলেন জার্মানিতে। মিউনিখের এক মঞ্চে তার লেখা ‘দ্য পিলারস সোসাইটি’ নামে সমাজ জীবনের চালচিত্র নিয়ে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন যা দর্শক মহল থেকে শুরু করে শিল্প মহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। এই নাটকটি পরবর্তীকালে তার নাট্যচর্চায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। তার আগের জনপ্রিয় দুটি নাটকেই ছিল গীতিনাট্যের প্রভাব। এই নাটক থেকেই তিনি গীতিনাট্যের ধারা থেকে বের হয়ে এসে গদ্যধর্মী নাটক লেখাতে মনোনিবেশ করেন, যার সার্থক প্রয়াস ‘দ্য পিলারস সোসাইটি’।
হেনরি ইবসেনের অমর সৃষ্টি ‘অ্যা ডলস হাউস’
এর ধারবাহিকতায় তিনি পরবর্তীতে নির্মাণ করেন তার সারা জাগানো তিন অঙ্কের নাটক ‘অ্যা ডলস হাউস’। এটি বিশ্বে রচিত বিভিন্ন নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক হিসেবে স্থান পেয়েছিল। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় নাটকটি এবং ঐ বছরের ২১ ডিসেম্বর বড়দিন উপলক্ষে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের রয়েল থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ করা হয়। এই নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অন্ধকার দিকগুলোকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন এবং অপূর্ব শৈলীতে নারীদের অবস্থা ও তাদের অধিকারের কথা তুলে ধরেন।
নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে নোরা নামের একজন নারী। ঊনবিংশ শতাব্দীর এক পরিবারকে কেন্দ্র করে নাটকটি আবর্তিত হয়।পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় একজন নারী কখনোই নিজের মতো করে বাস করতে পারে না। প্রতিনিয়ত তাকে সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলায় আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়। সমাজে তার বিশ্বাস, ভালোবাসা ও সততার কোনো মূল্য নেই। এই নাটকের মধ্য দিয়ে সেই সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইবসেনের তীব্র ধিক্কার জানান।
এই নাটকের জন্য সমালোচিতও কম হননি তিনি। শিল্পমহল ও নারী সমাজে এই নাটক ছিল তাদের বাধভাঙা উচ্ছ্বলতার বহিঃপ্রকাশ। অধিকার বঞ্চিত নারীদের মনের আবেগই যেন ব্যক্ত হয়েছে নাটকটির মধ্য দিয়ে। নারী অধিকার আন্দোলনে এই নাটক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৬ সালে ইবসেনের শততম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশিবার প্রদর্শিত নাটকের সম্মান লাভ করে ‘অ্যা ডলস হাউস’। ২০০১ সালে ইবসেনের স্বাক্ষর সংবলিত ‘অ্যা ডলস হাউস’ নাটকের পাণ্ডুলিপিকে ইউনেস্কো এক ঐতিহাসিক দলিল বিবেচনায় ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এর অন্তর্ভুক্ত করে।
অন্যান্য সাহিত্যকর্ম
এই নাটকের সাফল্যধারা তার পরবর্তী নাটকগুলোতেও প্রতিফলিত হয়। ১৮৮১ সালে ‘গোস্টস’ এবং ১৮৮২ সালে ‘অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল’ নাটক দুটিও দর্শকমহল ও সুধীমহলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পায়। এর পরপরই হেনরিক ইবসেনের সাড়া জাগানো নাটকগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে।
ইবসেনের অন্যান্য সারা জাগানো উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্য ওয়াইল্ড ডাক (১৮৮৪), রোসমের্শল্ম (১৮৮৬), দ্য লেডি ফ্রম দ্য সি (১৮৮৮),দ্য মাস্টার বিল্ডার (১৮৯২), হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েকেন (১৮৯৯)। এই নাটকগুলো ছিল মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণধর্মী। ১৮৮০ থেকে ১৯২০ এই দীর্ঘ চল্লিশ বছর ইউরোপের রঙ্গমঞ্চে তার নাটকগুলো প্রদর্শিত হতো সবচেয়ে বেশি।
বিংশ শতকের নাট্যকারদের কাছে তিনি ছিলেন অগ্রদূত, তাদের অনুপ্রেরণা। নাটকের প্রাচীনত্বকে ভেঙে নাটকের গঠনশৈলীতে এনেছেন সারল্য। তাই তাকে আধুনিক নাটকের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। হেনরিক ইবসেনকে বলা হয় ন্যাচারালিজম বা বাস্তবতাবাদের প্রবক্তা। বার্নার্ড শ প্রথম তার নাটকের সার্থক মূল্যায়ন করেছিলেন। সমালোচক M. Block বলেছিলেন “Modern Drama begins with Ibsen”। ১৯০৬ সালের ২৩শে মে সৃষ্টিশীল এই মহান শিল্পীর প্রয়াণ ঘটে।
ফিচার ইমেজ: cuttingball.com