একজন মেলিয়েস: স্পেশাল ইফেক্টের জন্মদাতা

আপনি কি জানেন লাইফ অফ পাই সিনেমায় যে মহাসমুদ্র দেখানো হয়েছিল, তা আসলে একটা বাথটাব? যদি জেনে থাকেন, তবে এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে, সুপারম্যান আসলে আকাশে ওড়ে না, ভোল্ডেমর্টের নাক মোটেও বোঁচা নয় এবং হগওয়ার্টসে আসলে কোনো উড়ুক্কু ঝাড়ু নেই। এটাও আপনাকে বলে দিতে হবে না যে দ্য রাইজ অভ দ্য প্ল্যানেট অভ দ্য এপের বানরটি আসলে একজন মাইনে পাওয়া নায়ক (অবশ্যই মনুষ্য প্রজাতির) এবং গেম অভ থ্রোন্সের ড্রাগনগুলো আসলে পাপেট মাত্র।

চলচ্চিত্রের পর্দায় আমরা প্রায়ই অসম্ভব জিনিস ঘটতে দেখি। সেই জগতে এক যুবকের মহাসমুদ্রের বুকে নৌকায় চেপে বাঘের সাথে পাঞ্জা লড়া যেমন স্বাভাবিক, তেমনি স্বাভাবিক ঝাঁটার উপর বসে শূন্যে উড়ে গিয়ে কিডিচ নামের এক আশ্চর্য খেলায় মেতে ওঠা।  চলচ্চিত্র ভুবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার নিঃসন্দেহে স্পেশাল ইফেক্টের আবিষ্কার। এই জাদুকরি ইফেক্টগুলো আবিষ্কার না হলে চলচ্চিত্র হয়ে উঠত নীরস। হয়তো কল্পকথার চলচ্চিত্রই নির্মাণই করা যেত না। মানে ভেবে দেখুন একবার, অ্যাকুয়াম্যান বাথটাবের তলায় ডুব দিচ্ছেন আর হ্যারি পটার লম্বা ঝাড়ু নিয়ে মাঠে-ঘাটে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অথবা অ্যাভেঞ্জার্সরা যেখানে দুর্ধর্ষ অগ্নিকাণ্ড ঘটাচ্ছে, তার পটভূমিকায় আগুন আর বিধ্বস্ত শহরের বদলে দেখছেন সবুজ দেয়াল। কেমন হবে?

এই যে স্পেশাল ইফেক্ট, চলচ্চিত্রের এই জাদুকরী বিষয়টি কোত্থেকে এলো? কাদের জাদুমন্ত্রে চলচ্চিত্র পর্দায় অসম্ভব সম্ভব হয়ে উঠল?

এমনই একজন জাদুকরের গল্প বলব আজ আপনাদের।

সালটা ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ। অর্থাৎ চলচ্চিত্র মাধ্যম তখন মাত্র আত্মপ্রকাশ করেছে। ঠিক তখনই এমন সব চলচ্চিত্র বানিয়ে বসেন সে জাদুকর, যা দেখে চমকে ওঠে পৃথিবীবাসী। প্রথমবারের মতো পর্দায় তারা ঘটতে দেখে অসম্ভব জাদুকরী ব্যাপার-স্যাপার, যা শুধু কল্পনাতেই সম্ভব। এই জাদুকর একজন ফরাসি ভদ্রলোক। নাম জর্জ মেলিয়েস। আজ আমরা যাকে স্পেশাল ইফেক্ট বলি, তারই প্রচলন করেন এই ভদ্রলোক।

১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর, প্যারিসের গ্রান্ড কাফেতে ঘটে গেল ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি ঘটনা। সেই ক্যাফের বেজমেন্টে প্রদর্শিত হলো বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র। লুমিয়ের পদবীধারী দুই ভাইয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে একটি নতুন গণমাধ্যমকে, যা পরবর্তী পৃথিবীতে হয়ে উঠবে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী যোগাযোগ মাধ্যম। ২৮ ডিসেম্বরের সেই ঐতিহাসিক দিনে লুমিয়ের ভাতৃদ্বয়ের চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে অন্যদের সাথে জর্জ মেলিয়াসও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

মেলিয়েস একজন শিল্পী এবং একইসাথে ব্যবসায়ী মানুষ। তিনি জাদুবিদ্যায়ও পারদর্শী (জাদুকর কথাটি শুধু কথার কথা নয়)। সেদিন অন্যদের মতো তিনিও পর্দায় চলমান ছবি দেখে মুগ্ধ হন। তার প্রবল আগ্রহ জন্মায় বিস্ময়কর এই গণমাধ্যম এবং তার সাথে জড়িত প্রযুক্তি নিয়ে। সেদিনই তিনি চলে যান সেই দুই ভাইয়ের কাছে। ১০,০০০ ফ্রাঙ্কের বদলে তিনি সিনেমাটোগ্রাফটি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় তাকে ফিরিয়ে দেন। খুব সম্ভবত নব্য এই আবিষ্কার তাদের হাতছাড়া হবে, এ ভয় ছিল তাদের। চলচ্চিত্র নিয়ে তখনও কোনো কপিরাইট আইন ছিল না।

প্রত্যাখানে অবশ্য দমবার পাত্র ছিলেন না মেলিয়েস। সৌন্দর্যতৃষ্ণা এবং সেই সৌন্দর্যের জন্য নিরন্তর সন্ধান দুটোই তিনি করতে জানেন। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যন্ত্রের সন্ধান শুরু করলেন।

স্পেশাল এফেক্টের জনক জর্জ মেলিয়েস (Image Source: Wikimedia Commons)

সৌভাগ্যক্রমে সিনেমার জন্য যে ক্যামেরা, প্রজেক্টর এবং অন্যান্য যন্ত্রের প্রয়োজন, তা আবিষ্কারের কাজ করছিলেন অনেকেই। তাদের সবাই কিন্তু লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের মতো সংরক্ষণ নীতি মেনে চলছিলেন না। মেলিয়েস সাহেব এমন এক যন্ত্রের সন্ধান পান তার সহকারী এবং বান্ধবী এক ফরাসি অভিনেত্রীর সাহায্যে। সেই অভিনেত্রী তাকে জানান, রবার্ট পল বলে এক ইংরেজ যন্ত্রনির্মাতা আছেন, যার কাছে অ্যানিমেটোগ্রাফ নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের যন্ত্র আছে। সেই যন্ত্র হয়তো লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় আবিষ্কৃত যন্ত্রের মতো শক্তিশালী নয়- তবে তাতে কাজ চলে যাওয়ার কথা। মেলিয়েস আর অপেক্ষা করলেন না। উড়ে গেলেন মহারানীর দেশ ইংল্যান্ডে। পলের সাথে দেখা করলেন তিনি। কিনে নিলেন সেই অ্যানিমেটোগ্রাফ। সেই সাথে পলের এবং এডিসন ম্যানুফ্যাকচার কোম্পানির কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও। ঠিকই ধরেছেন, ইলেক্ট্রিক বাতির আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন। সেই গল্প পরে হবে।

অ্যানিমেটোগ্রাফটিকে খুলে ঘেঁটে তিনি যন্ত্রটি কীভাবে কাজ করে বুঝে নেন এবং নিজেই একে চলচ্চিত্র নির্মাণের উপযুক্ত করেন। প্যারিসে তখনও ফিল্ম এবং ফিল্ম নির্মাণের কারখানা না থাকায় তিনি ফিল্ম আমদানি করেন ইংল্যান্ড থেকে। ধীরে ধীরে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে দক্ষ হয়ে ওঠেন।

একটি সুখকর দুর্ঘটনা ও নতুন উপলব্ধি

১৮৯৬ সালে জর্জ মেলিয়েস নিজের জাদুবিদ্যার থিয়েটার রবার্ট-হুডিনে প্রদর্শন করেন নিজের বানানো চলচ্চিত্র। একই বছর তিনি তৈরি করেন স্টার ফিল্ম কোম্পানি। স্বল্পদৈর্ঘ্য এই চলচ্চিত্রগুলো মূলত ছিল জাদুবিদ্যার খেলা। যেহেতু মেলিয়েস নিজে ছিলেন জাদুকর এবং হাত সাফাইয়ে দক্ষ। সেই ম্যাজিক ট্রিকগুলোই তিনি দেখাতে শুরু করেন চলচ্চিত্রে।

এভাবে জর্জ মেলিয়েস পুরোনো চলচ্চিত্র পুনর্নির্মাণ ও জাদুবিদ্যা দেখানো চলচ্চিত্র বানিয়ে হয়তো অর্থ এবং খ্যাতি দুই-ই কামাতেন, কিন্তু তিনি ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লেখাতে পারতেন না। জাদুবিদ্যা দেখাতে দেখাতে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী থেকে যেতেন, ইতিহাস বদলে দেয়া জর্জ মেলিয়েস হতেন না। কারণ, ক্যামেরার সাহায্যে বাস্তব ঘটনার চিত্রায়ন তখন অনেকেই করছিলেন। লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় এবং তৎকালীন সিনেমাটোগ্রাফাররা তখন ব্যস্ত এসকল প্রামাণ্য-চলচ্চিত্র নির্মাণে, যা প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানী-গুণী ও বিদ্যার্থীদের সম্পত্তি ছিল। লুমিয়েররা নিজেও চাইছিলেন চলচ্চিত্র মাধ্যমটি ব্যবহার হোক বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যে। তাদের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করে করে হয়তো ইতিহাসের গর্ভে একসময় হারিয়ে যেতেন জর্জ মেলিয়েস। চলচ্চিত্রকে মোহনীয় ও জাদুকরী রূপ আর দেয়া হত না তার। কিন্তু দৈবক্রমে এমন এক ঘটনা ঘটে গেল যার ফলে বদলে গেল চলচ্চিত্র নিয়ে মেলিয়েসের দৃষ্টিভঙ্গি।

মেলিয়েসের জীবনের এই স্মরণীয় ঘটনাকে তিনি পরবর্তীতে আখ্যায়িত করেছেন সুখকর দুর্ঘটনা বা Happy Accident হিসেবে। কোনো একদিন মেলিয়েস প্যারিসের রাস্তায় ক্যামেরা নিয়ে একটি দৃশ্য ধারণ করছিলেন। এমন সময় ঘটলো দুর্ঘটনা। কারিগরি কোনো কারণে হঠাৎ ক্যামেরা বন্ধ হয়ে গেল। অনেক কষ্টে সেই ক্যামেরা ঠিক করে যথারীতি কাজ শেষ করলেন। তিনি যে দুর্ঘটনাবশত একটি মারাত্মক আবিষ্কার করেছেন তা বুঝতে পারেন ভিডিওটি দেখার পর। তিনি দেখলেন, ক্যামেরা বন্ধ হয়ে যাবার কারণে তার করা ভিডিওর মাঝের অংশ কেটে গেছে। ফলে যা হয়েছে তা অপূর্ব। আগের শট এবং পরের শট মিলিত হয়ে একটি ইলিউশনের জন্ম নিয়েছে। একজন পথচারী পুরুষ পরিণত হয়েছে একজন নারীতে এবং একটি বাস পরিণত হয়েছে একটি হেয়ার্স গাড়িতে। এভাবে আকস্মিকভাবেই জর্জ মেলিয়েস আবিষ্কার করে বসলেন এমন একটি কৌশল যাকে বর্তমানে আমরা স্টপ ট্রিক বলে জানি। তার এই আবিষ্কার এই কারণে তাৎপর্যপূর্ণ যে এই আবিষ্কার চলচ্চিত্র সম্পর্কে মেলিয়েসের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন চলচ্চিত্রে কোন দিক নিয়ে তার কাজ করা উচিত।

দুর্ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জর্জ মেলিয়েস তার সিনেমার যন্ত্র এবং কলাকুশলীদের নিয়ে নিজের নির্মিত স্টুডিওতে এমন এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেন যে একের পর এক জন্ম দিতে থাকেন বিভিন্ন ইফেক্টের। এক হিসেবে জর্জ মেলিয়েস নামের এই সুদর্শন খেয়ালী ভদ্রলোকই স্পেশাল এফেক্টের জন্মদাতা।

মেলিয়েসের চলচ্চিত্র: দ্য ভ্যানিশিং গার্ল (Image Source: Wade’s Playlists, Movies and Stories, etc.)

১৮৯৬ সালে মেলিয়েস ১ মিনিটের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন যেখানে তিনি মঞ্চে উঠে এসে প্রথাগত জাদুবিদ্যা প্রদর্শনীর ঢঙে একজন স্বেচ্ছাসেবীকে ভ্যানিশ করে দেন। কাজটি তিনি করেন তার ক্যামেরার সাহায্য নিয়ে। চলচ্চিত্রের নাম ছিল ‘দ্য ভ্যানিশিং গার্ল’। সেখানে তিনি ব্যবহার করেন তার সদ্য আবিষ্কৃত ‘স্টপ ট্রিক’। বর্তমানে এভাবে কেউ জাদু দেখালে লোকে হাসবে। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে সময়টা তখন উনবিংশ শতকের শেষভাগ। পর্দার উপর যে চলমান দৃশ্য দেখা যেতে পারে অধিকাংশ মানুষ তা তখনও হজম করতে পারেনি। বলা হয়, লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় নাকি যখন প্রথম চলচ্চিত্রে ট্রেন স্টেশনে ট্রেন আসা দেখাচ্ছিলেন, দর্শকেরা তাকে সত্যিকারের ট্রেন ভেবে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যা ছিল মূলত লুমিয়েরদের অনুকরণ। ১৮৯৭ সালে প্যারিসের বাজারে আসে নতুন ফিল্ম ক্যামেরা। মেলিয়েস নিজের ক্যামেরা বাদ দিয়ে সেই নতুন ক্যামেরা কিনে নেন। পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি এই নব্য প্রযুক্তিই ব্যবহার করেন।

সাফল্য

জর্জ মেলিয়েস তখন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করলেন নতুন উদ্যমে। ১৮৯৬ এবং ১৮৯৭ ছিল ব্যস্ততার বছর। মেলিয়েস এই সময় প্যারিসের বাইরে তার নিজের জমিতে নির্মাণ করেন স্বপ্নের মতো একটি ফিল্ম স্টুডিও। স্টুডিওতে সূর্যালোক প্রবেশের সুবিধার জন্য ছিল কাচের দেয়াল ও ছাদ। এছাড়া ছিল ড্রেসিং রুম এবং স্টেজ সেটিংয়ের সুব্যবস্থা। এমনভাবে তিনি এই স্টুডিও নির্মাণ করেন যেখানে তিনি বাধাহীনভাবে সিনেমাটোগ্রাফির বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করতে পারবেন।

জর্জ মেলিয়েসের স্টুডিওর কল্পিত চিত্র; Image Source: GK Films

১৮৯৬ সালে মেলিয়েস ৭৮টি এবং ১৮৯৭ সালে ৫২টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। লুমিয়ের এবং অন্যান্য চলচ্চিত্র নির্মাতারাও তখন চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন দেদারসে। তাদের সাথে মেলিয়েসের তফাৎ ছিল নতুনত্বে। লুমিয়েররা তখন নির্মাণ করে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন প্রামাণ্য ধারার চলচ্চিত্র, যার মধ্যে বৈজ্ঞানিক সত্য আছে, আছে পেশাদারিত্ব, নেই শিল্প বা আর্ট। শিল্পের মাধুর্য দিয়ে তখন দর্শকের মন রাঙাচ্ছেন জর্জ মেলিয়েস। সাধারণ দর্শকদের তিনি টানছেন চলচ্চিত্রের দিকে। তিনিও লুমিয়েরদের মতো প্রামাণ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছেন বটে, তবে তার মূল লক্ষ্য এবং স্বতন্ত্র জনরা ছিল ফিরিস বা পরীর গল্প। যেখানে তিনি দর্শকদের নিয়ে যেতেন এক কল্পনার রাজ্যে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দর্শকরা তাদের বাল্যে পড়া রূপকথার গল্প এবং থিয়েটারে দেখা রূপকথাভিত্তিক নাটকগুলো বাস্তব হয়ে উঠছে। তিনি নিজে জাদুকর এবং ইলিউশনিস্ট বলেই পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন রূপকথার গল্পের মোহময় আবহ।

মেলিয়েস বিশ্বাস করতেন চলচ্চিত্রে স্বপ্ন ধরা যায়। মেলিয়েসের মৃত্যুর অনেক বছর পর নির্মিত হিউগো নামক চলচ্চিত্রে মেলিয়েসকে এক ভক্তের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়, “এখানে আমরা স্বপ্ন নির্মাণ করি। ঘুরে বেড়াও এবং স্বপ্ন খুজে নাও।” তাঁর চলচ্চিত্রগুলো ছিল অবাস্তব, রহস্যে পরিপূর্ণ এবং কল্পকাহিনী নির্ভর। জর্জ ব্রুনেল লিখেছেন,

MM. Méliès and Reulos have, above all, made a speciality of fantastic or artistic scenes, reproductions of theatre scenes, etc., so as to create a special genre, entirely distinct from the ordinary cinematographic views consisting of street scenes or genre subjects.

জাদুবিদ্যার পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞাপণের ছবি এবং প্রামাণ্য ছবিও করছেন। পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি কমিয়ে আনেন তার চলচ্চিত্রের সংখ্যা। ১৮৯৮ সনে মাত্র ২৭টি ছবি নির্মান করেন তিনি। কিন্তু তার নির্মাণশৈলী হয়ে ওঠে আরো শৈল্পিক, নতুনত্বে ভরপুর। বলাই বাহুল্য, তিনি তার নিজস্ব ধারার চলচ্চিত্রই শুধু নির্মাণ করতেন তা নয়, বরং তিনি সব ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। যদিও তিনি স্মরণীয় হন তার বিশেষ চলচ্চিত্রগুলোর জন্যই। তিনি পাশাপাশি স্পেশাল ইফেক্ট নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকেন। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে ব্যবহার করতে থাকেন সেগুলো। তিনি কলাকুশলী এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাহায্যে হাতে আঁকা রংয়ের ব্যবহারও করেছিলেন

মেলিয়েস নির্মিত চলচ্চিত্রে রঙের ব্যবহার (Image Credit: Georges Méliès)

A Dinner Under Difficulties চলচ্চিত্রে তিনি ব্যাকওয়ার্ড ইফেক্ট ব্যবহার করেন। The Cave of the Demons এবং Four Troublesome Heads চলচ্চিত্রে তিনি ব্যবহার করেন সুপার ইম্পোজিশন। এই নব্য ইফেক্ট এবং কৌশলগুলো বিনির্মাণ মোটেও সহজ ছিল না। বরং পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং কলাকুশলী সবাইকেই দক্ষ হয়ে উঠতে হত। হ্যাঁ, এ কথা অনস্বীকার্য যে দক্ষ এবং অধ্যবসায়ী সহচর ছাড়া মেলিয়েসের অর্জন সম্ভব হত না।

স্পেশাল ইফেক্ট ব্যবহার করে মেলিয়েস ১৮৯৯ সালে ৪৮টি চলচ্চিত্র নির্মান করেন। এই বছরই তিনি বানান তার বিখ্যাত দুটি চলচ্চিত্র। এর একটি The Dreyfus Affair, যা ছিল সমকালে চলমান একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির উপর ভিত্তি করে নির্মিত। চলচ্চিত্রটি ছিল মূলত আলফ্রেড ড্রেফুস নামক এক ফরাসি ইহুদী ক্যাপ্টেনকে নিয়ে যাকে মিথ্যে অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় এবং ডেভিল দ্বীপের কারাগারে পাঠানো হয়। এমন রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনীর সময় বাধে বিপত্তি। দর্শকদের দুই পক্ষের মধ্যে প্রথমে প্রবল বিতর্ক ও পরে হাতাহাতি শুরু হয়। শেষমেষ পুলিশ এসে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনে। ফলে চলচ্চিত্রের শেষটা কারোরই দেখা হলো না।

যেকোনো নতুন আবিষ্কার যখনই পৃথিবীতে আসে তখনই শুরু হয় তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতা। লুমিয়েররা চলচ্চিত্রকে জনগণের সামনে নিয়ে আসার পর পরই বিভিন্ন ব্যবসায়ী একে লুফে নেন। এমনই এক ব্যবসায়ী ছিলেন টমাস আলভা এডিসন। চলচ্চিত্রশিল্পে তিনি একচেটিয়া ব্যবসা ফেঁদে বসেন মার্কিন মুলুকে। তাঁর প্রতিযোগীরা তাকে প্রতিহত করার উপায় খুঁজে খুঁজে যখন প্রায় হয়রান এমন সময় মেলিয়েস প্রকাশ করলেন তাঁর উপন্যাসভিত্তিক চলচ্চিত্র সিন্ডারেলা। ৬ মিনিট লম্বা ছিল চলচ্চিত্রটি এবং অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিল ৩৫ জন।

একদিকে জনপ্রিয় গল্প, অন্যদিকে মেলিয়েসের শিল্পের জাদু। দ্রুত বিখ্যাত হয়ে উঠলো চলচ্চিত্রটি। টেব্লুক্স নামের এক অভিনব ইফেক্ট ব্যবহারের মাধ্যমে এটি হয়ে ওঠে আরো শৈল্পিক। ইউরোপ এবং আমেরিকাজুড়ে এত বিখ্যাত হয় এই চলচ্চিত্রটি যে মার্কিন চলচ্চিত্র বিতরণকারীদের টনক নড়ে। এমনই একজন বিতরণকারী সিগমুন্ড লুবিন পেয়ে গেলেন মারাত্মক অস্ত্র। এডিসনের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তিনি খুঁজছিলেন নতুন উপাদান। পেয়ে গেলেন সিন্ডারেলা। শুরু করলেন প্রদর্শনী। ১৮৯৯ সালের ডিসেম্বর থেকে এই চলচ্চিত্রটি প্রায়ই প্রদর্শিত হতো আমেরিকায়। চলচ্চিত্রগুলোর অনুকরণ হতে থাকে দেদারসে। কখনো মেলিয়েসের পুরো চলচ্চিত্র বা কখনো ট্রিক্সগুলো অনুকরণে মাধ্যমে অনেক নব্য চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী নিত্যই দু’পয়সা কামিয়ে নিচ্ছেন।

শিল্পের সৃষ্টি আনে ব্যবসায়িক সাফল্য এবং ব্যবসায়িক সাফল্য আনে অর্থ। অর্থ থেকে জন্ম নেয় নিত্য-নতুন শিল্প। অনেকে অবশ্য অর্থের জালে ফেঁসে প্রবলভাবে বাণিজ্যিক হয়ে ওঠে এবং নব-উদ্ভাবন থেকে সরে আসে। এভাবে যুগে যুগে কত সম্ভাবনা বিনষ্ট হলো তার ইয়ত্তা নেই। মেলিয়েস অবশ্য মোটেও এমন মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন শিল্পানুরাগী এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনে উন্মুখ। তিনি তার লভ্যাংশ দিয়ে নিজের স্টুডিও আরো বড় ও আধুনিক করে তোলেন। সেই সাথে আসেন নতুন যন্ত্র, নিত্য-নতুন প্রযুক্তি। আর পাশাপাশি চলতে থাকে ক্যামেরা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন স্টাইল, নির্মাণশৈলি বা ফর্ম, নতুন ট্রিকস বা শটের উদ্ভাবন।

মেলিয়েসের সাফল্যের দিন শেষ হয়নি তখনও। সামনে ধেয়ে আসছে নতুন এক শতাব্দী। মেলিয়েস কাজ করে যাচ্ছেন তার চলচ্চিত্র নিয়ে। ১৯০০ সালে প্রকাশ পায় জোয়ান অব আর্ক, ওয়ান ম্যান ব্যান্ড, দ্য ক্রিসমাস ড্রিম নামের চলচ্চিত্রগুলো। তিনি জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছে যান। তার হাত যেন পরশ পাথর, যা বানাচ্ছেন তা-ই সোনা হয়ে উঠছে। ১৯০১ সালে তিনি নির্মাণ করেন ব্রাহমিন এন্ড দ্য বাটারফ্লাই, রেড রাইডিংহুড ও ব্লু বিয়ার্ড। যে আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের চলচ্চিত্র দেখে মেলিয়েসের হাতেখড়ি তারাই একপর্যায়ে অনুকরণ করতে শুরু করে মেলিয়েসকে। বলা হয়, ১৯০২ সালে এডিসন কোম্পানির চলচ্চিত্র জ্যাক এন্ড দ্য বিনস্টক মূলত ছিল মেলিয়েসের চলচ্চিত্রের নিম্নমানের অনুকরণ

১৯০২ সাল আরেকটি বিশেষ কারণে বিখ্যাত। এই বছরই মেলিয়েস নির্মাণ করেন তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অ্যা ট্রিপ টু দ্য মুন। চলচ্চিত্রটি জুল ভার্নের ‘ফ্রম আর্থ টু দ্য মুন’ এবং এইচ জি ওয়েলসের ‘দ্য র্ফাস্ট ম্যান ইন দ্য মুন’ উপন্যাস দুটির অনুসরণে নির্মিত। চলচ্চিত্রটিকে ধরা যেতে পারে বিশ্বের প্রথম সফল সাইফাই চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি ছিল মাত্র ১৪ মিনিটের এবং তাতে খরচ হয় ১,০০০ ফ্রাংক। চলচ্চিত্রের মূল প্লট খুব সাধারণ। একগাদা বিজ্ঞানী একটি স্পেসশিপ নির্মাণ করে চন্দ্রপৃষ্টে আরোহণ করেন। তারপর যেকোনো সায়েন্স ফিকশনে যা হয়- তাদের দেখা হয় চন্দ্রবাসী কিছু প্রাণীর সাথে। তারা সেই বিজ্ঞানীদের তাড়া করে। একপর্যায়ে বিজ্ঞানীরা পালিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে।

‘অ্যা ট্রিপ টু দ্য মুন’ চলচ্চিত্রে চাঁদের গায়ে বিঁধে যাওয়া রকেট; Image Credit: Georges Méliès

চলচ্চিত্রের কাহিনী সাদামাটা, যেন কাঁচা হাতে লেখা সায়েন্স ফিকশন। কিন্তু এই চলচ্চিত্রের সত্যিকারের কৃতিত্ব এর নির্মাণশৈলিতে। মেলিয়েসের জাদুকরী হাতের ছোঁয়ায় এই চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে মোহময় এক কল্পকথা। সেই যুগে এমন চলচ্চিত্র ছিল সত্যিই বিরল। চলচ্চিত্রের প্রতি পরতে খুঁজে পাওয়া যায় শক্তিশালী কল্পনাশক্তির ছোঁয়া। যেমন- স্পেসশিপটিকে ছোড়া হয় একটি বিশাল কামানের সাহায্যে। স্পেসশিপটি যখন চাঁদের গায়ে গেঁথে যায় তখন চাঁদ মামা চিৎকার করে ওঠে।

শেষদৃশ্যে স্পেসশিপটি সমুদ্রে অবতরণ করে। সত্যিকার সমুদ্র নয়। মেলিয়েস সুপারইম্পোজিশনের মাধ্যমে একটি মাছের ট্যাংককে সমুদ্রে পরিণত করেন সুপার। এই চলচ্চিত্রকে বাস্তবধর্মী করার কোনো আগ্রহই মেলিয়েসের ছিল না। তিনি চলচ্চিত্রটিকে জাদুকরী ও মোহময় করে তুলতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।

অ্যা ট্রিপ টু দ্য মুন শুধু ফরাসি দেশে নয়- গোটা ইউরোপ এবং মার্কিন মুলুকেও বিখ্যাত হয়ে উঠে। সেই সাথে এটি হয়ে ওঠে চলচ্চিত্র পর্দার প্রথম সফল সায়েন্স ফিকশন। সেই সময় মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতারা এই চলচ্চিত্র পুরোপুরি কপি করে নিজেরা প্রচুর আয় করেন। কপিরাইট আইনের দুরবস্থা হলে যা হয় আর কী।

অ্যা ট্রিপ টু দ্য মুন ছিল মেলিয়েসের আন্তর্জাতিক খ্যাতির সোপান। অনেক বছর পর যখন কেউ জর্জ মেলিয়েসের কথা বলবেন সেই সাথে অবধারিতভাবে চলে আসবে ট্রিপ টু দ্য মুনের নাম। ১৯০২ সালে প্রকাশ পায় তার আরো কিছু চলচ্চিত্র। প্রত্যেকটিই বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তার মধ্যে ছিল জোনাথান সুইফটের বিখ্যাত উপন্যাস গালিভার্স ট্রাভেলস অনুসরণে গালিভার্স ট্রাভেলস, দ্য লিলিপুটিয়ানস এন্ড দ্য জায়ান্টস এবং ডেনিয়েল ডেফো নির্মিত রবিনসন ক্রুসো। ১৯০৩ সালে মেলিয়েস নির্মান করেন ‘দ্য কিংডম অফ ফেরিস’। এই চলচ্চিত্রটিও শিল্পগুণে ছিল অনবদ্য। ফিল্ম ক্রিটিক জিন মিত্রির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লিখেছিলেন,

Undoubtedly Melies’s best film and in any case most poetic.

হ্যাঁ কাব্যিকই বটে। জর্জ মেলিয়েসের ক্ষেত্রে ঠিক এই কথাটিই বলা সঙ্গত। তিনি কাব্য করতেন। দেখাতেন পর্দায় নির্মাণশৈলির জাদু।

১৯০৪ সালে মেলিয়েস আরেকটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যার নাম দ্য ইম্পসিবল ভয়েজ। এতে আছে একদল বিজ্ঞানী সারা পৃথিবী ভ্রমণ করে শেষে সূর্যে পৌঁছে যাওয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনী ।

১৯১২ সাল পর্যন্ত সাফল্যের সাথে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন জর্জ মেলিয়েস। কিন্তু এরপরই আসে পতন। জনপ্রিয়তা ও সাফল্যের শীর্ষে থাকা এই ফরাসি চলচ্চিত্রকার হঠাৎ জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেন এবং ধীরে ধীরে ছিটকে পড়েন চলচ্চিত্রজগৎ থেকে।

পতন

খ্যাতি এবং লোভ কোনোটিতেই ভেসে যাননি মেলিয়েস। তিনি প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করেছেন তার ক্যামেরা নিয়ে। বার বার ভেবেছেন কীভাবে তাঁর চলচ্চিত্রকে আরও জাদুকরী ও শৈল্পিক করে তোলা যায়। বাণিজ্যের উপর তিনি গুরুত্ব দিতেন শিল্পকে। এই শিল্প চেতনাই কাল হয় তার। প্রবল খ্যাতিমান ও শক্তিশালী এই চলচ্চিত্র নির্মাতা একদিন হেরে গেলেন বাণিজ্যের কাছে। ব্যবসা এবং জনপ্রিয়তা- দুদিক থেকেই অধঃপতিত হলেন এই বিশ্ব কাঁপানো চলচ্চিত্র প্রযোজক। কীভাবে?

১৯১২ সালের পর মেলিয়েসের পতন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও এর শুরু আরো আগে থেকে। এর কারণ ছিল দুটো। এক, তৎকালীন বেনিয়াদের সাথে প্রতিযোগিতা। দুই, প্রথম মহাযুদ্ধ।

সত্যি বলতে মেলিয়েসের কাজগুলোতে নতুনত্ব কিছুটা কমে আসছিল। তিনি পুরোনো ফর্মুলায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলেন। তাঁর চলচ্চিত্রের প্রতি যে দর্শকদের মোহ যে কমে যাচ্ছিল তা জানতে পারা যায় সে সময়ের চলচ্চিত্র সমালোচকদের বক্তব্য থেকে। চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ মিরিয়াম রোজেনের ভাষায়,

“lapse into the repetition of old formulas on the one hand and an uneasy imitation of new trends on the other.”

মেলিয়েস তখন করে বসলেন দুর্দান্ত একটি ভুল। তিনি প্যাথে ফ্রেরে নামক একটি চলচ্চিত্র কোম্পানির সাথে চুক্তি করলেন যে তিনি তাদের টাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন এবং বিনিময়ে কোম্পানিটি মেলিয়েসের চলচ্চিত্রগুলো বন্টন এবং সম্পাদনার অধিকার লাভ করবে। চুক্তির শর্ত ভেঙে গেলে বা লোকসান হলে প্যাথে ফ্রেরে মেলিয়েসের স্টার কোম্পানি ও মন্ট্রিলের স্টুডিও এমনকি মেলিয়েসের বাসা অধিগ্রহণ করার সুযোগ পাবে। এমন ভয়াবহ চুক্তি মেলিয়েস কেন করেছিলেন কে জানে। হয়তো নিজের সৃষ্টি নিয়ে একটি বেশিই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন এই খেয়ালী ভদ্রলোক।

ততদিনে মেলিয়েসের দেখিয়ে দেয়া চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন ট্রিক্স ব্যবহার করে নিত্যনতুন চলচ্চিত্র বানাতে শুরু করেছের নব্য চলচ্চিত্র নির্মাতারা। তারা পর্দায় নিয়ে আসছেন নতুন চমক। মেলিয়েসের প্রথাগত স্টাইল তখন বেশ সেকেলে হয়ে উঠছে দর্শকদের চোখে। নবীন এবং ঝানু ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে পেরে উঠলেন না এই প্রবীন চলচ্চিত্রনির্মাতা। ধীরে ধীরে দর্শক হারাতে শুরু করলেন তিনি। ১৯১০ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো সাফল্য পেলনা। ১৯১২ সালে নির্মিত দ্য কনকোয়েস্ট অফ দ্য পোল নামের উচ্চভিলাষী চলচ্চিত্রটিও না। সমালোচক এবং চলচ্চিত্র-বিশেষজ্ঞদের একাংশ এর ভূয়সী প্রশংসা করলেও বাণিজ্যিকভাবে মার খেল চলচ্চিত্রটি। ১৯১২ সালে প্যাথে ফ্রেরের সাথে চুক্তির শর্ত ভেঙে গেল।

১৯১২ সালে নির্মিত মেলিয়েসের কনকোয়েস্ট অফ দ্য পোলের দৃশ্য; Image Credit: Georges Méliès

 

এরপর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ ছেড়েই দিলেন পুরোপুরি। মনোযোগ দিলেন থিয়েটার এবং জাদুবিদ্যা দেখানোর কাজে।

১৯১৭ সালে পাকাপাকিভাবে চলচ্চিত্র ব্যবসা থেকে সরে এলেন মেলিয়েস। ১৯১৯ সালে শুরু হলো প্রথম মহাযুদ্ধ। ফরাসি সেনাবাহিনী মেলিয়েসের স্টুডিওর দখল নিলো। একসময়ের স্বপ্ন নির্মাণের কারখানা পরিণত হলো যুদ্ধাহতদের ক্যাম্পে। তাদের আহাজারিতে ভরে উঠলো স্টুডিওটি। মেলিয়েসের ২০০টি চলচ্চিত্রের ফিল্ম পুড়িয়ে ফেলা হলো এবং তা দিয়ে নির্মিত হলো অস্ত্র ও বুট জুতা। মনে ভীষণ আঘাত পেলেন মেলিয়েস। সপরিবারে প্যারিস ত্যাগ করলেন তিনি। ১৯২৩ সালে মেলিয়েসের সাধের প্যারিস-হুডিন থিয়েটার ভেঙে ফেলা হলো এবং পাথে ফ্রেরে তার স্টার ফিল্ম কোম্পানি এবং মন্ট্রিলের স্টুডিওর দখল নিলো এক কালের জনপ্রিয়তার শীর্ষের থাকা মেলিয়েস চোখের সামনে দেখলেন নিজের অতি যত্নে গড়ে তোলা রাজত্বের ধ্বংসযজ্ঞ

এভাবে দৈন্য ও হতাশায় ডুবে গেলেন এক প্রবল স্বপ্নদ্রষ্টা জাদুকর। ক্রমে ক্রমে প্রবল হর্ষধ্বনী দেয়া দর্শকেরাও ভুলে গেল তাকে। প্রথমে খ্যাতি বিদায় নিল, এরপর বিদায় নিল তার নিজ হাতে গড়া ফিল্ম স্টুডিওগুলো। একদিন প্রবল অভিমান আর রাগে তিনি নিজ হাতে পুড়িয়ে ফেললেন তার সাধের চলচ্চিত্রের ফিল্মগুলো।

স্করসেসে নির্মিত হিউগো চলচ্চিত্রে রাগান্বিত মেলিয়েসের নিজের ফিল্ম ও চলচ্চিত্রের সরঞ্জাম পুড়িয়ে ফেলার কল্পিত দৃশ্য; Image Credit: GK Film

 

চলচ্চিত্র জগৎ থেকে ছিটকে গেলেন মেলিয়েস। জনমন থেকেও ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেন। কেউ জানলো না কোথায় গেলেন তিনি। কেউ খোঁজও রাখলো না। পুড়ে যাওয়া অধিকাংশ ফিল্মের ফাঁকে কোথাও অযত্নে বেঁচে গেল মেলিয়েসের কয়েকটি প্রিয় চলচ্চিত্র। সেগুলোর খোঁজেও আর এলো না কেউ। মাত্র ২০০টি চলচ্চিত্র অযত্নে অক্ষত পড়ে রইল ভবিষ্যতের কোনো অজানা অনুসন্ধানীর প্রত্যাশায়।

আবার আলো জ্বললো

সালটা ১৯২৪। মেলিয়েস তখন একজন ভুলে যাওয়া মানুষ। দৈন্য তার নিত্যসঙ্গী। ততদিনে প্রথম পক্ষের স্ত্রী মারা গেছেন। তার প্রাক্তন পরিচারিকা এবং ফরাসি অভিনেত্রী জোহানে দেলসিকে বিয়ে করে তিনি গ্যারে মুঁপারনাসে একটি ক্যান্ডি এবং খেলনার দোকান চালাচ্ছেন। অধিকাংশ চলচ্চিত্রের ফিল্ম নিজের হাতে পুড়িয়েছেন তিনি। বাকিগুলো শোভা পাচ্ছে ফরাসি সেনাবাহিনীর পদযুগলে। কিছু বেঁচেছে বটে। সেগুলো খুব অযত্নে আগলে রেখেছেন ভীষণ অভিমানী এই চিত্র প্রযোজক। দোকানে বসে থাকেন এবং মাঝে মাঝে পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করেন। কেউ চেনে না তাকে। কেউ খোঁজ রাখে না। তিনি এখন ইতিহাস। ভুলে যাওয়া মানুষ। দৈন্য এবং কঠোর পরিশ্রমের বোঝা তার কাধে। 

কিন্তু মেলিয়েস ঘূর্ণাক্ষরেও জানতেন না যে এক ফরাসি সাংবাদিক হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাকে। সেই ফরাসি সাংবাদিক ছিলেন একজন চলচ্চিত্রপ্রেমী। তার উদ্দেশ্য ছিল ফরাসি চলচ্চিত্রের ইতিহাস নিয়ে একটি বই লেখা। তিনি খুঁজতে শুরু করেন মেলিয়েসকে। কিন্তু কেউ জানত না কোথায় আছেন তিনি। তরুণ সাংবাদিক একগুঁয়ে, সেই সাথে পরিশ্রমী। তিনি খুঁজতে খুঁজতে একদিন সত্যিই পেয়ে গেলেন মেলিয়েসকে। সাক্ষাৎকার নিলেন তার। ১৯২৬ সালে তিনি প্রকাশ করলেন তার বই।

ব্যস জ্বলে উঠলো আলো। মেলিয়েসকে আবার আবিষ্কার করলো পৃথিবী। ফরাসি চলচ্চিত্র গবেষক এবং সাংবাদিকেরা খুঁজতে শুরু করলেন তাকে। বেশিদিন আগের কথা তো নয়। সেই প্রজন্মের অনেকের বুকে তখন জ্বল জ্বল করছে মেলিয়েসের জাদুকরী চলচ্চিত্রের স্মৃতি। ফরাসি সিনে-ম্যাগাজিন জর্জ মেলিয়েসকে মুঁপারনাসে খুঁজে পেলেন। তার কাছ থেকে চেয়ে নিলেন একটি স্মৃতিকথামূলক রচনা। সেই রচনা প্রকাশ পেতেই সাংবাদিক ও গবেষকদের আগ্রহের পাত্র হয়ে উঠলেন মেলিয়েস। আবার বিখ্যাত হয়ে উঠলেন তিনি। ফরাসি চলচ্চিত্র জগৎ যেন পুনঃআবিষ্কার করলো তাকে।

১৯২৯ সালে জর্জ মেলিয়েসের সম্মানে সেল প্লেলে তার কাজগুলো নিয়ে আয়োজিত হলো একটি প্রদর্শনী। তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, এটি তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৩১ সালে লেজিয়ন অফ অনার ঘোষিত হন এই চলচ্চিত্র প্রযোজক। পুরষ্কার গ্রহণ করেন চলচ্চিত্র মাধ্যমের আবিষ্কারক স্বয়ং লুই লুমিয়েরের হাত থেকে, যে লুমিয়ের তাঁকে একসময় সিনেমাটোগ্রাফের যন্ত্র বিক্রি করতে রাজি হননি, সেই তিনিই উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,

Melies was the creator of cinematic spectacles.

এত কিছুর পরেও মেলিয়েসের দিন মোটেও ভালো কাটছিল না। খ্যাতি এলেও তার দৈন্য ঘোঁচেনি। জীবিকার জন্য পরিশ্রম করতে হত অহর্নিশ। এই বয়সে এত পরিশ্রম তার কাছে ক্ষণে ক্ষণে বেশ কষ্টকর মনে হত। কী আর করা- পেট তো চালাতে হবে। ফরাসি চিত্র পরিচালক ইউজিন লস্তেকে তিনি লিখেছিলেন, “কপাল ভালো আমি ভালো স্বাস্থ্য ধরে রেখেছি। কিন্তু দিনে ১৪ ঘন্টা, রবিবারে ছুটিছাটা ছাড়া কাজ করা ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই পরিস্থিতি থেকেও অচিরে মুক্তি পেলেন তিনি ও তার পরিবার। ১৯৩২ সালে সিনেমা সোসাইটি তাকে এবং তার পরিবারকে অর্লিতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি রিটায়ারমেন্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। এতে ভীষণ খুশি হন মেলিয়েস। তিনি এক মার্কিন সাংবাদিককে লিখেছিলেন, “আমি খুশি যে আমার থাকা-খাওয়ার চিন্তা আর করতে হবে না।

১৯৩৬ সালে আরো একটি সুখবর অপেক্ষা করছিল মেলিয়েসের জন্য। অর্লি অবসর নিবাসের একটি পরিত্যক্ত ঘরকে ঠিক করে দেয়া হয় মেলিয়েসের বেঁচে যাওয়া চলচ্চিত্রগুলো সংরক্ষণের জন্য। এই ঘরের দায়িত্ব পান মেলিয়েস নিজে।

কেমন কেটেছে এই জাদুকরের শেষ জীবন? হারিয়ে যাওয়া খ্যাতি, প্রাপ্য সম্মান এবং সৃষ্টিকর্মের সত্যিকার কদর- শেষ বয়সে সবই ফিরে পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন নিশ্চিন্ত নিবাস। ১৯১২ এর পর কোনো চলচ্চিত্র বানাননি তিনি। ১৯২৩ এর পর মঞ্চেও দেখা যায়নি তাকে। পুরাতনকে চলে গিয়ে নতুনকে স্বাগত জানাতে হবে- এই সত্য একরকম মেনেই নিয়েছেন তিনি। ছবি এঁকে, নব্য পরিচলক এবং শিল্পীদের উপদেশ দিয়ে সময় কাটান আর রক্ষা করেন তার বানানো চলচ্চিত্রের ফিল্মগুলো। 

১৯৩৮ সাল। প্যারিসে জর্জ মেলিয়েস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চলে গেলেন বটে, কিন্তু পেছনে রেখে গেলেন পরবর্তী যুগের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য অজস্র অনুপ্রেরণা। চলচ্চিত্র জগতকে করে দিয়ে গেলেন গতি, জাদুকরী নির্মাণশৈলি এবং মোহনীয় একটি কাব্যিক ধারা।

হ্যাঁ, আধুনিক যুগে জর্জ মেলিয়েসের চলচ্চিত্র মোটেই চলে না। চলার কথাও নয়। বর্তমান সময় বর্তমান প্রজন্মের হাতে। তারা তাদের সৃজনশীলতা দিয়ে রাঙিয়ে দিচ্ছে চলচ্চিত্র জগত। আবার নতুন কিছু নিয়ে আসবে পরের প্রজন্ম। পৃথিবীর ইতিহাস রিলে দৌড়ের মতো। ব্যাটন এখন আধুনিক প্রজন্মের হাতে। মেলিয়েস এখন শুধুই অনুপ্রেরণা।

This article is in Bengali language. It is about the life of Georges Méliès. Necessary references have been hyperlinked inside.

Related Articles

Exit mobile version