তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব, যার হাতে মিলিত হয়েছে আধুনিকতা আর ঐতিহ্য! নিজ সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা আর যুগের চাহিদা- দুটোর অসাধারণ সংমিশ্রণ তার নির্মাণে বিদ্যমান। তার হাত ধরেই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে স্থাপত্যের নতুন কিছু স্রোত- মডার্ন জাপানী আর্কিটেকচার, মেটাবলিজমের মতো নতুন নতুন ধারা। তিনি কেনজো তাংগে।
জন্ম ১৯১৩ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর জাপানের ওসাকাতে। প্রথমে কিছুদিন পরিবারের সাথে ছিলেন চীনের হাংকো, সাংহাই শহরগুলোতে। পরবর্তীতে ফেরত আসেন জাপানে। সেখানে তার ঠিকানা হয় শিকোকু দ্বীপের ইমাবারিতে।
১৯৩০ এর দিকে হিরোশিমাতে যান পড়াশোনার জন্য। আধুনিক স্থাপত্যের সাথে তার প্রথম পরিচয় সেখানেই, যখন তিনি ছিলেন হাই স্কুলের ছাত্র। বিখ্যাত স্থপতি লা কর্ব্যুসিয়ারের কিছু কাজ তিনি তখনই প্রথম দেখেন, যা তাকে পরবর্তীতে স্থাপত্যবিদ্যার প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
আর্কিটেকচারের উপর স্নাতক সম্পন্ন করেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৪২ সালে একটি নকশা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করলেও তার সেই কাজ আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেই শুরু হয় তাংগের ক্যারিয়ার, যা বিস্তৃত ছিল গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের পুরোটা জুড়ে।
তাংগের নগরবিদ্যার প্রতি আকর্ষণ তাকে যুদ্ধোত্তর জাপানের পুনর্গঠনে বেশ ভালোভাবেই সম্পৃক্ত করে। তার প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্ক। বরাবরের মতো সেখানেও তিনি আন্তর্জাতিক নকশা প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই আসেন। সেখানে স্থান পেয়েছে মানবিকতাবোধ, সকাতর ইতিহাস; সাথে নিয়ে আসেন মর্ডানিজমকে। A Bomb Dome নামে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ভবনকে সামনে রেখে তার নকশাটি করেন, যা যেকোনো পর্যটককে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জাপানী স্থাপত্যের সাথে মর্ডানিজম- এ দুটোর ফিউশনের অন্যতম সূচনা ছিল এটি। এভাবে একের পর এক চলতে থাকে তার কাজগুলো।
তাংগেই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি জাপানের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতিকে মডার্ন স্থাপত্যের সাথে এক মেলবন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন, পরিচিত করে তুলেছিলেন বিশ্বব্যাপী। এর প্রভাব হিসেবে জাপান হয়ে উঠেছিল স্থাপত্যবিদ্যার অন্যতম এক স্বর্গরাজ্য।
কেনজো তাংগে তার কাজগুলোতে নিজ সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন অনেকভাবেই। তবে তা কখনোই তার কাজকে পুরোপুরি পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলেনি।
তার মতে,
আর্কিটেকচার বা স্থাপত্যতে অবশ্যই এমন কিছু থাকতে হবে যা হবে মানুষের হৃদয়স্পর্শী। কিন্তু তার পরেও, এর মৌলিক আকার (ফর্ম), এর স্থানিক বিন্যাস (স্পেস) এবং উপস্থাপনাকে হতে হবে যৌক্তিক। আমাদের সময়ে সৃজনশীল কাজগুলোকে প্রকাশ করা হয় প্রযুক্তি এবং মানবিকতাবোধের সংমিশ্রণ হিসেবে। আমাদের ঐতিহ্য আমাদের সৃষ্টিকর্মে নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে, যা পুরো কর্মযজ্ঞকে প্রভাবিত করবে, কিন্তু দিনশেষে কখনোই তা সবকিছুকে ছাপিয়ে যাবে না। আমাদের ঐতিহ্য আমাদের সৃষ্টিতে সহাবস্থান করতে পারবে অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু এটি নিজেই পুরোপুরি সৃষ্টিশীল না-ও হতে পারে।
যা-ই হোক, যুদ্ধোত্তর জাপানের গণতান্ত্রিক সংস্কার তাংগের কাজের উপর বেশ প্রভাব ফেলে। ফলে তার কাজগুলো এমনভাবে নকশা করা যা সাধারণ মানুষের সাথে তার স্থাপনাগুলোর মিথষ্ক্রিয়াকে উৎসাহিত করে। ক্লাসিক্যাল রোমান আর গ্রিক টাউন হলগুলো থেকেই তিনি এই ধারণাটি লাভ করেন।
১৯৬৪ টোকিও অলিম্পিককে ঘিরে তিনি বিশ্ববাসীকে উপহার দেন আরেকটি চমৎকার নির্মাণ, ইয়োয়োগি ন্যাশনাল জিমন্যাশিয়াম, যার জন্য ১৯৮৭ সালে তিনি বিশ্ববিখ্যাত প্রিতজকার পুরষ্কারে ভূষিত হন। পুরষ্কার কমিটি একে উল্লেখ করেন “বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে সুন্দর স্থাপনার একটি হিসেবে।” এই কাজে তিনি নিও ফিউচারিস্টিক ঘরানার অন্যতম স্থপতি ঈরো সারিনেন, অন্যদিকে মর্ডানিস্ট লা কর্ব্যুসিয়ারের কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হন।
আধুনিক নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার একে একটি আদর্শ মডার্ন স্থাপনার অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তার করা কাগাওয়া প্রিফেকচারাল গভার্নমেন্ট অফিসে জাপানের ঐতিহ্যবাহী কাঠের স্থাপনার ছাপ এনে দেন, যোগ করেন আধুনিক স্থাপত্যের সাথে। কুরাশিকি টাউন হল তিনি করেন মাচিয়া নামের একধরনের ঘরের নকশা থেকে। এভাবে তার করা কাজগুলো বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী ধারাকে তুলে আনে। এছাড়াও তিনি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট বিল্ডিং, ইতালির নাপোলি শহরের Centro Direzionale বাণিজ্যকেন্দ্রের নকশাকার। সিঙ্গাপুর, চীন, ফিলিপাইনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করেন তিনি।
তাংগে বিশেষভাবে স্মরণীয় মেটাবলিজম নামে একটি নতুন স্থাপত্যরীতির অন্যতম প্রচলক হিসেবে। এই মতে, একটি জীবিত কোষের যেমন বৃদ্ধি, ক্ষয়-স্থানান্তর হয়, তেমনি একটি ভবনেও বৃদ্ধি, ক্ষয়, স্থানান্তর সম্ভব। এতে থাকে একটি কেন্দ্রীয় টাওয়ার, যাতে লিফটসহ যাবতীয় সুবিধাকে যুক্ত করা হয় এবং যা ভবনের মেরুদন্ড হিসেবে কাজ করে। এরপর ছোট ছোট লিভিং সেল বা সব ধরনের সুবিধা সম্বলিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘরকে এর সাথে যুক্ত করা হয়। প্রয়োজনবোধে এগুলোকে আলাদা করা, অন্য যেকোনো জায়গায় যুক্ত করা যায়। ফলে স্থাপনাটি পায় একটি ডায়নামিক রুপ। গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকেই এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। টোকিও শহরের নাকাগিন ক্যাপসুল টাওয়ার মেটাবোলিক ধারার একটি আদর্শ উদাহরণ।
গগনচুম্বী অট্টালিকা তৈরিতেও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না মোটেই। টোকিও মেট্রোপলিটন অফিস বিল্ডিং, আকাসাকা গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেল, শিনজুকু পার্ক টাওয়ার, ব্যাংক অব সাংহাই হেডকোয়ার্টার, ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংক টাওয়ার, ডিসকভারি প্রাইমিয়াসহ অসংখ্য অট্টালিকার রুপকার ছিলেন তিনি।
কর্মজীবনের স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯৬৫ সালে তিনি পান রয়্যাল ইনিস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট গোল্ড মেডেল। একই বছর পান সম্মানসূচক অলিম্পিক ডিপ্লোমা অব মেরিট, যেটি তিনি পান ইয়োয়োগি ন্যাশনাল জিমন্যাশিয়ামের জন্য। এর ঠিক পরের বছর পান আমেরিকান ইনিস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট গোল্ড মেডেল। ১৯৭৩ সালে ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অব আর্কিটেকচার থেকে গ্র্যান্ড মেডেল অব গোল্ড, সবশেষ ১৯৮৭ সালে স্থাপত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার প্রিতজকার প্রাইজ।
তাংগে জীবনের প্রায় শেষ অব্দি যুক্ত ছিলেন তার পেশায়। ২০০৫ সালের ২২ মার্চ ৯১ বছর বয়সে টোকিও শহরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন এই প্রতিথযশা স্থপতি। তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় তারই অন্যতম কীর্তি সেন্ট মেরি ক্যাথেড্রালে। প্রত্যেক নবীন স্থপতি, যারা চায় তাদের হাত ধরে ফুটিয়ে তুলতে নিজ সত্তাকে, নিজ সংস্কৃতিকে- তাদের জন্য কেনজো তাংগে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।