আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের রেসিডেন্ট স্কলার মাইকেল রুবিনের মতে, কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রকৃতপক্ষে কেমন, সেটি রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ কিংবা কূটনীতিবিদদের দেখে বোঝা যায় না। বরং এটি বোঝার জন্য দেখতে হবে রাষ্ট্রটির গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান এবং তার কার্যক্রমকে। কারণ কোনো রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রমই রাষ্ট্রটির পররাষ্ট্রনীতির প্রকৃত পরিচায়ক। একই তত্ত্ব প্রযোজ্য ইউরেশিয়ার ভূকৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র তুরস্কের ক্ষেত্রে।
তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন’ (Millî İstihbarat Teşkilatı, ‘মিল্লি ইস্তিহবারাত তেশকিলাত’, সংক্ষেপে MİT) বিশ্বের সবচেয়ে সুসংগঠিত এবং কার্যকরী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি। বর্তমানে তুর্কি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অধীনস্থ এমআইটির সদর দপ্তর অবস্থিত তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার এতিমেসগুত মেট্রোপলিটান ডিস্ট্রিক্টের ‘কালে’ (বাংলা প্রতিশব্দ ‘দুর্গ’) ভবনে। বিশ্বব্যাপী সক্রিয় এই গোয়েন্দা সংস্থাটির বর্তমান পরিচালক ডক্টর হাকান ফিদান।
হাকান ফিদান ১৯৬৮ সালে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তিনি ‘তুর্কি মিলিটারি অ্যাকাডেমি’তে অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৮৬ সালে তুর্কি সেনাবাহিনীতে নন–কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন ‘কমিউনিকেশন ইলেক্ট্রনিক ইনফর্মেশন সিস্টেমস স্কুল’ এবং ‘ল্যান্ড ফোর্সেস ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলে’ অধ্যয়ন করেন। ২০০১ সালে তিনি একজন সার্জেন্ট মেজর হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বিভিন্ন কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন, এবং একই সঙ্গে উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যান। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড গ্লোবাল ক্যাম্পাস’ থেকে রাজনীতি ও প্রশাসনিক বিজ্ঞান বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন, এবং তুরস্কের আঙ্কারায় অবস্থিত বিলকেন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার মাস্টার্স থিসিসের বিষয়বস্তু ছিল ‘পররাষ্ট্রনীতিতে ইন্টেলিজেন্সের ভূমিকা’ এবং পিএইচডি থিসিসের বিষয়বস্তু ছিল ‘তথ্য প্রযুক্তির যুগে কূটনীতি’। তিনি বিলকেন্ত ও হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে কিছুদিন অধ্যাপনাও করেছেন।
২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ফিদান অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত তুর্কি দূতাবাসে প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালে তিনি ‘তুর্কি সহযোগিতা ও সমন্বয় সংস্থা’র (Türk İşbirliği ve Koordinasyon Ajansı, ‘তুর্ক ইশবিরলি ভে কোওর্দিনাসিওন আজান্স’, সংক্ষেপে TİKA) প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ২০০৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালের নভেম্বরে তিনি তুর্কি প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক ডেপুটি আন্ডারসেক্রেটারি এবং বিশেষ দূত হিসেবে নিযুক্ত হন।
এসবের পাশাপাশি তিনি অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় অবস্থিত ‘আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা’র কার্যনির্বাহী বোর্ডের সদস্য, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত ‘জাতিসংঘ উন্নয়ন সহযোগিতা ফোরাম’–এর উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য ও ব্রিটেনের লন্ডনে অবস্থিত ‘ভেরিফিকেশন টেকনোলজি রিসার্চ সেন্টারে’র সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি জার্মানিতে অবস্থিত ন্যাটো র্যাপিড রিঅ্যাকশন কোর সদর দপ্তরের ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অপারেশন্স কমান্ডেও কাজ করেছেন। অবশেষে ২০১০ সালের ২৫ মে তিনি তুর্কি ইন্টেলিজেন্সের প্রধান নিযুক্ত হন, এবং এখন পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন।
তুর্কি রাষ্ট্রপতি আব্দুল্লাহ গুল প্রথম বারের মতো ফিদানকে ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল ‘আদালেত ভে কালকিনমা পার্তিসি’র (একেপি) নেতা বাশির আতালায় ফিদানকে তদানীন্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ফিদান যখন ‘তুর্কি সহযোগিতা ও সমন্বয় সংস্থা’র প্রধান ছিলেন, সেসময় তার দক্ষতা এরদোয়ানের নজরে আসে। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘তুর্কি সহযোগিতা ও সমন্বয় সংস্থা’ তুর্কি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ একটি সংস্থা, যেটির মূল দায়িত্ব তৃতীয় বিশ্বের (এবং প্রধানত বৃহত্তর তুর্কি জাতিভুক্ত) রাষ্ট্রগুলোকে উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করা।
এই সংস্থাটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ফিদান সংস্থাটিকে কার্যত একটি গোয়েন্দা সংস্থায় পরিণত করেন। সংস্থাটির কার্যক্রমকে তিনি তুরস্কের ‘soft power’ হিসেবে আখ্যা দেন এবং মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, বলকান ও আফ্রিকায় তুর্কি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব গড়ে তোলার জন্য সংস্থাটিকে ব্যবহার করেন। একই সময়ে তিনি এরদোয়ানের একজন অন্যতম রাজনৈতিক মিত্রে পরিণত হন। ২০০৭ সালের নভেম্বরে এরদোয়ান তাকে পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত করেন।
এসময় ফিদান ইরানের সমর্থক হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। ‘আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা’র কার্যনির্বাহী বোর্ডের সদস্য থাকাকালে তিনি ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার অধিকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে বিদ্যমান ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্যও তিনি প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। ধারণা করা হয়, ফিদান প্রাক্তন একেপি নেতা আহমেত দাভুতোগলু কর্তৃক প্রবর্তিত ‘নব্য ওসমানীয় মতবাদে’র সমর্থক। এসময় ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ফিদানকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে ‘আঙ্কারায় নিযুক্ত ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার স্টেশন চিফ’ হিসেবে অভিহিত করে।
২০১০ সালের ২৫ মে ফিদানকে এমআইটির পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। এসময় ফিদান একটি সংবাদ সম্মেলনে তার দুইটি লক্ষ্য সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন। এর মধ্যে একটি লক্ষ্য ছিল– তুরস্কে ‘রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আরেকটি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা হতে দেওয়া হবে না। অপর লক্ষ্যটি ছিল ফিদানের ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষের পরিচায়ক– তিনি ঘোষণা করেন, পাঁচ বছর এমআইটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তিনি রাজনীতিতে যোগদান করবেন।
এমআইটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরেই ফিদানের কারণে তুরস্কের ঘনিষ্ঠ দুই মিত্ররাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কে শীতলতা দেখা দেয়। এই বছর তুরস্ক চীনের সঙ্গে দুইটি যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়, এবং এই সামরিক মহড়ার আয়োজনে ফিদান কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে সতর্কবার্তা প্রদান করে। একই সময়ে ফিদানের উদ্যোগে তুরস্ক ফিলিস্তিনি সংগঠন ‘হামাস’–এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে, যেটি ইসরায়েলকে ক্ষিপ্ত করে তোলে।
‘রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্র’ গঠন প্রতিহত করার ব্যাপারে ফিদান যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটি মূলত গুলেন মুভমেন্টের প্রতি ইঙ্গিত করছিল। তুর্কি ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেন একসময় এরদোয়ানের রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন এবং তার অনুসারীরা তুর্কি সরকারের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এরদোয়ান ও গুলেনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়, এবং গুলেনের সমর্থকদের ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য এরদোয়ান সক্রিয় হন। ২০১২ সালে তুরস্কের প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয় (যেখানে গুলেনের সমর্থকদের আধিপত্য ছিল) ফিদানকে তলব করে। এটিকে এরদোয়ান তার একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মিত্রকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেন এবং এরপর তিনি তুর্কি আইনে বেশকিছু পরিবর্তন আনয়ন করেন। এর ফলে এমআইটি সদস্যদের আইনের সম্মুখীন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
একই বছর ফিদান প্রস্তাব করেন যে, তুরস্কের সমস্ত গোয়েন্দা কার্যক্রমকে একটি সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে আসা উচিত। কিন্তু বিরোধীরা তার এই প্রস্তাবকে তুরস্ককে একটি ‘গোয়েন্দা–শাসিত রাষ্ট্রে’ পরিণত করার প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করে এবং এর নিন্দা জানায়। একই সময়ে এরদোয়ান তুরস্কের সর্ববৃহৎ সার্ভেইল্যান্স ফ্যাসিলিটিকে এমআইটির নিকট হস্তান্তর করেন। এমআইটির কার্যপরিধি ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে, এবং ২০১০ সালে যেখানে এমআইটির বার্ষিক বাজেট ছিল প্রায় ৪০ কোটি (বা ৪০০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার, কয়েক বছরের মধ্যেই সেটি প্রায় ১০০ কোটি (বা ১ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়।
২০১৩ সালে ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দাবি করেন যে, ২০১২ সালে ফিদান একটি ইসরায়েলি গুপ্তচর দলকে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ধরিয়ে দিয়েছেন। এই দলটি তুরস্কে অবস্থান করে সেখান থেকে ইরানের বিরুদ্ধে গুপ্ত কার্যক্রম পরিচালনা করত এবং এদের মধ্যে ১০ জন ইরানি নাগরিক ছিল। এই ঘটনাটি তুর্কি–ইসরায়েলি সম্পর্কে মারাত্মক তিক্ততার সৃষ্টি করে। ধারণা করা হয়, ২০১০ সালে ইসরায়েল কর্তৃক ‘গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা’র ওপর আক্রমণ চালানোর প্রতিশোধ নিতে ফিদান এই কাজ করেছিলেন। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে ইসরায়েল কর্তৃক গাজার ওপর আরোপিত নৌ অবরোধকে উপেক্ষা করে ‘গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ গাজার দিকে যাচ্ছিল। এসময় ইসরায়েলি নৌ কমান্ডোরা জাহাজটিতে আক্রমণ চালায় এবং এর ফলে ১০ জন তুর্কি (যাদের মধ্যে ছিল ৯ জন তুর্কি নাগরিক ও একজন তুর্কি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক) নিহত হয়। এই ফ্লোটিলাটিকে গাজায় প্রেরণের ক্ষেত্রেও ফিদানের ভূমিকা ছিল বলে ধারণা করা হয়। একই বছর এমআইটি ফ্রান্সে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘পিকেকে’র তিনজন সদস্যকে খুন করে।
একই সময়ে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ায় এমআইটি বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সিরীয় সরকারকে উৎখাত করার জন্য ফিদান সিরিয়ায় সক্রিয় বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপকে অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করতে শুরু করেন, যেগুলোর মধ্যে আল–কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু গ্রুপও ছিল। এসময় এমআইটি ‘ইসলামিক স্টেট’ মিলিট্যান্ট গ্রুপের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে বলেও অভিযোগ ওঠে। প্রখ্যাত সাংবাদিক সাইমুর হার্শের মতে, এসময় তুর্কি ইন্টেলিজেন্স সিরীয় যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি জড়িত করার জন্য সিরিয়ায় ‘ফলস ফ্ল্যাগ অ্যাটাকে’রও আয়োজন করেছিল এবং সিরীয় মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোকে দিয়ে সিরীয় জনসাধারণের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে সিরীয় সরকারকে দায়ী করেছিল। এছাড়া, ২০১৪ সালে সিরিয়ায় লেবানিজ–আমেরিকান সাংবাদিক সেরেনা শিমের খুনের সঙ্গেও এমআইটি জড়িত ছিল বলে ধারণা করা হয়।
এমআইটির প্রধান হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের পর ফিদান ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন এবং আসন্ন তুর্কি আইনসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু এরদোয়ান ফিদানের এই পরিকল্পনা নাকচ করে দেন এবং ২০১৫ সালের ৯ মার্চ তাকে পুনরায় এমআইটির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। বিশ্লেষকদের মতে, এরদোয়ান তুর্কি আমলাতন্ত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি সহ্য করলেও রাজনীতিতে কোনো প্রভাবশালী (এবং প্রচ্ছন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী) ব্যক্তিত্বকে সহ্য করতে ইচ্ছুক নন, এবং এটিই ছিল ফিদানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার পেছনে মূল কারণ।
অবশ্য ২০১৬ সালে তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর গুলেনপন্থী সদস্যরা যে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালায়, সেটি সম্পর্কে ফিদান তুর্কি সরকারকে আগে থেকে সতর্ক করেননি বা করতে পারেননি। অভ্যুত্থানের রাতে তাঁ ভূমিকা কী ছিল, সেটিও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। কিন্তু অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সময় ফিদানের অস্পষ্ট ভূমিকার পরেও অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর তুর্কি রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে গুলেনপন্থীদের অপসারণের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার নির্দেশে এমআইটি তুরস্ক জুড়ে গুলেনপন্থীদের তালিকা তৈরি করে। এই তালিকার ওপর ভিত্তি করে তুর্কি সরকার প্রশাসন থেকে প্রায় দেড় লক্ষ তুর্কিকে অপসারণ করে এবং প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ তুর্কি নাগরিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা দায়ের করে।
শুধু তুরস্কের অভ্যন্তরেই নয়, তুরস্কের বাইরেও ফিদান গুলেনপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এমআইটি বিশ্বের ১৮টি রাষ্ট্র থেকে কমপক্ষে ৮০ জন গুলেনপন্থী তুর্কি নাগরিককে গ্রেপ্তার বা অপহরণ করে তুরস্কে নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে হয় রাষ্ট্রগুলোর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এমআইটির সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, অথবা তাদের অনুমতি ব্যতিরেকেই এমআইটি কথিত গুলেনপন্থীদের অপহরণ করে নিয়ে এসেছে। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউক্রেন, মলদোভা, কসোভো, আজারবাইজান, পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, মালয়েশিয়া, সুদান ও গ্যাবন। এর মধ্য দিয়ে এমআইটির (এবং ফিদানের নিজের) ক্ষমতার পাল্লা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এমআইটির প্রধান হিসেবে ফিদান দশ বছরেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন। কামাল আতাতুর্কের সময়কার গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান শুকরু আলী ওগেলের পর ফিদানই প্রথম ব্যক্তি, যিনি এত দীর্ঘ সময় ধরে তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থার কর্তৃত্বে ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ফিদানের সময়েই এমআইটি প্রথম বারের মতো তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে নিজেদের গুপ্তচর নিয়োগের অনুমতি লাভ করেছে। কার্যত ফিদান এমআইটিকে তুরস্কের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিতে পরিণত করেছেন।
এতদিন পর্যন্ত তুর্কি রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে ফিদানের অবস্থান কৌতূহলোদ্দীপক। তুরস্কে চলমান প্রতিটি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তিনি কাকতালীয়ভাবে বিজয়ীদের পক্ষ অবলম্বন করেছেন। তুর্কি ইন্টেলিজেন্সের মূল ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুরস্কের সমস্ত তথ্য তার হাতে কেন্দ্রীভূত। এমতাবস্থায় পরবর্তী যে কোনো ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ফিদান যে পক্ষকে সমর্থন করবেন, সেই পক্ষ এই দ্বন্দ্বে বিশেষ সুবিধা অর্জন করবে। এজন্য তুর্কি বিশ্লেষকদের অনেকেই বর্তমানে ডক্টর হাকান ফিদানকে তুরস্কের প্রচ্ছন্ন ‘কিংমেকার’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।