ইতস্তত পায়চারি করছেন অস্তাইজেস। মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন করে রেখেছে গত রাতের অদ্ভুত স্বপ্নটা। স্পষ্ট ভাসছে চোখের সামনে। কন্যা মান্দানার উড়ুসন্ধি থেকে বেরিয়ে আসছে পানি। প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে মিডিয়ার রাজধানী একবাটানা থেকে সমগ্র এশিয়া। ডুবে যাচ্ছে সে নিজেও। স্বপ্ন সমাজের নিচতলা আর উপরতলায় সমানভাবে কাজ করে না। যাদের অনেক কিছু হারানোর ভয়, তাদের স্বপ্নও বাস্তবের মতো গুরুত্বপূর্ণ। অস্তাইজেস সেই দলে। স্বপ্নটা তাই মানসিক অস্থিরতার ফল না, অনিরাপত্তা বোধের কারণ।
রহস্য উদঘাটনের জন্য ডেকে আনা হলো জ্যোতিষী। নক্ষত্রের গতিবিধি দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করায় উস্তাদ। পাণ্ডিত্য স্বপ্নের তর্জমা-তফসির করাতেও। সত্যিকার জ্ঞানী বলেই সমাজে সম্মানিত। যীশুর জন্মের সময় প্রাচ্যদেশীয় তিন জ্ঞানী ব্যক্তির গল্প এখনো প্রচলিত মানুষের মুখে মুখে। নক্ষত্র পাঠ করেই তারা নাকি ছুটে গিয়েছিল উপঢৌকন নিয়ে। সে অবশ্য অনেক পরের ঘটনা। তাছাড়া অস্তাইজেসের জ্যোতিষী সুখবর নিয়ে আসেনি। বরং উন্মোচন করলো নয়া অশনিসংকেত। মান্দানার গর্ভে শীঘ্রই জন্ম নেবে সন্তান। প্রবল প্রতাপে যে পদানত করবে গোটা এশিয়া। বানের জলের মতো ভাসিয়ে নেবে পূর্ব থেকে পশ্চিম। শুনে তটস্থ হয়ে পড়েন অস্তাইজেস। এ মুহূর্ত অব্দি পিতা সায়াক্সারেস মিডিয়ার মসনদে। ক্ষমতা পাওয়ার আগেই কি তাহলে হাতছাড়া হচ্ছে? অনাগত প্রতিযোগীর পদধ্বনিতে ব্যস্ত হয়ে যান তিনি।
মান্দানা তখনো কুমারী। রাজরক্ত হিসেবে সম্ভ্রান্ত কোনো রাজপুত্রকে প্রত্যাশা করার বয়স। অস্তাইজেসও তাই চেয়েছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু এমন একটা স্বপ্নের পর মেয়েকে নিজের রাজ্যে রাখা অসম্ভব। দূরের অপেক্ষাকৃত কমজোর কাউকে মনে করার চেষ্টা করেন তিনি। খুঁজেন বিয়ের অজুহাতে মেয়েকে নির্বাসনে দেয়ার শক্ত সুযোগ। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয় না তার জন্য। ক্যামবিসেস, রাজধানীর দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়ি নগরী আনশানের শাসক সাইরাসের পুত্র। অবশ্য শাসক না বলে প্রজা বলাই যৌক্তিক। আনশান তখন একবাটানার অধীনস্ত। বলার মতো তেমন কোনো নগরী না। মিডিয় জাতির রাজ্যে পারসিকরা এমনিতেই কোনঠাসা। সম্মানের দাঁড়িপাল্লায় তো অস্তাইজেসের ধারে কাছেও টিকবে না কেউ। ‘মান্দানাকে ওখানে দিলে মসনদ নিয়ে ভাবতে হবে না আর’- নিজেই নিজেকে আশ্বাস দেন অস্তাইজেস।
ক্যামবিসেসের রক্ত কিন্তু একেবারে ফেলনা নয়। মধ্য এশিয়ার চারণ ভূমি পার হয়ে অনেক আর্য গোত্র থিতু হয়েছে পারস্যের ভূভাগে। নিজেদের হিসাবে অভিজাতের কাতারেই তার বংশ। পূর্বপুরুষ আকিমেনেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আনশানে পারসিক বসবাস। তারপর কতো ঝড় ঝাপটা; ইয়াত্তা নেই। ত্যাগ করেনি নিজেদের অবস্থান। পরবর্তীতে মিডিয়ার স্বর্ণযুগে পারসিকরা পরিণত হয় করদ রাজ্যে। সেই পাহাড়ি ছোট্ট নগর ছেড়ে পারসিকরা কোন দিন রাজধানীতে হামলে পড়বে; এমনটা অস্তাইজেস বিশ্বাস করেন না। তাছাড়া ক্যামবিসেস ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। আধিপত্য বৃদ্ধি কিংবা রাজনৈতিক জটিলতা তাকে আড়ষ্ট করে না। আগে পিছে বহু সমীকরণ কষেই বিয়েটা সম্পন্ন হলো। নতুন কনে নিয়ে আনশানে ফিরে গেলো ক্যামবিসেস। হঠাৎ পিতা সাইরাসের মৃত্যুতে পাহাড়ি অঞ্চলের দায়িত্ব পড়লো তার কাঁধে।
বিয়ের এক বছর পার হয়নি। অথচ অস্তাইজেসের ঘুম ভেঙে দিলো ফিরে আসা দুঃস্বপ্ন। মান্দানার উড়ুসন্ধি থেকে বেরিয়ে আসছে অতিকায় এক আঙুর লতা। ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলছে এশিয়া। ফের তলব করা হলো জ্যোতিষী। স্বপ্নের তর্জমা আগের মতোই। তারই নাতি কেড়ে নেবে মসনদ। পদানত করবে দৃশ্যমান পৃথিবী। আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে যান অস্তাইজেস। ভেবে পান না কী করা যায়। কন্যাকে ডেকে পাঠান মিডিয়ায়। গর্ভবতী মান্দানা পিতার আহবান শুনে দেরি করলো না। প্রথম সন্তানের জন্ম তো মাতুলালয়ে হওয়াই উত্তম। অনেকটা নিশ্চিন্তেই পিতার ঘরে দিন গুনতে থাকে মান্দানা। আর গোপনে অপেক্ষা করে চলেন অস্তাইজেস। সিংহাসনের প্রতিযোগিতায় প্রতিপক্ষের পতনের অপেক্ষা। কন্যা তার কাছে অনেক প্রিয়। তবে যতটা প্রিয় হলে মসনদের মোহ ত্যাগ করা যায়; অতটা না। অতি আস্থভাজন লোক নিযুক্ত করলেন দেখাশোনার জন্য। পরামর্শ হলো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হারপাগাসের সাথে।
-হারপাগাস, একটা দায়িত্ব দিচ্ছি তোমায়। যা-ই হোক, মন দিয়ে করবে। কারণ, এর উপর নির্ভর করছে আমার নিরাপত্তা। মান্দানার সন্তানকে বাড়ি নিয়ে যাবে। যেভাবে হোক, হত্যা করবে। তারপর পুঁতে ফেলবে মাটিতে।
-হুজুর, এখন অব্দি আমার কাজে খুঁত পেয়েছেন? আগামীতেও পাবেন না। আপনার নির্দেশ পালন করাই আমার কর্তব্য।
যথাসময়ে জন্মগ্রহণ করলো শিশু। পিতামহের স্মৃতি জিইয়ে রাখতে নাম রাখা হয় সাইরাস। আর পূর্ব পরিকল্পনা মতো হারপাগাস তাকে নিয়ে রওনা হয় বাড়ির পথে। ঝোঁকের মাথায় অস্তাইজেসকে ওয়াদা দিয়েছিল একসময়। কিন্তু এই নিষ্পাপ শিশুকে কীভাবে হত্যা করবে- ঠাহর পায় না। তার নিজেরও সমবয়সী এক পুত্র আছে। তাছাড়া শিশুর সাথে তারও তো রক্তসম্পর্ক। হতে পারে অস্তাইজেস হত্যা করতে চান। পুত্রহীন বৃদ্ধের মৃত্যু হলে উত্তরাধিকারী কে হবে? মান্দানা সিংহাসনে এলে কি আমি বিপদে পড়বো না? চিন্তাগুলো একে একে ধাক্কা দেয় তাকে। সিদ্ধান্তের কাঁটা হেলে পড়ে বিপরীতে। তারচেয়ে বরং এক বিশ্বস্ত রাখালকে ডেকে পাঠালো সে; নাম মিত্রাদেতেস।
মিত্রাদেতেস বাস করে জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকায়। মিডিয়ার রাজধানী একবাটানা থেকে উত্তরে কৃষ্ণসাগরের দিকে। স্ত্রী স্পাকো আগে রাজ দরবারে কাজ করতো। সম্প্রতি একটি মৃত সন্তান হয়েছে তাদের। বিষাদে ভেঙে পড়েছিল সে। ইতোমধ্যে তলব আসে হারপাগাসের। চিন্তা স্তব্ধ হয়ে যায়, জীবন তো থামে না। নেহায়েত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছুটে আসে মিত্রাদেতেস। হারপাগাস আর তার স্ত্রী উভয়েই কাঁদছে। ইশারায় দেখালো একটা নবজাতক। সোনালি কাপড়ে আবৃত সাইরাস তখন হাত পা ছুড়ে চিৎকার করছে।
খানিকটা ভারসম্য ফিরিয়ে আনে হারপাগাস। ভাঙা কণ্ঠে নির্দেশনা দেয় রাখালকে। পাহাড়ের বিপজ্জনক কোন স্থানে রেখে আসতে হবে শিশুটা। নিশ্চিত করতে হবে মৃত্যু। যদি অন্যথা হয়; কপালের খারাবি থেকে রক্ষা করতে পারবে না কেউ। মিত্রাদেতেস আকাশ থেকে পড়ে। হঠাৎ মাথা কাজ করে না। কিন্তু রাজকীয় নির্দেশনার প্রতিবাদ হয় না। আলগোছে শিশুকে কোলে নিয়ে হাঁটা শুরু করে বাড়ির দিকে। হয়তো পরিচয়ই জানতে পারতো না। যে ভৃত্য পথ দেখিয়ে দিচ্ছিলো; সে-ই বিদায়ের সময় খোলাসা করেছিল শিশুর আদ্যোপান্ত।
অন্তত মিত্রাদেতেসের পরিবারের জন্য ঘটনাটা অলৌকিক। সদ্য মৃত সন্তানের শোকে মুহ্যমান স্পাকো। স্বামী ঘরে ফেরা মাত্রই একটা নবজাতক দেখতে পায় কোলে। অত্যন্ত সুঠাম আর সুশ্রী। সমস্তই খুলে বলে মিত্রাদেতেস। অন্যের দুর্ভাগ্য দেখলে নিজের কষ্ট লাঘব হয়। মাতৃত্ব জেগে উঠতে দেরি হয় না হৃদয়ে। পা জড়িয়ে ধরলো স্বামীর।
-এমন নিষ্পাপ শিশু। দোহাই তোমার, মাঠে ফেলে এসো না।
-অন্যথা করার সুযোগ নেই যে! বিব্রত হয় মিত্রাদেতেস। ‘হারপাগাস মৃতদেহ দেখতে লোক পাঠাবে। যদি না পাওয়া যায়; শূলে চড়ে খোয়াতে হবে প্রাণ’।
-লাশ দেখানোই যদি গুরুত্বপূর্ণ; তবে আমি তো একটা মৃত সন্তান প্রসব করেছি। সেটাই দেখাও। আমরা বরং মান্দানার পুত্রকে লালনপালন করি। কেউ তো আর বুঝতে পারছে না সত্য। দেখছে না হুকুম অমান্য করা হয়েছে কি না।
খুব একটা বুদ্ধিমতী না স্পাকো। তবু ভীত স্বরেই তুলে ধরতে চায় পরামর্শ। সন্তানটাকে আগলে রাখার আকুতি। মিত্রাদেতেসের মনে ধরে প্রস্তাব। জীবিত শিশুর শরীর থেকে খুলে ফেলা হয় আভিজাত্যের সাজ। আটপৌরে পোশাকে জড়িয়ে ঘরে ঢুকে যায় স্ত্রী। অন্যদিকে নিজেদের মৃত পুত্রকে সেই দামি পোশাকে সাজালো স্বামী। বাক্সে করে রেখে এলো ঘন জঙ্গলে। এই অবাধ্যতার পরিণাম কারো অজানা না। উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটলো তিন দিন। কেউ জানেনি এখনো। মিত্রাদেতেসই নিজে গিয়ে মৃত শিশুর অবস্থা দেখে আসলো কয়েকবার। তারপর সুবিধা বুঝে হারপাগাসকে জানালো মৃত্যুর খবর।
সত্যিই কেউ ধরতে পারেনি ফাকিটা। সরেজমিনে তদন্ত করতে দূত পাঠানো হয়। লাশ দেখে আশ্বস্ত হয় দূত। হ্যাঁ, একটা মৃত সন্তান পাওয়া গেছে। এদিকে সাক্ষী-সাবুত হাজির করতে পেরে ভারমুক্ত হারপাগাস। শিশুটাকে আড়ম্বের সাথে দাফন করলো। যথারীতি অস্তাইজেসের কানে জানিয়ে দিলো, ‘হুকুম তামিল’। নিজের প্রাপ্য মসনদ রক্ষার নিশ্চয়তা পেয়ে কেউ অসন্তুষ্ট থাকে?
বোধ হয় এইখানেই নিহিত পৃথিবীর রহস্য। একই ঘটনা সবার জন্য একভাবে ঘটে না। প্রতিটি দিনের প্রত্যেকটি গল্পের প্রত্যেকটি চরিত্র সম্পূর্ণ মৌলিক অবস্থান থেকে যুক্ত। পুত্রের অকালমৃত্যুর খবরে স্তব্ধ হয়ে যায় মান্দানা। বিষাদে বিবর্ণ মুখে ত্যাগ করলো পিতার গৃহ। কোনোরকমে আনশানে পৌঁছে আছড়ে পড়ে স্বামী ক্যামবিসের বুকে। নিষ্পাপ পুত্রটি আর বেঁচে নেই। কী বলে সান্ত্বনা দেবে, ক্যামবিসেসও ভাষা খুঁজে পায় না। অথচ ঠিক সেই সময়েই ছোট্ট সাইরাস হাত পা নাড়াচ্ছে জঙ্গলাকীর্ণ এক কুড়ে ঘরে। নতুন নাম আগ্রাদেতেস। নাহ, আর কোনদিন সত্যিকার পরিচয় প্রকাশ করবে না তারা। স্পাকো সমস্ত মাতৃত্ব নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে পুত্রকে। যেনো চাঁদ হাতে পেয়েছে। মিত্রাদেতেস না হেসে পারে না।
**প্রাচীন পারসিক শিক্ষাপদ্ধতি ছিলো মৌখিক। মনে রাখার সুবিধার জন্য অবতারণা করা হতো গল্পের। ফলে ঐতিহাসিক ঘটনা এবং চরিত্রগুলো প্রকাশের ধরন হতো উপকথার মতো। অনেক সময় একই ঘটনার কয়েকটি ভিন্ন গল্প তৈরি হতো। হেরোডোটাস নিজেই চারটি ভিন্ন বিবরণ জানতেন সাইরাসের জন্ম নিয়ে। এই গল্পটি সবথেকে নির্ভরযোগ্য বলে দাবি। টিসিয়াসের বর্ণনাতে সাইরাসের সাথে অস্তাইজেসের সম্পর্ক নেই। কিন্তু সেই দাবি অসত্য।
আরো পড়ুন