ভারতীয় উপমহাদেশে কয়জন বিজ্ঞানী আছেন যাদের খ্যাতি আছে বিশ্বজোড়া বলুনতো? যদি আপনার নিকট উপমহাদেশের বিজ্ঞানীদের সম্বন্ধে ন্যূনতম তথ্য থেকে থাকে তাহলে আমি নিশ্চিত সেখানে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমনের নাম আছে। সি ভি রমন নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। ‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কার করে তিনি হৈচৈ ফেলে দেন বিজ্ঞান বিশ্বে। তিনি দেখান যে আলো কোনো অণুর উপর ক্রিয়া করলে কিছুটা শক্তি সেই অণুকে দিয়ে দেয়। ফলে অণুটি স্পন্দিত হয়। আর অন্যদিকে আলোর রং যায় বদলে। আজকের বিশ্বে রমন স্পেকট্রোস্কপি দেহের রোগাক্রান্ত কোষগুলো শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হচ্ছে, ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে মৌলের অণু সনাক্তকরণের কাজে।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ট্রিচিনোপলি বা বর্তমান তিরুচিরাপল্লী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা চন্দ্রশেকারাম রমানাথান আইয়ার ছিলেন একজন পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক। তার মা পার্বতী আমালের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। রমনের বাবা চন্দ্রশেকারাম ছিলেন শিক্ষানুরাগী একজন ব্যক্তি যিনি তার স্ত্রীকে নিজে পড়তে লিখতে শেখান।
চন্দ্রশেকারামের ঘরে আট সন্তানের জন্ম হয়। রমন তাদের মধ্যে দ্বিতীয়। ব্রাহ্মণ হলেও রমনের বাবা ধর্মের প্রতি একপ্রকার উদাসীন ছিলেন। রমনও বাবার অনুকরণে ধর্মটাকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে নেন নি। তবে ধর্মীয় ঐতিহ্য ও রীতিনীতির প্রতি তার ছিল শ্রদ্ধা ও ভক্তি। ধর্মচর্চা খুব একটা না করলেও তিনি ব্রাহ্মণদের রীতি অনুযায়ী চিরকাল নিরামিষভোজী ছিলেন। শৈশব থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করতেন রমন। বাবার বিজ্ঞান শিক্ষক হবার সুবাদে প্রচুর পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের বই পড়তেন তিনি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাবার কলেজের লাইব্রেরি থেকেও বই ধার করতে শুরু করেন রমন।
১৯০৩ সালে ১৪ বছর বয়সী রমন ব্যাচেলর ডিগ্রী লাভের উদ্দেশ্যে তৎকালীন মাদ্রাজের (বর্তমান চেন্নাই) প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়াশোনা করতে যান। সেখানে ছাত্রাবাসের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না তিনি। ফলে বছর না ঘুরতেই স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে তার। পরবর্তী বছর তাই রমনের বাবা মাদ্রাজে রমনের জন্য একটি ঘর ঠিক করে দেন যেখানে রমন তার দাদা-দাদীর সাথে বাস করতেন। এবার পড়ালেখায় সম্পূর্ণরূপে মনোনিবেশ করেন তিনি। মেধাবী রমন পদার্থে পদকসহ ব্যাচেলর ডিগ্রী লাভ করেন। তার শিক্ষকরা তাকে বিলাতে গিয়ে পড়ালেখার পরামর্শ দেন। কিন্তু মেডিকেল চেকআপ করতে গেলে ডাক্তার বলেন তার স্বাস্থ্য বিলাত যাবার জন্য উপযোগী নয়। অগত্যা ভগ্ন স্বাস্থ্যের নিকট হার মেনে বিলাত যাবার পরিকল্পনা বাদ দেন রমন। এম এ পরীক্ষাটাও প্রেসিডেন্সীতেই দেন এবং প্রত্যাশিতভাবেই প্রথম স্থান অধিকার করেন।
১৯০৭ সালে সি ভি রমন সরকারি অর্থ বিভাগের অফিসার নিয়োগের পরীক্ষা তথা ‘এফ সি এস’ বা ‘ফাইন্যান্সিয়াল সিভিল সার্জন’ এর পরীক্ষা দেন এবং পাস করে যান। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই কলকাতায় সহকারী অ্যাকাউন্ট্যান্ট এর পদে নিযুক্ত হন রমন। এই চাকরি সম্বন্ধে স্মৃতি রোমোন্থন করতে গিয়ে রমন বলেছিলেন – “পরীক্ষা দিতে যারা এসেছিল আমি তাদেরকে দেখেই বুঝেছিলাম আমি প্রথম হবো।”
চাকরিতে ঢোকার আগেই অবশ্য বিয়েটা সেরে ফেলেন রমন। ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানে লোকাসুন্দরী আমাল নামক ১৩ বছর বয়সী মেয়ের প্রেমে পড়েন রমন। সিদ্ধান্ত নেন তাকেই বিয়ে করবেন। তখনকার সমাজে পিতামাতার অনুমোদন ব্যাতীত বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল অনেক বড় কিছু। তবে রমনের বাবা উদার মানসিকতার হওয়ায় আর কোনো নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়নি। রমন দম্পতির ঘরে দুই সন্তান রাধাকৃষ্ণান আর চন্দ্রশেখরের জন্ম হয়।
১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয় সি ভি রমনের প্রথম গবেষণা। গবেষণাটি ছিল আলোর প্রকৃতির উপর। তিনি গবেষণা পত্রটি তার শিক্ষককে দেখালে তিনি খুব একটা গুরুত্ব দেননি। তাই তিনি আর কোনো উপায় না দেখে গবেষণা পত্রটি সরাসরি পাঠিয়ে দেন ‘ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন’-এ। গবেষণাটি প্রকাশিত হয় এবং বিজ্ঞানী মহলে প্রশংসা পায়। দ্রুতই প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় গবেষণা। তবে এবার ঘটে যায় বেশ মজার একটি ঘটনা। চন্দ্রশেখর রমন যে তখনো একজন শিক্ষার্থী মাত্র সেটা জানতেন না নোবেলজয়ী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে। র্যালে রমনের গবেষণায় প্রভাবিত হয়ে রমনকে পত্র লেখেন যেখানে তিনি রমনকে ‘প্রফেসর’ বলে সম্বোধন করেন। র্যালে ধরেই নিয়েছিলেন এতো চমৎকার গবেষণা নিশ্চিতভাবে কোনো প্রফেসরেরই।
সরকারি চাকরিতে তখনকার সময়ে বেতন ছিল অন্যান্য চাকরির তুলনায় অনেক ভাল। এদিকে রমনেরও সংসার চালানোর জন্য আর্থিক স্বচ্ছলতা জরুরী হয়ে পড়ে। তবে চাকরি করলেও তার প্রধান আকর্ষণ ছিল বিজ্ঞানই। দশ বছর তিনি অর্থ বিভাগে চাকরি করেন। প্রতিভার গুণে খুব দ্রুতই পদোন্নতি হতো তার। তবে এই দশ বছর গবেষণা থেকে মোটেও দূরে থাকেননি রমন। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ এর ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করতেন নিজের অবসর সময়ে। এ সময় তার গবেষণার মূল বিষয় ছিল তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র ও ড্রাম এর কলাকৌশল। কলকাতার এই বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানটি রমন আসবার আগে পর্যন্ত ঘুমন্তই ছিল একরকম। রমন গবেষণা শুরু করতেই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানটি। গবেষণার পাশাপাশি তিনি নানান বিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাও দিতেন।
সরকারি চাকরির পাশাপাশি গবেষণা ও বক্তৃতা রমনকে বেশ ভালো রকমের জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এতোটাই যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিত অধ্যাপকের পদের জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অনেকদিন অর্থবিভাগে কাজ করে আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেন রমন। ফলে ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রস্তাব দ্বিতীয়বার না ভেবেই তিনি গ্রহণ করেন। আর এরপর থেকেই নিজের পুরো সময়টা বিজ্ঞান গবেষণায় ব্যয় শুরু করেন রমন।
বিজ্ঞানী লর্ড র্যালের কথা একটু আগেই বলেছি। তিনিই প্রথম আকাশের রং নীল হবার কারণ বর্ণনা করেন। আলোর বিক্ষেপণের কারণে আকাশের রং নীল হয় এবং আকাশের রঙের প্রতিফলনেই সমুদ্রের পানি নীল বর্ণের হয় বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। আর এজন্যই রমনের গবেষণার বিষয়বস্তু র্যালের নিকট এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯২১ সালে সৃষ্টি হয় রমনের সেই যুগান্তকারী আবিষ্কারের আবহ। সে বছর তিনি জাহাজে করে ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে গিয়েছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাত্রাপথে সমুদ্রের নীলাভ পানি দেখতে দেখতে তার মনে র্যালের তত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তিনি ‘র্যালে বিক্ষেপণ’ এর কারণে আকাশের রং নীল হয় এটা বিশ্বাস করলেও সমুদ্রের পানির ক্ষেত্রে র্যালের ব্যাখ্যা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কেননা র্যালে বিক্ষেপণ হচ্ছে নমনীয়। আলোর কণা বায়ু মাধ্যমের মধ্য দিয়ে আমাদের চোখে আসে। তখন বিক্ষিপ্ত কণাগুলো গ্যাসের অণুর উপর ক্রিয়া করার সময় কোনোরূপ শক্তি হারায় না। এজন্য তাদের বর্ণ পরিবর্তন হয় না। আর এখানেই রমন তার গবেষণার বিষয় খুঁজে পান।
১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতে ফিরে আসেন রমন। তিনি আকাশের রং, সমুদ্রের পানির রং নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌছান যে, সমুদ্রের পানি আলোর বিক্ষেপণের কারণে নীল হয়। তিনি তার এই গবেষণা ‘নেচার’ নামক জার্নালে পাঠিয়ে দেন। ১৯২৩ সালে তার গবেষণা আরও একধাপ এগিয়ে দেন আর্থার কম্পটন। ক্লাসিক্যাল ইলেক্ট্রোডাইনামিকস বিশ্বাস করতো এক্সরে সহ যে কোনো তড়িৎচুম্বক বিকিরণ সর্বদা স্থিতিস্থাপক হতে হবে। কিন্তু কম্পটন প্রমাণ করেন যে, রঞ্জন রশ্মি ইলেকট্রনের সাথে ক্রিয়া করে ইলেকট্রনকে কিছুটা শক্তি দান করে। এই আবিষ্কার পারতপক্ষে অস্থিতিস্থাপক বিক্ষেপণেরই প্রমাণ।
রমন এবং তার ছাত্ররা গ্যাস, তরল এবং কিছু কঠিনের মধ্য দিয়ে সাধারণ দৃশ্যমান আলোর বিক্ষেপণ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। তার এই গবেষণায় সূর্যের আলো ফিল্টার করে কেবল একবর্ণী আলোক রশ্মি (মনোক্রোম্যাটিক) ব্যবহার করেন। তারা বিভিন্ন তরলের মধ্যে এই আলোর বর্ণের পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। তবে আলোর পরিবর্তন খুব দুর্বলভাবে হওয়ায় তিনি আরও গবেষণা চালিয়ে যান। অবশেষে ১৯২৭ সালে গ্লিসারলের মধ্যে আলোর স্পষ্ট বর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করেন রমন। তিনি কাঁচ ও ক্রিস্টালের মধ্যে আলোর বিক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করেন। তার গবেষণায় ব্যবহৃত আলো পোলারাইজড হওয়ায় বর্ণ পরিবর্তনের ঘটনাটিকে কোনোভাবেই ফ্লোরোসেন্স ভাবা যায় না। অর্থাৎ রমনের গবেষণার ফল দাঁড়ায় একটি মৌলিক আবিষ্কার, ‘পোলারাইজেশনের সাথে আলোর বর্ণ পরিবর্তন’। এটিই হচ্ছে রমন ইফেক্ট। এই ইফেক্ট র্যালে বিক্ষেপণের তুলনায় অত্যন্ত বিরল। প্রায় এক কোটি ফোটনের মধ্যে একটি ফোটনের অস্থিতিস্থাপক বিক্ষেপণ ঘটে। রমনের এই গবেষণায় অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে তার ছাত্র এবং গবেষণা সহযোগী কৃষ্ণান। ১৯৩০ সালে সি ভি রমন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
রমন ইফেক্ট থেকে রমন দেখান যে, আলোর ফোটনের অস্থিতিস্থাপক বিক্ষেপণ যে পদার্থের মধ্যে আলোর বিক্ষেপণ ঘটে তার ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট’ হিসেবে কাজ করে। এ থেকে আবিষ্কৃত হয় রমন স্পেক্ট্রোস্কপি যা বর্তমান বিশ্বে উন্নত রসায়ন গবেষণাগারে বিভিন্ন পদার্থ সনাক্তকরণে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যবহৃত হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগ সনাক্ত করতে।
১৯২৯ সালে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন ‘নাইট’ উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি ব্যাঙ্গালোরে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এ ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত হন। স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক হবার গৌরব লাভ করেন তিনি ১৯৪৭ সালে। পরের বছর প্রতিষ্ঠা করেন ‘রমন গবেষণা ইনস্টিটিউট’ যেখানে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত গবেষণা করেছেন রমন। ১৯৭০ সালের ২১ নভেম্বর ৮২ বছর বয়সে ব্যাঙ্গালোরে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান পদার্থবিজ্ঞানী। উপমহাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য তিনি চিরন্তন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।