“চুম্বককে আদার সাথে ঘষলে তা আর লোহাকে আকর্ষণ করে না, এ ধরণের ভুলভাল তথ্য বছরের পর বছর ধরে প্রচলিত আর মানুষ বিশ্বাসও করে নিচ্ছে। ঠিক যেমন আগাছা আর অপ্রয়োজনীয় উদ্ভিদের বিকাশ হয় সবচেয়ে দ্রুত!” – উইলিয়াম গিলবার্ট
এরকম আরো অনেক চুম্বক সম্পর্কিত প্রচলিত বানোয়াট ও ভ্রান্ত তথ্যের রহস্য উন্মোচিত হয় উইলিয়াম গিলবার্টের ‘ডি ম্যাগনেট’ প্রকাশের সাথে সাথে। ১৬০০ সালে প্রকাশিত এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদের পুরো নাম ‘অন দ্য ম্যাগনেট অ্যান্ড ম্যাগনেটিক বডিজ অ্যান্ড দ্য গ্রেট ম্যাগনেট অব দ্য আর্থ‘। খুব সম্ভবত ১৫৮০ এর দিক থেকে গিলবার্ট তার গবেষণা শুরু করেন এবং ডি ম্যাগনেট লেখার কাজ শুরু করেন। অর্থাৎ তার এই গবেষণা কর্ম ছিল ২০ বছরের পরিশ্রমের ফসল! অনেকেই একে পৃথিবীর প্রথম বৃহত্তর পরিসরে পরীক্ষামূলক গবেষণা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার পরীক্ষার ধরণ এমন ছিল যে প্রকৃতিই তাকে নানা রকম প্রশ্ন করতো এবং একই সাথে সঠিক উত্তর দিত। এজন্য তাকে গ্যালিলিওর পাশাপাশি পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
উইলিয়াম গিলবার্টের ডি ম্যাগনেট রচনার পেছনে প্রথম অনুপ্রেরণা আসে নৌবাহিনী থেকেই। হ্যাঁ, চিকিৎসক হিসেবে ব্রিটিশ নৌবাহিনীতেও কাজ করেছেন কিছুদিন। সে সূত্রে তার পরিচয় হয়েছে স্যার ফ্রান্সিস ড্রেকের মতো বিখ্যাত নৌ কর্মকর্তার সাথে। নৌবাহিনী কিংবা জাহাজের নাবিকদের একটি অত্যাবশ্যক যন্ত্র ছিল কম্পাস যা গিলবার্টের মনে দাগ কাটে। নৌবাহিনীতে কাজ করাকালীনই তিনি চুম্বক নিয়ে গবেষণা করবেন বলে মনোস্থির করে ফেলেন। গবেষণার শুরুতে তিনি আদর্শ বিজ্ঞানীর মতো একটি ব্যাপক সাহিত্যানুসন্ধান চালান। এই অনুসন্ধানে তিনি চুম্বক বিষয়ক সেরা লেখা ‘এপিস্টোলা ডি ম্যাগনেটে’ খুঁজে পান। ১২৬৯ সালে প্রকাশিত সে গবেষণাটি করেছিলে ফরাসী বিজ্ঞানী পেট্রাস পেরেগ্রিনাস। গিলবার্ট তার নিজের গবেষণায় এই লেখার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
গিলবার্ট এমন সময়ে তার গবেষণা শুরু করেছিলেন যখন মানুষ ভাবতো চুম্বক সম্বন্ধে তারা সবকিছুই জানে! তখন মানুষ মূলত চুম্বকের দিকনির্দেশী ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারতো, কম্পাস ব্যবহৃত হতো ব্যাপক পরিমাণে, সার্ভেয়ররা টানেল নির্মাণের জন্য কম্পাস ব্যবহার করতো আর খনি মালিকগণ নতুন নতুন লোহার খনি খুঁজে পেতে চুম্বক ব্যবহার করতো। কিন্তু এসব বিষয় গিলবার্টকে যতটা না ভাবাতো তার চেয়ে বেশি ভাবাতো এর অন্তর্নিহিত ব্যাপারগুলো। চুম্বক আসলে কেন দুটি দিক নির্ভুলভাবে নির্দেশ করতে পারে? নিত্যদিনের ব্যবহারের মধ্যে ডুবে না থেকে গিলবার্ট এর ভেতরের অর্থ জানার জন্য পরীক্ষা আর গবেষণায় ডুব দেন। আর এখানেই প্রশংসা করতে হয় গিলবার্টের অসম আস্থা আর সাহসের। তখন ইউরোপে বিজ্ঞান চর্চার উপর চার্চের প্রবল প্রভাবের কথা কে না জানে। বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে পরীক্ষা করাকে নির্লজ্জতা আর সৃষ্টিকর্তার সাথে প্রতিযোগিতা করার সামিল মনে করা হতো। সেই ‘নির্লজ্জতা’ আর ‘প্রতিযোগিতা’র প্রতিযোগিতাই করেছিলেন সে সময়কার দুই বিখ্যাত বিজ্ঞানী গিলবার্ট আর গ্যালিলিও।
গিলবার্ট যখন চুম্বক নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, তখন তিনি শুধু গিলবার্ট ছিলেন না, ছিলেন ডক্টর গিলবার্ট। লন্ডনে চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই ‘লন্ডন’স কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স’ এর সেন্সর পদে অধিষ্ঠিত হন। উল্লেখ্য, এই কলেজ আক্ষরিক অর্থে লন্ডনের সমস্ত ডাক্তারদের নিয়ন্ত্রণ করতো। ডাক্তার হিসেবে গিলবার্টের সুনাম আলোর গতিতে লন্ডনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। তার ডি ম্যাগনেট প্রকাশের বছরই তাকে ফিজিয়াশিয়ানস কলেজের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৬০১ সালে উইলিয়াম গিলবার্টকে রানী এলিজাবেথের ব্যক্তিগত চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়। বলা বাহুল্য, গিলবার্টকে ততদিনে লন্ডনের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক গণ্য করা হতো। ১৬০৩ সালে রানীর মৃত্যুর পর রাজা জেমসের গৃহচিকিৎসক হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন গিলবার্ট, যতদিন না তার নিজের মৃত্যু হয়।
১৫৪৪ সালের ১২ মে ইংল্যান্ডের কোলচেস্টার শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উইলিয়াম গিলবার্ট। তার বাবা জেরোম গিলবার্ট পেশায় একজন আইনজীবী ছিলেন যিনা কিনা কোলচেস্টারের সবচেয়ে প্রভাবশালীদের একজন ছিলেন। উইলিয়াম গিলবার্টের মা তার শৈশবে মারা গেলে জেরোম দ্বিতীয় বিবাহ করেন। তবে নিজের আপন তিন ভাইবোনের সাথে সৎ মায়ের ঘরে জন্ম নেয়া আরো সাত ভাইবোন মিলে গিলবার্ট পরিবার বিশাল আকার ধারণ করলেও আর্থিক সমস্যায় তাদের পড়তে হয়নি। ছয় বছর বয়সে কোলচেস্টার স্কুলে পড়ালেখা শুরু করেছিলেন গিলবার্ট। ১৫৫৮ সালে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়া শুরু করেন এবং ১৫৬৯ সালে ডাক্তারি সার্টিফিকেট লাভ করেন। তবে এসব ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানা যেত যদি ১৬৬৬ সালে লন্ডনে ঘটে যাওয়া ‘গ্রেট ফায়ারে’ গিলবার্টের ব্যাক্তিগত লেখাগুলো পুড়ে না যেত।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি ছাড়াও ব্যক্তিগত কর্মজীবনের সাফল্য উইলিয়াম গিলবার্টকে এনে দেয় বিপুল বিত্তবৈভব। তবে তার এতো অর্থের বেশির ভাগই তিনি খরচ করেন জ্ঞান চর্চার পেছনে। তিনি তার বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় বই ও তথ্য সংগ্রহের জন্য ৫,০০০ পাউন্ডের বেশি খরচ করেন। অর্থের পরিমাণ যে কত বড় তা আপনি অনুধাবন করতে পারবেন কেবল তখনই যখন আপনি জানবেন যে সমপরিমাণ অর্থে দুটি আস্ত অত্যাধুনিক (সে সময়ের প্রেক্ষিতে) যুদ্ধজাহাজ ক্রয় করা সম্ভব ছিল! তৎকালীন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সবচেয়ে বড় জাহাজগুলোর একটি, ৬৯০ টন ওজনের ‘মেরিনার’ যা ৪০০ ক্রু এবং ৩৯টি কামান বহনে সক্ষম ছিল, এর দাম ছিল ৩,৬০০ পাউন্ড! বুঝতে পারছেন কি গিলবার্ট জ্ঞানার্জনের জন্য কত বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করেছিলেন?
তখন চুম্বকত্ব আর বিদ্যুতকে একই উৎস থেকে উৎসারিত বলে মনে করা হতো। আরো মজার ব্যাপার হলো, চুম্বক এবং বিদ্যুৎ, উভয়কেই অতিপ্রাকৃত বলে গণ্য করা হতো! এক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দ ‘ইলেকট্রিসিটি’ এর প্রথম ব্যবহার উইলিয়াম গিলবার্টই করেন বলে আমরা জানি। কিন্তু গিলবার্ট মূলত বিদ্যুতের প্রতিশব্দ হিসেবে ল্যাটিন শব্দ ‘ইলেকট্রিসিটাস’ ব্যবহার করেছিলেন যা ইংরেজিতে ইলেকট্রিসিটি হয়ে যায়। তিনি প্রচলিত ধারণা ভেঙে দিয়ে বিদ্যুৎ এবং চুম্বকের মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার করেন। তার পর্যবেক্ষণের কিছু দিক তুলে ধরা হলো।
- ঘর্ষণ থেকে স্থির বিদ্যুতের সৃষ্টি হয়, কিন্তু চুম্বকত্বের জন্য ঘর্ষণের প্রয়োজন হয় না। চুম্বকত্ব স্বাধীনভাবে বিরাজমান।
- আর্দ্র আবহাওয়ায় স্থির বিদ্যুতের আকর্ষণধর্মী ক্ষমতা হ্রাস পায়, কিন্তু চুম্বকের অপরিবর্তিত থাকে।
- একটি চুম্বক কেবল লৌহ এবং লৌহ জাতীয় কিছু চুম্বকীয় পদার্থকে আকৃষ্ট করতে পারে। কিন্তু একটি বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত বস্তু পানি সহ অসংখ্য চার্জহীন বস্তুকে আকর্ষণ করে।
- চুম্বক দ্বারা ভারী বস্তু উত্তোলন করা যায়, কিন্তু স্থির বিদ্যুতের সে ক্ষমতা নেই।
গিলবার্টের এই পর্যবেক্ষণগুলো পড়ে তাকে ভ্রান্ত ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ তার সময়ে স্থির বিদ্যুৎ ছাড়া আর কোনোকিছুর অস্তিত্ব ছিল না। অন্যদিকে চুম্বকত্ব এবং বিদ্যুতের মধ্যে যে গভীর যোগসূত্র রয়েছে তা জানতে হলে বিদ্যুৎ প্রবাহের প্রয়োজন ছিল, যা সে সময় সম্ভব ছিল না।
পৃথিবীর প্রথম ইলেকট্রোস্কোপ উইলিয়াম গিলবার্টের আবিষ্কার। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ভার্সোরিয়াম বা পিভোট। একটি ছোট চিকন লোহার সুইকে একটি পিভোটের উপর স্থাপন করে তিনি এই ইলেকট্রোস্কোপ তৈরি করেন। তিনি একটি বিড়ালকে ব্যবহার করে তার পরীক্ষাটি করেছিলেন। একটি বিড়ালের পশমে কিছুক্ষণ হাত বোলালে তা থেকে কিছু ইলেকট্রন কমে যায় এবং বিড়ালের পশম ধনাত্মক চার্জে চার্জিত হয়। গিলবার্ট একটি বিড়ালের পশম ঘষে তার কাছে নিজের ভার্সোরিয়াম নিয়ে আসেন। দেখা যায় ভার্সোরিয়ামটি বিড়ালের দিকে ঘুরে যায় বারবার। কারণ ধনাত্মক চার্জে চার্জিত পশম ভার্সোরিয়ামের ইলেকট্রন আকর্ষণ করে।
‘থার্মোরিম্যানেন্ট ম্যাগনেটাইজেশন’ বা প্রাকৃতিক উপায়ে কোনো চুম্বক পদার্থকে চুম্বকীয় ধর্ম প্রদান করার প্রক্রিয়াটি উইলিয়াম গিলবার্ট আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি দেখতে পান, কোনো লৌহকে যদি লাল বর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত উত্তপ্ত করা হয় এবং এরপর একে উত্তর-দক্ষিণমুখী করে ঠান্ডা করা হয়, তাহলে বস্তুটি চুম্বকীয় হয়ে ওঠে। এই থার্মোরিম্যানেন্ট প্রভাবের কারণ আমরা আজ জানি। এর কারণ হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুম্বক ডোমেইনের সজ্জা। উত্তর-দক্ষিণমুখী রেখে ঠান্ডা করার সময় সে পদার্থের ডোমেইনগুলো কিছুটা একমুখী হয়ে সজ্জিত হয় যা এর মধ্যে চুম্বকীয় ধর্ম আনয়ন করে। এই সজ্জার ব্যাপারটিকে ফেরোম্যাগনেটিজমও বলা হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই ফেরোম্যাগনেটিজম ব্যাপারটি পুরোটাই পারমাণবিক পর্যায়ের বিষয়, যা আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়া নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কিন্তু গিলবার্ট ঠিকই এ ব্যাপারে তার প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই পদার্থের ভেতরের গঠনগত কোনোকিছুর অনুক্রম পরিবর্তন হয়, যা বস্তুতে চুম্বক ধর্ম আনয়ন করে।
নিজের কাজে কর্মে এবং পরীক্ষা নিরীক্ষায় উইলিয়াম গিলবার্ট এতটাই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করতেন যে তিনি বিয়েই করেননি। ১৬০৩ সালের ২০ নভেম্বর ৫৯ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়েছিল বলা হলেও অনেকে এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কেননা সে বছর প্লেগ আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে ৩০ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কোলচেস্টারের ‘হোলি ট্রিনিটি চার্চ’-এ তাকে সমাহিত করা হয়। আধুনিক বিজ্ঞান আজ উন্নতির যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে এর পরীক্ষা নির্ভরতা। আর বিজ্ঞানের এই পরীক্ষানির্ভর হবার পেছনে উইলিয়াম গিলবার্ট একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ইতিহাস তাকে চিরকাল স্মরণ করবে তার অবদানের জন্য।