চার্লস টাউন্স: লেজারের জনক

“আমি বলি যে আমার সকল সাফল্য এসেছে ব্যর্থতা থেকে। কারণ ব্যর্থ হলে আমি ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করি।”

– চার্লস টাউন্স

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিক থেকে বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিতে রাডার সংক্রান্ত সামরিক প্রতিরক্ষা বিষয়ক কাজ শুরু করেন চার্লস টাউন্স। এই কাজ করতে করতে মাইক্রোওয়েভের উপর বেশ দক্ষতা তৈরি হয় টাউন্সের। এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫০ সালে তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতার মাঝেই গবেষণার সাথে জড়ান টাউন্স। তবে তখনো ঠিক সেরকমভাবে কিছু করা হয়ে উঠছিলো না। বিক্ষিপ্ত চিন্তা-ভাবনা আর ফিজিক্স ল্যাবে প্রতিদিন কিছু সময় কাটানো ছাড়া আর কিছুই না। সবকিছুর শুরুটা হলো ১৯৫২ সালে, একরকম অপ্রত্যাশিতভাবেই!

চার্লস টাউন্স তার মেজার যন্ত্রে কাজ করছেন; source: encyclopedia.com

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করেই টাউন্স সোজা চলে গেলেন পাশের পার্কে। সেখানে বসেই কিছু ভাবছিলেন আনমনে। হাতে ছিল তার ডায়েরি। আগের রাতে হাবিজাবি কিছু ভাবনা ডায়েরিতে লিখেছিলেন, সেগুলোই দেখতে লাগলেন টাউন্স। ভাবনাগুলো ছিল মাইক্রোওয়েভ কেন্দ্রিক। দেখতে দেখতেই হঠাৎ একগাদা বিচ্ছিন্ন শব্দাবলীর মাঝে খুঁজে পেলেন এমন এক গুচ্ছ শব্দ, যা তার নাম ইতিহাসে লিখিয়ে গেছে। ‘মাইক্রোওয়েভ অ্যামপ্লিফিকেশন অব স্টিমুলেটেড রেডিয়েশন’, বিচ্ছিন্ন কিছু শব্দ একত্রিত হয়ে এরূপে ধরা দিল টাউন্সের চোখে। ব্যস, হয়ে গেল আবিষ্কার! কলাম্বিয়াতে নিজের এক সহকারীর সাথে মিলে তৈরি করে ফেললেন পৃথিবীর প্রথম ‘মেজার’ বা ‘মাইক্রোওয়েভ অ্যামপ্লিফিকেশন অব স্টিমুলেটেড রেডিয়েশন’। এই মেজার হচ্ছে এমন যন্ত্র, যা সুসঙ্গত তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে। ১৯৫৩ সালে এই যন্ত্র তৈরি করেন টাউন্স।

টাউন্সের লেজারের গঠন; source: pddnet.com

“মাইম্যানের তৈরি লেজারে বেশ কিছু বিষয় ছিল, যা আমাদের গবেষণাপত্রে ছিল না।”- টাউন্স

এই উক্তিটির মর্ম বোঝার আগে জানতে হবে টাউন্সের লেজার সম্পর্কিত গবেষণার কথা। তার মেজার সংক্রান্ত গবেষণা চলাকালীনই বিজ্ঞানী নীলস বোর এই গবেষণা নিয়ে বিস্ময় এবং একইসাথে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তার মতে, এই গবেষণার সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ। অন্যদিকে কলাম্বিয়ার পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান, নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ইসাডোর র‍্যাবিও তার কনিষ্ঠ সহযোগী টাউন্সের কাজ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি তিনি টাউন্সকে এই গবেষণা ছেড়ে অন্য কোনো গবেষণা করবার পরামর্শও দেন! কিন্তু টাউন্স জ্যেষ্ঠদের কথায় কান না দিয়ে চালিয়ে গেলেন নিজের কাজ আর সফল হলেন। মেজার আবিষ্কারের প্রায় সাথে সাথেই জ্যোতির্বিজ্ঞানে কাজে লেগে গেল এই যন্ত্র। এর প্রথম ব্যবহার ছিল শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠতাপমাত্রা নির্ণয়ে।

মাইক্রোওয়েভ বা বেতারতরঙ্গ বিবর্ধন করেই থেমে যেতে পারতো টাউন্সের চিন্তাভাবনা। কিন্তু টাউন্স ছিলেন এমন এক চিন্তাশীল মানুষ, যিনি নিত্যনতুন চিন্তা করতে ভালোবাসতেন। বেতারতরঙ্গ বিবর্ধনের মতো আপাতদৃষ্টে (সে সময়ের প্রেক্ষাপটে) অসম্ভবকে সম্ভব করে এর চেয়ে আরো একধাপ কঠিন কাজের পরিকল্পনা করেন টাউন্স। বেতারতরঙ্গ বিবর্ধন করা গেলে দৃশ্যমান আলো কেন করা যাবে না! এই ভাবনাকে সায় দিল আলোকবিজ্ঞান। কেননা বেতারতরঙ্গ আর দৃশ্যমান আলো তো দিনশেষে তড়িৎচুম্বক বর্ণালীরই অংশ। তবে কাজটা যে অত সহজ হবে না, সেটা জানা ছিল টাউন্সেরও। তিনি তার শ্যালক আর্থার শলোর সাথে শুরু করলেন দৃশ্যমান আলোর বিবর্ধন সংক্রান্ত গবেষণা। ‘লাইট অ্যামপ্লিফিকেশন বাই স্টিমুলেটেড ইমিশন অব রেডিয়েশন’ বা লেজার নিয়ে টাউন্স ও শলোর গবেষণা প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘ইনফ্রারেড অ্যান্ড অপটিক্যাল মেজারস’ শিরোনামে প্রকাশিত এই গবেষণায় তারা এরকম লেজারের কাজ আশি ভাগ করেই ফেলেছিলেন।

নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করছেন চার্লস টাউন্স; source: greenvilleonline.com

১৯৫৮ সালেই লেজার সংক্রান্ত ধারণাটির পেটেন্ট করিয়ে নেন টাউন্স এবং শলো। তাদের গবেষণাপত্রটিই টেড মাইম্যানের লেজার তৈরির কাজ একদম সহজ করে দিয়েছিল। ১৯৬০ সালে টেড তৈরি করেন পৃথিবীর প্রথম লেজার যন্ত্র। আর তখনই মাইম্যানের উদ্ভাবনের প্রশংসা করে উপরের সেই প্রশংসাসূচক উক্তিটি করেছিলেন টাউন্স। তবে মজার ব্যাপার হলো, টাউন্স যখন আমেরিকায় বসে লেজার নিয়ে গবেষণা করছেন, রাশিয়াতে সে সময় নিকোলাই বেসভ এবং আলেকজান্ডার প্রখরভ নামক দুজন বিজ্ঞানী পৃথকভাবে একই গবেষণা করছিলেন। তবে তিনজনের কেউই অন্যদের গবেষণার কথা জানতেন না, যতদিন না তা প্রকাশিত হয়! ১৯৬৪ সালে চার্লস টাউন্সকে কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিকসে মৌলিক গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তবে তাকে দেয়া হয় অর্ধেক। বাকি অর্ধেক লাভ করেন বেসভ আর প্রখরভ।

১৯৬৭ সালে চার্লস ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে চলে যান। কর্মজীবনের বাকি সময়টা তিনি সেখানেই কাটিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই দুজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক মার্টিন রিস এবং ডোনাল্ড লিন্ডেন তাদের ‘ব্ল্যাক হোল’ বা কৃষ্ণগহ্বর বিষয়ক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যেখানে তারা দাবি করেন যে আমাদের ছায়াপথ ‘মিল্কি ওয়ে’ বা আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে একটি দৈত্যাকার কৃষ্ণগহ্বর লুকিয়ে আছে। এর তিন বছর পর তারা আরো দাবি করেন যে, প্রতিটি স্বাভাবিক ছায়াপথের কেন্দ্রেই একটি অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তারা একটি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বও প্রমাণ করতে পারেননি। এই কাজেই এগিয়ে এলেন চার্লস টাউন্স। তিনি বার্কলেতে তার গবেষণা সহযোগী দলের সাথে কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে কাজ শুরু করেন।

আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল; source: news4c.com

দুই বছরের মাথায় সাফল্যের নতুন পালক যুক্ত হয় টাউন্সের মুকুটে। ১৯৭৬ সালে ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে’ প্রকাশিত হয় তার কৃষ্ণগহ্বর বিষয়ক গবেষণা যা পরবর্তীতে বিজ্ঞানীদের এ সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনাই বদলে দিয়েছিল। টাউন্স আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের একটি অবলোহিত পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেন যেখানে দেখা যায় যে আমাদের এই ছায়াপথের কেন্দ্রে বিস্ময়কর পরিমাণের ভর উপস্থিত। পরিমাণটা হচ্ছে সূর্যের ভরের ৪০ লক্ষ গুণ! এমন অবিশ্বাস্য তথ্য আবিষ্কারের পর টাউন্সের কৌতুহল বেড়ে গেল কয়েক গুণ। তিনি ও তার দল চালিয়ে গেলেন গবেষণা এবং ১৯৮০ সালে পেলেন সর্বোচ্চ সাফল্য। তাদের পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত হলো যে ৪ মিলিয়ন সৌরভরের আকার একটি বিন্দুর মতো! অন্যকথায় আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে একটি আয়তনহীন বিন্দুর ভর ৪ মিলিয়ন সূর্যের চেয়ে বেশি! এ ব্যাপারটিই প্রমাণ করে যে তা একটি অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর। পরবর্তীতে আরো বিস্তৃত গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে এর ভর ৪.১ মিলিয়ন সৌরভরের সমান। হাবল টেলিস্কোপের কল্যাণে এখন আমরা জানি যে, প্রতিটি সর্পিলাকার ছায়াপথের কেন্দ্রেই রয়েছে একটি ‘সুপারম্যাসিভ’ কৃষ্ণগহ্বর। অথবা একেকটি সুপারম্যাসিভ কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় এক একটি ছায়াপথ।

আমি সর্বদা বিশ্বাস করেছি যে বিজ্ঞান এবং ধর্ম কখনোই আলাদা নয়।”- চার্লস টাউন্স

চার্লস টাউন্স ধার্মিক ছিলেন। তার পরিবার ছিল একটি আন্তরিক ব্যাপটিস্ট পরিবার। বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার পাশাপাশি ধর্ম নিয়ে করেছেন বিস্তর পড়ালেখা। ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক গবেষণার জন্য ২০০৫ সালে তাকে ১.৫ মিলিয়ন ‘টেম্পেলটন অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়। এই অর্থের অর্ধেক তিনি চার্চ কমিউনিটিতে দান করেন। ধর্মপ্রাণ হিসেবে তার সুনাম আমৃত্যু অক্ষত ছিল।

২৮ জুলাই ১৯১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যারোলাইনার গ্রিনভিলে জন্মগ্রহণ করেন চার্লস টাউন্স। বাবা হেনরি টাউন্স ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী আর মা এলেন হার্ড ছিলেন একজন কলেজ শিক্ষিকা। উচ্চশিক্ষিত বাবা-মায়ের কল্যাণে টাউন্স পরিবারের সকলের মধ্যে জ্ঞানস্পৃহা ছিল গভীর। শৈশব থেকেই এনসাইক্লোপিডিয়া আর ইতিহাস পড়তে শুরু করেন টাউন্স। প্রাথমিক শিক্ষাটা ঘরে বসেই সেরেছিলেন তিনি। ১৫ বছর বয়সে গ্রিনভিল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনে প্রবেশ করেন। পরের বছরই গ্রিনভিলের ছোট্ট ব্যাপটিস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ‘ফারমান’এ ভর্তি হন। সেখান থেকেই ১৯৩১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে বি.এসসি এবং আধুনিক ভাষাশিক্ষায় বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কার্বনের আইসোটোপ এবং এর পারমাণবিক স্পিন নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

চার্লস টাউন্স (১৯১৫-২০১৫); source: telegraph.co.uk

চার্লস টাউন্স ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে স্কিয়িং (বরফের মধ্যে একপ্রকার সরু পাতের উপর দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করা) করতে গিয়ে পরিচিত হন ফ্রান্সিস ব্রাউন নামক ২০ বছর বয়সী নারীর সাথে। শুরু হয় প্রেম। দু’মাস পরই তারা বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। ৪ মে পারিবারিকভাবে ব্রাউনকে বিয়ে করেন টাউন্স। এই দম্পতির ঘরে চারটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। ২০১৫ সালের ২৭ জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন টাউন্স। তাকে ক্যালিফোর্নিয়া চার্চে সমাহিত করা হয়।

ফিচার ছবি: npr.org

Related Articles

Exit mobile version