“বিজ্ঞানের ভাষা সার্বজনীন এবং এর অদৃশ্য এক ক্ষমতা আছে বিশ্বজুড়ে মানুষকে কাছাকাছি আনার।” –আর্থার কম্পটন
বিজ্ঞানী লরেন্স ব্র্যাগ এক্সরে ব্যবহার করে কীভাবে কঠিন পদার্থের ভেতরে পরমাণুর অবস্থান অনুমান করা যায়, তা দেখিয়েছেন। আর্থার কম্পটনও ব্র্যাগের নীতি অনুসরণ করেছিলেন পরমাণুতে ইলেকট্রনের বিন্যাস দেখতে। তাই তার এক্সরে আর ইলেকট্রন সংক্রান্ত গবেষণাটি আইনস্টাইনকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য ছিল না। বরং একটি স্বতন্ত্র গবেষণা ছিল। এই গবেষণার ধারাবাহিকতায় ১৯২২ সালে কম্পটন লক্ষ্য করেন যে, ইলেকট্রনের সাথে ক্রিয়া করে এক্সরেগুলোর কম্পাঙ্ক কমে যাচ্ছে এবং বেড়ে যাচ্ছে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। অর্থাৎ, শক্তি হারাচ্ছে রঞ্জনরশ্মি। তিনি আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে আসেন এক্সরে এবং ইলেকট্রন পরস্পর দুটি কণার মতোই সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ঠিক যেমন সংঘর্ষে লিপ্ত হয় দুটি পুল বল। আর এই সংঘর্ষ কেবল একটি এক্সরের সাথে একটি ইলেকট্রনের হয়। সংঘর্ষের পর যে নতুন পরিবর্তিত আলোক কণিকা পাওয়া যায়, কম্পটন তার নাম দেন ফোটন।
১৯২৩ সালের এপ্রিল মাসে কম্পটন তার এই গবেষণার বিষয়বস্তু আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটিতে প্রকাশ করেন। সাথে সাথে বিতর্কের ঝড় ওঠে। প্রাথমিকভাবে অনেকে মনে করতে থাকেন, কম্পটনের গবেষণা নিছক আইনস্টাইনের আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার স্বপক্ষের ব্যাখ্যা। অনেক সমসাময়িক পদার্থবিদই তার এই তত্ত্ব বিশ্বাস করতে অস্বীকৃতি জানান। ইলেকট্রনের সাথে ক্রিয়ায় আলোর কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যে পরিবর্তন আসতে পারে এ ব্যাপারটি তারা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আরো সহজে বললে এক্সরে যে কণিকা হিসেবে কাজ করতে পারে এ ব্যাপারটিই বিশ্বাস হচ্ছিল না বিজ্ঞানীদের। মে মাসে কম্পটন তার সম্পূর্ণ গবেষণাটি প্রকাশ করেন। তখনো তার তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করার পক্ষেই ছিলেন অধিক সংখ্যক বিজ্ঞানী। তবে মাত্র চার বছরেই দৃশ্যপটে আমূল পরিবর্তন আসে। তার এই তত্ত্ব, যা ‘কম্পটন ইফেক্ট’ নামে পরিচিত, এর জন্যই তাকে ১৯২৭ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ধারাবাহিকতায় এই পরিবর্তন আসে। ১৯২৪ সালে ডি ব্রগলীর পদার্থের তরঙ্গধর্ম আবিষ্কার এবং ১৯২৭ সালে জর্জ পেজেটের ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্ম আবিষ্কার কম্পটন ইফেক্টকে প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯১২ সালে পদার্থবিদ ভিক্টর হেস পৃথিবীতে শনাক্ত হওয়া রহস্যময় একপ্রকার মহাজাগতিক বিকিরণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯২১ সালে এই মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণায় যোগ দেন আর্থার কম্পটন। এই গবেষণায় তাকে উৎসাহিত করেছিল মেরি কুরির রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সম্বন্ধীয় ধারণা। মেরি কুরি ধারণা করেছিলেন রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা কোনো মহাজাগতিক রশ্মির মাধ্যমেই ঘটছে। তাই কম্পটনের এই গবেষণাটি এক অর্থে মেরি কুরির তত্ত্বের পরীক্ষামূলক গবেষণা ছিল। তিনি রেডিয়ামের একটি নমুনা নিয়ে গেলেন গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের তলদেশে। অন্য একটি নমুনা পর্যবেক্ষণ করলেন এমন স্থানে যেখানে মহাজাগতিক রশ্মির পরিমাণ খুব বেশি। দেখা গেল উভয় ক্ষেত্রে রেডিয়াম নমুনার তেজস্ক্রিয়তার কোনো পরিবর্তনই ঘটেনি! এ থেকে খুব সহজে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে মহাজাগতিক রশ্মি তেজস্ক্রিয়তার জন্য দায়ী নয়।
তেজস্ক্রিয়তায় মহাজাগতিক রশ্মির কোনো ভূমিকা প্রমাণিত না হবার পর কম্পটন বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ শুরু করেন মহাজাগতিক রশ্মি পর্যবেক্ষণে। কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ভ্রমণ করে তিনি পা রাখেন ভারতবর্ষেও। এই পর্যবেক্ষণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য উঠে আসে। দেখা যায় মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীর চৌম্বকীয় বিষুবরেখা থেকে অনেক দূরের স্থানগুলোতে উপস্থিত। এটি প্রমাণ করে যে মহাজাগতিক রশ্মি চার্জিত কণিকা। ১৯৩৩ সালে কম্পটন তার গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী লুইস আলভারেজের সাথে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যেখানে তারা মহাজাগতিক রশ্মিকে ধনাত্মক চার্জে চার্জিত প্রমাণ করেন। তবে গবেষণাটির একটি ভুল ছিল এই যে কম্পটন ও আলভারেজ মহাজাগতিক রশ্মির ধনাত্মক চার্জের জন্য প্রোটনকে দায়ী করলেও আসলে তা হচ্ছে পজিট্রন, ইলেকট্রনের প্রতিকণিকা।
আর্থার কম্পটনের বৈজ্ঞানিক কর্মজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন আমেরিকার প্রজেক্ট ম্যানহাটনে যোগ দেয়া। ১৯৪১ সালে আমেরিকার ডিফেন্স রিসার্চ কমিটি ইউরেনিয়াম বোমার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে একটি কমিটি গঠন করে, যার প্রধান করা হয় কম্পটনকে। তিনি এনরিকো ফার্মি সহ আরো কয়েকজন বিখ্যাত পদার্থবিদের সাথে মিলে গবেষণা শুরু করেন এবং নভেম্বরের মধ্যে ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর বোমা তৈরি সম্ভব বলে রিপোর্ট করেন। কিন্তু রিপোর্টে প্লুটোনিয়ামের কথা উল্লেখ ছিল না। ফলে প্লুটোনিয়ামের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের দায়িত্বও তাকে দেয়া হয়। তিনি পুনরায় তার মেটালারজিক্যাল ল্যাবে প্লুটোনিয়ামের চেইন বিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। উল্লেখ্য, কম্পটনের কাজ বোমা তৈরি ছিল না, বরং ছিল এর সম্ভাব্যতা যাচাই। ১৯৪২ সালের জুন মাসে কম্পটন বোমার ডিজাইন করার দায়িত্ব রবার্ট ওপেনহাইমারকে দেন। তখন কম্পটনের কাজ ছিল একটি সফল চুল্লী নির্মাণের কাজ তত্ত্বাবধান করা। বোমা তৈরির মূল কাজ শুরু হয় ১৯৪৩ সাল থেকে। যুদ্ধের বাকি সময়টুকু কম্পটন প্রত্যক্ষভাবে ম্যানহাটন প্রজেক্টের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৫ সালে বিজ্ঞানীদের যে প্যানেলটি জাপানে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের অনুমোদন দেয়, কম্পটনও তার একজন সদস্য ছিলেন। যুদ্ধ পরবর্তীকালে প্রজেক্ট ম্যানহাটনে তার অবদানের জন্য তাকে ‘মেডেল ফর মেরিট’-এ ভূষিত করা হয়।
আর্থার কম্পটনের পদার্থবিজ্ঞানী কম্পটন হয়ে উঠার শুরুটা হয় মাত্র ১২ বছর বয়সে, যখন তিনি একটি জোতির্বিজ্ঞানের বই পড়ে জোতির্বিদ হবার স্বপ্নে বিভোর হন। একটি দুর্বল টেলিস্কোপে নিয়মিত চোখ রাখা শুরু করেন এবং শনির বলয় দেখে বিস্ময়াভিভূত হন। ১৯১০ সালে পৃথিবীর আকাশে হ্যালির ধূমকেতু দৃশ্যমান হলে তিনি তার ক্যামেরায় সেই ধূমকেতুর একটি ছবি তোলেন, যা আমৃত্যু তার কাছে ছিল। তবে তার মেধার বিস্ফোরণ ঘটে ১৯০৭ সালে, যখন তিনি রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বিমান উড্ডয়নের প্রতি আকৃষ্ট হন। ভাবতে অবাক লাগে যে কতটা মেধাবী আর সাহসী হলে মাত্র ১৫ বছর বয়সের একজন যুবকের পক্ষে বিমান তৈরির কাজ শুরু করা সম্ভব! হ্যাঁ, তিনি বিমান বানানো শুরু করেন এবং তা অবশ্যই খেলনা হিসেবে নয়। এক বছরের মাথায় তার কাজ শেষ হয় এবং দৃশ্যমান হয় ২৭ ফুট প্রশস্ত ও ১২ ফুট লম্বা একটি কাঠের ফ্রেমের গ্লাইডার! আর এই গ্লাইডার তৈরিতে তার খরচ হয়েছিল ৩৫ ডলার, যা তিনি প্রতিবেশীর নানান টুকিটাকি কাজ করার মাধ্যমে জোগাড় করেন! ১৯০৯ সালে বিস্ময়বালক কম্পটন তার গ্লাইডার সফলভাবে উড্ডয়ন করতে সক্ষম হন। সে বছর তিনি অ্যারোনটিকসের উপর দুটি গবেষণাপত্রও লেখেন! তবে দুর্ভাগ্যবশত তার গ্লাইডারটি একটি অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়।
আর্থার কম্পটন ১৮৯২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের উস্টারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এলিয়াস ছিলেন উস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন এবং মা ওটেলিয়া ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা। বাবা মা উভয়েই শিক্ষিত হওয়ায় কম্পটন শৈশব থেকেই জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন। প্রাথমিক শিক্ষার অত্যন্ত শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই তিনি ১৪ বছর বয়সে উস্টার প্রিপারেটরি স্কুলে পড়ালেখা শুরু করেন। তবে উস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগে তার জীবনের বাঁক পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বাবা খ্রিস্টান কমিউনিটির প্রধান হওয়ায় তার পরিবারে ধর্মীয় চর্চা ছিল বেশ গম্ভীর। তিনিও শৈশব থেকেই অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পূর্বে মিশনারি হবার একরকম চিন্তা কাজ করছিল তার মাথায়! তবে পৃথিবীকে তার মতো একজন মেধাবী বিজ্ঞানীর চিন্তা থেকে বঞ্চিত হওয়া থেকে রক্ষা করেন তার বাবা এলিয়াস। তিনি কম্পটনকে এই বলে অনুপ্রাণিত করেছিলেন যে,
“মিশনারি না হয়ে একজন বিজ্ঞানী হতে পারলে খ্রিস্টান জাতি তোমার দ্বারা অধিক উপকৃত হবে!”
১৯১৯ সালে আর্থার কম্পটন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে গবেষণার জন্য স্কলারশিপ লাভ করেন। সেখানে তিনি গামা রশ্মির শোষণ এবং বিচ্ছুরণ নিয়ে কাজ করেন এবং আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ও জে জে থম্পসনের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের বন্ধু হন। রিসার্চ শেষ করে দেশে ফিরেই তিনি মিসৌরির ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। এ সময় থেকে তিনি গবেষণার জগতে সম্পূর্ণরূপে প্রবেশ করেন। ১৭ শতক থেকে চলে আসা নিউটনের কণিকা তত্ত্ব এবং হাইগেনসের তরঙ্গ তত্ত্বের বিতর্ক নিয়ে কাজ শুরু করেন কম্পটন। আক্ষরিক অর্থে তিনি আসলে আলো নিয়ে কাজ শুরু করেন। কেননা ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচুম্বক তত্ত্ব ততদিনে সে বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে। এরই মধ্যে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন নিয়ে আসেন আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা যা তাৎক্ষণিকভাবে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল। আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী আলোর কম্পাঙ্ক রয়েছে যা অবধারিতভাবে একে তরঙ্গরূপে প্রতীয়মান করে। কিন্তু তিনি এটাও বলেছেন যে, আলো কণার মতোও আচরণ করে। আর এখানেই অধিকাংশ বিজ্ঞানী বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২০ এর দিকে যখন প্রায় সকল বিজ্ঞানীই আলোর তরঙ্গ ধর্ম মেনে নিয়েছেন এবং কণা ধর্মকে ফেলে দিয়েছেন বাতিলের খাতায়, তখনই কম্পটন তার যুগান্তকারী গবেষণা শুরু করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় তিনি আবিষ্কার করেন কম্পটন ইফেক্ট এবং আলোর তরঙ্গধর্মের পাশাপাশি কণা ধর্মও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি এই কণিকার নাম দেন ফোটন। আর এভাবেই ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করে তার নাম।
১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আর্থার কম্পটন। ওহাইওর উস্টার সমাধিক্ষেত্রে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। মৃত্যুকালীনও তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ১৯২৭ সালে নোবেল পুরস্কার ছাড়াও তিনি মৃত্যুপরবর্তী রয়্যাল সোসাইটি ও ফ্রাঙ্কলিন ইনস্টিটিউট মেডেল লাভ করেন। চাঁদের একটি ক্র্যাটারের নাম তার নামে নামকরণ করা হয়। তার স্মৃতি চিরকাল ধরে রাখতে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক ছাত্রাবাস তার নামে নামকরণ করা হয়।