রিচার্ডসনের আজ প্রচুর কাজ। কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যেও টিভির সামনে থেকে সরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই তার নেই। ব্যাখ্যাতীত ব্যাপারগুলোতে রিচার্ডসনের সবসময়ই একটু বেশিই আগ্রহ কাজ করে। এই যেমন কয়েকদিন আগে টিভিতে এক ভদ্রলোক জাদুকরকে দেখেছে দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়নার উপর দিয়ে হাঁটতে, আবার আলকাত্রাজের মতো কুখ্যাত জেলখানা থেকে পালিয়ে যেতে কিংবা লিয়ারজেটের মতো এত বড় একটা বিমানকে চোখের সামনেই গায়েব করে দিতে। কিন্তু আজকের জাদুটা আরো ভয়াবহ।
পৃথিবীর বুকে এককভাবে রাজত্ব করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহর নিউ ইয়র্কের উপকূলে মার্কিনীদের স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপনে ফ্রান্স স্ট্যাচু অফ লিবার্টি উপহার দিয়েছিল; যা আজ কেবল স্বাধীনতারই নয়, বরং জাতিসত্তার প্রতীক। আর সেই জাদুকর ভদ্রলোক কিনা বলছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকে বসে তাদেরই জাতিসত্তার প্রতীককেই গায়েব করে দেবেন। রিচার্ডসন তাই এক মুহুর্তের জন্যেও টিভির সামনে থেকে সরতে ইচ্ছুক নন।
সময় বয়ে যাচ্ছে। রিচার্ডসনের যেন তর সইছে না। খানিক আগেই জাদুকরকে টিভির পর্দায় দেখা গেছে। পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে এখন। আর টিভিতে তার আগের সব অবিশ্বাস্য জাদুগুলো বারবার প্রচার করা হচ্ছে। রিচার্ডসন ভাবতে শুরু করে, এসব কি সত্যিই জাদু নাকি কেবল দৃষ্টিবিভ্রম? পরিপূর্ণ ভাবার সুযোগ হয় না রিচার্ডসনের তার আগেই টিভির পর্দায় আবারো উপস্থিত হয় সেই জাদুকর। সবাইকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন,
এই ৩১০ ফুট উচ্চতার স্বাধীনতার স্মারক লিবার্টিকে আমি অদৃশ্য করে কেবল এটাই মনে করিয়ে দিতে চাই যে, স্বাধীনতা কতটা মূল্যবান আমাদের কাছে এবং তা কতটা সহজেই হারিয়ে ফেলা যায়। আমি এই লেডি লিবার্টিকে অদৃশ্য করার মধ্য দিয়ে আমাদের জনগণকে জানাতে চাই যে, কীভাবে আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে চাইলেই আঁকড়ে ধরে রাখতে পারি।
কথা বলা শেষে জাদুকর এই বিশাল স্থাপনার সামনে একটা পর্দা তুলে দিলেন। তার খানিকবাদেই পর্দাটা নীচে নেমে এলো কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, লিবার্টিটা আসলেই নেই সেখানে যেখানে ওটা থাকার কথা। উপর থেকে একটা হেলিকপ্টার আলো ফেললো কিন্তু কোথাও লিবার্টিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। রিচার্ডসনের মতো শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরাই না, বরং পুরো পৃথিবী অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো জাদুকরের এহেন কর্মকান্ডে। খানিক বাদে পর্দাটা উঠে এলো এবং নামার সাথে সাথেই ঠিক আগের অবস্থানেই দেখা গেল স্ট্যাচু অফ লিবার্টিকে। এটাও কি সম্ভব? জ্বি, সম্ভব তবে তা কেবল মাত্র একজনের জন্যেই সম্ভব হয়েছিল আর তার নাম হচ্ছে ডেভিড সেথ কটকিন; তবে তিনি ডেভিড কপারফিল্ড নামেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৬ তারিখ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির মেটুসানে জন্মগ্রহণ করেন বিংশ শতাব্দীর এই বিখ্যাত জাদুকর। জন্মের পরপরই নাগরিকত্বের সমস্যায় পড়েন ডেভিড। কেননা, বাবা হায়ম্যান কটকিন; হাবেরদাশেরি কোম্পানির মালিক এবং একজন ইউক্রেনিয়ান তথা রাশিয়ান বা সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক ছিলেন। আর তার মা রেবেকা বীমা কোম্পানির কর্মকর্তা ছিলেন, তবে তার আদিনিবাস ছিল ইসরায়েলে। যদিও এ নিয়ে খুব বেশিদিন ডেভিডকে ভুগতে হয়নি, কেননা পরবর্তীতে এই সমস্যার সমাধানও হয়েছিল।
ছোটবেলা থেকেই ডেভিডের জাদু বা দৃষ্টি বিভ্রম করে দেয়া ব্যাপারগুলোতে বেশ আগ্রহ কাজ করতো। কিন্তু, তার পরিবার বলতেও পারবে না এই আগ্রহটা তার কোথা থেকেই বা আসলো। মেটুসান হাই স্কুলে থাকাকালীন, নিজের ছোটখাট পরিসরে করা জাদুর অনুষ্ঠানের টিকেট বিক্রি করেছিল এই চালাক ছেলেটা, যার জন্যে তাকে ৫ ডলার জরিমানাও গুণতে হয়েছিল। এরপর থেকেই স্কুলে জাদুকর ড্যাভিনো নামে পরিচিতি পায় সে।
স্কুলজীবন শেষ করার আগেই, ম্যানহাটনের ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্কে জাদুর প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছিলেন ডেভিড। এবং ব্রডওয়ের মঞ্চে অদৃশ্য হওয়ার জাদু দিয়েই সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। আর ঐ এক মঞ্চই তার জীবন পাল্টে দিয়েছিল। তার জাদুর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে আমেরিকান ম্যাজিশিয়ান সোসাইটি ডেভিডকে নিজেদের সদস্য হওয়ার আহবান জানায় এবং ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে সেখানে নিজের নাম লেখান ডেভিড।
পরবর্তীতে তিনি ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। নতুন একটা পরিকল্পনা নিয়ে তিন বছর কাটানোর পর, গীতিনাট্য ধারার একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন শিকাগোতে দ্য ম্যাজিক ম্যান নামে। তার পরিকল্পনা মোতাবেকই, অনুষ্ঠানটা এতটাই উপার্জন এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে তাকে শিকাগোর ব্রডওয়েতে চার সপ্তাহ কাঁটাতে হয়েছিল। কিন্তু তখন অবধি বিশ্ব তাকে ডেভিড সেথ নামেই চিনতো। এই সময়কালেই তিনি চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের সম্মানার্থে নিজের নামকরণ করেন ডেভিড কপারফিল্ড।
১৯৭৭ সালে, দ্য এবিসি অফ ম্যাজিক নামে প্রাইম টাইম টেলিভিশনে তার একটি অনুষ্ঠান প্রচার হয় যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরের বছর দ্য ম্যাজিক অফ ডেভিড কপারফিল্ড নামে তার নিজের টিভি সিরিজ বানানোর প্রস্তাব দেয়া হয় তাকে। অনুষ্ঠানটা এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে পরবর্তী ২০ বছরে ২১টি অনুষ্ঠানই সফলতার মুখ দেখেছিল। পরবর্তীতে সিবিএস ও তাকে একই শিরোনামে অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব দেয়। ১৯৮৪ সালে এই অনুষ্ঠানের ষষ্ঠ পর্ব অ্যামি এওয়ার্ড জিতে নেয় এবং টিভি রেটিংসের সর্বোচ্চ ধাপে উন্নীত হয়। তার সিবিএসের সাথে চুক্তির অষ্টম বছরে, অনুষ্ঠানটি চীনা প্রজাতন্ত্রের জন্যে সম্প্রচার করা হয়। ৪,৪৮০ কিলোমিটার দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়না ছিল যার মূল আকর্ষণ। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ডেভিড, নামক এই দুর্দান্ত জাদুকরের মায়াজালে পরিণত হলো এবং পুরো বিশ্ব অবাক হলো তার জাদুর মোহনীয়তায়।
১৯৯১ সালে ডেভিড কপারফিল্ড ইন্টারন্যাশনাল মিউজিয়াম এন্ড লাইব্রেরী অফ কনজিউরিং আর্টস নামে এক জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। এই জাদুঘরে ঐতিহাসিকভাবে উল্লেখযোগ্য সমস্ত জাদুবিদ্যার নিদর্শনসমূহের বিশাল সংগ্রহ আছে। অবশ্য ভূগর্ভস্থ জাদুর রেস্তোরাঁ নামে একটা খাবারের হোটেলের পরিকল্পনার কথা বেশ প্রচার হলেও তা কখনোই দৃশ্যমান হয়নি। এখনো, এই তেষট্টি বছর বয়সেও, পুরো বছর জুড়ে তিনি প্রায় ৫০০ এর মতো অনুষ্ঠান করে থাকেন এবং তার বার্ষিক আয় প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
১৯৯৩ সালে এক অনুষ্ঠানে জার্মান মডেল ক্লডিয়া শিফারকে মঞ্চে আহবান জানান, কারো মন পড়ার অভিনয়ের জন্যে এবং তার পর থেকেই তার সাথেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ডেভিড। সম্পর্ক থাকাকালীন, শিফারকে প্রায়ই ডেভিডের সাথে মঞ্চে দেখা যেত। এই জুটি বেশ দৃষ্টিনন্দন এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। টানা ছয় বছর প্রেম করার পর, ১৯৯৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে জনসম্মুখে নিজেদের বিচ্ছেদের কথা ঘোষণা করে এই জুটি। পরে তিনি এক ফ্রেঞ্চ মডেল এবং ফ্যাশন ডিজাইনার ক্লয়ি গোস্লিনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যান যে কি না তার থেকে ২৮ বছরের ছোট ছিল। এই জুটি থেকেই তার কন্যা সন্তান স্কাইয়ের জন্ম হয় ২০১০ সালে।
তার যশ পুরো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং তিনি হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের সবচাইতে বিখ্যাত জাদুকরদের একজন। ডেভিড কপারফিল্ড জাদুকে বিশ্বব্যাপী দর্শনীয় করে তুলেছিল এবং নব্বইয়ের দশকে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি অদৃশ্য করে এবং দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়না অতিক্রম করে তিনি তার ক্যারিয়ারের স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য, তার প্রতিভা মাত্র ১১ বছর বয়সেই প্রকাশ পেয়েছিল। তার ৬০ বছর বয়সের এই জীবনে, উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন গণমাধ্যম তাকে সম্মানসূচক স্বীকৃতি দিয়েছে। উইজার্ড অফ দ্য সেঞ্চুরি এন্ড মিলিনিয়াম খ্যাত এই জাদুকর তার টেলিভিশন অনুষ্ঠানের জন্য মোট ২১টি অ্যামি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, ১১টা গিনেজ রেকর্ড এবং হলিউডের এক উজ্জ্বল তারকার সাথে তিনি ওয়াক অন ফেইম এ সম্মানিত হয়েছেন।
এই ৬০ বছরের জীবনে তার সবচেয়ে বড় অর্জন, একমাত্র তিনিই সর্বকালের সবচেয়ে ধনী এবং বিখ্যাত জাদুকর হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। তিনি প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উপার্জন করেছেন বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে জাদু দেখিয়ে এবং তার টেলিভিশন অনুষ্ঠানের ব্যবসায়িক সাফল্যের মাধ্যমে। তার ভাষ্যমতে, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা অথবা মাইকেল জ্যাকসনের অনুষ্ঠানের চাইতেও তার অনুষ্ঠানে বেশি টিকেট বিক্রি হতো। বর্তমানে, লাস ভেগাসের এমজিএম গ্র্যান্ড হোটেল এবং ক্যাসিনোতেই অনুষ্ঠান করছেন এই গুণী জাদুকর।
ফোর্বস ম্যাগাজিনের বার্ষিক সংখ্যায় ৮০০ মিলিয়ন ডলারের সর্বাধিক পারিশ্রমিক পাওয়া তারকাদের মধ্যে ডেভিডের অবস্থান হয়েছিল প্রথম ২০ জনের মধ্যেই। ইতিমধ্যেই ডেভিড কপারফিল্ডকে নিয়ে বইও লেখা হয়েছে। ডেভিড কপারফিল্ড টেলস অফ দ্য ইম্পসিবল শিরোনামে বইটিতে জাদুর সমন্বয়ে গড়ে উঠা ফ্যান্টাসি গল্পের সংকলন করা হয়েছে। এরপরে আরেকটা বইয়ের নাম শোনা যায় ডেভিড কপারফিল্ড বিয়োন্ড ইমাজিনেশন নামে।
লাস ভেগাসের এক অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ রাঁধুনি গ্যাভিন কক্স সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন। নিজের একটা জাদুর কৌশলে অংশগ্রহনের জন্য কক্সকে ডেভিড বাছাই করেন দর্শকদের মধ্য থেকে। অন্য আরো ১২ জন মানুষের সাথে তাকেও অদৃশ্য করে পেছনের সিটগুলোতে তাদেরকে উপস্থিত করাটাই ছিল জাদুর অংশবিশেষ। কিন্তু আচমকাই কক্সের মস্তিষ্কে বেশ চাপ পড়ে এবং ব্যাপারটা এমনকি তাকে পারকিনসন রোগে আক্রান্ত করে ফেলেছিল পর্যন্ত। এবং এই ঘটনার নিষ্পত্তি হয়েছিল আদালতে।
ইতিহাসের বিখ্যাত হয়ে ওঠা এই জাদুকরের নাম আর যশ পুরো বিশ্বব্যাপী। ডেভিড কপারফিল্ড জাদুকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন এবং অবশ্যই পুরো বিশ্ব জুড়ে এক বিশাল জাদু দেখার দর্শক তৈরি করেছেন। এছাড়াও, সামাজিক কর্মকান্ডেও ডেভিডের উপস্থিতি বিদ্যমান। স্ট্রোক রোগীদের জন্যে একটা আলাদা অনুষ্ঠানই করে থাকেন তিনি যার পরিপূর্ণ অর্থ রোগীদের সেবায়ই খরচ করা হয় প্রায় ৩০টি দেশের এক হাজার হাসপাতালে।
ফরাসি সরকার তাকে নাইট উপাধি দিয়েছে। তিনি স্টিভেন স্পিলবার্গ, মার্টিন স্কোরসেস এবং কলিন পাওয়েলের সাথে মার্কিন কংগ্রেস লাইব্রেরির তরফ থেকে লিভিং লেজেন্ডের পুরষ্কার পেয়েছেন। তার মুখের প্রতিকৃতি দিয়ে বিশ্বের ছয়টি দেশের ডাকটিকেট বানান হয়েছে, আর এই সম্মানে ভূষিত হওয়া একমাত্র জীবিত জাদুকর তিনিই আছেন। তিনি নিজেই নিজের শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং জাদুবিদ্যার ইতিহাস এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন আজীবন।