যেখানে টানা মিনিট দশেক দৌঁড়াতেই আমাদের হাঁপিয়ে মরতে হয়, সেখানে প্রায় বিয়াল্লিশ কিলোমিটার টানা দৌড়ে এক ম্যারাথন শেষ করা আর দীর্ঘ মরণপণ যুদ্ধের মাধ্যমে রাজ্য জয় করা একই জিনিস। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন যে, ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচ লক্ষের অধিক মানুষ এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সফল হয়েছেন এবং দিন দিন এর পরিমাণ বেড়েই চলছে। ম্যারাথনের এই দূরত্ব টপকিয়ে কেউ আবার নাম লিখছে আল্ট্রাম্যারাথনের খাতায়।
আল্টাম্যারাথন হচ্ছে ট্র্যাডিশনাল ম্যারাথন থেকে একটু বেশি দূরত্বের দৌঁড় প্রতিযোগিতা, যার দূরত্ব ৫০ থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটারের মতো, যদিও বিভিন্ন জায়গায় এর ভিন্নতা দেখা যায়। অনেকে আবার আল্ট্রাম্যারাথনের এই দীর্ঘ দূরত্বটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পাড়ি দিচ্ছে শত শত মাইল। প্রতিকূল অবস্থায় নিজের সক্ষমতাকে ঝালিয়ে নিচ্ছে বারবার। বিশ্বের সামনে নিজেদের তুলে ধরছে অতিমানব হিসেবে। এদেরই একজন ডিন কারনাযেস (Dean Karnazes), যাকে পুরো পৃথিবী ‘আল্ট্রাম্যারাথন ম্যান’ নামে চেনে!
কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সময় দৌড়ের প্রতি কারনাযেসের ভালোবাসা শুরু। প্রথম দিকে মূল রাস্তা ধরে বাড়ি থেকে স্কুল, স্কুল থেকে বাড়ি পর্যন্তই ছিল তার দৌড়ানোর দূরত্ব। এরপর পরিমাণ বাড়িয়ে তিনি বিভিন্ন পথ ধরে দৌড়ানোর এই ধারাটি অব্যাহত রাখেন। তখন থেকেই আস্তে আস্তে নিজের সক্ষমতাকে বিভিন্নভাবে ঝালিয়ে নেন তিনি। মাত্র এগারো বছর বয়সে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের পছন্দের লিস্টে থাকা, চক্রাকারে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভ্রমণ করা সহ ইউনাইটেড স্টেটস সংলগ্ন সবচাইতে বড় পর্বত ‘মাউন্ট হুইটনি’র শিখরেও পৌছান কারনাযেস। বারোতম জন্মদিনে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে সাইকেলে ৬৪ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়ে তার দাদার বাড়ি পৌঁছানোর রেকর্ড ছিলো তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো।
জুনিয়র হাই স্কুলে থাকাকালীন কারনাযেস কোচ জ্যাক ম্যাকট্যাভিসের শরণাপন্ন হন। দৌড়ের ব্যাপারে জ্যাকের মূলমন্ত্র ছিল ‘Go out hard and finish harder’। সে সময় সেন্ট এন্টিনিউ কলেজের আয়োজনে হওয়া এক মাইল দূরত্বের ‘ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট লং ডিসটেনস চ্যাম্পিয়নশিপে’ ডিন চ্যাম্পিয়ন হন। তখন জ্যাক তাকে অভিবাদন জানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কেমন লাগছে?” উত্তরে ডিন বলেছিলেন, “কষ্টসাধ্য জিনিসের জন্য বের হওয়াই একমাত্র সঠিক এবং করণীয় কাজ। এতে চমৎকার কিছু অনুভব হয়।”
এর কিছুদিন পর বাবা নিক কারনাযেসের চাকরির সুবাদে ডিনের পরিবার সান ক্লেমেন্টে স্থানান্তরিত হয়। ডিন তখন সান ক্লেমেন্ট হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭৬ সালে শিক্ষানবিশ হিসেবে ব্যানার্স কামিংস নামের একজন কোচের আন্ডারে ক্রস-কান্ট্রি ম্যারাথনের একটি দলের সাথে যোগ দেন তিনি। ঐ সিজনে ডিন সর্বাধিক অনুপ্রেরণীয় দৌড়বাজ হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেন।
পরবর্তীতে সেই বছরেই ডিন প্রথমবারের মতো এনডুরেন্স ইভেন্টে যোগ দেন। ঐ ইভেন্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুস্থ, অবহেলিত শিশুদের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করা। ‘এক ল্যাপ, এক ডলার’ শ্লোগানের ঐ ইভেন্টে ডিন একশত পাঁচ ল্যাপ দৌড়ান, যেখানে তার সহপাঠীরা মাত্র ৮/১০ ল্যাপ করে দৌড়াতে সক্ষম হয়। হাই স্কুলে পাঠ থাকার সময়েই কোচের সাথে ভালো সম্পর্ক না থাকায় পুরো পনেরো বছরের জন্য দৌড়ানো বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে ফিরেও আসেন নতুন উদ্যমে। এসেই বাজিমাত করতে থাকেন পুরনো গতিতে।
২০০৫ সালে ঘুমহীন ৮০ ঘণ্টা ৪৪ মিনিটে ৫৬০ কিলোমিটার বা ৩৫০ মাইল দৌড়ানোর মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী আলোচিত হন ডিন। তার আগের রেকর্ডগুলোর তুলনায় এই দূরত্ব ছিল বিশাল। আর দৌড়পাড়ায় এটিকে সবচাইতে কঠিন এবং ক্ষতিকর দৌড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাড়ে তিন দিনের এই দৌড়ে তিনি গড়ে প্রতি তের মিনিটে এক মাইল করে দৌড়ান। এই দৌড়ের মূল লক্ষ্য ছিল নিজের সক্ষমতাকে যাচাই করা এবং বাচ্চাদের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করা। তিন দিন দৌড়ের পর Runnersworld নামের একটি ম্যাগাজিনের কাছে ফোনে তিনি বলেন, “আমার মনে হচ্ছে আমি ট্রেন দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছি। প্রত্যেকটা কোষে ব্যথা লাগছে। তবে গত দিনের থেকে ভালো অনুভব করছি। আমার আরও দৌড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। সর্বশেষ আমার ইচ্ছে আছে পুরো পাঁচশত মাইল একটানা দৌড়ানোর, এবং মনে হচ্ছে এটা করা সম্ভব। কিন্তু এই অভিজ্ঞতার পরে মনে হচ্ছে, এই দূরত্ব অতিক্রমের জন্য আমার থেকেও একজন ভালো দৌড়বিদ প্রয়োজন।”
পরবর্তীতে ২০০৬ সালে পরপর পঞ্চাশ দিনে ইউনাইটেড স্টেটসের পঞ্চাশটি ম্যারাথনে দৌড়ান ডিন। প্রায় এগারো-বারের মতো এককভাবে ক্যালিসটোগা থেকে সান্তা ক্রুজ পর্যন্ত ৩২০ কিলোমিটার দৌড়, ২০০২ সালে দক্ষিণ মেরুতে মাইনাস ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় স্নো-শ্যু ছাড়া দৌড়ানো সহ অসংখ্য রেকর্ড রয়েছে তার। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে উত্তপ্ত জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ডেথ ভ্যালি’তে ৪৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২১৭ কিলোমিটার দৌড়ে ‘বেডওয়াটার আল্ট্রাম্যারাথন’-এ চ্যাম্পিয়ন হওয়া। এছাড়াও ১৯৯৫ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত টানা এগারোবারের মতো ‘একদিন, একশত মাইল’ শ্লোগানে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘ওয়েস্টার্ন স্টেটস এনডুরেন্স রান’ এর ব্ল্যাক হোল্ডার তিনি। সাম্প্রতিককালে ২০১১ সালে ডিন মাত্র পঁচাত্তর দিনে ডিজনিল্যান্ড থেকে নিউইয়র্ক সিটি পর্যন্ত পুরো তিন হাজার মাইল দৌড়ান। এর জন্য তাকে দৈনিক গড়ে ৪০/৫০ মাইল দৌড়াতে হয়।
এছাড়াও এই ৫৪ বছর বয়সী অতিমানবীয় পর্যায়ের দৌড়বাজের ঝুড়িতে এতশত আকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি রয়েছে যেগুলো অধিকাংশ দৌড়বিদ স্বপ্নে দেখেই আত্মতৃপ্তি লাভ করে। যেমন- ডিন ২০০৫, ২০০৬ এবং ২০০৮ সালে ‘কমপিটিটর ম্যাগাজিন’ এর ‘এনডুরেন্স অ্যাথলেট অফ দ্য ইয়ার’ লাভ করেন। ২০০৭ সালে ESPN ESPY এর ‘বেস্ট আউটডোর অ্যাথলেট’ অ্যাওয়ার্ড জয়ী হন এবং একই সালে ম্যান’স জার্নালের ‘অ্যাডভেঞ্চার হল অফ ফেম’ লাভ করেন।
এই লম্বা দূরত্ব দৌড়ে অতিক্রম করার ব্যাপারে নানান দৌড়বিদের নানান দর্শন রয়েছে। এ ব্যাপারে ডিন বলেন “I run because long after my footprints fade away, maybe I will have inspired a few to reject the easy path, hit the trails, put one foot in front of the other, and come to the same conclusion I did: I run because it always takes me where I want to go.” তার মতে, দৌড়ানোর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়, যা আরো ভালভাবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সাহায্য করে। তিনি হৃদয় দিয়ে দৌড়ানোর কথা বলেন। হাল ছেড়ে না দিয়ে সামনে আগানোর কথা বলেন। বলেন, “Run when you can, walk if you have to, crawl if you must. But never give up.”
দৌড়ানোর পাশাপাশি ডিন মোটিভেশনাল স্পীকার হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী তার লেখা বই ‘Ultramarathon Man: Confessions of an All-Night Runner’ এর লেখক হিসেবে বেশ খ্যাতি লাভ করেন। তার লেখা আরো তিনটি বই, The Road to Sparta: Reliving the Ancient Battle and Epic Run that Inspired the World’s Greatest Footrace, 50/50: Secrets I Learned Running 50 Marathons in 50 Days, Run: 26.2 Stories of Blisters and Bliss পাঠক সমাজে বেশ সমাদৃত।
তথ্যসূত্র এবং ছবি
১) en.wikipedia.org/wiki/Dean_Karnazes
২) runnersworld.com/elite-runners/dean-karzes-runs-350-miles
৩) ultramarathonman.com