বিশ্বায়নের পৃথিবীতে ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতায় দিনকে দিন মানসিক অবসাদ ও অবসাদ থেকে সংঘটিত আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আক্রান্তের মধ্যে রয়েছেন প্রায় সব বয়সের মানুষ। আত্মহত্যার কারণ অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে জড়িয়ে থাকে দীর্ঘ অবসাদযুক্ত ইতিহাস।
একজন ব্যক্তির আত্মহত্যাকে মুক্তি হিসেবে ভেবে নেওয়ার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। হতে পারে সারাজীবন ধরে তথাকথিত সমাজের চোখে ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছেন তিনি অথবা ভালোবাসার মানুষটি ছেড়ে চলে গেছে অথবা খুব কাছের কেউ চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তার সঙ্গে। মানসিক অবসাদে ডুবে যেতে যেতে সেই মানুষটি তখন চারপাশের কাউকেই হয়ত আর বন্ধু হিসেবে পাননি, যাকে এসব কথা তিনি মন খুলে বলে একটু হালকা হতে পারবেন। এবং এমনই এক মুহূর্তে নিজের মূল্যবান জীবনকে নিজের হাতে শেষ করে দেওয়ার করুণ পদক্ষেপটি নিয়ে ফেলেন সেই ব্যক্তি।
আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে মানুষের অজান্তেই তৈরি হয়ে যায় নানা ‘সুইসাইড স্পট’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, সুউচ্চ কোনো জায়গা যেমন পাহাড়ি খাদ বা রেলব্রিজ বা নদীব্রিজ, সুইসাইড স্পটের তকমা পেয়ে থাকে। দিনের পর দিন সেখানে সুইসাইডের ঘটনা ঘটতে থাকলে স্থানীয়রা জায়গাটিকে সুইসাইড স্পটের আখ্যা দেন।
ধরা যাক, সেই ব্যক্তিটি এমনই কোনো এক সুইসাইড স্পটের কাছাকাছি পৌঁছে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পা বাড়াচ্ছেন, এমন সময়ে হঠাৎ মিষ্টি গলায় কেউ হয়ত এসে তাকে বিনীত স্বরে বললেন- ‘চলুন না, আমার বাড়িতে একটু চা খাবেন।’ অবসাদগ্রস্ত মানুষটি যেটুকু ভালোবাসার জন্য গুমরে মরেছেন এত কাল, মৃত্যুর একদম প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে এই কয়েকটি কথা তাকে এক মুহূর্তে অনেক কিছু ফিরিয়ে দিতে পারে।
জীবন শেষ করে দিচ্ছিলেন যিনি, তিনি আবারও জীবনে ফিরে আসতে পারেন দারুণভাবে। আর তার এই ফিরে আসাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার হয়ে উঠে ওই হাসিমুখ মানুষটির কাছে, যিনি কেবলমাত্র ওই একটি বাক্যেই জাদুর স্পর্শ বুলিয়ে দিয়ে গেলেন।
শুনে বিস্ময়কর লাগতে পারে, কিন্তু এমন একটি কাজ একজন মানুষ বছরের পর বছর করে গিয়েছেন। বস্তুত, তার জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এমন বহু মানুষকে জীবনের পথে ফিরিয়ে এনেছেন।
না, তিনি কোনো মনোবিদ ছিলেন না, মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গভীর গবেষণা তিনি করেননি, আত্মহত্যা ঠেকানোর কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণও তিনি নেননি। কেবলমাত্র জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই সন্ধান পেয়েছিলেন মানুষের মনের গোপনতম আকাঙ্খাটির।
মানুষটির নাম ডোনাল্ড টেলর রিচি। ডাকনাম ডন। যে দেশের আরেকজন ডনের কথা বিশ্বনন্দিত, সেই অস্ট্রেলিয়ারই বাসিন্দা ছিলেন এই ডন। সিডনিতে ওয়াটসন্স বে শহরের কাছে থাকতেন ডন। বাড়ির কাছেই সুনীল তাসমান সাগর। আর তাসমান সাগরের দিকে মুখ করে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে পাথুরে বাঁধ, যার পোশাকি নাম ‘দ্য গ্যাপ’। সাগরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কিন্তু এর খ্যাতি (বা কুখ্যাতি) নৈসর্গের জন্য নয়, অন্য একটি কারণে। উনবিংশ শতাব্দী থেকে অবসাদগ্রস্ত অস্ট্রেলিয়াবাসীর কাছে আত্মহত্যা করার পয়লা নম্বর ঠিকানা এই গ্যাপ। খাদের ধারে রয়েছে একটি তিন ফুট উঁচু রেলিং, যা অনায়াসেই পেরিয়ে যাওয়া যায়। যেন জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধান-মাত্র তিন ফুট!
২০১২ সালের ১৩ই মে ছিয়াশি বছর এগারো মাস বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার আগ অবধি সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির ড্রয়িংরুম থেকে রেলিংয়ের দিকে নজর রাখা ছিল ডনের প্রতিদিনের অভ্যাস। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই তড়িঘড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটতেন তিনি। তারপর মধুর গলায় হতভাগ্য মানুষটিকে বলতেন- ‘এক্সকিউজ মি, আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?’
তারপরেই চা অথবা বিয়ার পানের নিমন্ত্রণ জানাতেন নিজের বাড়িতে। শুনতে চাইতেন মানুষটির জীবনের গল্প। আশ্বাস দিতেন, যতটা সম্ভব তিনি সাহায্য করবেন। এইভাবে পঁয়তাল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডন বাঁচিয়েছিলেন বহু মানুষের জীবন। সরকারি মতে সংখ্যাটা একশো ষাট। কিন্তু, বেসরকারি মতে, চারশো থেকে পাঁচশোও হতে পারে। তবে সংখ্যা নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাননি ডন। প্রতিদিন ওই অভিশপ্ত জায়গাটির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখাকে নিজের কর্তব্য বলেই মনে করেছেন বরাবর।
ডোনাল্ডের জন্ম ১৯২৫ সালের ৯ই জুন, পূর্ব সিডনির ভক্লুজ শহরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান নেভির যুদ্ধজাহাজ এইচএমএএস হোবার্টে সিম্যান হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর জাপানি সেনা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করল। প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল অবশেষে। সেই ঐতিহাসিক ঘটনা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ডন। যুদ্ধের পর জীবনবীমা কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯৬৪ সালে ওয়াটসন্স বে শহরে ওল্ড সাউথ হেড রোডের একটি বাড়ি কেনেন তিনি। বাড়ির উল্টোদিকেই কুখ্যাত গ্যাপ। নতুন ঠিকানায় উঠে আসার পর থেকেই লক্ষ্য করতে শুরু করেন, বহু মানুষই জায়গাটির নিসর্গ উপভোগ করতে আসেন, কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই যেন নিমেষে হাওয়ায় মিলিয়ে যান। কৌতূহলী ডন অনুসন্ধান করে জানতে পারেন আসল কারণ। সেই শুরু হয় তার প্রতিদিনের প্রহরা। বাড়ির ড্রয়িংরুম থেকে সোজা দেখা যেত রেলিংটাকে। এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছিলেন ডন।
জোয়ান বয়সে শারীরিক শক্তিকে কাজে লাগাতেন ডন। রেলিং টপকে অবসাদগ্রস্ত মানুষটিকে একরকম জোর করেই টেনে আনতেন খাদের প্রান্ত থেকে। সেই ফাঁকে পুলিশে খবর দিতেন তার স্ত্রী ময়া। একবার এক মহিলাকে বাঁচাতে গিয়ে বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলেন ডন। নিজেকে শেষ করে দিতে সেই মহিলা বদ্ধপরিকর, আর তাকে সর্বশক্তি দিয়ে নিজের দিকে টেনে আনছেন ডন। অবশেষে তিনি সফল হয়েছিলেন। সামান্য ভুল হলেই জীবন চলে যেত তার।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে শারীরিক শক্তি যখন কমে এল, তখন এই কথা বলার পন্থা নেন, তবে ওই ঘটনার পর থেকে খানিক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই কথা বলতেন তিনি। পরবর্তীকালে মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত পরিষেবা আসার ফলে তার পক্ষেও অনেকটা সুবিধা হয়েছিল। সহজেই উদ্ধারকারী দলকে ডেকে আনতে পারতেন তারা। যাদের বাঁচাতেন, তাদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে চা অথবা বিয়ার সহযোগে তার সঙ্গে গল্প করতে বসতেন ডন ও তার স্ত্রী ময়া।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবসাদের কারণ হিসাবে দেখা যেত, জীবনে ব্যর্থতা কিংবা দীর্ঘদিন কোনো অসুখের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে অতিরিক্ত ওষুধ সেবনের ফলে জীবনের প্রতি আশা হারিয়ে ফেলেছে তারা। হেসে হেসে তাদের সঙ্গে কথা বলতেন স্বামী-স্ত্রী। কখনোই কাউন্সেলিং বা গভীর পরামর্শ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করতেন না তারা। দুজনে বিশ্বাস করতেন, মানুষকে একটু ভালবাসা ও উৎসাহ দিলেই সে আবার বাঁচার অর্থ খুঁজে পায়।
অবশ্য সবসময় যে সফল হতেন, তা নয়। অনেক সময়ই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্যাপে পৌঁছতে যেটুকু সময় লাগে, তার মধ্যেই ঘটে যেত মর্মান্তিক ঘটনা। ডন গিয়ে হয়ত দেখতে পেতেন, তাদের ব্যবহার্য ওয়ালেট, ঘড়ি বা চশমাগুলো শুধু রয়েছে, কিন্তু নীরব সাক্ষী জড়বস্তুগুলোর মালিকরা আর নেই।
একবার একজন ভদ্রলোক ক্রাচ নিয়ে এসেছিলেন। ডন যতক্ষণে গিয়ে পৌঁছান, ততক্ষণে শুধু ক্রাচ দুটোই রয়ে গেছে সদ্যমৃত মানুষটার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। এক সন্ধায় এক যুবককে রেলিং টপকাতে দেখে ঠিক সময়ে পৌঁছে যান ডন। তারপর প্রায় আধঘণ্টা ধরে তার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেন। তার মনে হয়েছিল, তিনি হয়তো তার কর্তব্যে সফল হতে পেরেছেন, কিন্তু যে মুহূর্তে ডন ছেলেটিকে বাড়িতে চা-পানের নিমন্ত্রণ জানান, প্রত্যুত্তরে সে ‘না’ জানিয়ে সোজা হেঁটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে খাদে। তাকে বাঁচানোর কোনো সুযোগই আর পাননি ডন।
পরে আবিষ্কার করেন, ছেলেটি তারই প্রতিবেশি ছিল, তার নাতনিদের সঙ্গে ছোটবেলায় কতই না খেলাধুলা করেছে। এমন ঘটনা যেকোনো মানুষকেই প্রবলভাবে নাড়িয়ে দেবে। কিন্তু ডন এই বিষয়ে আর পাঁচজনের চেয়ে বেশ আলাদাই। ব্যর্থতা তার মনকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারেনি কোনোদিন। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছেন এই ভেবে যে, এর বেশি আর তার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। এই সান্ত্বনা থেকেই হয়তো আবারো পরদিন কাউকে বাঁচানোর মানসিক শক্তি অর্জন করতেন তিনি।
বরাবর আড়ালে থাকতেই পছন্দ করতেন সদাহাস্য মানুষটি। ২০০৬ সালে তিনি মেডেল অব অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া সম্মানে ভূষিত হন। ২০১০ সালে স্থানীয় উলাহারা কাউন্সিলের তরফ থেকে ডন ও ময়াকে বর্ষসেরা নাগরিক খেতাব দেওয়া হয়। পরের বছর ন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ডে কাউন্সিল তাকে ‘বর্ষসেরা স্থানীয় নায়ক’ পুরস্কার প্রদান করে।
তবে রিচি দম্পতি সবচেয়ে বড় পুরস্কার বোধহয় তখনই পেতেন, যখন সেইসব মানুষেরা তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানাতে আবার ফিরে আসতেন অনেকদিন পরে। তেমনই একজন তাকে একটি দেবদূতের ছবি উপহার পাঠিয়েছিলেন। সেই ছবিতে লেখা ছিল- ‘আমাদের মধ্যে থাকা একজন দেবদূত’। কিংবা সেই মেয়েটি, যে কিনা পরে ফিরে এসেছিল এক বোতল শ্যাম্পেন নিয়ে, নিয়মিত পাঠাত ক্রিসমাস কার্ড।
অবসাদে ভুগত মেয়েটি। চিকিৎসাও চলছিল তার। কিন্তু চিকিৎসা-পদ্ধতিতে ঠিক বিশ্বাস রাখতে পারছিল না সে। দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে সে। জুতো খুলে যে মুহূর্তে ঝাঁপ দিতে যাবে, সেই মুহূর্তেই এসে পড়েন গ্যাপের দেবদূত। চা-টোস্ট খেতে খেতে ময়া তাকে পরামর্শ দেন, অন্য কোনো ডাক্তারকে দেখাতে। কয়েক মাস পরেই কৃতজ্ঞতা জানাতে ফিরে এসেছিল মেয়েটি। ফরাসী পানীয়ের বোতলের সঙ্গে দিয়ে গিয়েছিল একটি পোস্টকার্ড। তাতে লেখা- ‘আমার জীবনে আপনারা যে গুরুত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপ করলেন, সে কথা আমি কোনোদিন ভুলব না। আমি ভালো আছি।’
এই যান্ত্রিক, স্বার্থপর পৃথিবীতে মানুষ যেখানে নিজের কথা ভাবতেই সবসময় ব্যস্ত, যেখানে দুর্ঘটনা-আক্রান্ত মুমূর্ষুকেও এড়িয়ে চলে যায় পথচলতি মানুষ, সেরকম সময়ে দাঁড়িয়ে ডন প্রকৃত অর্থেই একজন দৃষ্টান্ত। যে কাজটা তিনি করতেন অত্যন্ত সহজভাবে, সেই আপাত-সহজ কাজটাই যে করে দেখানো বড় কঠিন। বিশেষত, দিনের পর দিন এক উদ্বেগ নিয়ে বাঁচা, এই বুঝি আবার কেউ মরতে এল। কিন্তু ডন বা ময়া বুঝি অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। এমন একটি অভিশপ্ত জায়গার এত কাছে থাকা তাদের কাছে মনে হয়েছে সৌভাগ্যের। কারণ, এত মানুষকে তারা যে সাহায্য করতে পারছেন তা তো এখানে না থাকলে করতে পারতেন না। তাই বোধহয় ডনের মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করেছিল প্রায় সমগ্র অস্ট্রেলিয়াই।
নিজের এই কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে জীবনবীমা কোম্পানির প্রাক্তন কর্মচারীটি মজা করে বলতেন- ‘আমি তো একজন সেলসম্যান ছিলাম আর তাই ওদের জীবন বিক্রি করেছি।’