ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর মৃত্যুর পর যারা ইসলামি সাম্রাজ্যের হাল ধরেন তাঁরাই ছিলেন খলিফা। প্রথম চারজন শাসককে বলা হয় খলিফায়ে রাশিদুন (‘সঠিক দিকে পরিচালিত খলিফাগণ’)। তারা ছিলেন হযরত আবু বকর (রা), হযরত উমার (রা), হযরত উসমান (রা) ও হযরত আলী (রা)। রোর বাংলার পাঠকদের উদ্দেশ্যে আমরা এ চারজনের শাসনকালীন জীবনের নানা দিক তুলে ধরব ধারাবাহিকভাবে।
প্রথমেই যার কথা আসবে তিনি হলেন হযরত আবু বকর (রা)। হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর ওফাতের পর ইসলামি দুনিয়া কী কী বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল? কেন অনেক গোত্র ইসলাম ত্যাগ করেছিল? কেন ‘ভন্ড’ নবীদের আবির্ভাব হয়েছিল? কীভাবে এগুলোর দমন করেন তিনি? আর কীভাবেই বা আবু বকর (রা) মারা যান? কেনই বা তার নাম আবু বকর? এমন অনেক রকম প্রশ্ন অনেকের মাথায় ঘুরে থাকে। চলুন খলিফা আবু বকরের (রা) শাসনামল থেকে ঘুরে আসি।
প্রথমেই আমরা নামের বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে নেই। আবু বকর (রা) এর আসল নাম কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন আবু কুহাফা (عبد الله بن أبي قحافة)। তাঁর জন্ম সম্ভবত ৫৭৩ সালের ২৭ অক্টোবর, অর্থাৎ নবীজীর (৫৭০ সাল) একদম কাছাকাছি। তাঁর উপাধি ছিল ‘সাদিক’ (সত্যবাদী) এবং ‘আতিক’ (দোযখের আগুন থেকে আল্লাহ্ কর্তৃক রক্ষাপ্রাপ্ত)। ছোটবেলায় তিনি অন্যান্য আরব শিশুদের মতো বেদুইনদের মাঝে খেলা করতেন উট নিয়ে। উট খুবই পছন্দ করতেন তিনি। ছাগল আর উটের বাচ্চা নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত ভালোবাসার জন্য লোকে তাঁর নাম দেয় ‘আবু বকর’, বা ‘উটের বাচ্চার বাবা’।
তাবারির বর্ণনা থেকে আমরা পাই, শুভ্র ত্বকের অধিকারী আবু বকর দেখতে হালকা পাতলা ছিলেন। প্রশস্ত দাঁড়ি, বড় কপাল। যতটুকু হাত দেখা যেত তাতে লোম চোখে পড়ত না।
অন্যান্য সাম্রাজ্যের মতো কি ইসলামেও নেতৃত্ব রক্তের সম্পর্কের মাধ্যমে স্থলাভিষিক্ত হবে, নাকি অভিজ্ঞতায় বলিষ্ঠতা কার বেশি সেটা দেখা হবে? যদি রক্তের সম্পর্কই মানা হয় তবে মুসলিম বিশ্বের প্রথম খলিফা হবার কথা ছিল হযরত আলী (রা) এর, যিনি ছিলেন নবী (সা) এর চাচাতো ভাই। তিনি আলী (রা) এর মর্যাদার কথা বলে থাকলেও স্পষ্ট করে কখনো এ বাক্য বলে যাননি– “আমার পরে আলীই হবে প্রথম খলিফা“, এবং এ কারণেই যত চিন্তা শুরু হয়। এ ব্যাপারে আলী (রা)-কে নিয়ে লেখা এ সিরিজের চতুর্থ পর্বে বিস্তারিত পড়তে পারবেন।
মক্কা থেকে যারা হিজরত করে মদিনা গিয়েছিলেন তারা ছিলেন ‘মুহাজির’, আর যারা তাদের সাহায্য করেছিলেন তাদের বলা হতো ‘আনসার’। যতদিন হযরত মুহাম্মাদ (সা) জীবিত ছিলেন, ততদিন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথেই সমস্যা শুরু হলো। মদিনার ‘সাকিফা’ নামের এক বাসায় মদিনার আনসার নেতারা মিলিত হন। এ বাসাটা আগে ইহুদীদের ছিল। তারা মিলিত হয়েছিল আলোচনা করবার জন্য যে তারা কাকে নেতৃত্ব দেবেন। অনেকটা যেন গৃহযুদ্ধ কিংবা অন্তত শীতল যুদ্ধ হতে চলেছে, খলিফা কি আনসারদের থেকে হবেন নাকি মুহাজিরদের থেকে? আনসারদের পছন্দ ছিলেন সাদ বিন উবাদাহ (রা)।
এ ব্যাপারে জানবার সাথে সাথেই আবু বকর (রা), উমার (রা) প্রমুখ ছুটে গেলেন সেখানে। সেখানে প্রস্তাব করা হয় আবু বকর (রা)-এরই খলিফা হওয়া উচিৎ। কারণ তিনি সবচেয়ে অভিজ্ঞ, আর নবীজীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, বিপদের বন্ধুও বটে। (উল্লেখ্য, আলী (রা) এর বয়স তখন যথেষ্ট কম, প্রায় ৩২)। সংক্ষেপে ঘটনা হলো, উমার (রা) এর পর একে একে বাকিরা খলিফা হিসেবে আবু বকর (রা)-কে মেনে নেন। উল্লেখ্য, যখন আবু বকর (রা) আর উমার (রা) এই আসন্ন একটি গৃহযুদ্ধ প্রতিহত করবার চেষ্টা করতে ব্যস্ত ছিলেন, তখন আলী (রা) নবী করীম (সা) এর জানাজার প্রস্তুতি এবং সেই সংক্রান্ত কাজ করছিলেন।
খলিফা হিসেবে আবু বকর (রা) এর জীবন শুরু হয় ৬৩২ সালের ৮ জুন, এবং তাঁর শাসনের সময়কাল ছিল ২৭ মাস।
হযরত মুহাম্মাদ (সা) মৃত্যুর আগে মক্কা প্রায় রক্তপাতহীনভাবে বিজয় করবার পর ইসলামকে আরবের বৃহত্তম শক্তি হিসেবে মেনে নেয় আরবের অনেক গোত্রই। কিন্তু এই আনুগত্য যেন অনেকটাই ছিল রাজনৈতিক, ক্ষমতার পক্ষে থাকবার জন্য। সেজন্যই নবী (সা) এর মৃত্যুর পর অনেক গোত্রই ইসলাম ত্যাগ করে। মক্কা, মদিনা, ওমানের আব্দুল কাইস গোত্র আর তায়েফের সাকিফ গোত্র ব্যতীত বেশিরভাগ জায়গাতেই এ ইসলাম ত্যাগের প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ যাকাত দেয়া থেকে বিরত থাকে। মুসলিম বিশ্বের ঐক্যতা রক্ষার জন্য এই ইসলাম ত্যাগ দমন করতে আবু বকর (রা) যে যুদ্ধ করেন সেটাকে বলা হয় ‘রিদ্দা যুদ্ধ‘। এ যুদ্ধে তিনি সফল হন, বেশিরভাগ গোত্রই পরাজিত হয়, এবং ইসলামি বিশ্বে ফিরে আসে।
ইসলাম ত্যাগের আরো একটা কারণ ছিল ভণ্ড নবীদের আবির্ভাব। হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর অভাবনীয় সাফল্য দেখে আরবের অনেকেই নিজেদের নবী বলে দাবি করতে থাকে। তারা আবু বকর (রা) এর কাছ থেকে ক্ষমতার ভাগাভাগি চেয়ে বসে। যেমন, বনু হানিফা-র মুসাইলিমা বিন হাবিব নামের একজন হাতের জাদুতে পারদর্শী ছিলেন; তাঁর দাবি ছিল তিনিও নবী। আল ইয়ামামা নামক স্থানে আবু বকরের (রা) এর বাহিনীর সাথে মুসাইলিমার যুদ্ধ হয় (৬৩২ সালের ডিসেম্বর মাসে)। মুসলিমদের নেতৃত্ব দেন খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) এবং এ যুদ্ধে মুসাইলিমা নিহত হন। কিন্তু মুসলিমদের পক্ষে মারা যান ৮০০ জন কুরআনের হাফেজ!
এতজন হাফেজ মারা যাওয়াতে উমার (রা) অস্থির হয়ে পড়েন কুরআনের সংরক্ষণের বিষয়ে। তিনি এ বিষয়ে আবু বকর (রা)-কে পরামর্শ দেন। তখন আবু বকর (রা) হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা)-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। কারণ যায়দ (রা) হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর প্রধান ওহী লেখক ছিলেন। এ কমিটিতে ছিলেন কুরআনের হাফেজগণ। কুরআনের সকল আয়াত সংগ্রহ করবার পর সেগুলো পরস্পর তুলনা করেন তারা। পুরোপুরি সন্তুষ্ট হবার পর তারা একটি কপিতে কুরআন লিপিবদ্ধ করেন। সেটা হযরত মুহাম্মাদ (সা) মারা যাবার মাত্র এক বছর পরের কথা। বেশিরভাগ সাহাবীই তখন জীবিত। কুরআনের এই কপিটি হযরত আবু বকর (রা) দিয়ে গিয়েছিলেন হযরত উমার (রা)-কে।
অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ মিটে যাবার পর আবু বকর (রা) ইসলামি বিশ্ব সম্প্রসারিত করবার দিকে মনোযোগ দেন। তিনি ইরাক দিয়ে শুরু করেন, কারণ সেটি ছিল সাসানীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ধনী অঞ্চল। ৬৩৩ সালে তিনি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) এর অধীনে বাহিনী প্রেরণ করেন ইরাকে। এমনকি তিনি প্রবল পরাক্রমশালী রোম সাম্রাজ্যের সিরিয়া প্রদেশে চারটি বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। তবে এই মিশনগুলো তিনি কেবল শুরু করে দিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী শাসকদের আমলে সেগুলো বেশি ফলপ্রসূ হয়েছিল এবং ইসলামি বিশ্ব আরও সম্প্রসারিত হয়েছিল।
হযরত উমার (রা) একবার এক বৃদ্ধা মহিলার খোঁজ পেলেন যাকে দেখা-শোনা করবার কেউ ছিল না। মহিলাটি আবার অন্ধও ছিলেন। ফজরের নামাজ শেষ করেই তিনি মহিলার বাসায় গেলেন, গিয়ে দেখলেন তাঁর বাসা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, টিপটপ! পর পর সাত দিন তিনি একই ব্যাপার খেয়াল করলেন, কে যেন আগেই এসে এই অন্ধ মহিলার বাসা পরিষ্কার করে যান। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলে তিনিও বলতে পারলেন না, কে যেন এসে করে দিয়ে যায় কাজগুলো, অন্ধ মানুষ, দেখতেও পারেন না।
একদিন উমার (রা) ফজরের আগেই ঐ বাসার সামনে উপস্থিত হলেন। অবাক বিস্ময়ে তিনি লক্ষ্য করলেন লোকটি আর কেউ না, স্বয়ং খলিফা হযরত আবু বকর (রা)! তিনি ঘর ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করে বেরিয়ে আসছেন দরজা দিয়ে। সকলের অলক্ষ্যে, কেউ যেন না জানে সেজন্য এই ফজরের সময়টা বেছে নিয়েছিলেন তিনি। এমনই মানবদরদী ও পরোপকারী ছিলেন হযরত আবু বকর (রা)।
৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট হযরত আবু বকর (রা) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বার্ধক্যজনিত এ রোগ থেকে আর সুস্থ হয়ে উঠেননি। প্রচণ্ড জ্বরে তিনি বিছানায় পড়ে থাকতেন, বুঝতে পারতেন তাঁর সময় শেষ হয়ে এসেছে। তিনি তখন হযরত আলী (রা)-কে ডেকে পাঠান এবং অনুরোধ করেন যেন তিনি তাঁর জানাজার আগে গোসল করিয়ে দেন লাশকে, কারণ হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর ক্ষেত্রে আলী (রা)-ই কাজটি করেছিলেন।
মৃত্যুর কিছু আগে, তিনি পরামর্শ দেন যে, হযরত উমার (রা) পরবর্তী খলিফা হতে পারেন, আবার যেন মুসলিম জাতি সমস্যায় না পড়ে সেজন্য।
আবু বকর (রা) মেয়ে আইশা (রা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, নবীজীর (সা) জন্য কয় টুকরো কাপড় লেগেছিল দাফনের সময়। আইশা (রা) উত্তর দিলেন, তিন টুকরো। তখন আবু বকর (রা) নিজের জন্যও তিন টুকরো কাপড় দিয়ে কাফন করতে বলেন। ৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট আবু বকর (রা) ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাজার নামাজ পড়ান হযরত উমার (রা)।
তিনি চেয়েছিলেন তাঁর কবর যেন নবী (সা) এর পাশেই হয় এবং মুসলিমরা তাঁকে সেখানেই সমাহিত করেন। মদিনার মসজিদে নববীতে গেলে হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর কবরের ঠিক পাশেই এখনও হযরত আবু বকর (রা) এর কবর দেখতে পাওয়া যায়।
রোর বাংলার পাঠকদের জন্য এর পরের পর্বে তুলে ধরা হবে হযরত উমার ফারুক (রা)-এর শাসনামলের ইতিবৃত্ত থেকে শুরু করে কেন ও কীভাবে তিনি আততায়ীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন সে ঘটনা।
পরের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: হযরত উমার (রা)।
ফিচার ইমেজ: WallpaperTag