আল্লা-হু আকবর
আল্লা-হু আকবর
আশহাদু আল্ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
আশহাদু আন্ না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ …
মধুর আযানের ধ্বনিতে সমগ্র ধর্মপ্রাণ মুসলিমের হৃদয় আকুল হয়। যে মানুষটি সর্বপ্রথম এই পবিত্র আযান কন্ঠে ধারণ করেছিলেন তাঁর নাম হযরত বিলাল (রা), ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন। আজ আমরা তাঁর জীবন কাহিনী জানবো, জানবো ইসলামের জন্য আমৃত্যু লড়াই করে যাওয়া এক সাহসী যোদ্ধার কথা।
হযরত বিলাল (রা) জন্ম নেন সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরীতে। জাতিতে তিনি একজন আফ্রো-আরব। পিতার নাম রাবাহ আর মায়ের নাম হামামা। তাঁর পিতা একজন ক্রীতদাস হলেও মা হামামা ছিলেন শাহজাদী। শাহজাদী কেমন করে গোলামের স্ত্রী হলো সেটা জানতে হলে আমাদের আরেকটু পিছনে ফিরে যেতে হবে।
শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। সেই বছরই আবিসিনিয়ার বাদশা আবরাহা তার বিরাট হস্তি বাহিনী নিয়ে পবিত্র মক্কা নগরী আক্রমণ করে। হস্তি বাহিনীর ভয়ে আরবরা ভয়ে আতঙ্কিত হলেও আল্লাহর ঘর রক্ষা করার ব্যবস্থা করলেন আল্লাহ নিজেই। হস্তিবাহিনীসহ আবরাহা পরাস্ত হল। এই ঘটনার কথা মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন শরীফে সূরা ফিলে উল্লেখ করা আছে। আরবি ‘ফিল’ শব্দের বাংলা অর্থ ‘হাতি’।
যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আবরাহার সমস্ত বাহিনী পালিয়ে গেলো। যারা পালাতে পারলো না তারা আরবদের হাতে বন্দী হলো। এই বন্দীদেরই একজন ছিলেন বিলাল (রা) এর মা হামামা। হামামা ছিলেন স্বয়ং বাদশাহ আবরাহার ভাতিজী। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে হলেন দাসী। সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের এক ব্যক্তি খলফের ঘরে তার স্থান হলো বাঁদী হিসেবে। সেখানেই আবিসিনিয়ার আরেক দাস রাবাহ কাজ করতো। তাদের বিয়ে হয় এবং তাদের ঘরেই জন্ম নেন ইসলামের একনিষ্ঠ কাণ্ডারি হযরত বিলাল (রা)।
হযরত বিলাল (রা) এর চেহারা মুবারকের যে বর্ণনা বিভিন্ন বই পুস্তকে লিপিবদ্ধ রয়েছে তা থেকে জানা যায়, একজন আফ্রো-আরব হিসেবে তাঁর গায়ের রং ছিলো কালো, দেহের গঠন ছিলো লম্বা, মাথার ঘন কালো চুলে তিনি লাল খিজাব ব্যবহার করতেন।
বাবা-মায়ের স্নেহের ছায়ায় শিশু বিলাল বড় হচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই বিলালকে এতিম করে তার বাবা-মা পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। এর আগে বিলালকে রেখে যান মনিব খলফের কাছে। একজন ক্রীতদাসের ছেলে হিসেবে তাঁকেও ক্রীতদাস হতে হলো। বিলাল সেভাবেই চলছিলেন।
একদিন মারা গেলেন খলফ। মনিব হলেন খলফের পুত্র উমাইয়া। উমাইয়া ছিলেন নির্মম। বিলালের উপর নেমে আসলো অকথ্য নির্যাতন। কিশোর বিলালের কাজে এতটুকু ভুলত্রুটি পেলেই তাঁর উপর অসহ্য নির্যাতন চালাতেন উমাইয়া। জুলুম আর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে বিলালের মনে হলো এর নাম মানুষের জীবন নয়। বাঁচতে হলে মানুষের মতন সম্মান নিয়ে বাঁচতে হবে। দুঃখের কথা, মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্নের কথা বলতেন বন্ধু আম্মার ইবনে ইয়াসিন (রা) এর সাথে। আম্মার (রা)-ও তাঁরই মত একজন হতভাগ্য ক্রীতদাস। আম্মার (রা) পরে নবীর (সা) প্রিয় সাহাবাদের একজন হয়ে ওঠেন এবং তাঁর হাতেই স্থাপিত হয় ইসলামের প্রথম মসজিদের ভিত্তিপ্রস্থর।
আম্মারের উপর তাঁর মনিব অত্যাচার চালাতেন। তাঁকে মরুভূমির তপ্ত বালুতে শুইয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। জালিম মনিবের অত্যাচারেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাঁর মা-বাবা। আম্মারের কাছেই বিলাল (রা) শুনলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর নাম। দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলেন ইসলাম গ্রহণ করবেন। একসময় সেটা করেও ফেললেন।
বিলাল (রা) ইসলাম গ্রহণের খবর চাপা রইলো না। মনিব উমাইয়া এবার হাজার গুণ ক্ষিপ্ত হলেন। বিলালের উপর চালানো অত্যাচারের মাত্রা চরমে পৌঁছালো। তাঁকে বলা হলো জন্তুর মতো চারপায়ে চলাফেরা করার জন্য। আদেশ অমান্য করলেই শাস্তি। কখনো বা বিলালের গলায় দড়ি বেঁধে ছেলেদের হাতে তুলে দেন। ছেলেরা তাঁকে মক্কার রাস্তায় রাস্তায় টেনে হিচড়ে নিয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে যান বিলাল। উমাইয়া বিলালকে লোভ দেখান, ইসলাম ত্যাগ করলেই উঠিয়ে নেবেন শাস্তি, নতুবা মাত্রা আরো বাড়বে। কিন্তু বিলাল তাঁর আদর্শ থেকে সরেন না একচুলও। প্রাণের চেয়েও যে আদর্শ বড়। ফলাফলে আরো ক্ষেপে যান উমাইয়া। নির্যাতন ক্রমাগত বেড়েই চললো।
এবার বিলালের বুকে ভারী পাথর চাপিয়ে তাঁকে মরুভূমির অগ্নিতপ্ত বালুর উপর চিৎ করে শুইয়ে রাখা হলো। বন্ধ করা হলো খাবার। চাবুকের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করা হলো। ক্ষত-বিক্ষত দেহে ছিটিয়ে দেওয়া হলো লবণ। কখনোবা চুবিয়ে রাখা হলো পানিতে। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর হয়েও নিজের আদর্শকে অস্বীকার করলেন না একটিবারের জন্য ও। মনে মনে শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যান। একদিন নিশ্চয়ই এই যন্ত্রণার অবসান হবে।
বিলালের উপর এই ভয়াবহ নির্যাতনের খবর গেলো নবী করীম (সা) এর কাছেও। কেঁদে উঠলো তাঁর অন্তর। ভাবতে লাগলেন কী করা যায়? সাহাবীদের সাথে আলোচনা করলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) নবীজীকে বললেন, “যেমন করেই হোক আমি হযরত বিলাল (রা)-কে মুক্ত করে আনবোই ইনশাল্লাহ। যত টাকা লাগে লাগুক।”
আবু বকর গেলেন উমাইয়ার কাছে। কিন্তু উমাইয়া জানতেন, আবু বকর ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি বুঝতে পারলেন আবু বকর বিলালকে ক্রয় করে মুক্ত করে দেবেন। তাই তিনি আবু বকরের প্রস্তাবে রাজি হলেন না। হতাশ মনে ফিরে এলেন আবু বকর।
এবারে এগিয়ে এলেন নবীজির চাচা হযরত আব্বাস (রা)। তিনি বললেন, “আমি যেহেতু এখনো ইসলাম গ্রহণ করিনি তাই উমাইয়া আমার কাছে বিলালকে বিক্রি করতেও পারে।” তা-ই হলো। উমাইয়া রাজী হলো। তবে অর্থ নয়, তাকে গোলামের বদলে গোলাম দিতে হবে। তা-ই সে পেলো। এই প্রথম মুক্তির স্বাদ পেলেন বিলাল (রা)। রাসুল (সা) এর সাহচর্যে তাঁর জীবন শুরু হলো নতুন করে। বিলাল (রা) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তৎকালীন ইসলাম অনুসারীর সংখ্যা ছিলো হাতে গোনা দশ-বারো জন। প্রায়ই আক্রমণ চালানো হতো তাঁদের উপর। তাই নবীজি আদেশ দিলেন আবিসিনিয়ায় হিজরতের। সবাই বিলালকে অনুরোধ করলো তাদের সাথে যাওয়ার জন্য। কিন্তু প্রাণের নবীকে ছেড়ে বিলাল কোথাও গেলেন না। এর কিছুদিন পর নবীর আদেশে বাধ্য হয়ে মদিনায় হিজরত করলেন।
কিছুদিন পরের কথা। নবীজি (সা) মদিনা সফরে গেলেন। নামাজ পড়ার জন্য মসজিদ তৈরি হলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো লোকজনকে একত্রিত করা নিয়ে। কী করা যায় তা নিয়ে ভাবতে লাগলেন সবাই। একদিন নবীজির আরেকজন প্রিয় সাহাবা আবদুল্লাহ বিন যায়েদ (রা) স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে আযানের কথাগুলো শুনলেন। নবীজিকে শোনাতেই তা তাঁর পছন্দ হলো। তিনি আবদুল্লাহ বিন যায়েদকে আদেশ দিলেন বিলাল (রা)-কে কথাগুলো শিখিয়ে দেয়ার জন্য। বিলাল (রা) এর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত সুরেলা এবং মিষ্টি হওয়ায় নবীজি (সা) বললেন, “বিলালই হবে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন।” তারপর থেকে বিলালের আযানেই আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিতো সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তাঁর আযানে মন এক অদ্ভুত পবিত্রতায় ছেয়ে যেতো।
বিলাল (রা) ইসলামের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, ত্যাগ আর নিষ্ঠার পুরস্কার স্বরূপ লাভ করলেন সারা মুসলিম জাহানের প্রথম মুয়াজ্জিন হওয়ার গৌরব। তিনি নবী করিম (সা) এর এবং প্রায় সমস্ত সাহাবাদেরই প্রিয়ভাজন ছিলেন। নবীজিকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন।
একসময় অসুস্থ হয়ে নবীজি (সা) ইন্তেকাল করলেন। শোকে বিহ্বল বিলাল (রা) মদিনা ছেড়ে চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু খলীফা আবু বকর (রা) এর অনুরোধে মদিনায় থেকে গেলেও রাসুলের (সা) মৃত্যুর পর যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাঁর মুখে কোনো হাসি ছিলো না। বন্ধ করে দিলেন আযান দেওয়া। সিরিয়ার যুদ্ধের সময় সেখানে পাড়ি জমালেন। বীরত্বের সাথে অংশ নিলেন জিহাদে। ভাগ্যের এমনই লীলাখেলা, যে উমাইয়ার হাতে বিলাল (রা) কে দিনের পর দিন অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, সেই উমাইয়ার মৃত্যু হলো বিলাল (রা) হাতেই।
লোকে তাঁর সুমধুর কণ্ঠের আযান শুনতে চাইতো। কিন্তু তিনি রাজী হতেন না। শেষমেশ খলীফার অনুরোধ রাখতে গিয়ে রাজী হলেন ঠিকই, কিন্তু সম্পূর্ণ আযান শেষ করার সাথে সাথেই বেহুশ হয়ে গেলেন। তারপর তাঁর আযান দেওয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো। যেখানে তাঁর প্রাণের নবীজি নেই, সেখানে তিনি কেমন করে আযান দেবেন। আযান দেয়ার জন্য অনুরোধ করলে বলতেন, “আমি যখন আযান দেবো, তখন ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার সময় পর্যন্ত ঠিক থাকতে পারলেও এরপর আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। ‘আশহাদু অান্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বলার সময় মসজিদের মিম্বারের দিকে তাকালে মহানবী (সাঃ) দেখবো না, তখন সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” তবু সাহাবীরা তাঁকে অনুরোধ করলো। কিন্তু বিলাল (রা) আগেরই মত নিশ্চল।
এবার সাহাবীরা অন্য এক উপায় বের করলো। নবীজির দুই দৌহিত্র হযরত হাসান (রা) এবং হযরত হোসাইন (রা)-কে ধরলেন বিলাল (রা) কে আযান দিতে অনুরোধ করার জন্য। তাঁদের অনুরোধ বিলাল (রা) ফেলতে পারলেন না। এই ছিলো তাঁর শেষ আযান। এই আযান তিনি আর শেষ করতে পারেন নি। আযানের মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যান।
এরপর মদিনা ছেড়ে তিনি চলে গেলেন সিরিয়ায়। রাসুল (সা)-কে ছাড়া তাঁর জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছিলো। একসময় চিরবিদায়ের ডাক এলো। দামেস্কের ফাওলান নামক স্থানে ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করলেন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বিলাল (রা)। দাফন করা হলো ফাওলানের বাবুস সাগীর গোরস্থানে। আল্লাহর রাস্তা আর নিজের আদর্শের জন্য আমরণ লড়াই করে যাওয়া সেই অকুতোভয় বীর সৈনিক আজও সেখানেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। যতদিন এই আযানের ধ্বনি বাজবে, ততদিন তিনিও বেঁচে থাকবেন মানুষের অন্তরে।
তথ্যসূত্র:
হযরত বিলাল (রাঃ)
লেখক- আবুল খায়ের আহমদ আলী
প্রকাশক- ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ