ইংল্যান্ডের নিউক্যাসেল শহরের অনেকগুলো পাড়া বা মহল্লার একটি হচ্ছে উইলাম। ১৮ শতকে এই পাড়াটি ছিল নিউক্যাসেলের সবচেয়ে দরিদ্রদের বসবাসস্থল। আরো নির্দিষ্ট করে বললে কয়লাখনির শ্রমিকদের পাড়া। এ পাড়ার সবচেয়ে ভাগ্যবঞ্চিত, দারিদ্রপীড়িত একটি দম্পতি হচ্ছে রোবার্ট এবং মাবেল স্টিফেনসন দম্পতি। এই ‘দিন আনে দিন খাওয়া’ দম্পতি সন্তানের মুখে অন্য যোগাতে না পারার আশংকায় প্রথম সন্তানের পর আর সন্তান গ্রহণ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পৃথিবীর শত কোটি মানুষের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলবে যে ব্যক্তির আবিষ্কার, তার আগমনের রাস্তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত সৃষ্টিকর্তারও পছন্দ হয়নি। সেজন্যই তো ১৭৮০ সালের প্রথমভাগে চাকরিতে পদোন্নতি ঘটে রোবার্টের। আর এর সুবাদে ১৭৮১ সালের ৯ জুন পৃথিবীর আলো দেখেন স্টিফেনসন দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান জর্জ স্টিফেনসন।
“ভাগ্যের লেখন, না যায় খণ্ডন”– প্রবাদ বাক্যটির সাথে সামঞ্জস্য রাখতেই যেন বিধাতা স্টিফেনসন দম্পতির সুখ স্থায়ী হতে দিলেন না। জর্জ স্টিফেনসনের জন্মের ২ বছর পরই কোনো কারণে রোবার্টের অবনমন ঘটে এবং পুনরায় খনির ফায়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। ফলে আবারো আগের অবস্থায় পতিত হয় রোবার্টের পরিবার। আহারে অনাহারে দিন কাটতে থাকে তাদের। অথচ জর্জ স্টিফেনসনকে দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। তার বাবা-মা এবং একমাত্র ভাই, সকলেরই অপুষ্টিতে ভুগে অস্থিচর্মসার অবস্থা। সেখানে শিশু স্টিফেনসন বেড়ে উঠছিলেন বলিষ্ঠ, সুঠাম দেহ নিয়ে। এই বৈপরীত্য কেবল স্বাস্থ্যেই নয়। কথাবার্তা, চালচলন আর বুদ্ধিমত্তা, সকল ক্ষেত্রেই স্টিফেনসন তার বাবা-মা আর ভাইয়ের চেয়ে বহুগুণে চৌকস হয়ে উঠলেন শৈশবেই।
তবে স্টিফেনসন যতই মেধাবী হন না কেন, তার অক্ষরজ্ঞানহীন বাবা-মা সেটা অনুধাবনই করতে পারলেন না। একদিকে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, অন্যদিকে শিক্ষার মর্ম উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়া রোবার্ট ৮ বছরের শিশু স্টিফেনসনকেই কাজে লাগিয়ে দিলেন। ছেলের বলিষ্ঠ গড়ন দেখে ধরেই নিয়েছিলেন যে, ছেলে কাজেকর্মে বেশ পটু হবে। হলোও তা-ই, প্রাথমিকভাবে ভেড়া চড়ানো এবং কৃষিকাজে নিয়োজিত স্টিফেনসনের ডাক পড়লো কয়লাখনিতে। তখন তার বয়স মাত্র ১০ বছর। তাকে দেয়া হলো খনি থেকে উত্তোলিত কয়লাভর্তি ক্যারেজ ট্রামের রাস্তা পর্যন্ত চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব। ঘোড়ায় টানা এই ক্যারেজের চালক হিসেবে স্টিফেনসনের দক্ষতা সবাইকে মুগ্ধ করে দিল।
স্টিফেনসন যখন ১৫ বছরের কিশোর, তখনই তিনি রীতিমতো সমীহ করার মতো দেখতে হয়েছেন। তখন তিনি খনির মধ্যে ওঠানামার লিফটে কাজ করতেন। একবার কোনো এক পুরাতন খনি শ্রমিক স্টিফেনসনের কাজে অভিযোগ আনলে তিনি ঐ ব্যক্তিকে মুষ্টিযুদ্ধে আহ্বান করে বসেন। ১৫ বছর বয়সের কিশোর, চল্লিশোর্ধ্ব কোনো ব্যক্তিকে মুষ্টিযুদ্ধে আহ্বান করছে দেখে সকলেই তাজ্জব বনে গেলেন! তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলেন মুষ্টিযুদ্ধে হাসিমুখে অংশ নেয়া ঐ ব্যক্তিটিই, কিশোর স্টিফেনসনের কাছে হেরে যাবার পর!
১৭ বছর বয়স হতে হতেই ইঞ্জিনম্যান হিসেবে চাকরি পান স্টিফেনসন। ততদিনে নিজেকে বিয়ের জন্য উপযুক্ত ভাবতে শুরু করেন তিনি। নিজ উদ্যোগে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান এক কৃষকের মেয়ের জন্য। কিন্তু বিধিবাম, প্রত্যাখ্যাত হন স্টিফেনসন। কারণ একটাই, স্টিফেনসনের অক্ষরজ্ঞানহীনতা। আর এই ঘটনা তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে যায়। প্রচণ্ড ক্রোধ থেকে তিনি ইঞ্জিনম্যানের কাজের বাইরেও টুকটাক কাজ করে অতিরিক্ত অর্থ আয় করতে শুরু করলেন, ভর্তি হলেন একটি নৈশ স্কুলে। এক বছরের মাথায় নিজের প্রখর মেধার বদৌলতে পড়তে, লিখতে এবং অঙ্ক করতে শিখে গেলেন স্টিফেনসন। এবার প্রস্তাব নিয়ে গেলেন নিজের দ্বিতীয় প্রেমের পরিবারের কাছে। “তবে নাহ, বিয়ে বুঝি আর হবে না”, দ্বিতীয়বারও প্রত্যাখ্যাত হয়ে তার মনে এমন ভাবনাই খেলা করতে শুরু করলো যেন!
২ বার বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হবার পর বিয়ে করার জন্য ‘উঠেপড়ে’ লাগেন স্টিফেনসন! ১৯ বছর বয়সে সফলতা পান, বিয়ে করেন ফ্রান্সেস হেন্ডারসনকে, যিনি কিনা তার দ্বিতীয় প্রেমিকারই ছোট বোন। যা হোক, দুই বছরের মধ্যে দুই সন্তান রোবার্ট এবং ফ্রান্সেসের জন্ম, স্টিফেনসনের কর্মস্পৃহা আরো বাড়িয়ে দেয়। তিনি অবসর সময়ে জুতা সেলাই, কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে অতিরিক্ত আয় করতে থাকেন। এতে করে সুখেই কাটছিল তার দিনগুলো। কিন্তু, সুখ কপালে বেশিদিন সইলো না। তিন বছর বয়সে শিশুকন্যা ফ্রান্সেস নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এর কিছুকাল পরই শিশু ফ্রান্সেসের সাথে পরলোকে যোগ দেন মা ফ্রান্সেসও।
স্ত্রী আর কন্যার জন্য শোক পালনে ডুব দিলেন না স্টিফেনসন। বরং সাংসারিক প্রয়োজনে অধিক আয়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন স্কটল্যান্ডে। সেখানে যন্ত্রপাতি পরিচালনা এবং মেরামত করার কাজ শিখছিলেন তিনি। ১৮১৩ সালে এক দুর্ঘটনায় তার বাবা রোবার্ট অন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ঐ দুর্ঘটনায় খনির একটি প্রধান যন্ত্রও বিকল হয়ে পড়ে। স্টিফেনসন সেটি সচল করতে সক্ষম হলে নিজগ্রামের খনিতেই ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়ে যান। আর তখন থেকেই শুরু হয় তার অদম্য ছুটে যাওয়া। সহজে কয়লা পরিবহনের জন্য কোনো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তৈরি জন্য শুরু করলেন নিরন্তর প্রচেষ্টা।
১৮১৪ সালে জীবনের প্রথম সাফল্য পান স্টিফেনসন। কয়লা বহনের ট্রাম এবং বাষ্প ইঞ্জিন সংযুক্ত করে বিশেষ প্রকৌশলে তিনি নির্মাণ করলেন পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক ট্রেন। তিনি, সে সময়কার প্রচলিত বাষ্প ইঞ্জিনের চেয়ে বেশ দ্রুতগতির এই রেলইঞ্জিনের নাম দেন ‘ব্লুচার’। প্রুসিয়ান সেনাপতি ব্লুচার, ওয়াটারলু’র যুদ্ধে ঝড়ের বেগে নিজের সৈন্যদের নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন, যা নেপোলিয়নকে পরাজিত করতে সহায়তা করেছিল। তার সম্মানেই এই ট্রেনের নামকরণ করা হয়। ব্লুচারের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘন্টায় ৪ মাইল, যা ঘোড়ায় টানা ক্যারেজের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু আট চাকার এই রেল ইঞ্জিন একত্রে ৩০ টন কয়লা বহনক্ষম ছিল বিধায় ঘোড়ায় টানা ক্যারেজ ব্যবহারের ইতি ঘটে।
এই কয়লা টানার ট্রেন তৈরির পর স্টিফেনসন খনির শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ ল্যাম্প তৈরির কাজ শুরু করেন। খনির ভেতরে সাধারণত নানাপ্রকার দাহ্য গ্যাস নির্গত হয়। ফলে, দাহ্য গ্যাস শ্রমিকদের ব্যবহৃত উন্মুক্ত শিখা বিশিষ্ট ল্যাম্পের আগুনের সংস্পর্শে মাঝে মাঝেই বিস্ফোরণ ঘটতো। স্টিফেনসন এমন একটি ল্যাম্প তৈরি করলেন, যার শিখা উন্মুক্ত নয় এবং বিস্ফোরণের ঝুঁকি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনে। এদিকে, স্টিফেনসন জ্ঞাত ছিলেন না যে, তার কিছুকাল পূর্বেই তৎকালীন ব্রিটেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হামফ্রে ডেভি একই প্রকারের ল্যাম্প প্রস্তুত করেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সকলে ধরেই নিলো যে, স্টিফেনসন ডেভির কৌশল চুরি করেছেন। স্বল্পজ্ঞানী সাধারণ এক কয়লা শ্রমিক কী আর ডেভির মতো বিজ্ঞানীকে টক্কর দিতে পারে? মামলা করে দেয়া হলো তার বিরুদ্ধে। অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজের ‘দোষ’ স্বীকার করেই তবে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন!
১৮১৯ সালে সান্ডারল্যান্ডে একটি ৮ মাইল দীর্ঘ রেলওয়ে স্থাপন করেন স্টিফেনসন। একে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম সম্পূর্ণ মেশিননির্ভর রেলওয়ে। তাছাড়া এটিই ছিল রেললাইন নির্মাণে ঢালাই লোহা ব্যবহারের প্রথম উদাহরণ। স্টিফেনসন এটিকে নিজের নামে প্যাটেন্ট করিয়ে নিলেন। পরের বছর তিনি প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে স্টকটন-ডার্লিংটন রেলওয়ে নির্মাণের কাজ পান। এই রেলওয়েই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম পাবলিক রেলওয়ে। ১৮২৫ সালে এটি চালু হয়, যা স্টিফেনসন নিজে কিছুদিন চালান। ততদিনে তিনি দারিদ্রতা আর অভাব অনটন পেছনে ফেলে ইংল্যান্ডের এক মস্ত ধনী হিসেবে নাম লিখিয়েছেন। ছেলে রোবার্টকে নিয়ে চালু করলেন নিজের রেলওয়ে ইঞ্জিন তৈরির কোম্পানি ‘লোকোমোশন’। এর মাধ্যমে আরো একটি প্রথমের সাথে তার নাম জড়িয়ে যায়। তার কোম্পানিটিই ছিল পৃথিবীর প্রথম রেলওয়ে নির্মাণ কোম্পানি।
উত্তর ইংল্যান্ডে যখন স্টিফেনসনের রেলওয়ে কোম্পানি লোকোমোশনের জয়জয়কার, দক্ষিণে তখন অন্য একজন রেলওয়ে নির্মাণ শুরু করে দিয়েছেন। তার নাম ব্রুনেল। কয়েক বছরের মধ্যে ব্রুনেল আর স্টিফেনসনের মধ্যে শুরু হয় অসম এক প্রতিযোগীতা। যদিও উত্তরে স্টিফেনসনের দাপট একচ্ছত্র ছিল, দক্ষিণে ব্রুনেল নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে পারছিলেন না স্টিফেনসনের জন্য। তাদের মধ্যে মূল প্রতিযোগীতাটাই হয়েছিল রেললাইনের মাপ নিয়ে। লাইনের দুই পাতের মধ্যকার দূরত্ব কতটুকু হবে, তাই নিয়ে বেশ ক’বছর চললো দ্বন্দ্ব। শেষতক স্টিফেনসনের মাপটাই স্বীকৃতি পায়। আর ব্রিটিশ সরকার তাকে লিভারপুল থেকে ম্যানচেস্টার পর্যন্ত দীর্ঘ রেলওয়ে নির্মাণের কাজ দেয়।
১৮২৯ সালে ইংল্যান্ডে একটি জাঁকালো রেল প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন কোম্পানির মোট ১০টি রেল ইঞ্জিন সে প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়। প্রতিযোগীতায় জিততে ইঞ্জিনটিকে ছয় টন ভার বহন করে ছুটে যেতে হবে। স্বদেশী, ইউরোপের অনেক দেশ এবং আমেরিকা থেকে আগত হাজারো মানুষকে বিস্মিত করে, স্টিফেনসনের নতুন সৃষ্টি ‘রকেট’ (তার নতুন রেল ইঞ্জিনটির নাম) ছুটলো ঘন্টায় ৩৬ মাইল বেগে। আর যায় কোথায়? এত গতি হলে যে যাতায়াত হবে অত্যন্ত দ্রুততাসম্পন্ন, অন্তত তখনকার প্রেক্ষাপটে। এই প্রতিযোগীতা জিতেই পুরো ইংল্যান্ড জুড়ে তারকা খ্যাতি লাভ করেন স্টিফেনসন। আমেরিকানরা তাকে ধরনা দিতে শুরু করে তাদের দেশে গিয়ে রেলওয়ে স্থাপন করে দিয়ে আসতে। আর স্টিফেনসন? তিনি তার মতোই কাজ করে যেতে লাগলেন। ইংল্যান্ডেই তার কাজের অভাব ছিল না, আমেরিকা যাবার আদৌ প্রয়োজন ছিল কি?
সৌভাগ্য তখন আর স্টিফেনসনকে ছেড়ে যেতেই চায় না! তিনি এত পরিমাণ অর্থ আয় করতে লাগলেন যেন নিজেই বিরক্ত হয়ে গেলেন! রেলওয়ের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন ৩টি কয়লা খনি, যেগুলো থেকে কয়লা উত্তোলন করে অর্থ সম্পদের চূড়ায় উঠে বসেন তিনি। ছেঁড়া জামা গায়ে দিয়ে, পচা-বাসি খেয়ে, বস্তিতে শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে দেয়া স্টিফেনসন বয়সকালে যখন বৈভবের চূড়ায় উঠে বসলেন, যখন গড়লেন নিজের রাজকীয় অট্টালিকা, তখন আরেক দফা অশান্তি তার জীবনে হানা দেয়। ১৮৩৫ সালে দ্বীতীয়বারের মতো বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু ১৮৪৫ সালে তার দ্বিতীয় স্ত্রী কোনো সন্তান না রেখেই মারা যান। সে বছরই আবার বিয়ে করেন স্টিফেনসন। তবে, এবারো তার সংসার বেশিদিন টেকেনি। না, এবার তার স্ত্রী নয়, তিনিই সংসারের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। ১৮৪৮ সালের ১২ আগস্টে, ৬৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ডার্বিশায়ারের চেস্টারফিল্ডে তাকে সমাহিত করা হয়। তার ছুটে চলা তো স্থবির হয়ে গিয়েছিল দেড় শতাধিক বছর আগে, কিন্তু তার উদ্ভাবন আজও ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে।
ফিচার ছবি: magnoliabox.com