১
কিছু কিছু রেকর্ড আছে যেগুলো কিনা আপনি শুধুমাত্র ছুঁতে পারবেন, কখনো ভাঙতে পারবেন না। ছয় বলের ওভারে ৩৬ রান করা এমনই একটি রেকর্ড। এক ওভারে যদি সবগুলো বৈধ বল হয়, তাহলে আপনি কখনোই ৩৬ রানের বেশি নিতে পারবেন না। তবে ৩৬ রান নেওয়াটাও কিন্তু এত সহজ বিষয় নয়। টানা ছয়টি ছয় মারতে হবে!
ক্রিকেটে এই কাজটি করা যে খুব কঠিন, সেটি একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই বোঝা যায়। স্বীকৃত ক্রিকেটে এই ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র চার বার। তবে যে কোনো কাজ যিনি প্রথম বার করেন, তিনি পথপ্রদর্শক হিসেবেই বিবেচিত হন। ১৯৬৮ সালের ৩১ শে আগস্ট প্রথমবার এই কাজটি করে পথপ্রদর্শক হিসেবে রয়ে গিয়েছেন স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স। টানা ছয় বলে ওভার বাউন্ডারি মারার শেষ বলটি সম্পর্কে স্লিপে দাঁড়ানো পিটার ওয়াকার বলেছিলেন, “ওটা ৬ নয়, ১২”। পরবর্তীতে সেই হারিয়ে যাওয়া বলটি একটা বাগান থেকে উদ্ধার করে ১১ বছর বয়সী রিচার্ড লুইস।
এই রেকর্ডের অংশীদার হবার সৌভাগ্য তো তবুও আরো কয়েকজন ক্রিকেটারের হয়েছে। সোবার্সের আরেকটি রেকর্ড আছে যা কিনা এখনো একক রেকর্ড হিসেবেই টিকে আছে।
টেস্ট ক্রিকেটে ট্রিপল সেঞ্চুরি করাটাও অনেক কঠিন কাজ। তবুও এই কঠিন কাজটা এই পর্যন্ত ২৬ জন ব্যাটসম্যান করেছেন। এদের মাঝে ডন ব্র্যাডম্যান, ব্রায়ান লারা, ক্রিস গেইল আর বীরেন্দ্র শেবাগ দুটো করে ট্রিপল করায় মোট ট্রিপল সেঞ্চুরির সংখ্যা ৩০টি। এই ২৬ জনের মাঝে মাত্র ৩ জন ব্যাটসম্যান নিজেদের প্রথম সেঞ্চুরিকেই ট্রিপল সেঞ্চুরিতে পরিণত করেছিলেন। সেই রেকর্ডের মালিক সিম্পসন আর নায়ার বাদে আরেকজন হচ্ছেন এই সোবার্স।
তবে এটিও সোবার্সের সেই ব্যতিক্রমী রেকর্ড নয়। সোবার্সই একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি কিনা টেস্ট ক্রিকেটে তার প্রথম সেঞ্চুরিকেই এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডে পরিণত করেছেন। সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড হিসেবে এটি টিকে ছিল ৩৬ বছর! এটি ছাড়াও সোবার্সই ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান ব্যাটসম্যনদের মাঝে সবচেয়ে কম বয়সে (২১ বছর ২১৮ দিন) কীর্তিটি গড়েন।
সোবার্স যখন অবসর নেন, তখন টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে বেশী রান করার রেকর্ডটি তার দখলে, যা কিনা টিকে ছিল ৯ বছর ২৭৫ দিন! ব্র্যাডম্যানের পর সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির রেকর্ডটিও ছিল তার। এসব রেকর্ড দেখে আপনি যদি ভাবেন যে, সোবার্স দুর্দান্ত একজন ব্যাটসম্যান ছিলেন, তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি ঠিক ভাবছেন! শুধুমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবেই সর্বকালের সেরা প্রথম চার-পাঁচজনের মাঝেই তার নাম অনায়াসে এসে পড়বে। কিন্তু এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। ক্রিকেটের খুঁটিনাটি সম্পর্কে কিছুটা খোঁজখবর রাখেন এমন যে কেউই জানেন, সোবার্স ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বোলার হিসেবে, কিন্তু ধীরে ধীরে পরিচিত হন সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে।
২
‘সর্বকালের সেরা’ উপাধিটিই কিছুটা বিতর্কিত। যদিও প্রায় সব ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার বললে সোবার্সকেই বেছে নেন। পরিসংখ্যানে ইদানিংকালের জ্যাক ক্যালিস কিছুটা এগিয়ে থাকলেও সোবার্সকে এগিয়ে রাখে পরিসংখ্যান বহির্ভূত কিছু বিষয়। তার সম্পর্কে বলা হতো, ক্রিকেট মাঠে করা সম্ভব এমন কিছু নেই, যা তিনি করেননি। মূলত বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার ছিলেন তিনি। তবে মাঝে মাঝে রিস্ট স্পিনও করতেন। প্রয়োজনে মিডিয়াম ফাস্ট বোলিং করতেন, সিমার হিসেবেও কাজ করতে পারতেন, মাঝে মাঝে ওপেনিংয়েও বল করেছেন। বোলার হিসেবে তার সংগ্রহ ২৩৫টি উইকেট।
ফিল্ডার হিসেবে ১০৯টি ক্যাচ ধরেছেন সোবার্স। খুব শর্ট পজিশনে ফিল্ডিং করতেন। তার কাছে বল গেলে রান নেবার আগে ব্যাটসম্যান একবারের জায়গায় দু’বার ভাবতেন। ব্যাটিংয়ের কথা তো আগেই বলা হলো। ক্যারিয়ারের শুরুতে একটু নিচের দিকে ব্যাটিং করার কারণে প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। এ কারণে প্রথম ২২টি টেস্ট ইনিংসে মাত্র ১৮ বার দুই অঙ্কের রান করলেও সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল মাত্র ৬৬ রানের। কিন্তু পরবর্তী ২৪ টেস্টে ৯৩.৭৫ গড়ে ২,২৫০ রান করে তিনি তার সামর্থ্যের প্রমাণ দেন। যেদিন ব্যাটিংয়ে সেট হয়ে যেতেন, সেদিন এক হাতে ম্যাচ বের করে নিয়ে আসতেন।
এছাড়াও তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৩৯টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে গ্যারি সোবার্স একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি এক সিরিজে একই সাথে ৩০০ রান করেছেন এবং ২০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েছেন তিনবার। এর মাঝে ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে করেছেন ৭২২ রান, সাথে ২০ উইকেট আর ১০টি ক্যাচ নিয়েছিলেন। এই সিরিজে তিনি অধিনায়কও ছিলেন। অন্য কোনো খেলোয়াড়ের এক সিরিজে একই সাথে ৫০০ রান, ১০ উইকেট আর ১০ ক্যাচ নেবার কৃতিত্বও নেই।
৩
অফিশিয়াল টেস্টে স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্সের অবিনশ্বর কিছু রেকর্ড থাকলেও তিনি ভিন্ন আরেকটি কারণে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে জায়গা করে আছেন। হুট করে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত হয়ে যাওয়ায় ইংল্যান্ড আর অষ্ট্রেলিয়ার দুটো সিরিজ বাতিল হয়ে যায়। সেই সময় ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ এই দুটো সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবর্তে ‘রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি দল গঠন করে, যেখানে দুটো দলেরই অধিনায়ক নির্বাচিত হন গ্যারফিল্ড সোবার্স।
প্রথম সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে পেস বোলিং উইকেটে গতির সাথে সুইংয়ের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ২১ রানে ৬টি উইকেট পান। এরপর ব্যাটিংয়ে নেমে ১৮৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন। বোলিংয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে স্পিন বল করে ইংল্যান্ডকে অলআউট করতে সাহায্য করেন। সেই সিরিজেরই চতুর্থ টেস্টে ১১৪ আর ৫৯ রানের দুটো ইনিংস খেলে দলকে ২ উইকেটের জয় পেতে সাহায্য করেন।
তবে এসব ছাপিয়েও রোমাঞ্চকর হয়ে উঠে অষ্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় সিরিজটি। সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে ডেনিস লিলিকে খেলতে সোবার্সের একটু সমস্যা হচ্ছিল। সিরিজের প্রথম টেস্ট ড্র হয়। দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে লিলির তোপে পড়ে (২৯ রানে ৮ উইকেট) ‘রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ অলআউট হয় মাত্র ৫৮ রানে। সেই ইনিংসে সোবার্স শূন্য রানে আউট হবার পর একটি কথা সাংবাদিক মহলের ফিসফাসে উঠে আসে। তৃতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসেও লিলির বলেই শূন্য রানে আউট হবার পর ফিসফাসটি আলোচনায় পরিণত হয়। সিরিজে তখন অষ্ট্রেলিয়া ১-০ তে এগিয়ে। প্রথম ইনিংসে ১০১ রানের লিড নেবার পরে দ্বিতীয় ইনিংসেও যখন মাত্র ১৪৬ রানে ৩ উইকেট পড়ে গেল, তখনই সোবার্স ব্যাটিং করতে নামেন। এরপর যা হলো তা কথায় বর্ণনা করা যায় না। মনে হলো যেন, তলোয়ার হাতে মাঠে নেমেছেন এক যোদ্ধা। সেরা ফর্মের লিলির ইয়র্কারেও চার মারছেন সমানে, সেঞ্চুরি করলেন মাত্র ১২৯ বলে। শেষ পর্যন্ত করলেন ২৫৪ রান!
সেই ইনিংস দেখে ব্র্যাডম্যান মন্তব্য করেছিলেন, “সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ায় খেলা কোনো ব্যাটসম্যানের সেরা ইনিংস”।
৪
উইজডেনের প্রবর্তিত ‘লিডিং ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ এর যে পুরষ্কার দেওয়া হয়, তাতে সোবার্স নির্বাচিত হয়েছেন ৮ বার। ব্র্যাডম্যান (১০ বার) বাদে অন্য কোনো খেলোয়াড়েরই ৩ বারের বেশি এই পুরষ্কার পাওয়ার রেকর্ড নেই।
এছাড়া উইজডেনের উদ্যোগে গত শতাব্দীর সেরা পাঁচজন ক্রিকেটার নির্বাচনে ১০০ জন বিচারকের মাধ্যমে একটি নির্বাচন হয়, যেখানে প্রত্যেক বিচারক তাদের মতে সেরা ৫ জন ক্রিকেটার বেছে নিতে পারবেন। অবাক করা বিষয় এটি ছিল না যে, ৯০ জনেরই সেরা পাঁচে ছিলেন সোবার্স। তবে অবাক করা বিষয় ছিল এটিই, বাকি দশজনের সেরা পাঁচ থেকে কীভাবে সোবার্স বাদ পড়লেন! একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ডন ব্র্যাডম্যান পান ১০০টি ভোট। বাকি তিনজন হলেন জ্যাক হবস (৩০), শেন ওয়ার্ন (২৭) আর ভিভ রিচার্ডস (২৫)।
এই পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা সর্বকালের সেরা যে কয়টি একাদশ নির্বাচন করেন, তাতে দুটো নাম যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল- গ্যারি সোবার্স আর ডন ব্র্যাডম্যান।
গ্যারফিল্ড সোবার্সের ক্রিকেট জীবন নিয়ে যদি কেউ গবেষণা করেন, নিদেনপক্ষে কেবল পরিসংখ্যানগুলোতেও চোখ বোলান, তাহলে তিনি সোবার্সকে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের স্বীকৃতি দিতে হয়তো একরকম বাধ্য হবেন। যখন কেউ সোবার্সকে দেখবেন বিশ্বের সেরা পাঁচজন ব্যাটসম্যানের একজন হিসেবে, যিনি কিনা দলের প্রয়োজনে ফাস্ট, ফাস্ট মিডিয়াম, স্পিন সব ধরনের বল করতে পারতেন এবং ফিল্ডার হিসেবে যেকোনো পজিশনেই দুর্দান্ত ছিলেন; সাথে ছিল অধিনায়কত্বের গুণ- এই বিশ্বাসটি তখন হয়তো তার মন থেকে আর কখনোই মুছবে না। গ্যারি সোবার্সের মতো এমন কেউ আর কখনোই ক্রিকেট ইতিহাসে আসবে না।