জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান- বিজ্ঞানের তিনটি শাখায় তিনি বেশ পারদর্শী ছিলেন। অবদান রেখেছেন রসায়ন, স্থাপত্যকলা আর ম্যাপ তৈরির কাজেও। তিনি একজন ‘রেনেসাঁম্যান’ হিসেবেও পরিচিত। কার কথা বলছি বুঝতে পারছেন কি? আরেকটু তথ্য দিলে হয়তো বুঝতে পারবেন। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম কোষ আবিষ্কার করে অণুজীববিজ্ঞানের দুয়ার খুলে দেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী বই ‘মাইক্রোগ্রাফিয়া’ তার হাতেই রচিত। এবার ধরতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। ‘সকল কাজের কাজী’ সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন রবার্ট হুক।
শৈশব
রবার্ট হুক ১৬৩৫ সালের ২৮ জুলাই ইংল্যান্ডের উইট দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জন হুক ছিলেন একজন ধর্মযাজক, যিনি ছেলেকেও নিজের মতো করেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মা সিসিলি গিলেজ ছিলেন একজন গৃহিণী। চার ভাইবোনের মধ্যে হুকই ছিলেন সবচেয়ে ছোট এবং সবচেয়ে রোগা। এই রুগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য স্কুল জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি বাসায় কাটিয়েছেন।
১৬৪৮ সালে হুকের বাবা জন মারা যান। ১৩ বছর বয়সী হুক বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারার পর ৪০ পাউন্ডের মালিক হন। সে সময়ের সাপেক্ষে তা মোটামুটি ভালো অর্থই ছিলো। তিনি চলে গেলেন লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টারে। সেখানে ওয়েস্টমিনিস্টার স্কুলে ভর্তি হয়ে যান। এই স্কুলে তিনি গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষার পাশাপাশি গণিত ও বলবিদ্যায় শিক্ষা লাভ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে হুক
১৬৫৩ সালে হুক অক্সফোর্ডে চলে যান। সেখানে তিনি একটি রসায়ন গবেষণাগারে আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েলের সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এখানে কাজ করার অভিজ্ঞতাই তাকে বিজ্ঞানের পথে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করে। ১৮ বছর বয়সী হুক অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে ভর্তি হন। তিনি সেখানে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি একজন সফল কোরাস গায়ক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
রয়্যাল সোসাইটিতে হুক
বয়েলের সূত্রের সাথে পরিচয় আছে নিশ্চয়ই? বিজ্ঞানী বয়েল যখন এই সূত্র আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন, তখন হুক ছিলেন তার প্রধান সহযোগী। মূলত বয়েলের গবেষণার জন্য যত যন্ত্রপাতির প্রয়োজন ছিল তার অধিকাংশই হুকের হাতে তৈরি। প্রায় সাত বছর বয়েলের গবেষণাগারে কাজ করে পরীক্ষামূলক যন্ত্রপাতির উপর ভালো রকম দক্ষতা অর্জন করেন হুক।
১৬৬২ সালে রবার্ট হুক লন্ডনে দু’বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ‘রয়্যাল সোসাইটি’তে গবেষণা বিষয়ক কিউরেটর হিসেবে নিযুক্ত হন। তার এই নিযুক্তির পেছনে ছিল বয়েলের অবদান। কিউরেটর বলতে প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত সকল গবেষণার প্রধান তখন তিনি। হুক এখানে কাজ করা কালেই তার জীবনের প্রধানতম আবিষ্কারগুলো করেন। রয়্যাল সোসাইটিতে তিনি প্রায় ৪০ বছর কিউরেটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
ঘড়ির উন্নয়ন
১৬৫৭ সালে রবার্ট হুক পেন্ডুলাম ঘড়ির একটি উন্নত মডেল তৈরি করেন। তিনি ঘড়ির পেন্ডুলামে নিজের তৈরি বিশেষ ধরনের এংকর ব্যবহার করেন। ফলে সময় গণনা হয় আরো সূক্ষ্ম। পরবর্তীতে হুক পকেট ঘড়ির জন্য এক প্রকার ব্যালেন্স স্প্রিং তৈরি করেন। তার এই ব্যালেন্স স্প্রিং পকেট ঘড়ির সময় গণনা আরো নিখুঁত করেছিল। কেননা এই ব্যালেন্স স্প্রিংটি দেয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামের মতোই কাজ করে। হুক একে ঘড়ির চাকার সাথে এমনভাবে যুক্ত করেন যে স্প্রিংটি নিয়মিত দোলন সৃষ্টি করতো এবং সময়ের চাকা সঠিকভাবে চলতো।
হুকের সূত্র
“স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে বস্তুর পীড়ন এর বিকৃতির সমানুপাতিক”
উপরোক্ত সূত্রটি পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে কখনো না কখনো পড়েছেন নিশ্চয়ই। এই বিখ্যাত সূত্রটি আবিষ্কার করেন রবার্ট হুক। সহজ বাংলায় বললে কোনো বস্তুর উপর আপনি যত বল প্রয়োগ করবেন, এর বিকৃতিও সেই বলের সমানুপাতেই ঘটবে। হুক মূলত স্প্রিং নিয়ে গবেষণা করে এই সূত্রটি আবিষ্কার করেন।
হুকের মাইক্রোস্কোপ
মাইক্রোস্কোপ তিনি উদ্ভাবন করেননি, তথাপি আধুনিক মাইক্রোস্কোপের পথপ্রদর্শন করে গিয়েছিলেন। তিনি নিজের গবেষণার সুবিধার্থে স্ক্রু চালিত ফোকাসিং যন্ত্রবিশিষ্ট একপ্রকার জটিল অণুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেন। তার এই যন্ত্রে কোনো নমুনার উপর সহজেই ফোকাস করা যেত। পূর্ববর্তী অণুবীক্ষণ যন্ত্রগুলোতে নমুনার উপর ফোকাস করতে নমুনাটিকেই নড়াচড়া করতে হতো। পরবর্তীতে তিনি নমুনাকে আলোকিত করতে একপ্রকার পানির লেন্সের প্রচলন করেন যার একপাশে অবস্থিত তেলের বাতির আলো নমুনাকে উজ্জ্বল করতো।
মাইক্রোগ্রাফিয়া
বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞান বিষয়ক যে বইটিকে প্রথম বেস্টসেলার বলা হয় তা হচ্ছে রবার্ট হুকের ‘মাইক্রোগ্রাফিয়া’। ৩০ বছর বয়সী হুক ১৬৬৫ সালে যখন এই বইটি প্রকাশ করেন, তখন বিজ্ঞানী মহলে তাকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। এই বইটি প্রকাশের পরই বোঝা যায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বাইরেও তিনি একজন চমৎকার চিত্রশিল্পী। যা-ই হোক, হুক তার নিজস্ব অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি মানুষের দৃশ্যমান জগতের বাইরে এক অদৃশ্য জগতকে সকলের অগোচরে নিয়ে আসলেন ডায়াগ্রাম এঁকে। কিন্তু নতুন সে জগত এতোটাই অপরিচিত ছিল যে, মানুষ বিশ্বাস করতে পারছিল না সেগুলো আদৌ বাস্তব না হুকের কল্পিত চিত্র!
হুকের মাইক্রোগ্রাফিয়াকে বলা হয় ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান বিষয়ক বই। পৃথিবীতে মানুষের অদেখা যে আরেক বিশাল জগতের উপস্থিতি আছে তা হুকই প্রথম প্রমাণ করেন। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের বিজ্ঞান তথা অণুজীববিজ্ঞান, কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান আর ন্যানো টেকনোলোজি তো মানুষ হুকের জন্যই ভাবতে পেরেছে এবং সম্ভব করতে পেরেছে!
উদ্ভিদ কোষ
যদিও আণুবীক্ষণিক জীব পর্যবেক্ষণের কৃতিত্ব লিউয়েন হুককেই দেয়া হয়, আদতে রবার্ট হুকই প্রথম আণুবীক্ষণিক জীব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তবে তিনি বুঝতে পারেননি যে, তিনি পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি হিসেবে অদৃশ্য জীব দেখে ফেলেছেন। যা-ই হোক, রবার্ট হুক তার গবেষণা চালিয়ে যান। তিনি ওক গাছের এক টুকরো ছাল বা শল্ক তার জটিল অণুবীক্ষণ যন্ত্রে রেখে পর্যবেক্ষণ করেন এবং অবিশ্বাস্য কিছুই দেখতে পান। তিনি দেখতে পান খালি চোখে যেমন দেখায়, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মধ্য দিয়ে তা একেবারেই ভিন্ন দেখাচ্ছে। জীবনের ক্ষুদ্রতম একক, যাকে আজ আমরা কোষ হিসেবে জানি, এর নামকরণ হুকই করেন। অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়া অসংখ্য ছোট ছোট ব্লক দেখেই হুকের মনে পড়ে যায় মঠ বা আশ্রমের ছোট ছোট কামরার কথা যেগুলো তখন সেল নামে পরিচিত ছিল। তাই হুক গাছের বাকলে দৃশ্যমান সেই ব্লকগুলোর নাম দিয়ে দেন সেল। সেই থেকে তিনি উদ্ভিদ কোষের আবিষ্কারক হিসেবে পরিচিত। তবে তিনি কেবল কোষের বাহ্যিক গঠনই দেখেছিলেন, তার সেই স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে কোষের অভ্যন্তরীণ গঠন দেখা সম্ভব হয়নি।
প্যালিওন্টোলজি
প্যালিওন্টোলজি বা জীবাশ্ববিজ্ঞান নিয়েও হুক কাজ করেন। তিনি বিভিন্ন ফসিলের উপর প্রাচীন কোষ পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে ফসিলগুলো একসময় জীবন্তই ছিল এবং কালের পরিক্রমায় এরা খনিজে পরিণত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার এই বৈপ্লবিক কথাগুলো তখনকার বিজ্ঞান সমাজ সহজে মেনে নিতে পারে নি। হুক তার পর্যবেক্ষণ থেকে আরো জানান যে পৃথিবীতে প্রাচীনকালে এমন অনেক জীব ছিল যা বিলুপ্ত হয়েছে। কথাটি খুবই সহজ সরল মনে হচ্ছে, কেননা আমরা সবাই জানি যে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছিল এবং অনেক প্রাণী রয়েছে বিলুপ্তির পথে। কিন্তু হুকের সময় এ কথার গুরুত্ব ছিল অসীম।
পদার্থবিজ্ঞানী হুক
হুকের সূত্রের কথা তো উপরেই আলোচনা করা হয়েছে। এর বাইরেও হুক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে ভেবেছেন। ১৬৭০ সালে তিনি এক বক্তৃতায় অপার্থিব বস্তুর (সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্র ইত্যাদি যা পৃথিবীর বাইরে অবস্থিত) উপর মহাকর্ষের প্রভাব নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন যে, প্রতিটি অপার্থিব বস্তুর উপরই মহাকর্ষ কাজ করে এবং দূরত্বের সাথে এই বলের হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কিত। তার মতে যদি মহাকর্ষ না থাকতো তাহলে অপার্থিব বস্তু তথা চাঁদ, সূর্য ইত্যাদি বৃত্তাকারে নয় বরং সরলরেখায় চলতো।
স্থাপত্যবিদ হুক
বিজ্ঞানী হিসেবে যখন বেশ পরিচিত হুক, তখন স্থাপত্যকলায়ও নিজের হাত পাকিয়ে নেন তিনি। নিতান্তই মনের আনন্দে তিনি বাড়ি-ঘরের নকশা আঁকতেন। কিন্তু মানুষের সেগুলো ভীষণ পছন্দ হতো। ১৬৬৬ সালে লন্ডন শহর এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের শিকার হয়, যাকে আমরা ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট ফায়ার অব লন্ডন’ হিসেবে জানি। সে অগ্নিকান্ডে লন্ডন শহরের অধিকাংশ বাড়িঘর আর স্থাপত্য ধ্বংস হয় বা কম-বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। জেনে অবাক হবেন যে, সেসব ক্ষয়প্রাপ্ত এবং ধ্বংস হওয়া স্থাপনাগুলোর পুনর্নির্মাণের অধিকাংশ নকশাই ‘অর্ধেক বিজ্ঞানী আর অর্ধেক স্থপতি’ রবার্ট হুক প্রণয়ন করেন! স্থপতি হিসেবে তার জনপ্রিয়তা তাকে লন্ডন শহরের সার্ভেয়ার হবার সুযোগ করে দেয়। তিনি বিজ্ঞানী হিসেবে জীবনে যা আয় করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি করেছিলেন এই স্থাপত্যবিদ্যা দিয়েই!
বিতর্ক ও শেষ জীবন
হুকের যেসব ছবি আমরা দেখি সেগুলো আসলে সঠিক কিনা তা আমরা জানি না। কেননা যখন তিনি বেঁচে ছিলেন, তখন কোনো চিত্রকরই তার ছবি আঁকেনি। অথবা আঁকা হলেও সেগুলো সংরক্ষিত করা হয়নি। পরবর্তীতে আঁকা ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা আসল হুককে দেখতে পাই কিনা তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। অন্যদিকে নিজের শেষ বয়সটা হুকের কেটে যায় বিতর্কের মধ্য দিয়েই। বিভিন্ন বিজ্ঞানীর সাথে বিভিন্ন আবিষ্কার নিয়ে সেসব বিবাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত যেটি সেটি হলো নিউটনের সাথে। তার অভিযোগ ছিল নিউটন তার মহাকর্ষ সূত্রে হুকের তত্ত্ব ব্যবহার করেছেন কিন্তু স্বীকার করেননি!
৬৭ বছর বয়সে নিজের জন্মস্থান লন্ডনেই মৃত্যুবরণ করেন রবার্ট হুক। দিনটি ছিল ১৭০৩ সালের ৩ মার্চ। আজ তার মৃত্যুর ৩০০ বছর পরও আমরা তার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।