গত ২৬ ডিসেম্বর মস্কোয় জর্জ ব্লেক নামক ৯৮ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধের মৃত্যু ঘটেছে। ঘোষণাটি এসেছে রুশ বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসভিআর’–এর পক্ষ থেকে, এবং তারা এই লোকটির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে। গুগলে ব্লেকের নাম লিখে সার্চ দিলে সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সমাজের নানা স্তরের মানুষের একগাদা টুইট চোখে পড়ছে, যেগুলোতে ব্লেককে ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘অসংখ্য মানুষের রক্ত ঝরানোর জন্য দায়ী’ ইত্যাদি অভিধায় অভিষিক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কে এই জর্জ ব্লেক? কেনই বা তার ওপর ব্রিটিশরা এত ক্ষিপ্ত? চলুন, গুপ্তচরবৃত্তির অন্ধকার জগতের এই কিংবদন্তী সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
জর্জ ব্লেকের প্রকৃত নাম ছিল জর্জ বেহার। ১৯২২ সালের ১১ নভেম্বর নেদারল্যান্ডসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর রটারডামে একটি ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে মিশ্র পরিবারে জর্জ বেহারের জন্ম। তার নামকরণ করা হয় ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জের নামানুসারে। তার বাবা আলবার্ট বেহার ছিলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যে জন্মগ্রহণকারী একজন সেফার্দি ইহুদি এবং তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করে ব্রিটেনের পক্ষে লড়াই করেন। উল্লেখ্য, ‘সেফার্দি ইহুদি’ বলতে ইহুদিদের সেই অংশকে বোঝানো হয় যারা মূলত আইবেরীয় উপদ্বীপের (স্পেন ও পর্তুগাল) অধিবাসী ছিল, কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে সেখান থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। আলবার্ট বেহার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার ধর্মীয় পরিচিতি গোপন রাখেন। অন্যদিকে, আলবার্ট বেহারের স্ত্রী ক্যাথেরিন (অর্থাৎ জর্জ বেহারের মা) ছিলেন জাতিগতভাবে ডাচ এবং ধর্মীয়ভাবে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান।
১৯৩৬ সাল পর্যন্ত জর্জ বেহার নেদারল্যান্ডসেই অবস্থান করেন, এবং তাদের পারিবারিক টেক্সটাইল ব্যবসার বদৌলতে তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই ছিলেন। কিন্তু এই বছর বেহারের বাবার মৃত্যু হয়, এবং ১৪ বছর বয়সী বেহারকে মিসরে তাদের এক ধনী আত্মীয়ার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বেহারের মা ও বোনেরা নেদারল্যান্ডসেই অবস্থান করতে থাকেন। বেহার মিসরের রাজধানী কায়রোর ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা করেন। উল্লেখ্য, ১৯২২ সালে মিসর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু কার্যত ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মিসর ছিল ব্রিটেনের একটি প্রোটেক্টরেট বা আশ্রিত রাষ্ট্র।
মিসরে অবস্থানকালে বেহার তার আত্মীয় হেনরি কিউরিয়েলের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হন। বেহারের চেয়ে বছর দশেকের বড় কিউরিয়েল ছিলেন একজন মার্ক্সবাদী এবং মিসরীয় কমিউনিস্ট দল ‘ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট ফর ন্যাশনাল লিবারেশন’–এর (ডিএমএনএল) একজন শীর্ষ নেতা। তার সংস্পর্শে এসে বেহার মার্ক্সবাদী চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। উল্লেখ্য, ১৯৫০ সালে কিউরিয়েলকে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য মিসর থেকে বহিষ্কার করা হয়, এবং ১৯৫৫ সালে ডিএমএনএল মিসরের অন্যান্য কমিউনিস্ট দলের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যায়।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বেহার নেদারল্যান্ডসে প্রত্যাবর্তন করেন, কিন্তু তার মা ও বোনেরা ইতোমধ্যেই ব্রিটেনে চলে গিয়েছিলেন। ১৯৪০ সালে জার্মানি নেদারল্যান্ডস আক্রমণ করে এবং অতিদ্রুত ডাচ সশস্ত্রবাহিনীকে পরাস্ত করে দেশটি দখল করে নেয়। একজন জার্মান গভর্নরের ওপর নেদারল্যান্ডসের শাসনভার ন্যস্ত হয়। ১৭ বছর বয়সী বেহার জার্মানদের হাতে গ্রেপ্তার হন, কিন্তু তার বয়স কম হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। বেহার নেদারল্যান্ডসে চলমান গোপন জার্মানবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগদান করেন এবং একজন বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করেন।
কিন্তু শীঘ্রই বেহারকে আবার অন্তরীণ করা হবে, এই আশঙ্কা দেখা দেয়। ১৯৪২ সালে বেহার জার্মান–অধিকৃত নেদারল্যান্ডস থেকে পালিয়ে যান, এবং সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, স্পেন ও ব্রিটিশ–নিয়ন্ত্রিত জিব্রাল্টার হয়ে ১৯৪৩ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে পৌঁছেন। সেখানে তিনি মা ও বোনদের সাক্ষাৎ লাভ করেন। একই বছর বেহারের মা আদালতে আবেদন করে তাদের পারিবারিক নাম পরিবর্তন করেন এবং ‘বেহার’–এর পরিবর্তে ‘ব্লেক’ নামটি গ্রহণ করেন। এর ফলে জর্জ বেহার পরিণত হন জর্জ ব্লেকে।
ব্লেক ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে (আনুষ্ঠানিকভাবে, ‘Royal Navy’ বা ‘রাজকীয় নৌবাহিনী’) একজন সাব–লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন এবং দুজন ক্রুর দ্বারা চালিত মিনি–সাবমেরিন চালানোর দায়িত্ব লাভ করেন। কিন্তু এই কাজে তিনি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি। ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস’ (এসআইএস বা প্রচলিত নাম অনুযায়ী ‘এমআইসিক্স’) ব্লেকের ভাষাজ্ঞানের জন্য তাঁকে রিক্রুট করে এবং ব্লেক সংস্থাটির ডাচ সেকশনে কাজ করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি এমআইসিক্সের ‘স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভে’ কাজ করেন এবং ইউরোপের জার্মান–অধিকৃত দেশগুলোতে গুপ্তচর প্রেরণ ও জার্মানবিরোধী গেরিলাদের রসদপত্র সরবরাহের কাজ করেন। এসময় তিনি আইরিস পিয়াক নামক এমআইসিক্সের এক নারীকর্মীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, কিন্তু ব্লেকের পরিবার অংশত ইহুদি হওয়ায় মেয়েটির পরিবার তাদের এই সম্পর্ককে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
১৯৪৬ সালে এমআইসিক্স ব্লেককে মিত্রশক্তি–অধিকৃত জার্মানির হামবুর্গে প্রেরণ করে। সেখানে ব্লেকের কাজ ছিল বন্দি জার্মান ‘ইউ–বোট’ ক্যাপ্টেনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। উল্লেখ্য, জার্মান সামরিক সাবমেরিনগুলোকে ‘ইউ–বোট’ (জার্মান: Unterseeboot) নামে অভিহিত করা হয়। হামবুর্গে দায়িত্ব পালন শেষে ব্লেককে ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনে ডেকে পাঠানো হয়, এবং তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ডাউনিং কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বিভিন্ন ভাষা অধ্যয়ন করেন, যেগুলোর মধ্যে রুশ ভাষাও ছিল। কার্যত এসময় স্নায়ুযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এবং কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্লেককে প্রস্তুত করা হচ্ছিল।
১৯৪৮ সালে ব্লেককে সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে অবস্থিত ব্রিটিশ দূতাবাসে ভাইস কনসাল পদে নিযুক্ত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল তার ছদ্মপরিচয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্লেকের মূল দায়িত্ব ছিল এমআইসিক্সের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের দূরপ্রাচ্য অঞ্চল, উত্তর কোরিয়া এবং (১৯৪৯ সালের পর থেকে) গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা। এসময় দূরপ্রাচ্যে কমিউনিস্ট ও নন–কমিউনিস্ট বিশ্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমশ তীব্র হচ্ছিল, এবং এজন্য দূরপ্রাচ্যের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা ছিল ব্রিটেনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
১৯৫০ সালের জুনে দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর উত্তর কোরীয় আক্রমণের মধ্য দিয়ে কোরীয় যুদ্ধ শুরু হয়, এবং শীঘ্রই উত্তর কোরীয় সৈন্যরা সিউল দখল করে নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীনে জাতিসংঘ দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করে, এবং ব্রিটেন মার্কিন–নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ বাহিনীতে যোগদান করে। এর ফলে উত্তর কোরীয় সৈন্যরা সিউলে অবস্থানরত ব্রিটিশ কূটনীতিকদের বন্দি করে, এবং তাদের মধ্যে ব্লেকও ছিলেন। ক্রমশ যুদ্ধের চাকা উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ঘুরতে শুরু করে এবং উত্তর কোরীয় সৈন্যরা সিউল থেকে পশ্চাৎপসরণের সময় ব্লেকসহ বন্দি ব্রিটিশ কূটনীতিকদের সঙ্গে করে নিয়ে যায়। প্রথমে তাদেরকে উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে অন্তরীণ করে রাখা হয়, এবং পরবর্তীতে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ বাহিনী পিয়ংইয়ং দখল করে নিলে তাদেরকে ইয়ালু নদীর তীরবর্তী একটি বন্দি শিবিরে প্রেরণ করা হয়।
উত্তর কোরিয়ায় থাকাকালে ব্লেক যুদ্ধের সত্যিকারের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এর চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না, কিন্তু ব্লেক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথমে ছিলেন নেদারল্যান্ডসে ও পরবর্তীতে ব্রিটেনে, যেখানে যুদ্ধের মাত্রা ততটা তীব্র ছিল না। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার গ্রামগুলোর ওপর মার্কিন বোমারু বিমানের নির্বিচার আক্রমণ তাকে হতচকিত করে। উল্লেখ্য, কোরীয় যুদ্ধ চলাকালে প্রায় ১২ থেকে ১৫ লক্ষ উত্তর কোরীয় বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিল, এবং এদের বড় একটি অংশ প্রাণ হারিয়েছিল মার্কিন বিমান হামলায়। উত্তর কোরীয় গ্রামগুলোর ওপর মার্কিন বিমান হামলা ছিল সাধারণত কৌশলগতভাবে মূল্যহীন, কারণ এই গ্রামগুলোর অধিকাংশ পুরুষ অধিবাসীই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল এবং এর ফলে গ্রামগুলোতে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ ছাড়া অন্য কেউ ছিল না।
প্রযুক্তিগতভাবে অনেক বেশি উন্নত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (ও পশ্চিমা বিশ্ব) কর্তৃক উত্তর কোরীয় জনসাধারণের ওপর পরিচালিত এই উদ্দেশ্যহীন ও নির্বিচার আক্রমণ ব্লেককে পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতি বিতৃষ্ণ করে তোলে। ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে, মিসরে অবস্থানকালেই ব্লেক মার্ক্সবাদী চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। কোরীয় যুদ্ধের নৃশংসতা পর্যবেক্ষণ করে তিনি কমিউনিজমের প্রতি অধিকতর সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে তিনি স্বেচ্ছায় পক্ষ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন, এবং উত্তর কোরীয় কর্তৃপক্ষকে জানান যে, তিনি সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার জন্য কাজ করতে প্রস্তুত। উল্লেখ্য, কোরীয় যুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর কোরিয়াকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করছিল এবং দেশটিতে সোভিয়েত সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। ব্লেকের পক্ষ পরিবর্তন সোভিয়েতদের জন্য ছিল খুবই লাভজনক, কারণ এর মধ্য দিয়ে তারা এমআইসিক্সের ভেতরে অনুপ্রবেশের সুযোগ লাভ করে।
১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে কোরীয় যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং অন্যান্য যুদ্ধবন্দিদের সাথে ব্লেককেও ‘মুক্তি’ দেয়া হয়। ব্লেকের পক্ষ পরিবর্তন সম্পর্কে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কোনো ধারণাই ছিল না, ফলে ব্লেক বীরের বেশে ব্রিটেনে প্রত্যাবর্তন করেন এবং এমআইসিক্সে আগের মতোই কাজ করতে থাকেন। একই সঙ্গে তিনি সোভিয়েতদের কাছে তথ্য পাচার করতে শুরু করেন। ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে তিনি গিলিয়ান অ্যালান নামক একজন এমআইসিক্স কর্মীকে বিয়ে করেন, এবং তার মাধ্যমে তিন সন্তানের জনক হন।
১৯৫৫ সালে ব্লেককে এমআইসিক্স কেস অফিসার হিসেবে বার্লিনে প্রেরণ করে। বার্লিন শহরটি তখন ছিল ভৌগোলিকভাবে পূর্ব জার্মানির অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু শহরটির কেবল পূর্বাংশ পূর্ব জার্মান সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। শহরটির পশ্চিমাংশ ছিল পশ্চিম জার্মানির নিয়ন্ত্রণাধীন। এমতাবস্থায় বার্লিন হয়ে উঠেছিল স্নায়ুযুদ্ধের গোয়েন্দা কার্যক্রমের একটি আদর্শ ক্ষেত্র। সেখানে ব্লেকের দায়িত্ব ছিল সোভিয়েত কর্মকর্তাদের এমআইসিক্সের ‘এজেন্ট’ হিসেবে রিক্রুট করা। কিন্তু ব্লেক উল্টো ব্রিটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’কে জানিয়ে দিতে থাকেন।
ব্লেক এসময় যেসব তথ্য কেজিবিকে সরবরাহ করেছিলেন, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল মার্কিন–ব্রিটিশ ‘অপারেশন গোল্ড’ সম্পর্কিত তথ্য। মার্কিন ও ব্রিটিশ গোয়েন্দারা পূর্ব বার্লিনে অবস্থিত সোভিয়েত সামরিক সদর দপ্তরের ওপর আড়ি পাতার উদ্দেশ্যে মাটির নিচ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিল এবং সেখান থেকে সোভিয়েত টেলিফোন লাইন ‘ট্যাপ’ করেছিল। এই অপারেশনটির মাধ্যমে তারা প্রচুর তথ্য জানতে পারে, এবং এজন্য একে তারা অত্যন্ত সফল একটি অভিযান হিসেবে বিবেচনা করত।
কিন্তু তাদের জানা ছিল না যে, ব্লেক শুরুতেই কেজিবিকে এই গোপন সুড়ঙ্গ সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছিলেন। এজন্য সোভিয়েতরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের টেলিফোন লাইনে প্রচুর ভুলভাল তথ্যের পাশাপাশি অল্প কিছু সঠিক তথ্যও আদানপ্রদান করতে থাকে, এবং এর মধ্য দিয়ে মার্কিন ও ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ভুয়া তথ্য সরবরাহ করতে শুরু করে। এক বছরের বেশি সময় ধরে সোভিয়েতরা এই ‘নাটক’ অব্যাহত রাখে। তারা চাইলেই সুড়ঙ্গটি বন্ধ করে দিতে পারত, কিন্তু সেক্ষেত্রে মার্কিন ও ব্রিটিশ গোয়েন্দারা সোভিয়েতদের ওপর নজরদারি করার নতুন কোনো উপায় খুঁজে নিত, যেটা হয়তো সোভিয়েতরা জানতে পারত না। তাছাড়া, সুড়ঙ্গটি সম্পর্কে জানার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েতরা সেটি বন্ধ করে দিলে ব্লেকের ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল। এজন্য ব্লেককে বার্লিন থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পরই কেবল সোভিয়েতরা সুড়ঙ্গটি ‘খুঁজে পায়’ (অর্থাৎ খুঁজে পাওয়ার নাটক করে), এবং যথারীতি এই উপলক্ষে জোরদার পশ্চিমাবিরোধী প্রচারণা চালায়। সামগ্রিকভাবে, ‘অপারেশন গোল্ড’ কার্যত ব্রিটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দাদের জন্য একটি লজ্জাজনক অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়।
বার্লিন থেকে প্রত্যাহার হওয়ার পর ব্লেক মূলত ব্রিটেনেই অবস্থান করেন। এই পুরো সময় জুড়ে তিনি ব্রিটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দা কার্যক্রম সম্পর্কিত প্রচুর তথ্য কেজিবির কাছে পাচার করতে থাকেন। তার প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শত শত পশ্চিমা গুপ্তচরের পরিচিতি কেজিবির কাছে ফাঁস হয়ে যায়। এর ফলে পূর্ব ইউরোপে এমআইসিক্সের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫৯ সালে ব্লেক কেজিবিকে জানান যে, সোভিয়েত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘গ্রু’তে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’ নিজেদের চর (mole) স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। ব্লেকের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী কেজিবি পিওতর পোপোভ নামক সেই গ্রু কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে, এবং পরবর্তীতে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।
অবশ্য ব্লেকের সৌভাগ্য এক পর্যায়ে শেষ হয়ে আসে। ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্ররাষ্ট্র পোল্যান্ডের গোয়েন্দা সংস্থা ‘জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়’–এর কর্মকর্তা মিখাইল গোলেনিয়েভস্কি পক্ষ পরিবর্তন করেন, এবং ব্লেকের প্রকৃত পরিচিতি ফাঁস করে দেন। এটি ছিল এমআইসিক্সের জন্য বড় একটি ধাক্কা। এসময় ব্লেক লেবাননে ‘মিডল ইস্ট সেন্টার ফর অ্যারাবিক স্টাডিজ’–এ অধ্যয়নরত ছিলেন। তাকে লন্ডনে ডেকে পাঠানো হয়, এবং তিনি লন্ডনে প্রত্যাবর্তনের পরপরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি স্বেচ্ছায় কেজিবির জন্য কাজ করতে রাজি হয়েছিলেন।
স্বভাবতই ব্লেকের বিচার হয় এবং বিচারে তাকে ৪২ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এটি ছিল তখন পর্যন্ত কোনো ব্রিটিশ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ মেয়াদের কারাদণ্ড (যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বাদে)। সেসময় পশ্চিমা সংবাদপত্রগুলো প্রচার করেছিল, ব্লেক ৪২ জন পশ্চিমা গুপ্তচরকে কেজিবির হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের প্রত্যেকের জন্য ব্লেককে এক বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে! অবশ্য ব্লেক এর চেয়ে দশগুণ বেশি সংখ্যক পশ্চিমা গুপ্তচরকে ধরিয়ে দিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।
কিন্তু ব্লেককে তার পুরো শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। তিনি উত্তর–পশ্চিম লন্ডনের ওয়র্মউড স্ক্রাবস কারাগারে বন্দি ছিলেন। তিনি কারাবন্দিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বন্দি থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে সিয়ান বুর্কে, মাইকেল র্যান্ডল এবং প্যাট্রিক পটোলের পরিচয় ঘটে। জাতিগতভাবে আইরিশ বুর্কে ছিলেন একজন ছোটখাট অপরাধী এবং বাকি দুজন ছিলেন পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী কর্মী। তারা ব্লেকের দীর্ঘ কারাদণ্ডকে ‘অমানবিক’ হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং এজন্য ব্লেককে কারাগার থেকে পালাতে সাহায্য করতে রাজি হন। ১৯৬৬ সালের ২২ অক্টোবর তাদের সহায়তায় ব্লেক কারাগার থেকে পালিয়ে যান এবং অল্প কয়েকদিন লুকিয়ে থাকেন। এরপর ব্লেক ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন এবং মোটরযোগে উত্তর ইউরোপ হয়ে পশ্চিম জার্মানির মধ্য দিয়ে পূর্ব জার্মানিতে পৌঁছেন। সেখানে কেজিবি কর্মকর্তারা সোৎসাহে ব্লেককে গ্রহণ করেন।
ব্লেকের পলায়নের জন্য অর্থায়ন করেন ব্রিটিশ চলচ্চিত্রকার টনি রিচার্ডসন, যিনি বামপন্থী চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, ব্লেকের পলায়নের পেছনে কেজিবির হাত আছে, কিন্তু এই ধারণা সম্পর্কে কোনো প্রমাণ ছিল না। পরবর্তীতে যখন দেখা গেল যে, ব্লেকের পলায়নে কেজিবির কোনো ভূমিকা ছিল না, বরং তিনজন সাধারণ ব্যক্তির সহায়তায় ব্লেক পালাতে সক্ষম হয়েছেন, তখন এটি ব্রিটিশ সরকারের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়। ব্লেককে যারা পালাতে সাহায্য করেছিলেন, তাদেরকে পরবর্তীতে ব্রিটেনে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, কিন্তু আদালত তাদেরকে দায়মুক্তি প্রদান করে। আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ব্লেকের পলায়ন সেসময় শোরগোল সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে এই ঘটনার ফলে ব্লেক ক্ষতিগ্রস্ত হন, কারণ তার পলায়নের দুই মাসের মধ্যেই ১৯৬৬ সালের নভেম্বরে তার স্ত্রী গিলিয়ান তার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নে পৌঁছানোর পর ব্লেক মস্কোয় বসবাস করতে থাকেন। তাকে সরাসরি কেজিবিতে নিয়োগ দেয়া হয় এবং তিনি সংস্থাটিতে কর্নেল পদমর্যাদা লাভ করেন। সোভিয়েত সরকার ব্লেককে ‘অর্ডার অফ লেনিন’ ও ‘অর্ডার অফ দ্য রেড ব্যানার’সহ নানাবিধ পদক ও পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৬৯ সালে ব্লেক ইদা নামক একজন রুশ নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং নতুন একটি পরিবার গঠন করেন।
১৯৯০ সালে ব্লেক ‘নো আদার চয়েস’ (No Other Choice) শিরোনামে একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন, এবং পরবর্তীতে ২০০৬ সালে ‘ট্রান্সপারেন্ট ওয়ালস’ (Transparent Walls) শিরোনামে তার লেখা আরেকটি বই প্রকাশিত হয়। ২০০৭ সালে রুশ সরকার তাকে ‘অর্ডার অফ ফ্রেন্ডশিপ’ পদক প্রদান করে। ‘এসভিআর’ কর্মকর্তাদের মতে, অবসর গ্রহণের পরেও ব্লেক গোয়েন্দা কার্যক্রম নিয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন, এবং এসভিআরের একজন পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতেন।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রায় তিন দশক পরেও ব্লেকের রাজনৈতিক মতবাদের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ২০১৭ সালে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে ব্লেক জানান যে, তখনও তিনি মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদের ওপর আস্থাশীল। রুশ গোয়েন্দাদের কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন, বর্তমান বিশ্বে দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিবিদরা পারমাণবিক যুদ্ধ এবং এর ফলে মানবজাতির ধ্বংস সাধনের বিষয়টিকে পুনরায় সামনে নিয়ে এসেছে, এবং এই পরিস্থিতিতে দুনিয়াকে ‘রক্ষা করা’র কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রুশ গোয়েন্দাদের ওপর ন্যস্ত!
ব্লেক তার পক্ষ পরিবর্তনকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে বিবেচনা করতেন না। তার মতে, কারো সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য প্রথমে তার অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। কিন্তু তিনি কখনো ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না! ব্লেক ছিলেন স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সেই স্বল্প সংখ্যক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের একজন, যারা কোনো আর্থিক বা অন্য কোনো সুবিধা লাভের জন্য নয়, বরং আদর্শিক কারণে পক্ষ পরিবর্তন করেছিলেন। কিছু কিছু প্রচারমাধ্যমে তাকে ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ডাবল এজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর ব্লেক মস্কোয় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। ব্লেকের মৃত্যুতে রুশ সরকার ও রুশ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা (ও বিশেষ করে ব্রিটিশ) প্রচারমাধ্যমে খোলাখুলিভাবেই অনেককে ব্লেকের মৃত্যু নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ব্লেকের কার্যক্রম কতটুকু সঠিক বা কতটুকু ভুল ছিল– সেটি নিয়ে বিতর্ক চলছে এবং এই বিতর্ক আদৌ শেষ হবে কি না, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট, ব্লেক জীবন্ত অবস্থাতেই গুপ্তচরবৃত্তির জগতের একজন কিংবদন্তী ছিলেন, এবং মৃত্যুর পরও তিনি একজন কিংবদন্তী হয়েই থেকে যাবেন।