স্কাইস্ক্র্যাপারের কারিগর ড. ফজলুর রহমান খান

সুদূর মার্কিন মুলূকের তৃতীয় বৃহত্তম শহর শিকাগো। শহরটিতে মেঘ ফুঁড়ে দাঁড়ানো ভবনের সংখ্যা মন্দ নয়। কিন্তু একটি ভবনকে আলাদা করে চিনে নিতে কষ্ট হয় না কারো, স্কাইস্ক্র্যাপারগুলোর মধ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে সে। ভবনটির আদি নাম সিয়ার্স টাওয়ার, মালিকানা বদলের কারণে বর্তমান নাম উইলিস টাওয়ার। ১১০ তলা বিশিষ্ট এ ভবনটি ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত শুধু শিকাগো শহরের নয়, পুরো পৃথিবীর উচ্চতম ভবন ছিলো। আর সেই সর্বোচ্চ ভবনটির রূপকার ছিলেন একজন বাংলাদেশী! তিনি শুধু কোনো বাংলাদেশীর ঔরসে জন্ম নিয়েছিলেন বলে নয়, উনার বেড়ে ওঠার পুরোটাই বাংলাদেশে। বলছিলাম ক্ষণজন্মা প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খানের কথা, যাকে ‘স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন’ বলা হয়!

উইলিস টাওয়ার বা তৎকালীন সিয়ার্স টাওয়ার

উইলিস টাওয়ার বা তৎকালীন সিয়ার্স টাওয়ার; ছবিসূত্র – www3.jjc.edu

এফ আর খানের শৈশব কাটে ফরিদপুর জেলার শিবচর থানার ভান্ডারীকান্দি গ্রামে। পিতা খান বাহাদুর আবদুর রহমান খান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে গোল্ড মেডেলিস্ট এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা। পুরান ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইন্টার পাস করেন ফজলুর রহমান খান। তারপর তৎকালীন শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পুরকৌশল প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হন।

দেশ বিভাগের পর পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ফাইনাল পরীক্ষায় বসা হয় নি তাঁর। পরে ঢাকায় ফিরে বিশেষ বিবেচনায় বুয়েট (তৎকালীন আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সমাপ্ত করেন তিনি। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি সরকারী বৃত্তি এবং ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট আরবানা শ্যাম্পেইন থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং তত্ত্বীয় ও ফলিত মেকানিক্সে যুগ্ম এমএস করার পর ফজলুর রহমান ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে।

আরেক স্কাইস্ক্র্যাপার ‘জন হ্যানকক সেন্টার’-এর মডেলের পাশে এফ আর খান, সাথে ভবনটির স্থপতি ব্রুস গ্রাহাম

আরেক স্কাইস্ক্র্যাপার ‘জন হ্যানকক সেন্টার’-এর মডেলের পাশে এফ আর খান, সাথে ভবনটির স্থপতি ব্রুস গ্রাহাম; ছবিসূত্র – lehigh.edu

বুয়েট থেকে ডিগ্রি অর্জনের পরপরই সেখানে অধ্যাপনা শুরু করেন এফ আর খান। পরে ১৯৫৬ সালে ডক্টরেট শেষ করে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, এ দেশে তাঁর মেধার যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তাই আবার বাধ্য হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, নিজের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। তারপর থেকে তিনি জন্ম দিতে থাকেন একের পর এক বিস্ময়।

শুধু উইলিস টাওয়ার নয়, তার অদূরে আরেকটি শততল ভবন ‘জন হ্যানকক সেন্টার’, এর সাথেও মিশে আছে এফ আর খানের নাম। এ দুটো গগনচুম্বী প্রজেক্টই তাকে এনে দেয় বিরল সম্মান আর বাংলাদেশের জন্য অশেষ গর্ব। উইলিস টাওয়ারের যখন কাজ চলছে পুরো দমে, ১৯৭২ সালে তিনি ‘ইঞ্জিনিয়ার নিউজ রেকর্ড’-এর ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ মনোনীত হন। ১৯৭৩ সালে এফ আর খান যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল একাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৪ সালে আমেরিকার ‘নিউজ উইক ম্যাগাজিন’-এর কভার ফিচারে তাঁকে মার্কিন স্থাপত্যের শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়। এছাড়া ‘ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ড’ ম্যাগাজিন তাঁকে পাঁচবার (৬৫, ৬৮, ৭০, ৭১ এবং ৭৯ সাল) স্থাপত্য শিল্পে ‘সর্বোচ্চ অবদানকারী ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে ঘোষণা করে। মুসলিম স্থাপত্য শিল্পে তাঁর গবেষণা আর বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ‘আগা খান স্থাপত্য পুরষ্কার’ লাভ করেন।

‘ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ড’-এর প্রচ্ছদে এফ আর খান

‘ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ড’-এর প্রচ্ছদে এফ আর খান। ছবিসূত্র – এফ আর খানের কন্যা ইয়াসমিন সাবিনা খানের ফেসবুক পেজ

এফ আর খান আন্তর্জাতিক স্কাইক্রাপার্স ও নগরায়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং বর্তমানে তাঁর সম্মানে ‘ফজলুর রহমান খান আজীবন সম্মাননা পদক’ প্রদান করে প্রতিষ্ঠানটি। তাঁর সম্মানে উইলিস টাওয়ারের পাদদেশে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে, ‘ফজলুর আর. খান ওয়ে’। তার পাশেই ‍নজরকাড়া স্মৃতিফলক ফজলুর রহমানের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা করে চলেছে।

সম্মানসূচক ফজলুর রহমান খান ওয়ে; ছবিসূত্র – প্রথম আলো

উইলিস টাওয়ারে এফ আর খানের স্মৃতিফলক

উইলিস টাওয়ারে এফ আর খানের স্মৃতিফলক; ছবিসূত্র – প্রথম আলো

বিখ্যাত দুই স্কাইক্র্যাপার তাঁকে সেই জগতের পথিকৃতের স্থান দিলেও তিনি পুরকৌশল প্রকৌশলের অন্যান্য শাখাতেও সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন। ওয়ান ম্যাগনেফিসেন্ট মাইল, জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হজ্জ্ব টার্মিনাল, কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, কলোরাডোতে অবস্থিত মার্কিন বিমান বাহিনীর একাডেমী, ম্যাকম্যাথ-পিয়ার্স সোলার টেলিস্কোপ, বেশ কিছু স্টেডিয়ামসহ আরো অনেক স্থাপনায় তিনি কাজ করেছেন।

কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন বা CAD-এর সূচনাও তাঁর হাত ধরে। ষাট-সত্তরের দশকে যখন পশ্চিমা প্রকৌশলীদের কাছেও কম্পিউটার খু্ব বেশি পরিচিত ছিলো না, তখন এই বাংলাদেশী প্রকৌশলীর হাত ধরেই পরিচিতি পায় ক্যাড। প্রকৌশলের আধুনিকায়নে তাঁর এ পদক্ষেপ ছিলো যুগান্তকারী।

কর্মজীবনের প্রায় পুরোটা বিদেশের মাটিতে কাটালেও তিনি বাংলাদেশ আর বাঙালীয়ানাকে অন্তরে ধারণ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা যখন নিক্সন সরকারের সমর্থন লাভ করে এবং সৈন্য সাহায্য পাওয়ার আশায় থাকে, তখন খোদ মার্কিন মুলুকে বসে তার বিরোধিতা করেন এফ আর খান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের যে আন্দোলন, তার নেতৃত্ব দেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে প্রবাসীদের নিয়ে গঠিত হয় দুটি সংগঠন: ‘বাংলাদেশ ইমার্জেন্সি ওয়েলফেয়ার আপিল’, যার উদ্দেশ্য ছিলো মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে প্রচার-প্রচারণা এবং রিলিফ সংগ্রহ এবং ‘বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ’, যে সংগঠনটি কূটনৈতিকভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছে বিশ্ববাসীর কাছে, বিশেষভাবে মার্কিন সরকারের কাছে। তিনি মার্কিন সিনেটে গিয়ে পাকিস্তানীদের মুখোশ উন্মোচন করে দেন। মূলত এই সংগঠনের তৎপরতায় ওয়াশিংটন সৈন্য পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করে।

বাঙালী জাতিসত্তার যে বিশেষ অঙ্গ রবীন্দ্র সঙ্গীত তা তিনি নিজের জীবনে ধারণ করেছেন এবং খুব ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। ছোটভাই ড. জিল্লুর রহমান খানের পিয়ানোর সুরে তাই পারিবারিক মিলনমেলায় সুর তুলতেন প্রায়ই।

পারিবারিক মিলনমেলায় রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছেন এফ আর খান। ছবিসূত্র – ইয়াসমিন সাবিনা খানের ফেসবুক পেজ

১৯৯৯ সালে ফজলুর রহমান খানের স্মরণে এই ডাকটিকিটটি প্রকাশ করে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ, যেখানে এফ আর খানের পেছনে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর বুকে তাঁর অমর হয়ে থাকার অন্যতম কারণ সিয়ার্স টাওয়ার।

ডাকটিকিটে ফজলুর রহমান খান। ছবিসূত্র – উইকিপিডিয়া

ফজলুর রহমান খান বলেছিলেন, “সিয়ার্স টাওয়ার যে সম্মান আমাকে এনে দিয়েছে, আমি সে কাজ করে যতটুকু আনন্দ পেয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ পাবো যদি দেশীয় সম্পদে স্কাইস্ক্র্যাপার তৈরির পন্থা আবিষ্কার করতে পারি।” কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি সেই কাজ আমাদের জন্য করে যেতে পারেন নি। তার পূর্বেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন স্কাইস্ক্র্যাপারের জনক।

মাত্র ৫২ বছর বয়সে জেদ্দা যাওয়া পথে মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তী। তার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর কীর্তিগাথা রচনাস্থল শিকাগোতে। সেখানকার গ্রেসল্যান্ড কবরস্থানের সমাহিত করা হয় তাঁকে, বহু বছর পর তাঁর স্ত্রী ল্যাসেলট খানও শায়িত হন একই কররে। তাঁদের এপিটাফের উপর লেখা আছে এফ আর খানের আজন্ম ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথের গানের দুটি চরণ –

“তোমার হল শুরু
আমার হল সারা
তোমায় আমায় মিলে
এমনি বহে ধারা।।”

এফ আর খান এবং ল্যাসেলট খান-এর সমাধি

এফ আর খান এবং ল্যাসেলট খান-এর সমাধি; ছবিসূত্র – ইয়াসমিন সাবিনা খানের ফেসবুক পেজ।

এফ আর খানের ৮৮তম জন্মদিনে গুগলের ‍ডুডল

ক্ষণজন্মা এই প্রকৌশলীর আটাশিতম জন্মদিন গেল গত ৩ এপ্রিল। তাঁর স্মরণে সেদিন গুগল প্রথমবারের মতো ডুডল প্রকাশ করেছিল যা দেখতে পেয়েছিলেন বাংলাদেশ এবং আমেরিকার সকল গুগল ব্যবহারকারী।

তথ্যসূত্র

১) drfazlurrkhan.com/

২) en.wikipedia.org/wiki/Fazlur_Rahman_Khan

৩) en.wikipedia.org/wiki/Willis_Tower

৪) facebook.com/YasminSabinaKhan

Related Articles

Exit mobile version