মার্গারেট থ্যাচার। আয়রন লেডি বা লৌহ মানবী নামে খ্যাত এই নারী ছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৯-৯০ সাল পর্যন্ত তার শাসনামল ছিল। দীর্ঘ প্রায় এক দশকের নেতৃত্বে তিনি যুক্তরাজ্যকে সম্পূর্ণ নতুন এক পথে চালনা করেছেন। প্রমাণ করে গেছেন, ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে কীভাবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে হয়।
রাজনীতিতে শ্রমিক সমিতির হস্তক্ষেপ হ্রাস, বিভিন্ন শিল্পখাতের বেসরকারিকরণ, রাজনৈতিক বিতর্কের ধারা পরিবর্তন, গণমানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ইত্যাদি নানাকিছুর শুভ সূচনা ঘটেছে থ্যাচারের হাত ধরে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, থ্যাচার তার রাজনৈতিক দর্শনে বন্ধুপ্রতিম যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যানের দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘতম সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেষতক তার নিজের রাজনৈতিক দল কনজার্ভেটিভ পার্টির সদস্যদের চাপে পড়ে বাধ্য হন পদত্যাগ করতে।
প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন মার্গারেট হিল্ডা রবার্টস। ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ারের শহরতলী গ্র্যান্থামে ১৯২৫ সালের ১৩ অক্টোবর মার্গারেটের জন্ম। বাবা আলফ্রেড ছিলেন দোকানদার এবং মা বিয়েট্রিস ছিলেন মেথডিস্ট। বাবা আলফ্রেডও যুক্ত ছিলেন সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে। ষোল বছর যাবত গ্র্যান্থামের কাউন্সিল সদস্য হিসেবে কাজ করার পর ১৯৪৫ সালে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। মেয়র হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, বেশিদিন হয়নি। সে সময়ে কোনো নারী সম্ভবত স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না, তিনি অক্সফোর্ডে পড়তে যাচ্ছেন। মার্গারেট থ্যাচার পেরেছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনা শেষ করলেন রসায়ন বিভাগ থেকে এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফিতে বিশেষ দক্ষতা নিয়ে। এসময়ে তার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন নোবেলজয়ী রসায়নবিদ ডরথি হজকিন। স্নাতক সম্পন্ন করে থ্যাচার রসায়নবিদ হিসেবে যোগদান করেন এসেক্সের কোলচেস্টারে অবস্থিত বিএস প্লাস্টিকসে।
১৯৪৮ সালে ইম্পেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি চাকরির আবেদন করেন এবং প্রত্যাখ্যাত হন। কারণ ইম্পেরিয়ালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টিতে থ্যাচার ছিলেন উদ্ধত, একগুঁয়ে, জেদি এবং নিজের মতামতে অটল থাকা একজন মানুষ। তিনি এতটুকু বিচলিত না হয়ে দিব্যি রসায়নবিদ হিসেবে তার কাজ চালিয়ে গেলেন আর সাথে তার রাজনীতির ক্ষুধাটুকু রয়েই গেল। লোকাল কনজার্ভেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের সাথে তিনি যুক্ত হয়ে গেলেন। ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালে পরপর দুই মেয়াদে তিনি কনজার্ভেটিভ পার্টি থেকে লেবার পদপ্রার্থী হিসেবে সাধারণ নির্বাচনে সবচেয়ে কনিষ্ঠ এবং একমাত্র নারী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন।
দুবারই তিনি হেরে যান। ১৯৪৯ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কিছুকাল পরেই তার পরিচয় ঘটে সফল ব্যবসায়ী ডেনিস থ্যাচারের সাথে। ডেনিসের তখন সদ্য বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে। প্রথম দর্শনেই ডেনিসকে ভালো লাগে মার্গারেটের এবং ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখ তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরই মাধ্যমে মার্গারেট হিল্ডা রবার্টস হলেন মার্গারেট থ্যাচার।
১৯৫৫ সালে কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হওয়ায় মার্গারেট থ্যাচার রাজনীতি থেকে সাময়িক অবসর গ্রহণ করেন। ততদিনে তিনি দুই যমজ সন্তানের মা। তাদের দেখাশোনা করার জন্যই রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে সরে আসেন থ্যাচার। চার বছর বাদে ১৯৫৯ সালে এক বলিষ্ঠ প্রচারণার পর অবশেষে তিনি ফিঞ্চলে কাউন্টিতে কনজার্ভেটিভ পার্টির সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। পরবর্তী দশকে তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে নানাবিধ পদে সফলতার সাথে কাজ করেন এবং ইংল্যান্ড জুড়ে এক তুমুল জনপ্রিয় ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে আলোচিত-সমালোচিত হন। এই ১০ বছরের পরিক্রমায় তিনি আলোচনার কেন্দ্রে থাকেন তার ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট নীতির প্রতি শর্তহীন সমর্থনের দরুন।
১৯৭০ সালে থ্যাচার সেক্রেটারি অভ স্টেট ফর সায়েন্স অ্যান্ড এডুকেশন হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সমালোচক এবং সাধারণ মানুষের তুমুল সমালোচনার শিকার হন ফ্রি স্কুল মিল্ক স্কিমের অবসান ঘটানোর মাধ্যমে। ইংল্যান্ড জুড়ে মানুষ তাকে ডাকতে শুরু করে ‘থ্যাচার, মিল্ক স্ন্যাচার’ নামে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হেথের সাথে তার সম্পর্ক ঠিক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ছিল না। দুজনের মাঝে বোঝাপড়ার অভাবের কারণে থ্যাচার কোনোভাবেই হেথকে তার ধারণাগুলো সম্পর্কে বিশদভাবে বোঝাতে পারছিলেন না। এতে করে ক্যাবিনেটের একজন সদস্য হিসেবে এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে তার দক্ষতা, মেধা, প্রজ্ঞার সুবিচার হচ্ছিল না।
একের পর এক প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে তিনি তখন বেশ ক্লান্ত। নিতান্তই দিশেহারা হয়ে ১৯৭৩ সালের এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি এই হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন যে, হয়তো তার জীবদ্দশায় তিনি কোনো নারীকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখে যেতে পারবেন না। থ্যাচার খুব শীঘ্রই নিজেই নিজেকে ভুল প্রমাণ করলেন। ১৯৭৪ সালে কনজার্ভেটিভ পার্টি ক্ষমতা হারালে নিজ দলের মাঝে দারুণ শক্তিশালী সদস্য হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন। হেথকে পরাজিত করে ১৯৭৫ সালে তিনি কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। এ বিজয়ের মাধ্যমেই থ্যাচার প্রথম নারী হিসেবে হাউজ অভ কমন্সে বিরোধী দলকে নেতৃত্ব প্রদান আরম্ভ করেন।
ততদিন ইংল্যান্ড আক্ষরিক অর্থেই এক চূড়ান্ত ছন্নছাড়া অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল পুরোপুরিভাবে দেউলিয়া, বেকারত্বের হার আকাশচুম্বী, শ্রমিক সমিতিগুলোর মাঝে কলহ ইত্যাদি মিলিয়ে যুক্তরাজ্য রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত। মূলত এই অস্থিতিশীল অবস্থাই কনজার্ভেটিভ পার্টির জন্য শাপেবর হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৯ সালে কনজার্ভেটিভ পার্টি আবার ক্ষমতায় বহাল হলে থ্যাচার ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ১৯৭৯ সালের মে মাসে যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মার্গারেট থ্যাচারের উদ্দেশ্য ছিল একেবারে স্বচ্ছ ও দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন। পরজীবী যুক্তরাজ্যকে স্বনির্ভর যুক্তরাজ্য হিসেবে গড়ে তোলা এবং নাগরিকদের ভিক্ষাবৃত্তিমূলক মনোভাব বদলে ‘নিজেই গড়ব নিজের দেশ’ দর্শনে দীক্ষিত করাই ছিল তার পরিকল্পনা। প্রথম মেয়াদে থ্যাচারের কাজের অধিকাংশই ছিল অর্থনৈতিক স্থিরতা ফিরিয়ে আনা। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং সেবাখাতসমূহকে বেসরকারিকরণের মাধ্যমে তিনি যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চেয়েছিলেন। তেল, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিভিশন, রেডিও, বিমান, ব্রিটিশ স্টিল ইত্যাদি খাতকে তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে বেসরকারি খাতে স্থানান্তর করেন। ফলাফল হিসেবে ১৯৮০ সাল নাগাদ ব্যক্তিগত পর্যায়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা আগের চেয়ে তিনগুণ বৃদ্ধি পায় এবং সরকার তার অধিগ্রহণকৃত প্রায় ১৫ লক্ষ গৃহ মূল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
মার্গারেট থ্যাচারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল তার রাজনৈতিক দর্শনে। তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ হতে সক্ষম হয়েছিলেন, যে তার অবসর গ্রহণের পরেও তিনি তার কাজ, বিচার ক্ষমতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে বিরোধী দলের কাছে সমধিক পূজনীয় হয়ে উঠেছিলেন। ব্রিটিশ লেবার পার্টি, যাদের থ্যাচার দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতাসীন হতে দেননি, তার অবসর গ্রহণের পর তারাও থ্যাচারিজমে দারুণ অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে।
পরবর্তী সময়ে লেবার পার্টির রাজনৈতিক কার্যকলাপে থ্যাচারিজমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব লক্ষণীয় ছিল প্রবলভাবে। হাউজ অভ লর্ডস তাকে পিয়ারেস ফর লাইফ (যার উপাধি কখনও সঞ্চারিত হতে পারে না) ঘোষণা করে। অবসর জীবনে মার্গারেট প্রতিষ্ঠা করেন থ্যাচার ফাউন্ডেশন- গণতন্ত্রের প্রচার-প্রসার ঘটানোই ছিল যার উদ্দেশ্য। লৌহ মানবীকে যুক্তরাজ্য তো বটেই, সমগ্র পৃথিবীই স্মরণ করবে যুগ যুগ ধরে। দৃঢ়তার এমন সুনিপুণ সংজ্ঞায়ন পৃথিবীতে বারবার আসে না!