এটি সম্ভবত ২০০০ সালের দিকের ঘটনা। তখন আমি থাকতাম গ্রামে। সেই সময়ে গ্রামের অনেক বাড়িতে টেলিভিশন বলতে কিছুই ছিলো না। তখন ছিলো বিটিভির সময়। বিটিভিতে প্রতি শুক্রবার পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখানো হত। তিনটা থেকে শুরু হয়ে তিন-চার ঘন্টা ধরে চলতো। সাথে ছিলো সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপন বিরতি।
আশেপাশের আর কোনো বাড়িতে যেহেতু টেলিভিশন ছিলো না, তাই প্রতি শুক্রবার বাংলা সিনেমা দেখার জন্য আমাদের সাদাকালো ছোটখাটো টেলিভিশন সেটটার সামনে মানুষের ভিড় জমে যেত। কারণ ওই একটা সিনেমাই ছিলো কারো কারো জন্য পুরো সপ্তাহের বিনোদন। ছোট ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়ো মানুষজন সবাই ছিলো সেই দলে।
এরকমই কোনো এক শুক্রবারে কার চিৎকার-চেচামেচিতে যেন আমার ঘুম ভাঙলো। বাড়িতে মোটামুটি উৎসবের আমেজ। কিছুক্ষণ পর যা জানা গেল তা হল যে আজ নাকি সালমান শাহ এর সিনেমা দেখানো হবে।
আগেই বলে রাখি- বিটিভিতে পুরো একদিন কী দেখানো হবে তা আগের দিন রাত্রেই বলে দেওয়া হতো। তখন আমার বয়স তখন হবে ছয় কিংবা সাতের মতো। কোনো এক কারণে টেলিভিশনের প্রতি অগাধ আকর্ষণ। হাঁ করে তাকিয়ে থাকি সিনেমা শুরু হলে। ছোট্ট একটা বাক্সের ভিতরে এত এত মানুষজন, পশুপাখি, উচু উচু বিল্ডিং কীভাবে এলো সেটা তখনও আমার কাছে রহস্যের মতো। ঠিক তেমনেই এক রহস্য সালমান শাহ। সবার কাছে এই নায়কের নাম শুনতে শুনতে তখন আমি মোটামুটি ক্লান্ত।
সেই আমি যখন শুনলাম আজ সালমান শাহের সিনেমা আছে তখন আমার আনন্দ আর দেখে কে! তিনটা বাজার আগেই গোসল, খাওয়া-দাওয়া সেরে একটা চেয়ার নিয়ে একেবারে টেলিভিশনের সামনে রেডি। কিন্তু আমার আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। সময় বাড়ার সাথে সাথে মানুষজনের ভিড়ও বাড়তে লাগলো। অন্য সব দিনের থেকে আজ ভিড় কয়েকগুণ বেশি। শেষমেশ আমারই সাধের চেয়ারখানা ছেড়ে দিয়ে একেবারে পিছনে কোনো এক জায়গায় গিয়ে বসা লাগলো।
অনেক হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে শেষ পর্যন্ত শুরু হলো সিনেমা। প্রথমবারের মতো টেলিভিশন পর্দায় দেখতে পেলাম সালমান শাহ-কে। নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উজ্জলতম নক্ষত্র। যার তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা এখনো হয়তো অনেকটা কিংবদন্তীর মতো শোনাবে।
আমাদের চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তীর জন্ম ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলায়। তাঁর পিতার নাম কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মাতা নীলা চৌধুরী। সালমানের দাদার বাড়ি সিলেট শহরের শেখঘাটে আর নানার বাড়ি দারিয়া পাড়ায় । যে বাড়ির নাম এখন ‘সালমান শাহ হাউস’ । তাঁর নানার মূলবাড়ি ছিল মৌলভিবাজারে। তাদের পরিবারটি ছিল সংস্কৃতিমনা। তাঁর নানা পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এ অভিনয় করেছিলেন। তাই অভিনয় জগতে আসার জন্য ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সবার উৎসাহ, সহায়তা তিনি পেয়েছিলেন। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় সবার আদরেরও ছিলেন তিনি।
দিন যায় আর আমাদের নায়ক ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন। ভর্তি হন খুলনার বয়রা মডেল হাই স্কুলে। এরপর ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকার ধানমন্ডি আরব মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। সেই সময়ে বন্ধুমহলে সবাই তাঁকে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে চিনত। ১৯৮৬ সালে ছায়ানট থেকে পল্লিগীতিতে উত্তীর্ণও হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ধানমন্ডির মালেকা সায়েন্স কলেজ থেকে বি. কম পাস করেন। সেই সময়েই বন্ধুদের বলতেন তাঁর স্বপ্নের কথা। বলতেন একদিন অনেক বড় অভিনেতা হবেন তিনি।
চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের আগেই ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট বিয়ে করেন তিনি। স্ত্রী ছিলেন তাঁর মায়ের বান্ধবীর মেয়ে সামিরা হক। তাঁর শ্বশুড় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক উইকেটকিপার এবং অধিনায়ক শফিকুল হক হীরা। সামিরা কিছু চলচ্চিত্রে সালমানের পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করেন।
আমরা সবাই জানি সালমান শাহের চলচ্চিত্রে পদার্পণ হয়েছিলো সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়ে। কিন্তু সালমান শাহের অভিনয় যাত্রা শুরু হয় তারও আগে, আশির দশকের দিকে। হানিফ সংকেতের উপস্থাপনায় কথার কথা নামক একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে গানের মডেল হন তিনি। একজন সম্ভাবনাময় তরুণ কীভাবে তাঁর পরিবারের নানারকমের ঝামেলার কারণে মাদকাসক্ত হয়ে মারা যায়, এই ছিল গানটির মুল বিষয়বস্তু। গানটির প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই সালমান শাহ মিডিয়াতে প্রথম আলোচিত হন।
এরপর মঈনুল আহসান সাবেরের লেখা ধারাবাহিক ‘পাথর সময়’-এ একটি চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে সালমান শাহ-এর অভিনয় জীবন শুরু হয়। ওই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে তৌকির আহমেদ অভিনয় করলেও তাঁর চরিত্রটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই সময়ে বিটিভিতে আকাশ ছোয়াঁ নামক একটি নাটকেও তিনি অভিনয় করেন। তারপরে তিনি আরও বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন। এগুলো হলো দেয়াল (১৯৮৫), সব পাখি ঘরে ফিরে (১৯৮৫), সৈকতে সারস (১৯৮৮), পাথর সময় (১৯৯০), ইতিকথা (১৯৯৪), নয়ন (১৯৯৫) এবং স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬)। এর মাঝে বেশ কয়েকটি নাটক ইউটউবেও পাওয়া যায়। এছাড়া বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেন তিনি।
এবার আমরা শুনবো তাঁর চলচ্চিত্রে পদার্পণের গল্প। সেই সময়ে তিনটি জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার (‘সনম বেওয়াফা’, ‘দিল’ ও ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’) কপিরাইট কিনে নেয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দ মেলা। তারা পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানকে বলেন এগুলোর যেকোনো একটির কাহিনী নিয়ে একটি বাংলা ছবি পুনঃনির্মাণ করার জন্য।
কিন্তু তখনকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এরকম রোমান্টিক ধাঁচের সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য এরকম কোনো উপযুক্ত জুটি তিনি খুঁজে পাননি। শুরু হলো নতুন মুখের সন্ধান। নায়িকা হিসেবে সেই সময়ের জনপ্রিয় মডেল মৌসুমীকে নির্বাচন করা হয় শেষ পর্যন্ত, কিন্তু নায়কের দেখা আর মেলে না।
এমনই এক সময়ে ‘ইমন’ নামে একটি ছেলের সন্ধান পান তিনি। তিনি ইমনকে তার সাথে দেখা করতে বলেন। ইমন যখন তার সাথে দেখা করার জন্য দরজা দিয়ে তার অফিসে ঢুকছিলেন, তখনই তিনি বুঝে ফেলেন যে তিনি তার নায়ক পেয়ে গেছেন।
এরপর তিনি ইমনকে ‘সনম বেওয়াফা’ ছবির জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইমন তাতে রাজি নয়। কারণ হিসেবে সে জানালো যে ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ সিনেমাটিই তাঁর বেশি পছন্দ। এটি সে ইতিমধ্যে ২৬ বার দেখে ফেলেছে। আমির খান ও জুহি চাওলা অভিনীত ওইসময়ের অন্যতম সুপারহিট হিন্দি সিনেমা ছিল সেটি।
শেষপর্যন্ত সোহানুর রহমান সোহান রাজি হন এবং তাঁকে নিয়েই ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। এই ইমন ছেলেটির পুরো নাম ছিলো শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। পরবর্তীতে তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সালমান শাহ। এই সালমান শাহ নামেই তিনি এদেশের কোটি ভক্তদের হৃদয় জয় করে নেন একসময়। এভাবেই শুরু হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে জগতের একটি নতুন অধ্যায় যার প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছিলো শুধুই সালমান শাহ।
অবশ্য ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্র নির্মাণ যখন শেষ হয় তখন অনেকেই এই ছবিটির সাফল্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কারণ এটি ছিলো একটি হিন্দি সিনেমার পুনঃনির্মাণ। কিন্তু তাদের সেই আশংকা সত্যি হয়নি। দর্শকরা সালমান শাহের মতো একজন তরুণ, ফ্যাশন সচেতন, সুদর্শন নায়ককে সাদরে বরণ করে নেয়। সুপার হিট হয় সালমান-মৌসুমী জুটি। সালমান শাহ এবং মৌসুমী অবশ্য এই ছবিতে অভিনয়ের আগেই একে অপরকে চিনতেন। খুলনার বয়রা মডেল হাই স্কুলে পড়ার সময় সালমান শাহের সহপাঠী ছিলেন মৌসুমী। কিন্তু কোনো এক কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব তৈরী হয়। একটা সময় পর তারা একসাথে আর কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি।
কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার পর পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের সাথে আর তাঁর আর কাজ করা হয়নি। খুবই ছোট একটা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। যদিও ঘটনাটা বেশ মজার। কেয়ামত থেকে কেয়ামত মুক্তি পাওয়ার পর সালমান এবং মৌসুমী দুজনই তাদের মাকে নিয়ে পরিচালকের সাথে কোন একটা সিনেমা হলে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে তারা একটি হোটেলে উঠলেন। তখন তারা আবিষ্কার করলেন যে তাদের রুমগুলোর মধ্যে শুধু একটাতে অ্যাটাচড বাথরুম আছে। তো ওই রুমটাতে কারা থাকবেন এ নিয়ে সালমান শাহ এবং মৌসুমীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া চলছে। এমন সময় পরিচলক সোহানুর রহমান এসে মৌসুমীর পক্ষ নিলেন। সালমান শাহ ছিলেন প্রচন্ড অভিমানী স্বভাবের। মৌসুমীর পক্ষ নেওয়াতে পরিচালকের উপর রাগ করলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটলো এরকম একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ মুক্তির পর সালমান শাহকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক ব্যবসা সফল সিনেমা উপহার দিয়ে চলেন তিনি। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত এই চার বছরে ২৭টি সিনেমায় অভিনয় করেন সালমান শাহ। এগুলো হলো- ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ (১৯৯৩), ‘তুমি আমার’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘সুজন সখী’, ‘বিক্ষোভ’, ‘স্নেহ’, ‘প্রেম যুদ্ধ’ (১৯৯৪), ‘কন্যাদান’, ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘আঞ্জুমান’, ‘মহামিলন’, ‘আশা ভালোবাসা’ (১৯৯৫), ‘বিচার হবে’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘প্রিয়জন’, ‘তোমাকে চাই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘জীবন সংসার’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’ (১৯৯৬), ‘প্রেমপিয়াসী’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘শুধু তুমি’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘বুকের ভেতর আগুন’ (১৯৯৭)। এর মধ্যে প্রিয়জন ছবিতে তাঁর সাথে ছিলেন পরবর্তী সময়ের জনপ্রিয় নায়ক রিয়াজ।
সালমান শাহ ‘মন মানে না’ ছবিটির ৫০% কাজ শেষ করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে রিয়াজ কে দিয়ে ছবিটি করানো হয়।
২৭টি সিনেমার ১৪টিতেই সালমানের বিপরীতে অভিনয় করেন শাবনূর। এই সালমান-শাবনূর জুটি বোধহয় বাংলাদেশের সিনেমা জগতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি। তাদের প্রথম ছবি ছিলো ‘তুমি আমার’। এই ছবির পরিচালক জহিরুল হক সালমান শাবনুরকে দিয়ে আরও একটি ছবিতে হাত দিয়েছিলেন যা ছিল খান আতাউর রহমানের কালজয়ী ফোক ছবি ‘সুজন সখী’র রিমেক ‘রঙ্গিন সুজন সখী’। দুর্ভাগ্যবশত জহিরুল হক ছবিটি শেষ করতে পারেননি। শেষ হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরন করেছিলেন। জহিরুল হকের মৃত্যুর পর শাহ আলম কিরন ‘সুজন সখী’ ছবিটির কাজ শেষ করে ছবিটি মুক্তি দেন ১৯৯৪ সালের ১২ আগস্ট ।
পরবর্তীতে মোহাম্মদ হান্নান তার ‘বিক্ষোভ’ ছবিতে রোমান্টিক গল্পের বাহিরে তারুণ্যদীপ্ত প্রতিবাদী চরিত্রে দর্শকদের সামনে নতুন এক সালমানকে হাজির করেন। ‘বিক্ষোভ’ ছবিটি ছিল রোমান্টিক ইমেজের বাহিরে সালমানের ভিন্নধর্মী শ্রেষ্ঠ একটা ছবি যা তাঁর ক্যারিয়ারে আর একটাও নেই । তুমি আমার’ ও ‘বিক্ষোভ’ ছবির সাফল্যের পর সালমান শাবনুর জুটি তখনকার ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
এছাড়া সালমান শাহের জুটি হয়ে অভিনয় করেছিলেন শাবনাজ, শাহনাজ, লিমা, শিল্পী, শ্যামা, সোনিয়া, বৃষ্টি, সাবরিনা ও কাঞ্চি। কিন্তু এই জুটিগুলো তেমনভাবে দর্শকদের নজর কাড়তে পারেনি। যার ফলে পরিচালকরা সালমান-শাবনূর জুটির উপরেই নির্ভর করতে থাকেন।
ফ্লপ শব্দটি কখনো এই মহানায়ককে স্পর্শও পর্যন্ত করতে পারেনি। তাঁর প্রতিটি সিনেমা দেখার জন্য সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়তো দর্শকরা। তখন অসংখ্য তরুণীর স্বপ্নের পুরুষ এই সালমান শাহ, বলিউডের কোনো নায়ক নয়। সুন্দর চেহারার সাথে অভিনয় ক্ষমতা, ফ্যাশন সচেতনতা, ব্যক্তিত্ব সবকিছু মিলিয়ে এমন উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, যার কাছাকাছি পৌছাতে পারেনি পরবর্তী সময়ের আর কোনো নায়ক।
একটা ঘটনা বলি। একবার একটি মেয়ে অনেক দূর থেকে কলেজ ফাঁকি দিয়ে এসেছে সালমান শাহের সাথে দেখা করার জন্য। সে তাঁর ফ্ল্যাটের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে । সালমান এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন কেন কলেজ ফাঁকি দিয়ে এসেছে সে। তারপর মেয়েটিকে চলে যেতে বললেন। আর এতে রাগ হয়ে মেয়েটি তাঁর সামনেই একটি ব্লেড দিয়ে হাত কেঁটে ফেললো!
সালমান যতক্ষণ এফডিসিতে থাকতেন, গেটের বাইরে হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায় থাকতো তাঁকে একবার দেখার জন্য। এরকম জনপ্রিয়তা আর কোনো নায়কের ভাগ্যে জোটেনি। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস এত এত মানুষের ভালোবাসাও তাঁকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি আমাদের মাঝে।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। সেদিন ছিলো শুক্রবার। এদেশের সিনেমাপ্রেমীদের জন্য সবচেয়ে দুঃখের দিন। কী এক অভিমানে এইদিনই সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে বিদায় নেন এই মহাতারকা। তিনি যখন মারা যান তখন বেশ কিছু ছবির কাজ অসমাপ্ত ছিল।
মৃত্যুর কয়েকমাস আগে একদিন সালমান শাহ পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলেন। সালমান তাকে বললেন তারা আবার একসাথে কাজ করবেন। সোহান সালমানকে শিডিউল ঠিক করতে বললেন এবং বললেন তিনি একটি গল্প প্রস্তুত করছেন সিনেমার জন্য। সালমান তাঁর শিডিউল ঠিক করেও রেখেছিলেন। কিন্তু সালমানের অকাল প্রয়াণ তা আর হতে দিল না। সোহানুর রহমান সোহানের সাথে সালমান শাহের আর কাজ করা হল না।
মাত্র চার বছরের অভিনয় জীবন তাঁর। এই অল্প সময়ে তৈরী করেছিলেন অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী। তাঁর মৃত্যু লন্ডভন্ড করে দিয়েছিলো তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোর জীবনও। সালমানের দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর তাঁর বাবা বলেছিলেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী জিনিস বোধহয় পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। পুত্রের মৃত্যুশোক বেশিদিন সইতে পারেননি তিনি। কয়েক বছর পর মারা যান ছেলে হারানোর দুঃখ বুকে নিয়ে।
শোনা যায় প্রায় ২২-২৩ জনের মতো তরুণী আত্মহত্যা পর্যন্ত করে তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে। তাঁর নজরুল নামে একজন বন্ধু ছিলো। সালমান মারা যাওয়ার পর যে শুধু পাগলের মতো এফডিসির সামনে ঘুরে বেরাতো। ফারুক নামে আরেকজন বন্ধু ছিলো তাঁর। সে-ও কোথাও যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
সালমান শাহ যখন মারা যান। তখন আমার বয়স ২ বছরও হয়নি। সালমান শাহ কে, মৃত্যু কী বোঝার বয়স তখনও হয়নি। বুঝতে পারি আরও কয়েক বছর পর। আমাদের বাড়িতে আনন্দমেলা বা ছায়াছন্দ এরকম নামের অনেকগুলো ম্যাগাজিন ছিলো। সালমান শাহের অনেক ছবি ছিলো সেই ম্যাগাজিনগুলোতে। তাছাড়া অনেক পোস্টার আর ভিউ কার্ডেও ছিল এই নায়কের ছবি। ওই সময়টাই হয়তো ছিলো সবকিছুতে মুগ্ধ হওয়ার সময়। যা দেখি তাতেই মুগ্ধ হই। এই নায়কের কখনো বড় চুল, কানে দুল, চোখে সানগ্লাস, মাথায় ক্যাপ। আমি শুধু ভাবি বড় হয়ে এরকম যদি হতে পারতাম!
সেই সময় কেউ একজন বলল যে সালমান শাহ কয়েক বছর আগে মারা গেছে। আমি বিশ্বাস করিনি। ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় যার এত এত ছবি, সিনেমায় যে হাসে, কাঁদে, গান গায়, কয়েকটা ভিলেনকে একাই পিটিয়ে আধমরা করে দেয়, সে আবার মারা যায় কীভাবে? অনেককেই জিজ্ঞেস করলাম। সবাই একই কথা বললো।
একসময় আমি বুঝতে পারি আর কাউকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সালমান শাহ আসলেই মারা গেছেন। আমাদের বাড়ির পিছনে একটা পুকুর ছিলো। খুব মন খারাপ হলে সেখানে গিয়ে একা একা একটু কান্নাকাটি করে আসতাম। আবার পুকুর পাড়ে গেলাম একা একা। আরো একটু কান্নাকাটি করে আসলাম।
সালমান শাহের মৃত্যু এখনও রহস্য। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন অনেক রকম কথা শুনেছি। ওসব কিছু নিয়ে আমি কখনো ভাবতাম না। তখন শুধু জানতাম সালমান শাহ আর কখনো আসবে না। ছোটবেলার আবেগগুলো হয়তো খুবই ভয়াবহ জিনিস। বড় হয়ে কত সিনেমা দেখেছি। কত বিখ্যাত অভিনেতার অভিনয় দেখে হেসেছি, কেঁদেছি। এখন তো বাংলা সিনেমাই আর দেখা হয় না তেমন। কিন্তু সেই শৈশবের হৃদয়ের যতখানি জায়গা জুড়ে ছিলো সালমান শাহ, এখনও ততখানি জায়গা জুড়েই সালমান শাহ।
বেঁচে থাকলে এখন সালমান শাহের বয়স হতো ৪৫ বছরের মতো। ওই চার বছরেই তিনি যা করেছিলেন, এখনো যদি বেঁচে থাকতেন তবে কতখানি দিতে পারতেন এদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে? আমরা কোনোদিন তা আর জানতে পারবো না।
তাঁর মৃত্যুতে এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে তা আজও পূরণ হয় নি। মাঝে মাঝেই ইউটিউবে গান শুনতে শুনতে সালমান শাহের কোনো একটা গান চলে আসে। পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। নিচের কমেন্ট সেকশনে দেখি এখনো তাঁর ভক্তদের কান্না। তাদের একটাই আফসোস, “ইস! সালমান শাহ যদি আজ বেঁচে থাকতো?”
সালমান শাহ এখনও বেঁচে আছেন, তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে স্বপ্নের নায়ক হয়ে, ভালোবাসার রাজপুত্র হয়ে। এত বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এদেশের মানুষ সালমানকে ভুলতে পারেনি। মৃত্যুর এত বছর পরও তাঁর জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি।
এই মহানায়কের প্রতি রইলো অগাধ শ্রদ্ধা।