(পর্ব ৪ এর পর থেকে)
“না, আমি এর চাইতে সহজ কাজ চাই না। যে কাজটা আমি ভালো জানি, সেটা করার মাধ্যমে আমি দেশের জন্য বেশি কার্যকরী হতে চাই।” (জোসেফ স্তালিনের উদ্দেশ্যে গিওর্গি ঝুকভ, জুলাই ১৯৪১)
অপারেশন বার্বারোসা: জার্মানদের মহাপরিকল্পনা
ভোর ৪টা, ২২ জুন, ১৯৪১। ৩৫ লক্ষ সৈন্যের জার্মান–নেতৃত্বাধীন অক্ষবাহিনী (যাদের মধ্যে ছিল ১৫২ ডিভিশন জার্মান সৈন্য, ১৪ ডিভিশন রুমানীয় সৈন্য এবং ১৪ ডিভিশন ফিনিশ সৈন্য) ১,০০০ মাইল দীর্ঘ এক রণাঙ্গন জুড়ে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ শুরু করল। পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে যোগ দিল হাঙ্গেরীয় ও ইতালীয় সশস্ত্রবাহিনী, স্প্যানিশ ‘ব্লু ডিভিশন’, ক্রোয়েশীয় ও স্লোভাক সৈন্যদল এবং ইউরোপের জার্মান–অধিকৃত প্রতিটি রাষ্ট্র থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবক দল। এর মধ্য দিয়ে শুরু হলো বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আক্রমণাভিযান, ‘অপারেশন বার্বারোসা’!
আক্রমণকারী অক্ষবাহিনীকে ৩টি আর্মি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়েছিল। এদের মধ্যে ‘আর্মি গ্রুপ নর্থ’ বাল্টিক উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্য দিয়ে লেনিনগ্রাদ (বর্তমান সেইন্ট পিটার্সবার্গ) বরাবর আক্রমণ চালায়, ‘আর্মি গ্রুপ সাউথ’ কিয়েভ অভিমুখে অগ্রসর হয়, আর ‘আর্মি গ্রুপ সেন্টার’ মিনস, স্মোলেনস্ক ও মস্কো অভিমুখে ধাবিত হয়। জার্মান–নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির রণকৌশল ছিল ইতিপূর্বে পোল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত রণকৌশলের অনুরূপ: প্রথমে তাদের আর্মার্ড বহর সোভিয়েতদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে অগ্রসর হয়ে সোভিয়েত সৈন্যদের ঘিরে ফেলবে, এরপর তাদের পদাতিক সৈন্যদল অবরুদ্ধ সোভিয়েত সৈন্যদলগুলোকে ধ্বংস করে সোভিয়েত ভূমি নিজস্ব দখলে নেবে।
জার্মানদের উদ্দেশ্য ছিল এরকম: তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিমাঞ্চলে মোতায়েনকৃত লাল ফৌজের বৃহদাংশকে ধ্বংস করে ফেলবে এবং তারা যাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুবিস্তৃত অভ্যন্তরে পশ্চাৎপসরণ করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করবে। তাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিল ভোলগা নদী থেকে আর্খানজেলস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে নিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি ‘আত্মরক্ষামূলক প্রতিবন্ধক’ স্থাপন করা। তীব্র ইহুদিবিদ্বেষী ও কমিউনিজমবিরোধী জার্মান নাৎসিদের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি ‘ইহুদি–বলশেভিক’ রাষ্ট্র, অর্থাৎ ইহুদিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। এজন্য তারা চেয়েছিল, লাল ফৌজের পাশাপাশি তারা সোভিয়েত কমিউনিস্ট সরকারকেও ধ্বংস করে দেবে।
তদুপরি, উগ্র বর্ণবাদী নাৎসিরা বিশ্বাস করত, সোভিয়েত ইউনিয়নের স্লাভিক, ‘এশিয়াটিক’ ও ‘তুর্কি–মঙ্গোলয়েড’ জাতিগুলো জার্মানদের চেয়ে নিচু জাতি এবং তারা অবমানব (subhuman) ছাড়া অন্য কিছু নয়। এজন্য জার্মানদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিবাসীদের একাংশকে নিশ্চিহ্ন করা ও অপর অংশকে জার্মানদের দাসে পরিণত করা, এবং ভারতবর্ষ যেরকম ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল, সেরকম উরাল পর্বতমালা পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূখণ্ডকে জার্মানির উপনিবেশে রূপান্তরিত করা। সুতরাং সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য এই যুদ্ধ ছিল অস্তিত্বের সংগ্রাম।
বার্বারোসার প্রারম্ভে ঝুকভ: সীমান্ত রক্ষার লড়াই
জার্মান আক্রমণের সংবাদ মস্কোয় পৌঁছানোর পরপরই লাল ফৌজের জেনারেল স্টাফের প্রধান জেনারেল গিওর্গি ঝুকভ সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেমিয়ন তিমোশেঙ্কোর সঙ্গে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব ও প্রধানমন্ত্রী জোসেফ স্তালিনের কার্যালয়ে উপস্থিত হন এবং সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে তারা লাল ফৌজের উদ্দেশ্যে একটি নির্দেশনা জারি করেন। এই নির্দেশনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে প্রবেশকারী শত্রু সৈন্যদের ধ্বংস করার জন্য সোভিয়েত সৈন্যদের নির্দেশ দেয়া হয়, কিন্তু বিশেষ অনুমতি ছাড়া সীমান্ত অতিক্রম না করার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। শত্রুপক্ষের স্থল ও বিমানবাহিনীর ওপরে এবং জার্মান–নিয়ন্ত্রিত ভূমির ৬০–১০০ কি.মি. গভীর পর্যন্ত আক্রমণ পরিচালনার জন্য সোভিয়েত বিমানবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়, কিন্তু ফিনল্যান্ড ও রুমানিয়ার আকাশসীমায় প্রবেশ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।
এর দুই ঘণ্টা পর ৯টা ১৫ মিনিটে স্তালিন, তিমোশেঙ্কো ও ঝুকভ লাল ফৌজের উদ্দেশ্যে আরেকটি নির্দেশনা জারি করেন। এই নির্দেশনায় উত্তরে লিথুয়ানিয়ার সুভালকি অঞ্চলে অগ্রসরমান জার্মান সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য লাল ফৌজের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলীয় ও পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টকে এবং দক্ষিণে জামোস্তিয়ে অঞ্চলে অগ্রসরমান জার্মান সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য লাল ফৌজের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টকে নির্দেশ দেয়া হয়। উভয় ক্ষেত্রেই সোভিয়েত সৈন্যদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তারা যেন সোভিয়েত ভূখণ্ড থেকে জার্মান সৈন্যদের অপসারণের পর জার্মান–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে আক্রমণ চালায়। কিন্তু এই নির্দেশনার ফলাফল ছিল সোভিয়েতদের জন্য বিপর্যয়কর।
এই নির্দেশনা প্রদানের পরপরই দক্ষিণ দিকে জার্মানদের বিরুদ্ধে প্রতিআক্রমণ পরিচালনার তত্ত্বাবধান করার জন্য ঝুকভকে দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টে প্রেরণ করা হয়। ২২ জুন বিকেলে ঝুকভ কিয়েভে পৌঁছান, কিন্তু সেখানে তার অবস্থান ছিল সংক্ষিপ্ত। কয়েক দিনের মধ্যেই সোভিয়েতদের প্রতিআক্রমণ ব্যর্থ হয়, যদিও এই প্রতিআক্রণের ফলে ইউক্রেনে জার্মান বাহিনীর অগ্রযাত্রা কিছুটা শ্লথ হয়ে আসে। কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টে সোভিয়েতদের প্রতিআক্রমণ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয় এবং জার্মানরা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে মিনস্ক দখল করে নেয় ও অন্তত ৪ লক্ষ সোভিয়েত সৈন্যকে বন্দি করে। এই বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে স্তালিন ঝুকভকে মস্কোয় তলব করেন এবং ২৬ জুন বিকেলে ঝুকভ মস্কোয় ফিরে যান।
২৯ জুন স্তালিন দুইবর সোভিয়েত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আসেন এবং উভয় ক্ষেত্রেই রণাঙ্গনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘হিংস্র’ প্রতিক্রিয়া দেখান। একপর্যায়ে তিনি ঝুকভের কাছে লাল ফৌজের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চান, কিন্তু ঝুকভ নিশ্চিতভাবে কোনো উত্তর দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ঝুকভের ওপরে মারাত্মক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ঝুকভের ভাগ্য ভালো ছিল যে, তার ওপরে স্তালিনের খড়গ নেমে আসেনি।
কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের কমান্ডার জেনারেল দিমিত্রি পাভলভের ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন ছিল না। ১ জুলাই স্তালিন পাভলভকে তার পদ থেকে অপসারণ করেন এবং কয়েক দিনের মধ্যেই পাভলভসহ পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের সিনিয়র অফিসারদের গ্রেপ্তার করা হয়। ২২ জুলাই তাদেরকে ভীরুতা, আতঙ্ক সৃষ্টি, অপরাধমূলক অবহেলা এবং বিনা অনুমতিতে পশ্চাৎপসরণের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। অনুরূপভাবে, সোভিয়েত বিমানবাহিনীর বেশকিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকেও গ্রেপ্তার করা হয় এবং জার্মান বিমান আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। একই সঙ্গে সোভিয়েত সামরিক নেতৃত্বে বেশ কিছু রদবদল আনা হয়।
কিন্তু জার্মানদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে এবং তারা দ্রুতগতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে থাকে। এসময় লাল ফৌজের ব্যবহৃত রণকৌশল ছিল খুবই স্থূল প্রকৃতির, কিন্তু কার্যকরী। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও তারা জার্মানদের বিরুদ্ধে সর্বত্র তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ফলে জার্মানদের অগ্রযাত্রার গতি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে। এবং এভাবে জার্মানদের প্রতি সেকেন্ড দেরি ছিল সোভিয়েতদের জন্য চূড়ান্ত বিচারে লাভজনক। এসময় ঝুকভ সোভিয়েত জেনারেল স্টাফের প্রধান ছিলেন এবং এই দায়িত্বে থাকাকালে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল, চরম বিপর্যয়ের মুখেও তিনি মানসিক স্থিরতা বজায় রাখতে সক্ষম হন এবং ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকেন। ১৫ জুলাই তিনি লাল ফৌজের প্রতিটি ফ্রন্টে একটি নির্দেশনা প্রেরণ করেন, যেটিতে যুদ্ধে সোভিয়েতদের বিপর্যয়ের ট্যাকটিক্যাল কারণগুলো তুলে ধরা হয় এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের নির্দেশ দেয়া হয়।
ইয়েলনিয়া আক্রমণাভিযান: সোভিয়েত ভূমিতে জার্মান সমরযন্ত্রের প্রথম পরাজয়
কিন্তু ঝুকভ জেনারেল স্টাফের কাজ কখনোই তেমন পছন্দ করতেন না এবং তার নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও তিনি জেনারেল স্টাফের কাজগুলো ঠিক আয়ত্ত করতে পারেননি। তিনি সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে থাকাটাই বেশি পছন্দ করতেন। এজন্য স্তালিন যখন ইয়েলনিয়া অঞ্চলে জার্মানদের বিরুদ্ধে প্রতিআক্রমণ চালানোর জন্য ঝুকভকে কোনো একজন সেনা কর্মকর্তার নাম সুপারিশ করতে বলেন, ঝুকভ নিজেই সেই আক্রমণ পরিচালনার অনুমতি প্রার্থনা করেন। ফলে ৩০ জুলাই ঝুকভকে জেনারেল স্টাফের প্রধান পদ থেকে অপসারণ করে লাল ফৌজের রিজার্ভ ফ্রন্টের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।
১৯৪১ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি জার্মান সৈন্যরা স্মোলেনস্ক শহর দখল করে নেয়, কিন্তু এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জুড়ে জার্মান ও সোভিয়েত সৈন্যদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল। স্মোলেনস্কের মধ্য দিয়েই জার্মান সৈন্যদের মস্কো অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল, তাই এই অঞ্চলের সামরিক গুরুত্ব ছিল উভয় পক্ষের জন্যই অপরিসীম। এজন্য লাল ফৌজ এই অঞ্চলে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং দুই মাস যাবৎ জার্মানদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে রাখে। কিন্তু এসময় তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় ৫ লক্ষ সোভিয়েত সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত বা নিখোঁজ হয় এবং প্রায় আড়াই লক্ষ সৈন্য আহত হয়।
জার্মানরা স্মোলেনস্কের নিকটবর্তী ইয়েলনিয়া দখল করে নিয়েছিল, এবং ঝুকভের নেতৃত্বাধীন রিজার্ভ ফ্রন্টকে ইয়েলনিয়া পুনর্দখল করা ও দেসনা নদীর পূর্ব অবস্থিত একটি শক্তিশালী জার্মান সৈন্যদলকে ধ্বংস করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ঝুকভের রিজার্ভ ফ্রন্টে ছিল প্রায় ৫০ ডিভিশন সৈন্য, কিন্তু আক্রমণের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণের সময় বা সুযোগ কোনোটাই তার ছিল না। এর ফলে আগস্টের মাঝামাঝি ঝুকভের অধীনস্থ ২৪তম আর্মি পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই জার্মানদের ওপর আক্রমণ চালাতে বাধ্য হয়, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। ঝুকভ নিজে সৈন্যদলটির প্রতিটি ডিভিশন পরিদর্শন করেন এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর কয়েক দিনের জন্য আক্রমণ স্থগিত রাখেন।
এই সময়ে ঝুকভ নতুন আক্রমণ পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, অন্যদিকে সোভিয়েতরা তীব্র গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে জার্মানদের ব্যতিব্যস্ত রাখে। ৩০ আগস্ট ঝুকভ পুনরায় আক্রমণ শুরু করেন এবং রিজার্ভ ফ্রন্টের ৪৩তম আর্মিও এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। ৬ সেপ্টেম্বর নাগাদ সোভিয়েত সৈন্যরা ইয়েলনিয়া পুনর্দখল করতে সক্ষম হয় এবং জার্মান সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করে। এই যুদ্ধে প্রায় ১৭,০০০ সোভিয়েত সৈন্য এবং ৪৫,০০০-৪৭,০০০ জার্মান সৈন্য হতাহত হয়।
ইয়েলনিয়া আক্রমণাভিযানে সোভিয়েত বিজয়ের রণকৌশলগত বা ভূখণ্ডগত তাৎপর্যের তুলনায় এর মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য ছিল বহুগুণ বেশি। এটিই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মানদের বিরুদ্ধে স্থলপথে পরিচালিত প্রথম সফল আক্রমণাভিযান। এই বিজয়ের ফলে সোভিয়েত সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং জার্মানদের যে পরাজিত করা সম্ভব, সেটি তাদের সামনে স্পষ্ট হয়। ঝুকভের সৈন্যদের কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সোভিয়েত সরকার তার ১০০তম, ১২৭তম, ১৫৩তম এবং ১৬১তম ডিভিশনকে ‘গার্ডস’ বা ‘রক্ষী’ মর্যাদা প্রদান করে। অন্যদিকে, এই অভিযানে পরাজয়ের ফলে জার্মান সৈন্যদের আত্মবিশ্বাসে প্রথমবারের মতো চিড় ধরে এবং ‘জার্মানরা অপরাজেয়’ – এই ধারণা নিয়ে প্রথমবারের মতো সংশয় সৃষ্টি হয়।
লেনিনগ্রাদের প্রতিরক্ষা: নেভার তীরবর্তী দৈব ঘটনা
ইয়েলনিয়ায় সফল আক্রমণাভিযান পরিচালনার পর স্তালিন ঝুকভকে মস্কোয় ডেকে পাঠান এবং ১১ সেপ্টেম্বর ঝুকভ মস্কোয় স্তালিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ৪ ঘণ্টা স্থায়ী এই বৈঠকে স্তালিন ঝুকভকে লেনিনগ্রাদ ফ্রন্টের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। পরের দিন ঝুকভ বিমানযোগে লেনিনগ্রাদের উদ্দেশ্যে রওনা হন। লেনিনগ্রাদের নিকটবর্তী লাদোগা হ্রদ অতিক্রমের সময় দুটি জার্মান যুদ্ধবিমান ঝুকভকে বহনকারী বিমানকে ধাওয়া করে, কিন্তু বিমানটি নিরাপদে লেনিনগ্রাদে অবতরণ করতে সক্ষম হয়।
এ সময় জার্মান সৈন্যরা লেনিনগ্রাদ অবরোধ করে রেখেছিল। বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পর জার্মানদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল লেনিনগ্রাদ দখল করা এবং লেনিনগ্রাদ দখলের পরেই কেবল মস্কো অভিমুখে ধাবমান হওয়া। প্রথমে সবকিছুই জার্মানদের পরিকল্পনা মোতাবেক চলছিল। জার্মানরা লিথুয়ানীয় সীমান্তে সোভিয়েতদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সহজেই অতিক্রম করে এবং তিন সপ্তাহের মধ্যে ৩০০ মাইল অগ্রসর হয়ে বাল্টিক অঞ্চলের সিংহভাগ অধিকার করে নেয়। কিন্তু এরপর লাল ফৌজের প্রতিরোধ ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকে এবং জার্মানদের অগ্রগতি শ্লথ হতে শুরু করে। এর ফলে ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরের আগপর্যন্ত জার্মান সৈন্যরা লেনিনগ্রাদের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারেনি।
এই পর্যায়ে অধৈর্য্য হয়ে জার্মানরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, লেনিনগ্রাদ দখল না করেই তারা মস্কোর দিকে ধাবিত হবে এবং সরাসরি আক্রমণ চালানোর পরিবর্তে অবরোধের মাধ্যমে লেনিনগ্রাদের পতন ঘটাবে। তাদের বিশ্বাস ছিল, শীঘ্রই লেনিনগ্রাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং খাদ্যের অভাবে শহরটির অধিবাসীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। জার্মানদের উদ্দেশ্য ছিল লেনিনগ্রাদকে সম্পূর্ণভাবে ধূলিসাৎ করে দেয়া।
সামরিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে জার্মানদের নিকট লেনিনগ্রাদের সম্ভাব্য পতন ছিল সোভিয়েত সরকারের জন্য একটি ভয়াবহ ব্যাপার। লেনিনগ্রাদের পতন ঘটলে জার্মানরা উত্তর দিক থেকে মস্কোর ওপর আক্রমণ চালানোর সুযোগ পেয়ে যেত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও একটি অন্যতম সামরিক শিল্পকেন্দ্র সোভিয়েতদের হাতছাড়া হয়ে যেত। তদুপরি, লেনিনগ্রাদ ছিল বলশেভিক বিপ্লবের কেন্দ্রভূমি, তাই তীব্র বলশেভিকবিরোধী নাৎসিদের নিকট লেনিনগ্রাদের পতন ঘটলে সেটি হতো সোভিয়েত জনসাধারণের জন্য একটি তীব্র মনস্তাত্ত্বিক আঘাত এবং সোভিয়েত সরকারের জন্য খুবই অপমানজনক ঘটনা।
১৯৪১ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের আগে জার্মান সৈন্যরা লেনিনগ্রাদকে প্রায় সবদিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল এবং এজন্য স্থলপথে লেনিনগ্রাদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য অংশের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ৯ সেপ্টেম্বর জার্মান সৈন্যরা লেনিনগ্রাদের উত্তর–পূর্বে লাদোগা হ্রদের তীরে অবস্থিত শ্লিসেলবুর্গ দখল করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে লেনিনগ্রাদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য অংশের সর্বশেষ স্থল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে লেনিনগ্রাদের পতন ঘটার সম্ভাবনা গাঢ় হয়। এমতাবস্থায় লেনিনগ্রাদ ফ্রন্টের নতুন কমান্ডার হিসেবে ঝুকভের দায়িত্ব ছিল শহরটিকে প্রায় নিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষা করা।
ঝুকভ লেনিনগ্রাদে পৌঁছানোর পর সেখানকার পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। শহরটিকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করার পর জার্মানরা সোভিয়েত সৈন্যদের দুর্বলতা যাচাই করার জন্য শহরটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর ছোট ছোট আক্রমণ চালাচ্ছিল। প্রত্যুত্তরে ঝুকভ প্রতিআক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন। ১৫ সেপ্টেম্বরে প্রদত্ত এক নির্দেশনায় তিনি শত্রুপক্ষের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ, মর্টার হামলা ও বিমান হামলা পরিচালনা, লেনিনগ্রাদের প্রতিরক্ষার জন্য ৪টি প্রতিরক্ষা রেখা নির্মাণ, শত্রুপক্ষের পার্শ্বভাগ ও পশ্চাদ্ভাগে আক্রমণ পরিচালনা এবং এমগা ও শ্লিসেলবুর্গ অঞ্চলদ্বয় পুনর্দখলের জন্য সোভিয়েত সৈন্যদলকে নির্দেশ দেন। ১৭ সেপ্টেম্বরের আরেকটি নির্দেশনায় তিনি ঘোষণা করেন, কোনো কমান্ডার, রাজনৈতিক কর্মী বা সৈন্য অনুমতি ছাড়া নিজের অবস্থান ত্যাগ করলে তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হবে।
ঝুকভ যখন লেনিনগ্রাদ ফ্রন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন সেখানে প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ সোভিয়েত সৈন্য মোতায়েন ছিল। তাদের বিপরীতে ছিল প্রায় সমান সংখ্যক জার্মান সৈন্য। কিন্তু জার্মান বাহিনীতে দুইটি ট্যাঙ্ক ডিভিশন ছিল, যা সোভিয়েত বাহিনীতে ছিল না এবং যুদ্ধক্ষেত্রের আকাশ পুরোপুরিভাবে জার্মান বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। তদুপরি, উত্তর দিক থেকে ১৪টি ফিনিশ ডিভিশন লেনিনগ্রাদ ও সোভিয়েত কারেলিয়ার ওপর আক্রমণ চালাচ্ছিল। অবশ্য মূল যুদ্ধ কেন্দ্রীভূত ছিল লেনিনগ্রাদের দক্ষিণ প্রান্তে এবং জার্মান সৈন্যরা লেনিনগ্রাদের সীমানা থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে অবস্থান নিয়েছিল।
কিন্তু পুরো সেপ্টেম্বর জুড়ে জার্মান ও সোভিয়েতদের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে এবং ঝুকভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সৈন্যদের প্রতিরোধের মুখে জার্মানদের লেনিনগ্রাদ দখলের পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এভাবে মাস খানেকের মধ্যে ঝুকভ লেনিনগ্রাদ ফ্রন্টে শৃঙ্খলা ও মনোবল ফিরিয়ে আনেন এবং কার্যকরী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে শহরটিকে রক্ষা করেন। ইতিহাসবিদ ডেভিড গ্লান্টজের ভাষায়, ঝুকভের লৌহসদৃশ ইচ্ছাশক্তি ‘নেভার তীরবর্তী দৈব ঘটনা’র (Miracle on the Neva) সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য, ১৯১৯–১৯২০ সালের সোভিয়েত–পোলিশ যুদ্ধ চলাকালে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশর কাছে পোলিশ সৈন্যদের নিকট লাল ফৌজ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে পোল্যান্ড ও পশ্চিম ইউরোপে বলশেভিকদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত হয়। এই ঘটনাটি ‘ভিশ্চুলার তীরবর্তী দৈব ঘটনা’ (Miracle on the Vistula) নামে পরিচিতি লাভ করে এবং এই নাম থেকেই ‘নেভার তীরবর্তী দৈব ঘটনা’ নামটির উৎপত্তি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঝুকভ লেনিনগ্রাদকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু শহরটির ওপর থেকে জার্মান অবরোধ প্রত্যাহার করাতে পারেন নি। আরো প্রায় তিন বছর শহরটি জার্মানদের দ্বারা অবরুদ্ধ থাকে এবং এসময় লেনিনগ্রাদে অন্তত ১০ লক্ষ সোভিয়েত সৈন্য ও অন্তত ১০ লক্ষ ৪০ হাজার সোভিয়েত বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায়। কিন্তু ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানরা শহরটি দখল করার ক্ষেত্রে যেরকম সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল, সেরকমটি আর কখনো হয়নি। এখানেই ঝুকভের কৃতিত্ব নিহিত ছিল।
সামগ্রিকভাবে, ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ ঝুকভ নিজেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন সফল সমরনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। ১৯৩৯ সালে খালখিন গোলে জাপানিদের বিরুদ্ধে অর্জিত সাফল্য এবং ১৯৪১ সালে ইয়েলনিয়া ও লেনিনগ্রাদে জার্মানদের বিরুদ্ধে অর্জিত সাফল্য তাকে খ্যাতিমান করে তোলে। বিশেষ করে যুদ্ধের প্রারম্ভে সোভিয়েতদের বিপর্যয়ে লাল ফৌজের জেনারেল স্টাফের প্রধান হিসেবে ঝুকভের যে দায় ছিল, প্রথমে ইয়েলনিয়া ও পরে লেনিনগ্রাদের রণাঙ্গনে সাফল্য অর্জনের মধ্য দিয়ে ঝুকভ সেটি থেকে দায়মুক্তি অর্জন করেন। লাল ফৌজ যখন প্রায় প্রতিটি রণাঙ্গনে পরাজিত হচ্ছিল, তখন ঝুকভ ছিলেন একমাত্র সেনানায়ক, যিনি পরাজয় এড়াতে সক্ষম হন।
এদিকে অন্যান্য রণাঙ্গনে লাল ফৌজের অবস্থা ক্রমশ শোচনীয় হয়ে উঠছিল। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ জার্মান সৈন্যরা কিয়েভ দখল করে নেয় এবং এই যুদ্ধে সোভিয়েতরা প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ সৈন্য হারায়। কিয়েভ দখলের পর জার্মান সৈন্যরা ক্রিমিয়া ও রোস্তভের দিকে অগ্রসর হয়। রোস্তগ ছিল সোভিয়েত ককেশাস এবং বাকুর তেলক্ষেত্রগুলোর প্রবেশদ্বারস্বরূপ। অক্টোবরের প্রথম দিকে জার্মানরা পুনরায় মস্কো অভিমুখে ধাবিত হয় এবং ভিয়াজমা ও ব্রিয়ানস্কে সংঘটিত লড়াইয়ে সোভিয়েতরা আরো প্রায় ৫ লক্ষ সৈন্য হারায়।
এই পরিস্থিতিতে স্তালিন ৫ অক্টোবর ঝুকভকে ফোন করেন এবং বিমানযোগে লেনিনগ্রাদ থেকে মস্কোয় প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। ৬ অক্টোবর ঝুকভ যথারীতি মস্কোর উদ্দেশ্যে রওনা হন। শীঘ্রই ঝুকভকে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে অংশ নিতে হবে!
(এরপর দেখুন ৬ষ্ঠ পর্বে)