১
একসময় তার তুলনা হতো দিয়াগো ম্যারাডোনার সাথে। ৮৬ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ম্যারাডোনার চেয়ে অনেকাংশে এগিয়েও ছিলেন। হয়তো ভাগ্যের আরেকটু সমর্থন পেলে ক্যারিয়ার শেষে যে অবস্থানে ছিলেন, তার চেয়েও এগিয়ে থাকতে পারতেন। অন্তত তার ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান বলে, তিনি ফুটবলপ্রেমীদের আরেকটু বেশি মনোযোগ দাবি করেন। তবে সেটা না পেলেও, গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়দের মাঝে প্রথম সারিতেই তিনি ছিলেন।
যেকোনো দেশের জন্যই ‘প্রথম’ জিনিসটা একটু বিশেষ কিছু। প্রতিটি দেশেই যুগে যুগে অনেক গ্রেট জন্মায়। কিন্তু যে মানুষটি প্রথম কোনো কাজ করে, তাকে সবসময়ই একটা বাধার সম্মুখীন হতে হয়- সেটা হচ্ছে মানসিক বাধা। ইতিহাস ভাঙাটা খুব কঠিন কাজ, সবাই পারে না। যারা পারে, তারা ইতিহাসে নতুন একটি অধ্যায় লিখে রাখে তাদের কীর্তি দ্বারা।
ফ্রান্স ফুটবলের জন্য এমনই এক ইতিহাস গড়ার কাজ করেছিলেন মিশেল প্লাতিনি। কী করেছিলেন সেটা বলার জন্যই আজকের এই লেখা।
২
ফ্রান্স বিশ্ব ফুটবলে বরাবরই একটা মাঝারি গোছের দল ছিল। ফুটবলে সর্বোচ্চ সফলতা পেতে হলে দল ভালো হওয়ার সাথে সাথে একজন স্পেশাল খেলোয়াড়েরও প্রয়োজন হয়। প্লাতিনি আসার আগে ফ্রান্স ফুটবলে তেমন কোনো তারকা ফুটবলার ছিল না। এক জা ফন্টেইন ছিলেন, যিনি এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড করেছিলেন (১৩ গোলের সেই রেকর্ডটাকে মোটামুটি অবিনশ্বর বলা যায়)। তবে তিনিও ক্লাব ফুটবল অথবা জাতীয় দলের হয়ে তেমন কিছু জিততে পারেননি।
ফ্রান্সকে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক (ইউরো ১৯৮৪) শিরোপা জেতানোর মূল নায়ক ছিলেন মিশেল প্লাতিনি। তবে সেটা এত অল্প কথায় বলে ফেললে প্লাতিনির মাহাত্ম্যটা ঠিকভাবে বোঝা যাবে না। এরকম ‘ওয়ান ম্যান শো’ আর কোনো টুর্নামেন্টে কেউ দেখাতে পেরেছেন কিনা সেটা বের করতে হলে, অবশ্যই আতশী কাচ নিয়ে বসতে হবে।
ইউরো কাপ শুরু হবার প্রথম আসরে ফ্রান্স ৪র্থ হয়েছিল। এরপর টানা ৫টি আসরে ফ্রান্স টুর্নামেন্টে কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ১৯৮৪ ইউরোতে ফ্রান্স সুযোগ পায় স্বাগতিক হিসেবে।
আগের বছরের ব্যালন ডি অর জিতে ইউরো ১৯৮৪তে প্লাতিনি তারকা হিসেবেই শুরু করেছিলেন। তবে সব তারকা বড় টুর্নামেন্টে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেন না। প্লাতিনি যেভাবে সুবিচার করলেন, তা ফুটবল ইতিহাসেই বিরল।
গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ফ্রান্স ডেনমার্ককে হারায় প্লাতিনির দেওয়া একমাত্র গোলে। এর পরের ম্যাচে বেলজিয়ামকে ৫-০ গোলে হারানো ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন প্লাতিনি। তারপরের ম্যাচে যুগোস্লাভিয়াকে ৩-২ গোলে হারানো ম্যাচে আরেকটি হ্যাটট্রিক করেন তিনি।
সেমিতে ফ্রান্স মুখোমুখি হয় পর্তুগালের। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে ড্র হওয়ার পর ম্যাচটা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। সেখানে এক পর্যায়ে ম্যাচের ফল হয় ২-২। ম্যাচটি টাইব্রেকার যাবে এমন ভাবনা যখন সবাই ভাবছিল, ঠিক তখনই ম্যাচের ১১৯তম মিনিটে প্লাতিনির গোল। ফাইনালে স্পেনের বিপক্ষে দলের হয়ে ১ম গোলটিও প্লাতিনির পা থেকেই আসে। শেষ পর্যন্ত ৯০তম মিনিটে ফ্রান্স আরেকটি গোল করে ২-০ গোলে ম্যাচটা জিতে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে তাদের ১ম শিরোপা জয় করে।
ইউরোর ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে প্লাতিনি টুর্নামেন্টের সবকটি ম্যাচে গোল করেন। যে টুর্নামেন্টে আর কোনো খেলোয়াড় ৩টির বেশি গোল করতে পারেননি, সেখানে স্ট্রাইকার না হয়েও ৯টি গোল করা নিঃসন্দেহে একটি বাড়তি কৃতিত্ব দাবি করে। এছাড়া ইউরো ইতিহাসে এক টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডও প্লাতিনির।
৩
ক্লাব ফুটবলের প্লাতিনি অনেক আগে থেকেই সুপরিচিত ছিলেন। জুভেন্টাস তাদের ইতিহাসের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে ১৯৮৫ সালে। এর আগে দুবার ফাইনালে উঠলেও তাদেরকে রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। প্রথমবারের মতো তাদের ইউরোপ সেরা হওয়ার পেছনে প্লাতিনির অবদান অসামান্য। একমাত্র সেমিফাইনাল বাদে প্রতিটা রাউন্ডে গোল করেন তিনি। ফাইনালে তার একমাত্র গোলেই জুভেন্টাস চ্যাম্পিয়ন হয়। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন তিনি।
জুভেন্টাস তাদের ইতিহাসের প্রথম ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপও জিতে প্লাতিনির নৈপুণ্যে। নির্ধারিত সময়ে ২-২ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচটিতেও ১টি গোল করেন প্লাতিনি। পরে টাইব্রেকারে দলের পক্ষে সর্বশেষ গোলটি করে শিরোপা নিশ্চিত করেন তিনি। ম্যান অব দি ম্যাচ হন প্লাতিনি। প্লাতিনিই প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টানা তিন বার ব্যালন ডি অর জেতার রেকর্ড করেন।
৪
বড় ম্যাচে জ্বলে ওঠার জন্য বিখ্যাত প্লাতিনি বিশ্বকাপেও যথেষ্ট ভালো খেলেছেন। তিনি দলে আসার আগের দুই বিশ্বকাপে ফ্রান্স বাছাই পর্বের গণ্ডিই পার করতে পারেনি। ১৯৭৮ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে বুলগেরিয়াকে ৩-১ গোলে হারানো ম্যাচে প্লেমেকার হিসেবে খেলা প্লাতিনি ৩০ গজ দূর থেকে একটা গোল করে সবার নজরে পড়েন। তবে মূল বিশ্বকাপে তেমন কিছু করতে পারেননি। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মাত্র ১টি গোল করতে সক্ষম হন, দলও বাদ পড়ে যায় গ্রুপ পর্ব থেকে।
পরের বিশ্বকাপের (১৯৮২) বাছাই পর্বে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ফ্রি কিক থেকে গোল করে প্লাতিনি দলকে মূল পর্বে উঠতে সাহায্য করেন। এই বিশ্বকাপে প্লাতিনি অধিনায়কের দায়িত্ব পান। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব পার করে সেমি ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি হয় ফ্রান্স। এই ম্যাচটিকে ফুটবল বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ম্যাচ হিসেবে গণ্য করা হয়। নির্ধারিত সময়ে ম্যাচটি ৩-৩ গোলে ড্র হওয়ার পর টাইব্রেকারে পশ্চিম জার্মানি ম্যাচটা জিতে নেয়। ম্যাচে ফ্রান্সের পক্ষে প্রথম গোলটি করেন প্লাতিনি। ম্যাচটিকে প্লাতিনি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি হিসেবে উল্লেখ করেন।
পরের বিশ্বকাপে ফ্রান্স গ্রুপ পর্ব পার হয়ে দ্বিতীয় পর্বে মুখোমুখি হয় আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন ইতালির। ইতালিকে ২-০ গোলে হারানো ম্যাচের প্রথম গোলটি করেন প্লাতিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় দুর্ধর্ষ ব্রাজিলের। ব্রাজিলের সেই দলে খেলেছিলেন জিকো আর সক্রেটিসের মতো কিংবদন্তী খেলোয়াড়। ক্যারেকার গোলে ব্রাজিল এগিয়ে গেলেও, প্লাতিনির গোলেই ফ্রান্স ম্যাচে ফেরত আসে। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে ম্যাচটা জিতে নেয় ফ্রান্স।
সেমিতে আবারও মুখোমুখি হয় পশ্চিম জার্মানির এবং এবারও হেরে যায় ফ্রান্স। প্লাতিনি অবসরে যাবার পরের দুই আসরে ফ্রান্স বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের গণ্ডিই পার হতে পারেনি।
কোনো বিশ্বকাপেই প্লাতিনি গোল্ডেন বল, সিলভার বল কিংবা ব্রোঞ্জ বল পাননি। তবে এর পরেও ২০১৪ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়ের তালিকায় দশম স্থানে আছেন তিনি। অথচ অনেক বিশ্বকাপ জয়ী এবং গোল্ডেন বল জয়ী খেলোয়াড়ও তালিকায় তার পেছনে রয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, বিশ্বকাপে তার পারফর্মেন্স কতটা চমকপ্রদ ছিল।
৫
ফ্রান্সের হয়ে খেলা ৭২টি ম্যাচের মাঝে ৪৯টিতেই অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন প্লাতিনি, দলের হয়ে ৪১টি গোল করেন তিনি, যা কিনা এক সময় ফ্রান্সের পক্ষে সর্বোচ্চ ছিল। পরবর্তীতে থিয়েরি হেনরি রেকর্ডটা ভেঙে ফেলেন। তবে হেনরির গোল গড় প্লাতিনির (০.৫৭) চেয়ে অনেক কম (০.৪১)।
প্লাতিনিকে ভালোভাবে বুঝতে চাইলে এসব পরিসংখ্যানও যথেষ্ট নয়। ফ্রান্সের ফুটবল ইতিহাস পরবর্তীতে আরো সমৃদ্ধ করার জন্য যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, সেই জিনেদিন জিদানের একটা উক্তি থেকে প্লাতিনি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে-
“যখন আমি ছোট বেলায় বন্ধুদের সাথে খেলতাম তখন সবসময়ই প্লাতিনির মতো হতে চাইতাম।”
জিদান এক সময় অর্জনে হয়তো প্লাতিনিকে ছাড়িয়েও গিয়েছেন, তবে ‘চেষ্টা করলে কিছু করা যাবে’ এমন বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তরটা কিন্তু প্লাতিনির গড়ে দেওয়া।