আবদুর রাজ্জাকের উচ্চতর গবেষণা এবং অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কি সমাচার

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আব্দুর রাজ্জাক উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে বিলেতে পাড়ি জমান। ‘লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স’ এ উচ্চতর গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে তিন বছরের বৈতনিক ছুটি মঞ্জুর করে (যদিও পরবর্তীতে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য তাকে আরও দুই বছরের বৈতনিক ছুটি দেওয়া হয়)। বোম্বে থেকে সৈনিকদের জাহাজে চেপে আব্দুর রাজ্জাক এসে পৌঁছান রানীর দেশে।

অধ্যাপক লাস্কি; Image Source: Encyclopedia Britannica

আব্দুর রাজ্জাকের গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘Political Parties in India’। এই গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজার) হিসেবে নিযুক্ত হন ‘A Grammar of Politics’ গ্রন্থের লেখক প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হ্যারল্ড জোসেফ লাস্কি। তার বিশ্বাস ছিল, মুসলিম লীগ ইংরেজদের বিভাজন নীতির ফল। অবশ্য ব্যক্তি হিসেবে তিনি নিজেও জওহরলাল নেহরুর ভক্ত ছিলেন। তাই কংগ্রেস ছাড়া যে ভারতে কোনো রাজনৈতিক দল আছে সেটা মানতেই চাইতেন না তিনি। ফলে, নিজের গবেষণার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে লাস্কিকে রাজি করাতে আব্দুর রাজ্জাককে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়।

বলা বাহুল্য, শেষপর্যন্ত আব্দুর রাজ্জাকের যুক্তি অধ্যাপক লাস্কির কাছে যথোপযুক্ত মনে হয়। গবেষণার শুরুর দিকে আব্দুর রাজ্জাক হ্যারল্ড লাস্কির কাছে একবার জানতে চান, কীভাবে পড়াশোনা শুরু করব? উত্তরে লাস্কি তাকে বলেন, “মাই বয়। গো অ্যান্ড সোক!” আব্দুর রাজ্জাক বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, “প্রথমে লাইব্রেরিতে ঢুইক্যাই আপনার টপিকের কাছাকাছি যে যে বই পাওন যায় পয়লা একচোট পইড়া ফেলাইবেন। তারপর একটা সময় আইব আপনি নিজেই খুঁইজ্যা পাইবেন আপনার আগাইবার পথ।” অধ্যাপক লাস্কি মূলত জ্ঞানের আধারে অবগাহনের সাথে তুলনার জন্য ‘সোক’ শব্দটির ব্যবহার করেছিলেন।

অ্যা গ্র্যামার অব পলিটিক্স গ্রন্থের মাধ্যমেই বিখ্যাত হন অধ্যাপক লাস্কি; Image Source: Amazon.com

আব্দুর রাজ্জাক নিজ গুণেই অধ্যাপক লাস্কির প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। তাদের সম্পর্ক শুধুমাত্র ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। উপাচার্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন যখন বিলেতে শিক্ষক সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন, তখন অধ্যাপক লাস্কির সাথে আব্দুর রাজ্জাক তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। শুধু তা-ই নয়, সাক্ষাতের দিন যথাসময়ে হ্যারল্ড লাস্কি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইনকে অভ্যর্থনা জানাতে সিড়ির সামনে অপেক্ষা করছিলেন, যা আব্দুর রাজ্জাক নিজেও কখনো দেখেননি। তিনি বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করেছেন, “তিনি সাধারণত এভাবে আর কাউকেই স্বাগত জানাতেন না। এমনকি জওহরলাল নেহরু ও কৃষ্ণ মেনন সাক্ষাৎ করতে এলেও নয়।

পূর্বেই বলা হয়েছে, অধ্যাপক লাস্কি ছিলেন জওহরলাল নেহরুর ভক্ত। তিনি একবার আব্দুর রাজ্জাককে বলেছিলেন, “তুমি চেষ্টা করলে নেহেরুর মতো হতে পারবে।” এ থেকেই বোঝা যায় আব্দুর রাজ্জাকের সাথে অধ্যাপক লাস্কির সম্পর্ক শুধু ছাত্র-শিক্ষকের নয়, ছিল হৃদ্যতার। যদিও আব্দুর রাজ্জাক নিজের সম্পর্কে এই ধারণার লালন করেননি, এবং সাথে সাথেই তিনি জানিয়ে দেন, “আই ডু নট উইশ টু বি মেনশনড উইথ মি. নেহরু।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, আব্দুর রাজ্জাকের গবেষণা শেষ হবার পূর্বেই ১৯৫০ সালে অধ্যাপক লাস্কি মারা যান। অসমাপ্ত গবেষণা শেষ করবার জন্য আব্দুর রাজ্জাক তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে হিসেবে মরিস জোন্সকে নির্বাচিত করেন। অন্যদিকে, দেশ ছাড়ার পাঁচ বছরে পেরিয়ে যাচ্ছিল আব্দুর রাজ্জাকের। কিন্তু, গবেষণার অভিসন্দর্ভ রচনার কাজ কোনোভাবেই এগোচ্ছিল না। এই অবস্থায় ড. মজহারুল হকসহ লন্ডনে অবস্থানরত তার বন্ধুবান্ধবরা তাকে অভিসন্দর্ভ রচনার তাগাদা দেওয়া শুরু করেন। তাদের চাপের মুখে গবেষণাপত্র লেখার কাজ শেষ করেন তিনি।

Image Source: Baatighar

গবেষণার মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সময় বাধে বিপত্তি। পরীক্ষার একজন বোর্ড মেম্বার তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার থিসিসে রেফারেন্স নম্বরগুলো আছে, কিন্তু পাদটীকায় রেফারেন্সগুলো কোথায়?” এ প্রশ্ন শুনে তিনি বেশ অবাক হন। এরপর অভিসন্দর্ভ খুলে দেখেন- পাদটীকার রেফারেন্সগুলো সত্যিই লেখা নেই। প্রকৃত ঘটনা হলো, জীবন সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাকের ছিল নিদারুণ উদাসীনতা। ফলে, টাইপিস্টরা যে তার পাদটীকার রেফারেন্সগুলো টাইপ করেননি সেটা তিনি একবারের জন্যও খুলে দেখেননি। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এমন বিষয়ে আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন ভয়ানক খামখেয়ালি। উপরন্তু, বোর্ডের অন্য এক সদস্য সেসময় ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন। তিনি আব্দুর রাজ্জাককে বলেন, “আমি ভেবেছিলাম তোমার থিসিস থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পারব।” আব্দুর রাজ্জাক এর উত্তরে বলেন, “আপনি যে পরীক্ষা কমিটিতে থাকবেন, তা তো আমি জানতাম না!

সব মিলিয়ে থিসিস বোর্ড আব্দুর রাজ্জাককে আরও ছয় মাস লন্ডনে থেকে গবেষণাপত্রটি ঠিকঠাক করে জমা দিতে বলে। কিন্তু, আব্দুর রাজ্জাক সে কথায় কান না দিয়ে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। গবেষণা অসমাপ্ত রেখেই ১৯৫০ সালের ১৫ জুলাই লিভারপুল বন্দর থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে S.S. Clan Mackensie নামের জাহাজে চেপে বসেন তিনি। উচ্চতর গবেষণার স্বীকৃতি নিতে বিলেত আসা আব্দুর রাজ্জাক সঙ্গে নিয়ে ফেরেন পাঁচ বছরের বিলেতজীবনের সংগৃহীত বইয়ের বাক্স!

Language: Bangla
Topic: Gyantapas Abdur Razzaq's research & his days with Professor Harold J. Laski
তথ্যসূত্র:
১. আব্দুর রাজ্জাক জীবনীগ্রন্থ- নাজমুল হাসান
২. যদ্যপি আমার গুরু -আহমদ ছফা
৩. সাক্ষাৎকারে সরদার ফজলুল করিম : বিষয় অধ্যাপক আবুদর রাজ্জাক- মোহাম্মদ আলী

Feature image source: আজকের পত্রিকা

Related Articles

Exit mobile version