‘Beauty with Brain’ – বহুল প্রচলিত এই কথাটি কখনো শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কল্পনা করুন তো এমন একজন ব্যক্তিত্বের কথা, যিনি তার রূপের মাধুর্য দিয়ে মাত করে রেখেছেন সিনেমার জগৎ আর উদ্ভাবনী ক্ষমতার বদৌলতে পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন প্রযুক্তির পথে। প্রিয় পাঠক, আমরা আজ এমনই একজন ব্যক্তির কথা জানবো যিনি রুপে-গুণে অনন্য।
হেডি ল্যামার। প্রতিভাবান এই মানুষটির পরিচয় দিতে গেলে বলতে হয় তার অভিনয়ের দক্ষতা এবং প্রযুক্তি খাতে তার অবদানের কথা। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এমজিএম এর স্বর্ণযুগে অভিনয় করে যাওয়া এই রূপসী অভিনেত্রী জাতিতে ছিলেন অস্ট্রিয়ান-আমেরিকান। বর্ণালিভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অগ্রযাত্রায় তার অবদান ছিল অসামান্য।
ব্যক্তিগত পরিচয়
মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার স্টুডিওস ইনকর্পোরেশন হলো যুক্তরাষ্ট্রের একটি খ্যাতনামা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, যেটি বিভিন্ন টেলিভিশন অনুষ্ঠান এবং ফিচার সিনেমার প্রযোজনা ও পরিবেশনার কাজ করে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানটির সোনালী সময়ের সাক্ষী ছিলেন হেডি ল্যামার। তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো Tortilla Flat, Lady of the Tropics, Boom Town and Samson and Delilah ইত্যাদি।
কাজ করেছেন ক্লার্ক গাবলে ও স্পেন্সার ট্রেসির মতো বিখ্যাত অভিনেতাদের সাথে। ল্যামার একজন বিজ্ঞানীও ছিলেন। বর্ণালীভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় তার অবদান পরবর্তীতে আধুনিক তারহীন যোগাযোগ ব্যবস্থার চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করেছে। বৃশ্চিক রাশির জাতিকা ল্যামারের জন্ম ১৯১৩ সালের ৯ নভেম্বর। নিভৃতচারী এই অভিনেত্রী ও গবেষক ফ্লোরিডায় নিজ বাসস্থানে ২০০০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
ল্যামারের অভিনয় জীবন
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় কিসলার দম্পতির কোল আলো করে আসেন এই অভিনেত্রী। কথায় আছে, প্রতিভা কখনও চাপা থাকে না। শুধু দরকার এমন কাউকে যিনি প্রতিভার মূল্যায়ন করতে জানেন অথবা পৃথিবীর সবার সামনে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন। ল্যামারের প্রতিভার আবিষ্কারক ছিলেন একজন অস্ট্রিয়ান পরিচালক। ১৯৩৩ সালে যৌনাচারের দায়ে অভিযুক্ত চেক চলচ্চিত্র Ecstasy-তে অভিনয়ের সূত্র ধরেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়ে নেন ল্যামার।
ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করা ল্যামার প্রথম বিয়ে করেন ১৯৩৪ সালে, ১৯ বছর বয়সে। ধনাঢ্য সামরিক অস্ত্র প্রস্তুতকারক ফ্রিটজ ম্যান্ডল জাতিতে ছিলেন অস্ট্রিয়ান এবং ল্যামারের স্বামী। তার কাজ ছিল নাৎসিদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করা। দাম্ভিক স্বামীর সাথে অসুখী সংসারের পাট চুকিয়ে রাতের অন্ধকারে সাইকেল চালিয়ে ল্যামার পালিয়ে চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে লন্ডন থেকে নিউইয়র্কগামী জাহাজে মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার স্টুডিওর কর্ণধার লুইস মেয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন ল্যামার। আধো আধো ইংরেজি বলছিলেন ল্যামার, কিন্তু তার বাচনভঙ্গি ছিল হলিউডের মতো প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র জগতে অভিনয় করার মতোই দৃষ্টিনন্দন।
ভিয়েনিজ এই রূপসী স্বল্প সময়ের মাঝেই থিতু হন তার বেভারলি হিলসের জীবনে এবং নিজেকে অভ্যস্ত করে নেন গ্ল্যামারের এই জীবনের সাথে। হেডি ল্যামার নামে চুক্তিবদ্ধ হন হলিউডের মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার স্টুডিওর সাথে। এবার ভাগ্যদেবী ল্যামারের প্রতি প্রসন্ন হলেন। প্রথম আমেরিকান চলচ্চিত্রেই বাজিমাত করেন তিনি। Algiers নামের এই ছবিতে চার্লস বয়ারের সাথে অভিনয় করে ল্যামার কাঁপিয়ে দেন বক্স অফিস।
বড় পর্দার জীবনের ইতি
ল্যামারের অভিনয়জীবনে ভাটা পড়ে ১৯৫০ সালের দিকে। ১৯৫৮ সালে The Female Animal ছবিতে জেন পওয়েলের সাথে কাজ করার মাধ্যমে তার বর্ণাঢ্য চলচ্চিত্র জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৬৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ Ecstasy and Me, যেটি তৎকালীন সময়ে চূড়ান্ত বিতর্কের জন্ম দেয় এবং বলা বাহুল্য যে, বেস্টসেলার এই বইটি সর্বমহলে দারুণ আলোচিত এবং সমালোচিত হয়।
পরবর্তীতে প্রতিলিখনের কাজে অসঙ্গতির দরুন বইটিতে বেশ কিছু রুচিবিরুদ্ধ এবং বিকৃত তথ্য উপস্থাপনের অভিযোগ এনে তিনি বইটির প্রকাশকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে তিনি ১৯৬৬ ও ১৯৯১ সালে দু’বার গ্রেফতার হন, যদিও কোনোবারই তাকে আইনগত দিক থেকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। খ্যাতনামা এই অভিনয়শিল্পী দর্শকের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছিলেন ১৯৪০ সালে অস্কার মনোনয়নপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র- ‘Algiers’ এবং ‘Sampson and Delilah’ তে অভিনয়ের মাধ্যমে।
এক অন্য ল্যামারের খোঁজে
সাধারণ মানুষের কাছে ল্যামারের খ্যাতির কারণ ছিল তার অভিনয় দক্ষতা এবং রূপ। তবে তার ব্যক্তিসত্ত্বার সবচেয়ে মৌলিক পরিচায়ক ছিল তার উদ্ভাবনী মন। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর তিনি সান্নিধ্য পান জন এফ কেনেডি এবং হাওয়ার্ড হিউজেসের মতো ব্যক্তিদের, যারা তার পাশে ছিলেন বলেই তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি নিজস্ব আগ্রহে গবেষণা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। এরই সূত্র ধরে ১৯৪১ সালে তিনি বর্ণালীভিত্তিক প্রযুক্তির প্যাটেন্ট অর্জন করেন, যেটি আজকের জিপিএস, ব্লুটুথ এবং নিরাপদ ওয়াইফাই এর মতো অত্যাধুনিক তারহীন যোগাযোগব্যবস্থার অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছে। ফলাফল হিসেবে আজকের পৃথিবী যোগাযোগের ক্ষেত্রে এত দূর এগিয়ে গিয়েছে। বাংলা ভাষার সেই চিরাচরিত বাণী, ‘যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে’- ল্যামারের ক্ষেত্রে বোধ করি কথাটি এতটুকুও মিথ্যা নয়।
১৯৪২ সালে ল্যামার বেছে নেন তার চেনা পথ থেকে একেবারেই আলাদা এই জগতকে। তিনি এবং তার সঙ্গীত পরিচালক বন্ধু জর্জ অ্যান্থেইল একসাথে কাজ করা শুরু করেন বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে গুপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। এই গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিবর্তনের মাধ্যমে শত্রুদেরকে মিত্রবাহিনীর নিকট পাঠানো বার্তার পাঠোদ্ধারের চেষ্টা ভণ্ডুল করে দেওয়া। সুনির্দিষ্ট করে বললে জার্মান নাৎসি বাহিনীকে পরাস্ত করতে, সামরিক এবং মুঠোফোন উভয় ক্ষেত্রে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করার অগ্রযাত্রায় এই পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এটিও সত্য যে, ল্যামারের কাজের গুরুত্ব সাথে সাথেই সবাই অনুধাবন করতে পারেনি, কারণ দূরপাল্লার ক্ষেত্রে এর প্রভাব তখন পর্যন্ত কার্যকরভাবে প্রমাণিত হয়নি। কয়েক দশক পর ল্যামার এবং তার বন্ধু অ্যান্থেইল যৌথভাবে ‘Electronic Frontier Foundation (EFF) Pioneer Award’ এ ভূষিত হন এবং আশ্চর্যজনকভাবে ঠিক একই বছর প্রথম নারী হিসেবে হেডি ল্যামার আবিষ্কার দুনিয়ার অস্কারখ্যাত ‘BULBIE™ Gnass Spirit of Achievement Award’ অর্জন করেন।
টালমাটাল জীবনের নানা রঙ
ল্যামারের বিবাহের সংখ্যাটা ছিল ছয়। ১৯৩৯ সালে জীন মার্কের সাথে দ্বিতীয় সংসারে তিনি পুত্র সন্তান জেমসকে দত্তক নেন। তৃতীয় স্বামী জন লোডারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর ১৯৪৫ ও ১৯৪৭ সালে জন্ম দেন যথাক্রমে ডেনিস ও অ্যান্থনি নামের দুই পুত্র সন্তানের। ১৯৫৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন।
জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি আক্ষরিক অর্থেই নিভৃতচারী হয়ে যান। ফ্লোরিডায় অবস্থিত অরল্যান্ডোর উত্তরে ক্যাসলবেরিতে তিনি তার জীবনের পরবর্তী দিনগুলো অতিবাহিত করেন। সেখানেই ২০০০ সালের ১৯ জানুয়ারি, ৮৬ বছর বয়সী এই মহান ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটে।
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
সিনেমা জগতের এক অনন্য প্রতিভা, অভিনয়ের সুনিপুণ দক্ষতা, পর্দায় সপ্রতিভ উপস্থিতি বা এরকম আরও অসংখ্য উপাধি, তকমা, বিশেষণে হেডি ল্যামারকে আখ্যায়িত করা যাবে। তবে লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল তার অসম্ভব সৃজনশীল মন আর উদারপন্থী মনোভাবের কথা। অবাক করা তথ্য হলো, ল্যামার যে জিনিসের মাঝে নিজেকে খুঁজে পেতেন সেটা কখনোই অভিনয় ছিল না।
তার একান্ত স্বতঃস্ফূর্ত মনোনিবেশ ছিল গবেষণার প্রতি, যা তাকে অভিনেত্রীর পাশাপাশি ভিন্ন এক পরিচয় এনে দেয়। তার এই ভিন্ন পরিচয়ের পেছনে সবচেয়ে চমকপ্রদ ও হৃদয়বিদারক ঘটনাটি হলো তার নিজের আবিষ্কারের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব নৌবাহিনীকে দিয়ে দেওয়া এবং পরবর্তীতে যথেষ্ট দৈন্যতার মাঝে দিন কাটানো। আপামর জনসাধারণের অজানা ছিল এক হেডি ল্যামার যিনি তার জীবনের এত দ্যুতি, এত প্রাপ্তি, এত খ্যাতি নিয়েও মাদকাসক্ত হয়ে বেছে নিয়েছিলেন এক আশ্চর্য একাকী জীবন।
এসব গল্প হলেও সত্য ঘটনাবলী নিয়েই ২৪ নভেম্বর, ২০১৭ তে মুক্তি পায় ল্যামারের মহাকাব্যিক জীবন অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘Bombshell: The Hedy Lamarr Story’ ।
ছবিটির পরিচালক অ্যামি অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত অ্যালেকজান্দ্রা ডিন। পরিচালকের অসাধারণ নৈপুণ্যে উন্মোচিত হয়েছে ল্যামারের জীবনের নানা অজানা দিক, যিনি মানুষ হিসেবে সৌন্দর্য পরিমাপের ঊর্ধ্বে, কিন্তু আধুনিক দুনিয়ার তাবৎ মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে একজন অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
ফিচার ইমেজ: imdb.com