২০ বছর বয়সে সোনালী ছোটচুলো সে মেয়েটিকে বিশ্ববাসী চিনেছিলো ব্রিটেনের রাজবধু হিসেবে। তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে রাজপ্রাসাদ ছাড়বার পরও তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন ২১ বছর হতে চললো। এখনো তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী, আজও তাঁর বেদনাবিধুর বিদায় অশ্রুসিক্ত করে কোটি ভক্তকে। অসহায়ের কাছে ‘জনগণের যুবরানী’, ফ্যাশন সচেতন বিশ্বের কাছে স্টাইল আইকন আর সন্তানদের কাছে একজন মমতাময়ী মা- এই তিন কারিশমায় ব্রিটেনের (সাবেক) রাজবধুর পরিচয়ের বাইরেও তিনি যেন বিশেষ কিছু! তাঁর জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আজকের এই লেখা।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়ামের স্ত্রী কেট মিডলটন ও ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারির বাগদত্তা মেগান মার্কেলের মতো প্রিন্সেস ডায়ানা কোনো সাদামাটা পরিবার থেকে আসেননি। ১৯৬১ সালের ১ জুন তাঁর জন্ম হয়েছিলো ব্রিটেনের অন্যতম অভিজাত স্পেন্সার পরিবারে। সেই স্পেন্সার পরিবার, যারা উত্তরাধিকার সুত্রে মার্লবোরোর ডিউক, ভিস্কাউন্ট চার্চিল ও স্যান্ডারল্যান্ডের আর্লের মতো রাজকীয় খেতাব বহন করে চলেছেন। তাঁর বাবা ছিলেন ভিস্কাউন্ট অ্যালথর্প এডওয়ার্ড জন স্পেন্সার এবং মা ভিস্কাউন্টেস অ্যালথর্প ফ্রান্সেস শ্যান কিড। ৬ বছর বয়সেই বাবা-মা’র বিচ্ছেদ দেখতে হয়েছিলো ডায়ানাকে। তাঁর জিম্মা নিয়ে বাবা ও মায়ের কদর্য আইনী লড়াই প্রভাব ফেলেছিলো ডায়ানার শিশুমনে। শেষ অবধি লেডি ডায়না স্পেন্সারের শৈশব কেটেছিলো বাবার কাছেই।
‘৮ম আর্ল অব স্পেন্সার’ খেতাব পাবার পর অ্যালথর্প থেকে সপরিবারে নর্দাম্পটনে চলে আসেন ডায়ানার বাবা এডওয়ার্ড স্পেন্সার। সেখানে তাঁর বাবা বিয়ে করেন বিখ্যাত লেখিকা বারবারা কার্টল্যান্ডকে। সৎ মায়ের সাথে কোনোদিনই বনিবনা হয়নি ডায়ানা ও তাঁর ভাই চার্লসের। বাবার মৃত্যুর পর মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই বংশীয় খেতাব ‘৯ম আর্ল অব স্পেন্সার’ পান ডায়ানা।
কেন্টের ওয়েস্ট হেলথ পাবলিক স্কুলের কয়েক বছর পড়বার পর তিনি আবাসিক স্কুল রিডলসওয়ার্থ হলে পড়েছেন। পড়াশোনায় অতটা ভালো কখনোই ছিলেন না তিনি। ফেল করেছিলেন ‘ও’ লেভেলে। পরবর্তীতে পড়াশোনা তিনি শেষ করেছিলেন সুইজারল্যান্ডের ইনস্তিতুত আলপিন ভিদেমানেত্তে থেকে। পড়াশোনায় খারাপ হলেও খেলাধুলা ও সাঁতারে কিশোরী ডায়ানা ছিলেন ভীষণ পটু। ভালোবেসেছিলেন ব্যালে নৃত্যকে, কিন্তু ৫’৮” উচ্চতার ডায়ানা এই নাচের জন্য ‘একটু বেশিই লম্বা’ হওয়ায় ইচ্ছা সত্ত্বেও এতে ক্যারিয়ার গড়তে পারেননি।
প্রিন্স চার্লসের সাথে পরিচয়, প্রণয়, অতঃপর…
সুইজারল্যান্ডে পাঠপর্ব চুকিয়ে লন্ডনে ফেরা অভিজাত পরিবারের এই মেয়েটির তারুণ্য কেটেছিলো খুবই সাদামাটাভাবে। শিশুবৎসল ডায়ানার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিলো শিশু-পরিচারিকা হিসেবেই। পরবর্তীতে কিছুদিন খণ্ডকালীন বাবুর্চির কাজ করে ১৯৭৭ সালে তিনি যোগ দেন লন্ডনের নাইটসব্রিজের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে, সহকারি শিক্ষিকা পদে। মজার ব্যাপার হলো, সেই বছরই ডায়ানার সাথে চার্লসের প্রথম আলাপ হয় বোন সারাহ ম্যাককর্কুডেলের প্রেমিক হিসেবে। সময়ের ব্যবধানে সে আলাপ গড়ালো প্রেমে। শুধু বয়সেই ১৩ বছরের বড় ফারাক নয়, ব্যক্তিত্বের দিক থেকেও দুজন ছিলেন দুই মেরুর। লাজুক আর ফ্যাশন সচেতন ডায়ানার বিপরীতে রাশভারী, বাগানপ্রিয় প্রিন্স চার্লস।
ডায়ানার সাথে যে কেবল তখন থেকে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের পরিচয়, তা নয়। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছোট দুই ছেলে প্রিন্স অ্যান্ড্রু ও প্রিন্স এডওয়ার্ডের ছোটবেলার খেলার সাথী ছিলেন ডায়ানা। যা-ই হোক, ব্রিটিশ রাজমুকুটের পরবর্তী উত্তরাধিকার হওয়ায় প্রিন্স চার্লসের এই প্রেম নজর কেড়েছিলো বিশ্ব মিডিয়ার। এই জুটির চার বছরের প্রণয় পরিণতি পায় ১৯৮১ সালের ২৯ জুলাইয়ের এক মাহেন্দ্রক্ষণে। লন্ডনের সেন্ট পল’স ক্যাথেড্রালে অনুষ্ঠিত তাঁদের বিয়ে সরাসরি সম্প্রচারিত হয় বিশ্ব মিডিয়ায়, যার সাক্ষী হয়েছিলো বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।
যুবরানী যখন মা, যখন জনতার হৃদয়ের রানী
বিয়ের ১১ মাসের মাথায় ১৯৮২ সালের ২১ জুন জন্ম নেয় চার্লস ও ডায়ানার ভালোবাসার প্রথম উপহার প্রিন্স উইলিয়াম আর্থার ফিলিপ লুইস। ১৯৮৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয় তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান প্রিন্স হেনরি চার্লস অ্যালবার্ট ডেভিড (প্রিন্স হ্যারি)।
‘ব্রিটিশ রাজবধু’র বাইরে এসে তিনি গড়তে চেয়েছিলেন নিজের আলাদা একটি পরিচয়, এখানেই ব্যতিক্রম তিনি! পোশাক সচেতনতা দিয়ে ফ্যাশন আইকন বা কোটি তরুণের চোখে মোহময়ীই তিনি কেবল হননি, তিনি ভেবেছিলেন সাধারণ মানুষের জন্য। এইচআইভি সম্পর্কিত সচেতনতা তৈরিতে নানা ক্যাম্পেইনে সরাসরি যুক্ত থাকার পাশাপাশি এইডস আক্রান্তদের জন্যও মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ডায়ানা। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করা দাতব্য সংস্থাগুলোর অনুদান যোগাড়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতেন তিনি। গণমাধ্যমও এই মানবীকে এমনভাবেই লুফে নিলো যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে পর্যন্ত পত্রিকা সম্পাদকদের ওয়েবমিনস্টারে তলব করতে হয়েছিলো! সেখানে তুমুল বিতর্ক হয়েছিলো একটি কোটি টাকার প্রশ্নে; একজন মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে নাকি জনগণের জানার অধিকার- গণমাধ্যমের অগ্রাধিকার কোনটা হওয়া উচিত।
চার্লসের সাথে বিচ্ছেদ: কীভাবে, কেন?
জীবন রুপকথা নয়, তাই সব গল্পের শেষটাও হয় না মনমতো। প্রিন্সেস ডায়ানা ও চার্লসের সংসারের সুখও তাই বোধ হয় সইলো না তাঁদের অদৃষ্ট। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় অ্যান্ড্রু মর্টনের বই ‘ডায়ানা: হার ট্রু স্টোরি‘। বুলিমিয়া ও বিষণ্ণতার সাথে ডায়ানার নিরন্তর লড়াইয়ের কথা উঠে এসেছিলো বইটিতে। ওদিকে ক্যামিলা পার্কার-বাওলেসের (বর্তমান ডাচেস অব কর্নওয়াল) সাথে স্বামী চার্লস পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় আরো দিশেহারা ডায়ানা নিজেও জেমস গিলবের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যান। ১৯৯২ সালে এই দুই সম্পর্কের কথা গণমাধ্যমের কল্যাণে পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। ফলশ্রুতিতে রাজপরিবার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর পার্লামেন্টে চার্লস-ডায়ানার বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন। ১৯৯৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয় তাঁদের।
১৯৯৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে চার্লস সম্পর্কের ভাঙনের পেছনে নিজের বিশ্বাসভঙ্গ ও অন্যাসক্তির দায় স্বীকার করেছিলেন। দ্য সান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডায়ানার সাথে বিয়ের অনেক আগে থেকেই ভাঙা-গড়ার মধ্যেই চলছিলো চার্লস-ক্যামিলার প্রেম। ঘটনাক্রমে ক্যামিলা তাঁর প্রাক্তন প্রেমিককে বিয়ে করে ফেললে চার্লস হয়ে পড়েন একা। এর মাঝেই ডায়ানার সাথে প্রেম, বাগদান, বিয়ে। কিন্তু বিয়ের আগের রাতেও ক্যামিলার জন্য চার্লস কেঁদেছিলেন বলে গুঞ্জন আছে। এ গোপন প্রেমের বিভিন্ন নথিতে একটি ব্যাপার বারবার এসেছে। চার্লস নাকি বাগদানের পর ডায়ানার কোনো এক ‘অন্ধকার দিক’ আবিষ্কার করেন, যেটিই ছিলো ক্যামিলার প্রতি তাঁর পুনরাসক্তির কারণ। এমনকি ডায়ানাও ১৯৯৫ সালে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
“আমাদের বিয়েতে আসলে ছিলাম আমরা তিনজন মানুষ (চার্লস, ডায়ানা ও অদৃশ্য ক্যামিলা)।”
গণমাধ্যমের নেতিবাচক ভূমিকা ও ডায়ানার নতুন সম্পর্ক
আত্মপরিচয়ে বিশ্বময় এতটাই ভাস্বর হয়েছিলেন ডায়ানা যে, ব্রিটিশ রাজপরিবার ছেড়ে আসবার পরও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিলো অটুট। বরং বিয়ের পর পুরোটা উদ্যম তিনি ব্যয় করেছিলেন মানুষের সেবায়। স্থল-মাইন সম্পর্কে যুদ্ধপীড়িত অ্যাঙ্গোলায় সচেতনতা কার্যক্রমের জন্য তিনি গিয়েছিলেন মানুষের দ্বারে দ্বারে। সাবেক রাজবধুর হু হু করে বাড়তে থাকা এই জনপ্রিয়তা প্রিন্স চার্লসকে জনগণের কাঠগড়ায় (বিচ্ছেদের জন্য) খলচরিত্রে পরিণত করছিলো। ওদিকে ফ্যাশন দুনিয়া ও দাতব্য কর্মসূচিতে তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাশন ম্যাগাজিনসহ ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলো তাঁকে অতি মহিমান্বিত করে নিজেদের কাটতিও বাড়িয়েছিলো।
সেই দৃশ্যপট বদলাতেও বেশি সময় লাগলো না। খ্যাতির চূড়া থেকে পতন হলো ডায়ানার, যখন তিনি প্রেম করা শুরু করলেন মিশরীয় চলচ্চিত্র প্রযোজক দোদি ফায়েদের সাথে। উল্লেখ্য, দোদি ফায়েদের আগেও পাক বংশোদ্ভুত শল্য চিকিৎসক হাসনাত খানের সাথে ‘দুই বছরের সম্পর্ক’ নিয়ে গুজব চাউর হয়েছিলো গণমাধ্যমে, অথচ দুজনেই সবসময় নিজেদের কেবল ‘ভালো বন্ধু’ হিসেবে দাবি করে গেছেন। বলা বাহুল্য, খ্যাতির বিড়ম্বনার কারণেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর শিকার হয়েছিলেন তিনি। প্রিন্স চার্লসের সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর ব্যক্তিজীবনের বাকিটা তিনি কীভাবে কাটাবেন, সেই স্বাধীনতাও যেন তাঁকে দিতে ইচ্ছুক ছিলো না তৎকালীন ব্রিটিশসহ বিখ্যাত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। ডায়ানা-ফায়েদ যুগল কোথায় যাচ্ছেন, কী খাচ্ছেন- এ নিয়েও নেতিবাচক চর্চা ও সমালোচনা চলতে লাগলো গণমাধ্যমে। অবশ্য গণমাধ্যমের এই সমালোচনার পিছে দোদি ফায়েদের ‘প্লেবয়’ সুলভ একটি নেতিবাচক ইমেজের ভূমিকাও ছিলো। সেই থেকে ব্যক্তিজীবন নিয়ে সাংবাদিক ও অতর্কিত ছবিশিকারী ‘পাপারাজ্জি’দের থেকে পালিয়ে বাঁচতে লাগলেন প্রিন্সেস ডায়ানা।
মরে গিয়েই বাঁচতে হলো পাপারাজ্জির কবল থেকে
পাপারাজ্জি থেকে এই পালিয়ে বাঁচতে চাওয়ার নীতিই হয়তো কাল হয়েছিলো ডায়ানার জীবনে। ১৯৯৭ সালের আগস্টে ফ্রান্সে প্রমোদ ভ্রমণে এসেছিলেন ডায়ানা ও ফায়েদ। ৩১ আগস্ট সকালে ‘হোটেল রিৎজ’ থেকে একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে করে বেরোতেই পথিমধ্যে তাদের ধাওয়া করে পাপারাজ্জিদের একটি দল। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি আকস্মিক মোড় নিতে গিয়েই ঘটলো অঘটন। এক টানেলের রাস্তায় তাঁদের বহনকারী গাড়িটি অন্য গাড়ির সাথে সংঘর্ষে দুমড়ে মুচড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান দোদি ফায়েদ ও গাড়িটির চালক। কোনোমতে বেঁচে যান ডায়ানার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। ওদিকে দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত ডায়ানাকে দ্রুতই একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। শরীরে অজস্র জখম নিয়ে তীব্র যন্ত্রণার সাথে কয়েক ঘন্টার লড়াই শেষে পরপারে পাড়ি জমান প্রিন্সেস ডায়ানা।
ডায়ানার অশ্রুসিক্ত শেষ বিদায়
তাঁর মৃত্যুর পর স্বয়ং ব্রিটেনের রানীকে পর্যন্ত সমালোচিত হতে হয়েছিলো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে বিলম্ব করায়। পুত্রের বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত তিক্ততার জের সত্ত্বেও রানীকে সেলাম ঠুকতে হয়েছিলো ডায়ানার জনপ্রিয়তার কাছে। ৫ সেপ্টেম্বর বাকিংহাম প্যালেস থেকে পাঠানো এক টেলি-শোকবার্তায় রানী এলিজাবেথ ডায়ানার অসামান্য জীবনাদর্শকে ‘অবিস্মরণীয়’ আখ্যা দেন।
৬টি কালোঘোড়ায় অস্ত্রসজ্জিত রাজকীয় সওয়ারী সমেত কেনসিংটন প্যালেস থেকে ৬ সেপ্টেম্বর প্রিন্সেস ডায়ানার শবযাত্রা শুরু হয়। চার মাইলের এ শবযাত্রায় পথের দুই পাশে হাজারো ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীর সাথে ছিলেন অশ্রুসিক্ত ডায়ানার দুই সন্তান উইলিয়াম ও হ্যারি। আজকের ‘ডিউক অব ক্যামব্রিজ’ প্রিন্স উইলিয়াম তখন মাত্র ১৫ বছর বয়সী কিশোর, আর হ্যারির বয়স ১৩।
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে ডায়ানার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক আবেগঘন অন্তিমস্তুতি পাঠ করেছিলেন তাঁর ভাই চার্লস স্পেন্সার। এল্টন জনের শোকসঙ্গীত পরিবেশনাও ছিলো সে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে। সে অনুষ্ঠান টেলিভিশনে প্রত্যক্ষ করেছিলো বিশ্বের প্রায় বত্রিশ মিলিয়ন মানুষ। অবশেষে তাঁর কফিন নিয়ে যাওয়া হয় স্পেন্সার মালিকানাধীন অ্যালথর্পের একটি ছোট্ট দ্বীপে। সেখানেই সমাহিত হন কোটি মানুষের হৃদয়ের রানী প্রিন্সেস ডায়ানা।
রহস্যময় মৃত্যু তদন্ত ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
মৃত্যুর দেড় বছর পর তদন্তকার্যে বেরিয়ে আসে, প্রিন্সেস ডায়ানার গাড়ির চালক হেনরি পল নির্ধারিতের চেয়ে বেশি গতিবেগে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। সেই চালক মদ্যপান ও এন্টি ডিপ্রেসেন্ট ওষুধ সেবনে আসক্ত ছিলেন। দুর্ঘটনার জন্য পূর্বে কয়েকজন আলোকচিত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলেও সে অভিযোগ তুলে নেওয়া হয় এবং চূড়ান্ত তদন্ত ফলাফলে বেপরোয়া চালককেই দায়ী করা হয়।
অন্যদিকে জনপ্রিয়তার তোড়ে ‘জনগণের যুবরানী’র মর্মান্তিক মৃত্যুকে নিয়ে দানা বাঁধতে থাকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের নানান কথা। ২০১৩ সালে ডায়ানার মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয় অ্যালেন পাওয়ার রচিত ‘দ্য প্রিন্সেস ডায়ানা কন্সপিরেসি’। সেই বইটিতে দাবি করা হয়, প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যু আসলে ছিলো একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সরাসরি রাজপরিবারকে ‘খুনের নির্দেশদাতা’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “প্যারিসের সেই টানেলে ডায়ানার গাড়িকে ধাওয়া করা পাপারাজ্জিদের দলে ছিলেন ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা এম সিক্সটিনের এক ছদ্মবেশী কর্মকর্তা। তিনিই বৈদ্যুতিক বন্দুক দিয়ে ডায়ানাদের গাড়িচালক পল হেনরিকে শক প্রয়োগ করাতেই ঘটেছিলো এ দুর্ঘটনা।” এমনকি দোদি ফায়েদের বাবাও একে নিছক দুর্ঘটনা বলতে নারাজ ছিলেন। বইয়ের দাবির মতোই তাঁর ভাষ্য। ডিউক অব এডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপকে হত্যাকান্ডের নির্দেশদাতা বলে অভিযুক্ত করেন তিনি।
ওদিকে এম সিক্সটিনের সাবেক গোয়েন্দা রিচার্ড টমলিন্সনের অভিযোগের আঙুল ছিলো গাড়িচালকের দিকেই। তাঁর মতে গাড়িচালক হেনরি ছিলেন এক গুপ্তচর এবং দুর্ঘটনায় তীব্র আলো ব্যবহার করা হয়েছিলো। এ ‘তীব্র আলো’ তত্ত্বের সাথে মিল আছে টেলিগ্রাফ কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্টের। সেখানে ঐ দিনের প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে বলা হয়, চারটি মোটরবাইক ঝাঁক বেঁধে এগোচ্ছিলো গাড়িটির সাথে। দুর্ঘটনার ঠিক আগ মুহূর্তে তারাও তীব্র এক আলোর ঝলকানি দেখতে পান। তাদের ধারণা, এতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলো গাড়িটির চালক।
যদিও দুর্ঘটনাস্থল ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত এক বিশেষ অনুসন্ধান এ ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না।
স্মৃতির পাতায় অক্ষয় ডায়ানা
স্থলমাইন সচেতনতায় ডায়ানার ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর মৃত্যুর বছরের ডিসেম্বরেই কানাডায় ১২২ দেশের সরকার কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয় অটোয়া মাইন-নিষিদ্ধ চুক্তি। ২০০৭ সালে ডায়ানার মৃত্যুর এক দশকপুর্তির খানিক আগে তাঁর দুই পুত্র মায়ের ৪৬ তম জন্মদিন পালন করেন একটু অন্যভাবে। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ সে জন্মদিনটিতে আয়োজন করা হয় একটি কনসার্ট, যা থেকে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ দাতব্য সংস্থায় দান করে দেয়া হয়। ২০১৫ এর ২ মে-তে জন্ম নেয় প্রিন্স উইলিয়াম ও কেট মিডলটনের দ্বিতীয় সন্তান। ডায়ানার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সে কন্যার নাম রাখা হয় শার্লট এলিজাবেথ ডায়ানা।
গত বছর প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর দুই দশকপুর্তিতে তাঁর দুই পুত্রের উদ্যোগে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত ব্যবহার্য জিনিসের এক প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়েছিলো কেসিংটন প্যালেসে। এই বছর সান ডিয়েগোর লা জোলা নাট্যশালায় অভিষেক প্রদর্শনী হতে যাচ্ছে ‘ডায়ানা’ শিরোনামে একটি মিউজিক্যাল ছবির। রাজপরিবারের অনুমতিক্রমে শৈশব থেকে শুরু করে ১৯৮১-তে ডায়ানার রাজকীয় বিয়ে পর্যন্ত ঘটনার নাট্যরূপ দেখতে পাবেন দর্শকেরা।
ফিচার ইমেজ: Life Is A biggest Mystery