১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা তখন চারদিকে। সে মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি অসহায়ের ভূমিকায় ছিলো ইহুদিরা। ঠিক তখনই হিলডা গিরিঞ্জার নামক এক ইহুদি নারী নাৎসি বাহিনী থেকে বাঁচতে কন্যা মাগদাকে নিয়ে পাড়ি জমান নিউইয়র্কে। ভিয়েনায় জন্ম নেওয়া এই ইহুদি নারী ছ’ বছর ধরে ইউরোপের এখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাঁচার তাগিদে। প্রথমে তুরস্ক, তারপর লিসবন। সেখানে নাৎসি ক্যাম্পে প্রায় ধরা পড়তে গিয়ে বেঁচে ফিরেছিলেন। তারপর ইউরোপ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে গমন হিলডার জন্য খুলে দেয় এক নতুন অধ্যায়।
হিলডা গিরিঞ্জার ছিলেন ইতিহাসের প্রথম ফলিত গণিতের নারী প্রভাষক। তবে শুধু ফলিত গণিত নয়, হিলডার জানাশোনার পরিধি ছিলো আরো বিস্তৃত। নিজের জ্ঞানকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগাতেও পারদর্শী ছিলেন এই ইহুদি নারী। গিরিঞ্জার ছিলেন বিংশ শতাব্দির ফলিত গণিতের অন্যতম অগ্রদূত। সেই সময় গণিত থেকে আলাদা হয়ে ফলিত গণিত নিজের স্বতন্ত্রতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো। যেখানে সবচেয়ে বড় অবদান ছিলো হিলডার। সম্ভাবনা ও প্রজননশাস্ত্রেও নিজের গণিতের উপর দখলদারি কাজে লাগিয়েছেন তিনি। তার অনেক কাজের উপর ভিত্তি করেই আজকের প্রকৌশল ও বিজ্ঞানের অনেক অংশ দাঁড়িয়ে আছে। গিরিঞ্জার নিজের কাজকে যতটা না পেশা হিসেবে নিতেন, তারচেয়ে বেশি নিতেন আবেগ হিসেবে।
গিরিঞ্জারের জন্ম ১৮৯৩ সালে, ভিয়েনাতে। তখনকার সময়ে মেয়েদের পড়ালেখার চেয়ে বিয়ে করে ঘর-সংসারেই মনোযোগ ছিলো বেশি। তবে গিরিঞ্জারের বাবা-মা চেয়েছিলেন, তাদের মেয়ে একটু আলাদা পথে হাঁটুক। তাই মেয়েকে হাইস্কুলে পাঠিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়েও নিজেদের জমানো টাকা দিয়ে মেয়েকে পদার্থ ও গণিতশাস্ত্রে পড়াশোনা করতে পাঠান। সেই সময় বিংশ শতাব্দীর কিছু বিখ্যাত অধ্যাপকের অধীনে পড়ার সৌভাগ্য হয় তার। আর্নেস্ট মাচ, উইলেহেম উইরটিংগারের মতো বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়ে ওঠেন হিলডা। ১৯১৭ সালে নিজের ডক্টরাল ডিগ্রী নেন। তারপর ত্রিকোণমিতি ও জেনারালাইজড উপপাদ্য নিয়ে গবেষণা করতে নামেন তিনি। কয়েকদিনের মধ্যেই একটি জার্নালে এ বিষয়ক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
এতকিছুর পরও শুধু ইহুদি হওয়াতে ভিয়েনায় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। এক্ষেত্রে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন উইলেহেম উইরটিংগার। তিনিই বার্লিনের একটি গণিত জার্নালের সহকারী পরিচালকের পদে নিযুক্ত করেন হিলডাকে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই ১৯২১ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের সহকারী পরিচালক বনে যান তিনি। অধ্যাপক রিচার্ড ভন মিজেস ছিলেন সে বিভাগের পরিচালক। এর ছ’ বছরের মাঝেই ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে ফলিত গণিতে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে যোগদান করেন হিলডা গিরিঞ্জার।
ভন মিজেসের অধীনে ফলিত গণিতে বিপুল পরিবর্তন আসে হিলডার মাধ্যমে। পরিসংখ্যান, সম্ভাবনা ও প্লাস্টিসিটি বিভাগে অভূতপূর্ব সাফল্য বয়ে আনেন। কোনো প্লাস্টিকের বস্তুতে চাপ প্রয়োগের ফলে প্লাস্টিকের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু ধাতব বস্তুর থেকে প্লাস্টিকের আকৃতি পরিবর্তন বেশ আলাদা। ভন মিজেস দীর্ঘদিন ধরে এর জন্য সূত্র খুঁজে আসছিলেন। অবশেষে হিলডা গিরিঞ্জার এ কাজে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। তিনি দু’টি সমীকরণকে এক করে একটি স্বতন্ত্র সমীকরণে রূপ দেন।
পরবর্তী সময়ে এর নাম হয় গিরিঞ্জার সমীকরণ। এই সমীকরণ থেকেই আজকের স্লিপ লাইন তত্ত্বের আবিষ্কার। এ তত্ত্ব দিয়ে পদার্থের চাপের সহনশীলতা কিংবা ভেঙে যাওয়ার ক্ষমতা নির্ধারণের মাধ্যমে কাজ করা হয়। ১৯৩৩ সালেই নিজের অনস্বীকার্য অবদান হিসেবে সহকারী অধ্যাপকের পদে উত্তীর্ণ হন হিলডা। তবে দুঃখের বিষয় হলো, সে বছরই নাৎসি বাহিনী জার্মানির রাজনীতিতে ক্ষমতায় আসে।
নাৎসি বাহিনী ক্ষমতায় এসেই ইহুদিদের নিয়ে বিভিন্ন শমন জারি করে। যার ফলে অনেক জ্ঞানী-গুণী ইহুদির মতো হিলডাও নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের পদটি হারান। এই সময়টাতে স্বামীর সাথেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তার। এই কঠিন সময়ে নিজের মেয়ে মাগদাকে নিয়ে বার্লিন ত্যাগ করেন হিলডা। কিছুদিন ব্রাসেলসে থেকে ইস্তাম্বুলে আশ্রয় নেন মা-মেয়ে। তখন তুরস্কে ক্ষমতায় ছিলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের উচ্চতর শিক্ষার ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। যার জন্য জার্মানি থেকে আসা প্রায় দু’শো জন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিকে স্বাগত জানায় তুরস্ক সরকার। এ তালিকায় হিলডা গিরিঞ্জার ও ভন মিজেসও ছিলেন। ভন মিজেসকে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের বিভাগীয় প্রধান করা হয়। অন্যদিকে হিলডার সাথে পাঁচ বছরের চুক্তিতে সহকারী অধ্যাপকে ভূষিত করা হয় তাকে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গিরিঞ্জার ১৮টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এমনকি তুর্কি ভাষায় একটি ক্যালকুলাসের বইও বের করে ফেলেন। শুধু গণিতেই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি, মেন্ডেলীয় বংশগতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করে জেনোটাইপ ও রক্তের গ্রুপ নিয়েও সমীকরণ তৈরি করেন।
কিন্তু এই সুসময় বেশিদিন টেকেনি। ১৯৩৮ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুর পরেই তুরস্ক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ইহুদিদের বিচ্ছেদ শুরু করে। এদিকে হিলডার সাথে চুক্তিও নবায়ন করা হয়নি। আর তার বিদায়ে ভন মিজেসও থাকতে চাননি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রে গমন। কিন্তু ১৯৩৯ সালে কোটা প্রথার কারণে সেসময় আমেরিকায় পাড়ি জমানো বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মানুষই যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়ার সুবিধা পেত। সে বছর নাৎসি বাহিনীর তাণ্ডবে কোটা বেশ আগেই পূরণ হয়ে যায়।
তবে হিলডার ভাগ্য ভালো যে, অভিবাসী ব্যবস্থাটিতে কিছু ফাঁকফোঁকর ছিলো। বিজ্ঞানী ও স্কলারদের জন্য কোটাবিহীন ভিসাও দিত আমেরিকা। প্রতি বছর এর সংখ্যা ছিলো ৯০০। কিন্তু নারীদের জন্য এই ভিসা পাওয়াও বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো। কারণ, সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নারীদের সুযোগ পাওয়াই ভার ছিলো। ভন মিজেস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে গেলেও হিলডা গিরিঞ্জারের ভিসা ঝুলে রইলো।
তাই বাধ্য হয়ে লন্ডন ও লিসবনে বলতে গেলে যাযাবরের মতোই ঘুরতে শুরু করলেন হিলডা ও মাগদা। এদিকে ভন মোজেস চাচ্ছিলেন হিলডার একটি গতি করার। বিখ্যাত পদার্থবিদ আইনস্টাইন ও ভন মিজেস মিলে চেষ্টাচরিত করতে লাগলেন। শেষপর্যন্ত হিলডা ভন মিজেসকে তাকে বিয়ে করে ভিসা এনে দেওয়ার জন্য বলেন এবং ১৯৪৩ সালে তারা বিয়ে করেন। এর ফলে ছ’ বছর পর সে বছরেই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে পারেন তিনি ও তার মেয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ফলিত গণিতের কদর আমেরিকায় থাকে তুঙ্গে। বিভিন্ন গবেষণা ও কাজে ফলিত গণিতের গুরুত্ব হয়ে দাঁড়ায় অপরিসীম। কিন্তু শুধু নারী হওয়ার কারণেই অনেক জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছিলো হিলডাকে। গণিত বিভাগে কোনো নারীর থাকাটা অনেকটা ট্যাবুই ছিলো সেসময়।
মানুষের ধারণাই ছিলো যে, মেয়েরা গণিতে ভালো হতে পারে না। বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে কলেজেই শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। কিন্তু গবেষণার জন্য কলেজে এত সুযোগ সুবিধা পেতেন না তিনি। ১৯৫৯ সালে হুইটন কলেজ থেকে অবসরে যাওয়ার আগে গণিতে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন হিলডা।
একই বছরে আমেরিকান একাডেমি অভ আর্টস এন্ড সায়েন্স-এর ফেলোশিপ গ্রহন করেন। তবে তার সবচেয়ে স্বনামধন্য কাজ ছিলো ১৯৫৩ সালে ভন মিজেসের মৃত্যুর পর তার অসমাপ্ত দু’টি গবেষনা শেষ করে তা প্রকাশ করা। এই বই দু’টি ছিলো সম্ভাব্যতা ও পরিসংখ্যান নিয়ে গবেষণা। দু’টোর একটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। আরেকটি প্রকাশ পায় ১৯৫৭ সালে।
বিজ্ঞানি কিংবা গুণী মানুষদের নিয়ে কল্পনার দৌড় আমাদের কাছে অনেকটা সাদা চামড়ার পুরুষ পর্যন্তই। কিন্তু হিলডা গিরিঞ্জার শুধু নারীই নন, নারী হয়ে জন্মানোতে পদে পদে পেয়েছেন নানা বিপত্তি। তবু থেমে থাকেননি তিনি। নিরলস শ্রম দিয়ে নিজের কাজকে ভালোবেসে গণিতকে নতুন আকার দিয়েছেন এই গুণী ব্যক্তিটি। অবসরের পরও সময় পেলেই গণিত নিয়েই পড়ে থাকতেন তিনি। অবশেষে ১৯৭৩ সালে ৮০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হিলডা। দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে নিজের নামকে স্বর্ণাক্ষরেই লিখে গেছেন ইতিহাসের পাতায়।
বিজ্ঞানের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/