সাঁওতাল নারী-পুরুষের একটি দল রোহণপুর স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলেছে। দলনেতা মাতলা সর্দার পথ দেখিয়ে নিচ্ছে। পদে পদে বিপদ। স্টেশনে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিল দলটি। হঠাৎ এক সাঁওতাল নারী কোমরের কাছে শাড়িতে গোঁজা ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন। পুলিশের চর কাছেই ছিল। গ্রেফতার করল তাকে। ঠিকই বুঝেছিল সে, দরিদ্র সাঁওতালের কাছে ঘড়ি থাকতে পারে না। ইনি আর কেউ নন, তেভাগার রানী ইলা মিত্র। সাঁওতাল শাড়ি আর স্থানীয় ভাষায় নিজেকে লুকিয়ে চললেও ছোট্ট এই ভুলে ধরা পড়েন পুলিশের হাতে।
তেভাগা কী?
ইংরেজ শাসনের আগপর্যন্ত জমির মালিক ছিল কৃষক। ফসলের তিনভাগের একভাগ খাজনা দিতে হত জমিদারকে। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদার ও কৃষকদের জীবনযাপনে পূর্বের তুলনায় বিস্তর ফারাক নিয়ে এল। জমির মালিক হল জমিদার, যে সরাসরি কর দেবে বৃটিশ রাজকে। কিন্তু জমির সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকায় মধ্যস্থতাকারীদের কাছে ইজারা দিয়ে কৃষকদের থেকে দূরে থাকলেন জমিদার। ইজারাদার যেকোনো উপায়ে অর্থ আদায় ও নিজের লাভ খুঁজতো। ১৯৪৬-৪৭ সালে আধিয়ারী ব্যবস্থায় অর্ধেক ফসল দাবি করে বসে নতুন জমির মালিকেরা। সূর্যাস্ত আইনের ফলে অনেক প্রাচীন জমিদারী শেষ হয়ে যায়। তাদের বদলে জমিদারী কিনে নেয় নব্য ব্যবসায়ীরা। শহরায়ন আর সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির কারণে অনেক জমিদার শহরমুখী হচ্ছিলেন। কৃষকদের সাথে জমিদারদের সৃষ্টি হওয়া এই দূরত্বকে কাজে লাগায় ইজারাদারেরা। কৃষকদের উপর চলতে থাকে অত্যাচার। মোটামুটি স্বচ্ছল কৃষকেরা হয়ে যান বর্গাচাষী। দরিদ্র এই কৃষকেরা কিন্তু মুখ বুজে সহ্য করে নেয়নি এসব অবিচার। তারা রুখে দাঁড়িয়েছিল এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ১৯৪৬ সালে কিছু বর্গাচাষী ধান কেটে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। আধিয়ারির নিয়ম অনুযায়ী কৃষকের রক্ত জল করা ফসল কাটার পর যাবে জমির মালিক অথবা জোতদারের বাড়িতে। সেখানে ফসল ও খড়ের সমান ভাগাভাগি হবে। কিন্তু যেহেতু জমির ফসলে বীজ থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যয় ও প্রতিদিনের পরিশ্রম কৃষকের, তাই অর্ধেক ফসলের অধিকার দাবি করা কৃষককে পথে বসানোর সামিল ছিল। তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকদের ভেতর আন্দোলনটি সংগঠিত করে তোলে কম্যুনিস্ট পার্টি। এ সময় ইলা মিত্রের স্বামী রামেন্দ্র মিত্রকে তেভাগার আদর্শ ছড়িয়ে দিতে মনোনীত করে পার্টি। তখন তিনি স্বামীর সাথে পায়ে হেঁটে কাদা-বন-জঙ্গল পেরিয়ে কৃষকদের একত্র করতে কাজ করে গিয়েছেন। যশোর, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, চব্বিশ পরগণা, খুলনাসহ মোট ১৯টি জেলায় আন্দোলন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লেও তীব্র হয়ে ওঠেনি পূর্ববাংলায়। অনেক ভূমিমালিক স্বেচ্ছায় কৃষকদের তেভাগা অধিকার দিতে রাজি হন। ১৯৪৮-৫০ সালে দ্বিতীয় দফায় তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার আর পাঁচটা আন্দোলনের মতোই তেভাগা আন্দোলনকেও ভারতের ষড়যন্ত্র বলে খেতাব দেয়। ইলা মিত্র ছিলেন এই সময়ের প্রধান পথ প্রদর্শকদের একজন।
একজন ইলা সেনের রানীমা ইলা মিত্র হয়ে ওঠার গল্প
বৃটিশ সরকারের অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল নগেন্দ্র সেনের গ্রামের বাড়ি ছিল যশোরে (বর্তমান ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রাম)। চাকরির কারণে পরিবার নিয়ে কলকাতায় থাকতেন। সেখানেই ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর জন্ম হয় তার মেয়ে ইলার। ইলা সেন লেখাপড়া করেছিলেন বেথুন স্কুল আর বেথুন কলেজে। তিনি কিন্তু ছোটবেলাতেই নিজের অসাধারণত্বের প্রমাণ রেখে চলেছিলেন। সাঁতার, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন- কীসে সেরা ছিলেন না তিনি? প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে ১৯৪০ সালের জাপান অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেবার আর অলিম্পিকের আসরই বসেনি। কিন্তু ঈশ্বর তার নিয়তি লিখেছিলেন রাজনীতিতে। হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে কলকাতা মহিলা সমিতির সক্রিয় সদস্য হিসেবে আন্দোলন শুরু করেন। ১৮ বছর বয়সে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।
১৯৪৫ সালে ইলা সেনের বিয়ে হয় রামেন্দ্র মিত্রের সাথে। জমিদার বংশের ছেলে হয়েও কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ও দেশকর্মী ছিলেন রামেন্দ্র। ইলা মিত্র থেকে রানীমা হয়ে ওঠা কিন্তু একদিনের যাত্রা ছিল না। তখনকার দিনে নারীদের জন্য অবরোধ প্রথা ছিল ভয়ানক। জমিদার বাড়ির বউ হয়ে ইলা মিত্রকে অনেকগুলো দিন অন্দরমহলেই কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু এরই মাঝে রামেন্দ্র মিত্রের বন্ধু আলতাফ মিয়ার একটি উদ্যোগ ইলা মিত্রের জীবনে পরিবর্তন নিয়ে এলো। উদ্যোগটি ছিল বালিকা বিদ্যালয় করার। মাত্র চারজন ছাত্রী আর নানারকম বাধা নিয়ে প্রথমদিকে কাজ শুরু করলেও দ্রুতই শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এভাবে গ্রামের মানুষের কাছাকাছি এসে সমাজসেবা শুরু করেন তিনি, জমিদারবাড়ির বধুমাতা থেকে অচিরেই হয়ে ওঠেন নাচোলের রানীমা। দেশভাগের পরেও দেশ ছাড়েনি রমেন্দ্র মিত্রের পরিবার। মুসলীম লীগ ক্ষমতায় আসার পর কম্যুনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় অনেক নেতাকর্মী। সবকিছুর প্রতিকূলে শোষিত কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তখনও ইলা মিত্র স্বামী রমেন্দ্র মিত্রের সাথে করে চলেছেন তেভাগার আন্দোলন।
অবশেষে তাদের আত্মগোপন করতে হয় চন্ডীগড় গ্রামে। এদিকে পাকিস্তান সরকার নিপীড়ন করে তেভাগা আন্দোলন চিরতরে বন্ধ করে দিতে চায়। জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। হত্যা করা হয় ১৫০ কৃষককে। চন্ডিগড় গ্রামে সাঁওতালদের একত্র করে তাদের ভেতর প্রতিরোধের মনোভাব গড়ে তোলেন ইলা মিত্র। পুলিশ খবর পায় এখানে লুকিয়ে আছে তেভাগার বিদ্রোহীরা। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি পুলিশ গ্রামে হানা দিয়ে তেভাগা আন্দোলনে জড়িত অভিযোগে গ্রেফতার করতে আসে দুজন কৃষককে। কিন্তু তখন সারা গ্রামেই জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন। গ্রামের কৃষকদের ভয় দেখাতে গুলি ছুঁড়লে মৃত্যু হয় এক কৃষকের। উত্তেজিত গ্রামবাসী হত্যা করে ৬ জন পুলিশকে। শুধু এটার অপেক্ষাতেই যেন এতদিন বসেছিল সরকার। পুলিশ মিলিটারী মিলে ৭ জানুয়ারি গ্রাম ঘেরাও করা হয়, শেষমুহুর্তে দলবলসহ ধরা পড়ে যান ইলা মিত্র। গ্রেফতার করার পর তার উপরে চলে পাশবিক নির্যাতন। এমনকি গণধর্ষণও বাদ যায়নি। ইলা মিত্রের জবানবন্দি বইটিতে ইলা মিত্র বলেছেন-
“প্রচণ্ড তর্জন গর্জনে শব্দ শুনে চমকে উঠলাম, চেয়ে দেখি, হরেককে দলের মধ্য থেকে মারতে মারতে বার করে নিয়ে আসছে। ওদের মুখে সেই একই প্রশ্ন, বল, ইলা মিত্র সে-ই পুলিশদের হত্যা করবার আদেশ দিয়েছিল। না বললে মেরে ফেলব, একদম মেরে ফেলব। আমি চেয়ে আছি হরেকের মুখের দিকে। অদ্ভুত ভাববিকারহীন একখানি মুখ। অর্থহীন দৃষ্টিতে শূন্যপানে তাকিয়ে আছে। ওদের এতসব কথা যেন ওর কানেই যাচ্ছে না। ক্ষেপে উঠল ওরা। কয়েকজন মিলে ওকে মাটিতে পেড়ে ফেলল। তারপর বুট দিয়ে বুকে পেটে সজোরে লাথি মেরে চলল… আমাদের ছেড়ে চলে গেছে হরেক। আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। একটু আগেই আমি কেঁদেছিলাম। কিন্তু এখন আমার সমস্ত কান্না শুকিয়ে গেছে। তার পরিবর্তে ভিতর থেকে প্রচন্ড একটা জেদ মাথা তুলে জেগে উঠেছে। আমার মন বলছে, মারুক, মারুক, ওরা আমাকেও এমনি করে মারুক। আর মনে হচ্ছে, এই যে আমাদের কয়েকশো সাথী এদের কাউকে দিয়ে ওরা কথা বলাতে পারবে না, কিছুতেই না। ওদের হার হয়েছে। ওদের হার মানতে হবে।”
মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় তার জন্য। রাজশাহী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচার চলাকালে নিজের উপর চলা অত্যাচারের বর্ণনা দেন তিনি। কিন্তু বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় তার। অন্যদিকে মাওলানা ভাসানীসহ সাধারণ ছাত্রজনতা তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। অবশেষে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দিতে রাজি হয় পাকিস্তান সরকার। ঢাকা থেকে চলে যান কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কংগ্রেস প্রথমে তাকে ভারতের নাগরিকত্ব দিতে রাজি না হলেও রমেন্দ্র মিত্রের স্ত্রী হিসেবে নাগরিকত্ব প্রদান করে। পশ্চিমবঙ্গে গিয়েও নিজেকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখতে পারেননি ইলা মিত্র। ১৯৬৭-৭৮ সাল পর্যন্ত পর পর চারবার পশ্চিমবঙ্গের লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন । ১৯৭১ সালে রমেন্দ্র ও ইলা মিত্র বাংলাদেশের হয়ে কাজ করেছেন। আজীবন হার না মানা এই রানীমা ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর কলকাতায় পরলোকগমন করেন। আমৃত্যু নিজেকে বাংলাদেশীই ভেবে এসেছেন তিনি।
অত্যাচার নির্যাতনকে উপেক্ষা করে জমিদারের গৃহবধূ সাদামাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। শত শত বিঘা জমি দান করে গেছেন কৃষকদের নামে। তার বাস্তুভিটা আজ ভূমিদস্যুদের দখলে হলেও বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কৃষক আন্দোলন, তেভাগার রানীমা হয়ে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
ফিচার ইমেজ © Ayub Al Amin