তারা ক্যাথরিন জনসনকে বলেছিল, চাঁদটাকে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে এনে দিতে। আর তিনি তা-ই দিয়েছিলেন! একটা পেন্সিল, একটা স্লাইড রুল আর নিজের ক্ষুরধার গাণিতিক মগজকে কাজে লাগিয়ে তিনি নিখুঁতভাবে হিসাব করেছিলেন অ্যাপোলো-১১ এর কক্ষপথকে। হ্যাঁ, সেই অ্যাপোলো-১১, যাতে চড়ে চাঁদের বুকে পা রেখেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং আর নিরাপদে বাড়িও ফিরে এসেছিলেন।
পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় ১৯১৮ সালের ২৬শে আগস্ট জন্ম নেন ক্যাথরিন কোলম্যান। তবে বিশ্বব্যাপী তিনি ক্যাথরিন জনসন নামেই পরিচিত। আমেরিকান এই গণিতবিদ তিন দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস প্রোগ্রামে কাজ করেছেন। হিসাব করে বের করেছেন হাজারও স্পেসক্র্যাফটের গমনপথ। সবচেয়ে বড় কথা, তার নিখুঁত হিসাবের ওপর ভিত্তি করেই নভোচারীরা চাঁদের মাটিতে পা রাখতে পেরেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই তার তুখোড় বুদ্ধিমত্তা আলো ছড়াতে শুরু করে। সরাসরি সেকেন্ড গ্রেডে ভর্তি হন তিনি। দশ বছর বয়সে যোগ দেন হাই স্কুলে। স্কুলে গণিত সম্পর্কিত যত ধরনের ক্লাস করা সম্ভব, সবগুলোতে যোগ দিতেন তিনি। তার একজন মেন্টর, বিখ্যাত গণিতবিদ ডক্টর উইলিয়াম শিফিন ক্লেটন তার জন্য ‘জিওমেট্রি ইন স্পেস’ নামের বিশেষ এক কোর্স ডিজাইন করেছিলেন।
আঠারো বছর নাগাদ গণিত এবং ফ্রেঞ্চ ভাষায় যৌথভাবে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন পশ্চিম ভার্জিনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে। এরপর ১৯৩৯ সালে পশ্চিম ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে যোগ দেন তিনি, সেখানে যোগ দেয়া প্রথম তিন আফ্রিকান-আমেরিকান নারীর একজন ছিলেন তিনি। সেবছরেই জেমস গোবলকে বিয়ে করেন তিনি। প্রথম সেমিস্টার যেতে না যেতেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া ক্যাথরিন সেই গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ছেড়ে সংসারে মন দেবার সিদ্ধান্ত নেন। এরকম সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে তার ক্যারিয়ার প্রায় থেমেই গিয়েছিল সেই পর্যায়ে। জেমস ১৯৫৬ সালে মারা যাবার সময়ে তিন কন্যাসন্তান রেখে যান।
দুর্ভাগা সেই সময়ে চাপের মুখে পড়ে তার সফল হবার নেশা কিছুটা প্রাণ পায় যেন। সেই বছরেই তিনি ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ফর অ্যারোনটিক্সে (এনএসিএ) কাজ করা শুরু করেন। সেসময়ে তারা চন্দ্রাভিযানের জন্য কোনো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটারের সাহায্য ছাড়াই জটিল সব হিসাব-নিকাশ করতে বাধ্য হচ্ছিল। সেজন্য তারা নিম্ন আয়ে কিছু নারীকে এই হিসাবের কাজে চাকরি দেয়। প্রথম দফায় সুযোগ না পেলেও দ্বিতীয় দফায় সেখানে সুযোগ পান ক্যাথরিন। ১৯৫৯ সালে বিয়ে করেন ভেটেরান আর্মি অফিসার জিম জনসনক। ২০১৯ সালে জিমের মৃত্যুর আগপর্যন্ত একসাথে ছিলেন তারা।
সেখানকার ওয়েস্ট এরিয়া কম্পিউটিং ইউনিটে আরো কয়েকজন আফ্রিকান-আমেরিকান নারীদের সাথে কাজ করতেন তিনি। তাদের কাজ ছিল সেখানকার ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য জটিল সব গাণিতিক সমীকরণগুলো হাতে-কলমে সমাধান করা।
শুধু নারী হবার কারণে নয়, ক্যারিয়ার গড়ে তোলার পথে প্রধান অন্তরায় ছিল তার গায়ের রঙ। সেসময়ে এনএসিতে বর্ণবাদ প্রথা চালু ছিল। তাদেরকে আলাদা বাথরুম এবং ডাইনিং রুম ব্যবহার করতে হত। তবে অবস্থার উন্নতি হয় খুব শীঘ্রই। ১৯৫৮ সালে এনএসিএ যুক্ত হয় সদ্য স্থাপিত ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ওরফে নাসার সাথে, যেখানে বর্ণবাদ নিষিদ্ধ ছিল।
নাসাতে ক্যাথরিন ছিলেন স্পেস টাস্ক গ্রুপের সদস্য। ১৯৬০ সালে তিনি গ্রুপের একজন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে একটি পেপার লেখেন। তার বিষয়বস্তু ছিল একটি নভোযানকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে স্থাপন করা নিয়ে। ঐ বিভাগের প্রথম নারী হিসেবে কোনো রিসার্চ পেপার লেখার কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। সারাজীবনে সর্বমোট ২৬টি পেপার লিখেছেন তিনি।
১৯৬১-৬৩ সাল পর্যন্ত মনুষ্যচালিত নভোযান মহাকাশযান সম্পর্কিত নাসার মার্কারি প্রোগ্রামেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। ১৯৬১ সালে তিনি ফ্রিডম-সেভেন নভোযানের পথ হিসাব করেন, তাতে করেই যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশে প্রথম মানুষ পাঠাতে সমর্থ হয়। সেই ভাগ্যবান মানুষটি ছিলেন অ্যালান বি শেপার্ড জুনিয়র। পরের বছর আরেক নভোচারী জন গ্লেন একটা অনুরোধ নিয়ে আসেন ক্যাথরিনের কাছে। তিনি তাকে বলেন, ইলেকট্রনিক কম্পিউটার তার নভোযান ফ্রেন্ডশিপ-সেভেনের যে গমনপথ হিসাব করেছে, তা ঠিক আছে কি না দেখে দিতে। ভাবুন একবার, কম্পিউটারের ভুল হলেও হতে পারে কিন্তু ক্যাথরিনের ভুল হবে না, এমনটাই ধারণা ছিল সবার। পরবর্তীতে জন সেই নভোযানে চড়েই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা প্রথম নভোচারী হিসেবে ইতিহাস গড়েন।
সেসময়ে সোভিয়েতরা আকাশজয়ের পথে কিছুটা এগিয়ে ছিল। ষাটের দশকের শুরুর দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি চাঁদে শাটল পাঠানোর মিশন শুরু করার নির্দেশ দেন নাসাকে। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিযানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ক্যাথরিন। চাঁদের ঘূর্ণনের সাথে নভোযানের ঘূর্ণনের তাল মেলানোর জন্য নাসার ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের সাথে কাজ করা শুরু করেন তিনি। ঠিক কোন সময়ে স্পেস শাটলটি নিক্ষেপ করলে তা সম্ভব করে, তার সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ হিসাবগুলো নির্ভুলভাবে করে ফেলেন। ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো-১১ সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করে এবং পৃথিবীতেও নিরাপদভাবে ফিরে আসতে সমর্থ হয়। মানবজাতির নভো-অভিযানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটির পেছনে নীরব ডায়নামাইট হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন ক্যাথরিন।
‘রকেট সায়েন্স’ প্রবাদটা সাধারণত খুব কঠিন কোনো বিষয়ের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে ক্যাথরিন কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই রকেট সায়েন্স নিয়ে একটা টেক্সটবই লিখেছিলেন। ল্যাংলি রিসার্চ সেন্টারে অবস্থিত নাসার ফ্লাইট ডাইনামিক ব্রাঞ্চে কাজ করার সময়ে যৌথভাবে বইটি লিখেছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে নাসার মঙ্গল অভিযানের মিশনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৮৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
নাসার ফ্লাইট রিসার্চ ডিভিশনে দীর্ঘ ৩৩ বছর কাজ করার পরেও ইতিহাস তাকে কিছুটা অবহেলার দৃষ্টিতেই দেখেছে। নাসার এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে যুগান্তকারী অবদান রাখার পরেও তার নাম সেজন্য অনেকেরই অজানা। আধুনিকযুগে নারীদের সমঅধিকার আন্দোলনের বহু আগেই তিনি নাসায় গণিতবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। শুধু তিনি নয়, সেসময় তার সাথে কাজ করা অন্যান্য নারীরাও কঠোর অধ্যবসায় দিয়ে কাজ করার পরে এবং সর্বোচ্চ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের প্রাপ্য মূল্যায়নটুকু পাননি।
জীবনের সায়াহ্নে এসে অবশ্য কিছুটা হলেও স্বীকৃতি পান ক্যাথরিন। যে দক্ষিণ ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পড়তে ঝরে পড়েছিলেন, ৭৫ বছর পরে সেখান থেকেই সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। স্টেম (সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাথমেটিকস) ফিল্ডে অগ্রদূত হিসেবে ভূমিকা রাখার জন্য ২০১৫ সালে তাকে প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম দেয়া হয়। যেকোনো মার্কিন নাগরিকের জন্য এটা সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন,
জীবনভর আকাশের তারাগুলোকে জয় করার উদ্দেশ্যে কাজ করে যাওয়া ক্যাথরিন অবশেষে নিজেকেও তাদের ভিড়ে শামিল করে নিলেন। বহু বছর ধরে অসাধ্য সব বাধা পাড়ি দিয়েছেন তিনি পর্দার পেছন থেকে। তবে এখন তিনি আমার এবং মিশেলের মতো লাখো মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস।
২০১৬ সালে নাসা তার নামানুসারে একটি বিল্ডিং এর নামকরণ করে ‘ক্যাথরিন জি জনসন কম্পিউটেশনাল ফ্যাসিলিটি’। ক্যাথরিন এবং তার দুই নারী আফ্রিকান-আমেরিকান সহকর্মী ডরোথি ভন এবং ম্যারি জ্যাকসনের একসাথে নাসায় কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে মারগট লি লেখেন ‘হিডেন ফিগার্স: দ্য আমেরিকান ড্রিম অ্যান্ড দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ দ্য ব্ল্যাক ওমেন হু হেল্পড উইন দ্য স্পেস রেস’ বইটি। ২০১৬ সালে এর ওপর ভিত্তি করে ‘হিডেন ফিগার্স‘ নামে হলিউডে একটি মুভি নির্মিত হয় যা অস্কারসহ বিভিন্ন জায়গায় সাড়া ফেলে দেয়। তারাজি পি হেনসন অভিনয় করেন ক্যাথরিনের ভূমিকায়। মুভিটি মুক্তির সময়ে তিন নারীর মধ্যে একমাত্র ক্যাথরিনই বেঁচে ছিলেন। সেবছর ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা তাকে উপাধি দেয়, ‘মোস্ট হাই প্রোফাইল কম্পিউটার’।
২০২০ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১০১ বছর বয়সে নিউপোর্ট নিউজের এক বয়স্ককেন্দ্রে তার মৃত্যু হয়। গণিত কিংবা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অবদান নারীদের জন্য অসামান্য এক অনুপ্রেরণা। বিজ্ঞান কিংবা গণিতের ক্ষেত্রে নারীদেরকে খাটো করে যে স্টেরিওটাইপ প্রচলিত, তাকে শক্তিশালী এক চপেটাঘাত দিয়েছেন তিনি নিজের মগজের জোরে। বর্ণবাদ আর লিঙ্গবৈষম্যকে পিছে ফেলে নিজের অদম্য প্রচেষ্টা দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই আকাশ জয় করে নিয়েছেন।