Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাওসার আহমেদ চৌধুরী: গীতিকার থেকে জ্যোতির্বিদ হয়ে ওঠার গল্প

শুধুমাত্র একটি বিশেষণে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা অনেকটাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে এই ব্যক্তিকে। বর্তমানে তিনি বহুল পরিচিত একজন হস্তরেখাবিশারদ বা জ্যোতির্বিদ হিসেবে। মানুষের ভাগ্য গণণাই তার এখন নেশা এবং পেশা। একটি দৈনিক পত্রিকায় সাপ্তাহিক হিসেবে তার রসালো লেখনিতে রাশি গণনা আর ভাগ্য বর্ণনা আমরা পরম আগ্রহ সহকারে পড়ে থাকি। কিন্তু লোকটির নামটির সাথে মিশে রয়েছে আরো অনেক গুণাবলী, খ্যাতি আর অনবদ্য জীবনের গল্প। বলছিলাম কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কথা; যিনি একাধারে কবি, লেখক, গীতিকার, চিত্রশিল্পী এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী; Image Source: mixcloud.com

কাওসার আহমেদ চৌধুরী ১৯৪৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের সবচাইতে আদুরে ছেলে ছিলেন তিনি। কোনো কিছু করতে কখনো কারো কাছে বাধার সম্মুখীন হননি। তাই ছোটবেলা থেকে কেমন যেন খামখেয়ালিপ আর বাউন্ডুলে স্বভাব পেয়ে বসেছিল তাকে। সংসারে থেকেও তিনি যেন বৈরাগ্য বেছে নিয়েছিলেন। 

জীবনে কখনো কোনোকিছু পরিকল্পিতভাবে করেননি। যখন যা মনে হয়েছে তা শিখেছেন, করেছেন। বয়স যখন ১১ বছর, তখন থেকেই কবিতা আর জ্যোতিশাস্ত্রের প্রতি অনুরাগের শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তির পর স্বপ্ন দেখেন চিত্রশিল্পী হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন বেশিদিন স্থির হয়নি। এরপর চিত্রনির্মাতা হওয়ার ঝোঁক পেয়ে বসল।

ঋত্বিক ঘটক; Image Source: dnaindia.com

সেই সূত্রেই পরিচয় হয় ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকর ঋত্বিক ঘটকের সাথে। পরবর্তীতে বন্ধুত্বে পরিণত হয় তাদের এই সম্পর্ক। ঋত্বিক ঘটকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে একটি চরিত্রে অভিনয় করার জন্য প্রস্তাব করেন কাওসার আহমেদকে। কিন্তু সময় এবং ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে আর কাজ করা হয়ে ওঠেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভেবেছিলেন দেশে এসে চলচ্চিত্রের কাজ করবেন। কিন্তু তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং অর্থের সংকটে সেই স্বপ্ন আর বাস্তবে রূপ নেয়নি।

চলচ্চিত্রে যুক্ত হতে না পারলেও সাহিত্যাঙ্গন থেকে কখনোই দূরে ছিলেন না তিনি। ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন। তার কবিতা পড়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কলকাতার জনপ্রিয় দেশ পত্রিকায় তার কবিতা প্রকাশিত হয়। 

তবে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে মূলত গীতিকার হিসেবে। অসাধারণ কিছু গানের স্রষ্টা তিনি। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া ‘যেখানেই সীমান্ত তোমার সেখানেই বসন্ত আমার’, নিয়াজ মোহাম্মদের ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়ল তোমায়’, লাকী আখন্দের ‘আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না’, সামিনা চৌধুরীর কণ্ঠে ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে’, ফিডব্যাকের ‘মৌসুমি-১’, ‘মৌসুমি-২’ আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া ‘এই রুপালি গিটার ফেলে’ এবং এই প্রজন্মের শিল্পী নাফিস কামালের গাওয়া ‘এই শহরে এক নগর ছিল’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

গান লেখার শুরুটা অনেকটা আকস্মিকভাবেই। চারুকলায় পড়ার সময় আজিমপুরের একটি কলোনিতে বোনের বাসায় থাকতেন। তখন সেই কলোনিতে বাস করতেন আরেকজন খ্যাতনামা শিল্পী খন্দকার ফারুক আহমেদ। বিভিন্ন চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গানে তিনি গন্ঠ দিয়েছেন। নীল আকাশের নিচে আমি, আমি নিজের মনে নিজে যেন, বাসন্তী রং শাড়ী পড়ে, আমার এই গান তুমি শুনবে, আমি কার জন্যে ছাড়াও আরো অসংখ্য গান বেশ জনপ্রিয় হয় তখন। তিনি বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত শিল্পীও ছিলেন।

খন্দকার ফারুক আহমেদ; Image Source: youtube.com

ফারুক আহমেদের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল কাওসার আহমেদের। এদিকে বড় বোনের গান লেখার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। বড় বোনকে দেখে কাওসার আহমেদেরও গান লিখতে ইচ্ছে হলো। কবিতার চর্চা তো আগে থেকেই আছে। কিন্তু গান লেখার কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। ফারুক আহমেদ তাকে গান লেখায় বিশেষভাবে সহায়তা করেন।

তার এই ঘটনাবহুল জীবনে অনেক বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্ষ তিনি পেয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন অসাধারণ সংগীত প্রতিভা, প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম। সিলেটের স্কুলে পড়ার সময় সুজেয় শ্যামের সাথে পরিচয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পরিচয় হয় আরেক বিখ্যাত সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খানের সঙ্গে। এই শেখ সাদী খানের বাসাতেই আবার দেখা হয় সুজেয় শ্যামের সঙ্গে। সেই থেকে অনেকদিন একসাথে গানবাজনা করেন। কাওসার আহমেদ লিখতেন, সুজেয় শ্যাম সুর করতেন আর তাদের আরেক বন্ধু মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন সেই সুরে কন্ঠ দিতেন। জমে উঠত গান নিয়ে আড্ডা, আলোচনা আর বিতর্ক। সেই আড্ডা-গানে যোগ দিতেন শিল্পী আসাদুজ্জামান নূর, কবি নির্মলেন্দু গুণসহ খ্যাতনামা আরো অনেকেই। গান লেখার পাশাপাশি চলতে থাকে ছবি আঁকাও। নির্মলেন্দু গুণের অনুরোধে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ এর প্রচ্ছদের নকশা করেন কাওসার আহমেদ। এরপরে আরো অনেকগুলো বইয়ের প্রচ্ছদে কাজ করেন তিনি।

অসুস্থ কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে দেখতে হাসপাতালে যান নির্মলেন্দু গুণ; Image Source: thedailystar.net

ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল কাওসার আহমেদের। দেশভাগের সময় বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে হয়েছিল বলে সেই ক্ষোভ আর দুঃখ কখনো ভুলতে পারেননি ঋত্বিক ঘটক। তাই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ছিল তার অন্যরকম টান। বাংলাদেশে এলেই কাওসার আহমেদের সাথে ঘুরে বেড়াতেন এ প্রান্ত থেকে ও’প্রান্ত। কত গল্প আর আড্ডা! অসাধারণ প্রতিভাধর, সৃজনশীল এবং জ্ঞানী মানুষটির কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছেন, শিখেছেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তার কাছ থেকেই মূলত চিত্রনাট্য লেখার প্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি। একবার নিজের গাড়িতে করে প্রায় সাড়ে ৪০০ মাইল পেরিয়ে কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে আসেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তার একমাত্র কবিতার বই ‘ঘুম কিনে খাই’-তে একটি কবিতা ‘ঋত্বিকের সঙ্গে কলকাতা যাত্রা ১৯৭২’ এ সেই ভ্রমণের কথা উল্লেখ আছে। ঋত্বিক ঘটকের হাত ধরেই বাংলাদেশের আরেক দিকপাল আলোকচিত্রী ও চলচ্চিত্র পরিচালক বেবী ইসলামের সাথে পরিচয় কাওসার আহমেদের।

কাওসার আহমেদের সাথে নির্মলেন্দু গুণ, সমর দাস এবং লাকী আখন্দ; Image Source: dhakatribune.com

এরপর চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন তিনি। ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএর অর্থায়নে চলচ্চিত্রের ওপর প্রশিক্ষণের জন্যে বিদেশ যান। ফিলিপাইনে গিয়ে ভিডিও ফিল্ম কীভাবে তৈরি করতে হয় শিখেছেন। বিশ্ববিখ্যাত প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা পিটার কিংয়ের সংস্পর্ষে এসে চলচ্চিত্র তৈরির বিভিন্ন কৌশল শিখেছেন। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় ছুটেছেন চলচ্চিত্র তৈরির উপর নিজের জ্ঞান বাড়ানোর জন্যে। শিখেছেন নিজের আনন্দে; এর থেকে অর্থ আয় করবেন তেমন অভিপ্রায় কখনো ছিল না তার।

তখন সরকারি কিছু প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। পরিবার পরিকল্পনার ওপর বাংলা ও ইংরেজিতে বিভিন্ন তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন বিজ্ঞাপন নির্মাণেও কাজ করেন তিনি। বিটিভিতে একসময়ের প্রচারিত জনপ্রিয় হাসির নাটক ‘ত্রিরত্ন’র চিত্রনাট্য লেখেন তিনি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার জ্যোতিষীর পরিচয়টাই সবার কাছে প্রধান হয়ে ওঠে।

পাকিস্তান আমলে সিলেট বেতারে তার লেখা প্রথম গান প্রচারিত হয়। এর আগেও অনেক গান লিখেছেন যেগুলো বয়স কম ছিল বলে অন্যদের নামে প্রচারিত হতো। পরবর্তীতে তিনি টিভিতে তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু তার গান লেখার প্রতি আগ্রহ এবং ভালবাসা অনেকগুণে বেড়ে গেল যখন লাকী আখন্দের সাথে পরিচয় হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের দিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে লাকী আখন্দের সাথে পরিচয়। প্রথম পরিচয়েই লাকী আখন্দ কিছু গান চেয়ে বসলেন কাওসার আহমেদের কাছে। সেই গানগুলোর অসাধারণ সুর করলেন লাকী আখন্দ। একটি ছিল ফেরদৌস ওয়াহিদের গাওয়া ‘পলাতক সময়ের হাত ধরে’, আরেকটি সামিনা চৌধুরীর গাওয়া ‘বলো না তুমি কোথায়?’।

লাকী আখন্দ; Image Source: beherenow.com.bd

এরপর থেকে দুজনের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। লাকী আখন্দকে ছাড়া আর কারো কাছে গান দিতেন  না তিনি। পরবর্তীতে কাওসার আহমেদের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র এসবের প্রতি ঝুঁকে পড়া মোটেও পছন্দ ছিল না লাকী আখন্দের। তার একটাই কথা, কাওসার আহমেদের জন্ম গান লেখার জন্যে। লাকী আখন্দের মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাদের বন্ধুত্ব ও ভালবাসা ছিল অটুট।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও কাওসার আহমেদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। অস্ত্র হাতে তুলে না নিলেও মুজিবনগর সরকারের অধীনে তিনি গোয়েন্দা হিসেবে তথ্য সংগ্রহের কাজ করতেন। বিভিন্ন ছলচাতুরীতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ডেরার খবর নিয়ে আসতেন। ভাল ছবি আঁকতে পারতেন বলে সেসব জায়গার নকশা এঁকে বিভিন্ন অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন।

সব মিলিয়ে অসম্ভব ঘটনাবহুল এক জীবন কাওসার আহমেদ চৌধুরীর। কখনো এক নিয়মে আঁটকে ছিলেন না তিনি। জীবনের বিভিন্ন বাঁকে বিভিন্ন জ্ঞানের ছোঁয়া পেয়েছেন, যা তাকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বর্তমানে শুধুমাত্র জ্যোতিষচর্চা নিয়েই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। তার অসাধারণ কৌতুকপূর্ণ লেখনি ও অমায়িক ভাবভঙ্গী সাধারণ মানুষের মাঝে জ্যোতিষশাস্ত্রকে দিয়েছে অন্য মাত্রা। তবে জ্যোতিষশাস্ত্রের পাশাপাশি তার ক্ষুরধার লেখনিও যেন থেমে না থাকে এই আমাদের প্রত্যাশা।

This article is a Bengali article. This story is about the lyricist and astrologer Kawser Ahmed Chowdhury.

 All the sources are hyperlinked into the article.

 Featured Image: .kalerkantho.com

Related Articles