Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মনোহর আইচ: একজন বাঙালী হারকিউলিসের গল্প

মনোহর আইচ জন্ম নিয়েছিলেন ১৯১২ সালের ১৭ মার্চ, বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার ধামতি গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই সাধারণ বাঙাল কিশোরের মতো তার আগ্রহ ছিল খেলাধুলায়, বিশেষত কুস্তিজাতীয় খেলায়। বারো বছর বয়সে আক্রান্ত হন কালাজ্বরে। রোগটি তাকে প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে, কিন্তু তিনি ফিরে আসেন।

ভগ্ন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে শুরু করলেন দেশীয় স্টাইলে শরীর চর্চা। পড়ালেখা করতেন ঢাকার জুবিলি স্কুলে। একবার সে স্কুলে জাদু দেখাতে আসেন বিখ্যাত জাদুশিল্পী পি সি সরকার। মনোহর আইচের শরীর চর্চা ও শরীর নির্ভর ক্রিয়াদি দেখে তার ভালো লাগে। তিনি তার দলে নিয়ে নেন তাকে।

মনোহর তখন পি সি সরকারের সাথে বিভিন্ন প্রোগ্রামে তার ক্রীড়াকৌশল দেখাতে শুরু করেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল:

  • দাঁত দিয়ে ইস্পাত বাঁকানো,
  • গলার সাহায্যে বল্লম আনমিত করা,
  • তরবারির উপর পেট রেখে শুয়ে থাকা,
  • দেড় হাজার পাতার বই নিমিষে ছিঁড়ে ফেলা ইত্যাদি জটিল সব খেলা।

একসময় ভারতের ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তখন ভারতে ব্রিটিশ শাসন চলছে। এয়ার ফোর্সের একজন অফিসার ছিলেন রিউব মার্টিন। মনোহরের শরীরচর্চা প্রীতি দেখে তিনি তাকে উৎসাহ দেন এবং আধুনিক অনেক শরীরচর্চা পদ্ধতির সাথে তাকে পরিচিত করান। মনোহর সেই সময়ে শরীরচর্চা তথা ওয়েট ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে নিজের দেহকে এমনভাবে নির্মাণ করেন যে রয়াল ফোর্সের অন্য সবার প্রশংসার পাত্র হয়ে উঠেন।

মনোহর আইচ; Source: ibbfindia.com

কিন্তু একদিন এক অফিসারের সাথে তার তর্ক শুরু হয়। তর্কের বিষয় ছিল ব্রিটিশ শাসকদের ভারতে প্রজাদের উপর নির্যাতন-শোষণ নিয়ে। সেই অফিসার ভারত সম্পর্কে তাচ্ছিল্যপূর্ণ এক মন্তব্য করে বসেন। মনোহর তার রাগ সামলে রাখতে পারেন নি। কষে এক চড় বসিয়ে দেন তাকে। এই কাজের জন্য মনোহরকে জেলে ঢোকানো হয়। জেলে যাওয়ার পরেই তিনি বডি বিল্ডিং নিয়ে ভালো করে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেন। তার মনে হতে থাকে তিনি চাইলে বিশ্ব বডি বিল্ডিং প্রতিযোগীতায় যেতে পারেন। এর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন তিনি। তখন এমন সময়ও গিয়েছে যে, দিনে তিনি বারো ঘন্টা ব্যায়াম করে গেছেন।

তার কথায়, “জেলে আমি একা একা, কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি ছাড়াই ব্যায়াম করে যেতাম, কখনো কখনো দিনে ১২ ঘন্টা করে।” তার এমন শরীরচর্চা প্রীতি দেখে জেল কর্তৃপক্ষ অভিভূত হয়ে গেল। তারা তার জন্য একটু বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করল। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর মনোহর আইচ জেল থেকে ছাড়া পান অন্য সবার সাথে।

কিন্তু বডি বিল্ডিং চালিয়ে নেয়া তার জন্য সহজ ছিল না। স্ত্রী এবং চার সন্তান ছিল, তাছাড়া তারা ছিলেন দরিদ্র। সন্তানদের পড়ানো সহ জীবনযাত্রার নানা খরচ। সুতরাং মনোহর বিভিন্ন ছোটখাট কাজ করে নিজের বডি বিল্ডিংয়ের জন্য অর্থ জোগাড় করতেন। একসময় তার বুকের ছাতি হয় ৫৪ ইঞ্চি আর কোমর ২৩ ইঞ্চি, অর্থাৎ পারফেক্ট একটি ভি আকৃতি বলতে যা বোঝায়।

মনোহর আইচ

মনোহর আইচ; Source: outlookindia.com

তার এই পরিশ্রম ও চেষ্টা বৃথা যায় নি। ১৯৫০ সালে তিনি মিস্টার হারকিউলিস খেতাব জেতেন। ১৯৫২ সালে জেতেন মিস্টার ইউনিভার্স খেতাব। এরপর আসে আরো অনেক খেতাব, এর মধ্যে আছে এশিয়ার সেরা বডিবিল্ডারের খেতাবও। তার উচ্চতা ছিল মাত্র ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি। এজন্য তাকে ডাকা হতো পকেট হারকিউলিস নামে।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম এই মিস্টার ইউনিভার্স খেতাবধারী, আমাদের মতোই একজন বাঙালি, জীবনাচরণে ছিলেন বেশ সাদামাটা। এখনকার যারা জিম করেন তাদের ডায়েটের কত নিয়ম আছে, ভাত খাওয়া যাবে না, কমপ্লেক্স কার্ব খেতে হবে ইত্যাদি। মনোহর আইচ কিন্তু ভাতই খেতেন। ‘পান্তা ভাতের জল, তিন পুরুষের বল‘- এ কথা তিনি বলতেন। তিনি এটাও জানিয়েছেন যে, একসময় দিনে চারবেলা পান্তা খেতেন।

বিভিন্ন বয়েসে পকেট হারকিউলিস; Source: ibbfindia.com

ইন্ডিয়া টুডের সাথে কথাবার্তায় তার খাবারের কথা বলছিলেন। যখন তার বয়স শত বছর পেরিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে খেতেন দুধ দিয়ে চিঁড়া, এরপর খেতেন এক কাপ কফি। দুপুরে ভাত, ডাল এবং সবজি বা মাছ। বিকেলে থাকতো কফি। রাতের বেলায় আবার ভাত। কখনো ফলের রস খেতেন দিনে। তিনি বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী ফলের ও মিঠা পানির মাছের ভক্ত ছিলেন। সপ্তাহে তিন দিন মাংসও থাকত খাবারের তালিকায়।

সবচেয়ে দারুণ ছিল তার জীবন দর্শন। তিনি বলতেন, “আমি কখনো দুশ্চিন্তাকে প্রশ্রয় দেই না। ছোটবেলা থেকে টাকা রোজগার নিয়ে আমার সমস্যা ছিল। কিন্তু অবস্থা যা-ই হোক না কেন, আমি চিন্তিত হই না, খুশি থাকি।

নিজের তৈরী ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম শেখাতেন। ভারতের আটবারের চ্যাম্পিয়ন বডি বিল্ডার সত্য পাল তারই শিষ্য। এছাড়া আরেক শিষ্য প্রেমচাঁদ দোগরা ১৯৮৮ সালে জিতেছিলেন মিস্টার ইউনিভার্স খেতাব।

মনোহর আইচ

মনোহর আইচ; Source: outlookindia.com

বডি বিল্ডিংয়ে শরীর ও মনের সংযোগ খুবই জরুরী। কারণ আমাদের শরীর একটি নিউরোমাসকুলার সিস্টেম এবং মাসল গ্রোথের মস্তিষ্কের সিগনালও জরুরী। শরীর ও মনের সংযোগভিত্তিক বডি বিল্ডিংয়ের একজন বিখ্যাত প্রচারক ছিলেন ব্রুস লী। তার মতোই মনোহর আইচ মনে করতেন, দেহের উন্নতির জন্য মনের সাথে তার সংযোগ জরুরী। এজন্য মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। শুধুমাত্র শারীরিক কসরতের উপরই বডি বিল্ডিং নির্ভর করে না।

বডি বিল্ডিংয়ের এই কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব মারা যান ২০১৬ সালের ৫ জুন। তখন তার বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর। শতায়ু হলেও তিনি ছিলেন শক্ত সমর্থ। শেষদিকে বার্ধক্যজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি।

শতায়ু মনোহর আইচ; Source: thehindu.com

মনোহর আইচের জীবনে দেখা যায়, দারিদ্রতার জন্য তিনি অনেক প্রতিকূল অবস্থায় পড়েছেন, কিন্তু হতোদ্যম হননি। সবসময় হাসিখুশি থেকেছেন এবং নিজের কাজ করে গেছেন। একসময় তিনি এটাও বলেছেন যে, মিস্টার ইউনিভার্স খেতাব জিতবেন কি না তা ভাবেন নি, কেবল নিজের ব্যায়ামটা ঠিকমত করে গেছেন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, নিজের ভবিষ্যত জীবনের ভালোর জন্য অন্যের গোলামী করার মানসিকতা তার ছিল না। তাই সেই ব্রিটিশ অফিসারের মন্তব্যের প্রতিবাদ তিনি করতে পেরেছিলেন। বর্তমান সময়ে এই জিনিসটা আমাদের মধ্যে দেখা যায় না। দেখা যায়, ভবিষ্যতে নিজের ক্ষতি হতে পারে এই ভেবে কোনো অন্যায় দেখে তারা কথা বলে না, চুপ থাকে। নিজের আখের গোছাতে চায়।

মনোহর আইচের জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তিনি আমাদের সাধারণ খাবারের উপরই নির্ভর করতেন তার বডি বিল্ডিংয়ের জন্য। সুতরাং নতুন যারা ফিটনেস সচেতন ও বডি বিল্ডিং করেন, তারা বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন পাউডার, ম্যাস গেইনার, ক্রিয়েটিন ও স্টেরয়েড ইত্যাদির পিছনে না ছুটেও নিজেদের বডি বিল্ডিং চালিয়ে যাবার সাহস পেতে পারেন পকেট হারকিউলিসকে দেখে।

ফিচার ইমেজ: outlookindia.com

Related Articles