ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র পাকিস্তান কখনোই রাজনৈতিকভাবে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার উত্তরসূরী রুশ ফেডারেশনের নিকটবর্তী ছিল না। এর ফলে পাকিস্তান ও রাশিয়ার মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের মাত্রা কখনোই খুব বেশি ছিল না। ১৯৭২ সালে সমগ্র পাকিস্তানে মাত্র ৫৬ জন সোভিয়েত নাগরিক অবস্থান করছিল। কিন্তু রুশ–পাকিস্তানি সম্পর্কের এই নেতিবাচক পরিস্থিতি সত্ত্বেও একজন প্রাক্তন রুশ/সোভিয়েত নাগরিক পাকিস্তানের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বস্তুত, পাকিস্তানের জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ ‘মিনার–এ–পাকিস্তান’ ও বিখ্যাত ক্রিকেট খেলার মাঠ ‘গাদ্দাফি স্টেডিয়াম’ নির্মাণ থেকে আরম্ভ করে স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম অস্ত্র কারখানা ‘ওয়াহ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি’র বিস্তৃতি– সবই একজন প্রাক্তন রুশ নাগরিকের মস্তিষ্কপ্রসূত।
নাসরেদ্দিন মুরাত খান (রুশ: Насреддин Муратханов, ‘নাসরেদ্দিন মুরাতখানভ’; উর্দু: نصر الدین مرات خان, ‘নাসর আল–দিন মুরাত খান’) ছিলেন জন্মসূত্রে রুশ/সোভিয়েত এবং কর্মসূত্রে পাকিস্তানি নাগরিক। ১৯০৪ সালে তদানীন্তন রুশ সাম্রাজ্যের দাগেস্তান প্রদেশের (Дагестанская область, ‘দাগেস্তানস্কায়া ওব্লাস্ত’) বুয়নাকস্ক শহরে মুরাত–খান জন্মগ্রহণ করেন। এটি বর্তমান রুশ ফেডারেশনের উত্তর ককেশীয় ফেডারেল জেলার (Северо-Кавказский федеральный округ, ‘সেভেরো-কাভকাজস্কি ফেদেরালনিই ওক্রুগ’) অন্তর্গত দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রের (Республика Дагестан, ‘রেসপুবলিকা দাগেস্তান’) অংশ।
মুরাত খান জন্মসূত্রে রুশ নাগরিক হলেও জাতিগতভাবে রুশ ছিলেন না। তার পরিবার ছিল জাতিগতভাবে কুমিক এবং ধর্মগতভাবে সুন্নি মুসলিম। ‘কুমিক’রা বৃহত্তর তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত একটি সুন্নি মুসলিমপ্রধান জাতি, যাদের মূল আবাসভূমি দাগেস্তান। বর্তমানে রাশিয়ায় ৫ লক্ষাধিক এবং তুরস্কে প্রায় ১০ হাজার কুমিক বসবাস করে।
মুরাত খানের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনগ্রাদ (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট অফ আর্কিটেক্টস, টাউন প্ল্যানার্স অ্যান্ড সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স’ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৩০ সালে স্নাতক অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি একই ইনস্টিটিউট থেকে স্থাপত্য এবং নগর পরিকল্পনা বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৩০ সাল থেকে মুরাত খানের বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি প্রথমে জন্মভূমি দাগেস্তানে এবং পরবর্তীতে লেনিনগ্রাদ শহরে বিভিন্ন স্থাপত্য সংক্রান্ত দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। এসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের একনায়ক জোসেফ স্তালিন সমগ্র সোভিয়েত রাষ্ট্র জুড়ে ব্যাপক শিল্পায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং এজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে নির্মিত হচ্ছিল প্রচুর সরকারি দপ্তর, শিল্পকারখানা, স্কুল–কলেজ, চিকিৎসাকেন্দ্র এবং অন্যান্য ধরনের ভবন। গড়ে উঠছিল নতুন নতুন শিল্প শহর। এজন্য এসময় সোভিয়েত ইউনিয়নে স্থপতি ও প্রকৌশলীদের বিপুল চাহিদা ছিল, ফলে মুরাত খানেরও কাজের কমতি ছিল না। মুরাত খান সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ভবন ও স্থাপনার নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণকাজের তত্ত্বাবধান করেন। এগুলোর মধ্যে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থপতি ভ্লাদিমির লেনিনের স্মরণে নির্মিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ।
১৯৩৭–১৯৩৮ সালে স্তালিনের নির্দেশে সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত প্রভাবাধীন অঞ্চলসমূহে (যেমন: মঙ্গোলিয়া, জিনজিয়াং, তুভা ও গৃহযুদ্ধ–কবলিত স্পেন) বাস্তব ও কল্পিত শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আকারে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন করা হয় কিংবা ‘বাধ্যতামূলক শ্রম শিবির’ বা ‘গুলাগ’–এ প্রেরণ করা হয়। মুরাত খানকেও এসময় গ্রেপ্তার করা হয় এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, কিন্তু ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে মুক্তি প্রদান করা হয়।
এরপর তাকে উত্তর ককেশীয় প্রকল্প ট্রাস্টের পিয়াতিগরস্ক শাখার প্রধান প্রকৌশলী ও প্রধান স্থপতি নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে তাকে একই ট্রাস্টের ভরোশিলভস্ক (বর্তমান স্তাভ্রোপোল) শাখার প্রধান প্রকৌশলী ও পরিচালক নিযুক্ত করা হয় এবং ১৯৪২ সালের আগস্ট পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
এদিকে ১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মানি ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো (রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি, ফিনল্যান্ড ও অন্যান্য) অতর্কিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। যুদ্ধে প্রাথমিক সাফল্য অর্জনের পর ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জার্মান–নেতৃত্বাধীন অক্ষবাহিনীর মস্কো আক্রমণ ব্যর্থ হয়। ১৯৪২ সালের ২৫ জুলাই অক্ষবাহিনী রোস্তভ শহরটি দখল করে ককেশাসের দিকে ধাবিত হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত মিকোপ, গ্রোজনি ও বাকুর তেলভাণ্ডার দখল করে নেয়া। এতদঞ্চলে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ খর্ব করার উদ্দেশ্যে তারা এই অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন অ–রুশ জাতিকে মস্কোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য প্ররোচিত করে। এর ফলে ককেশাসের বিভিন্ন অংশে, বিশেষত চেচনিয়ায় সোভিয়েতবিরোধী বিদ্রোহ দেখা দেয়।
মুরাত খানও এই বিদ্রোহে যোগদান করেন। সোভিয়েত সরকারের হাতে তার ব্যক্তিগত ভোগান্তি এবং মুসলিম–অধ্যুষিত উত্তর ককেশাসকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার আকাঙ্ক্ষা ছিল তার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল কারণ। কিন্তু যুদ্ধের গতি ক্রমশ অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যেতে শুরু করে এবং স্তালিনগ্রাদ ও কুরস্কের ঐতিহাসিক যুদ্ধের পর এই যুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। ১৯৪৪ সালের মে মাসে অক্ষবাহিনী ককেশাস থেকে বিতাড়িত হয় এবং ককেশাসে সোভিয়েত কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। আক্রমণকারী অক্ষশক্তির সঙ্গে যোগদানের কারণে মুরাত খান সোভিয়েতদের কাছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত হন এবং তাদের হাতে বন্দি হলে মুরাত খানের মৃত্যুর সম্ভাবনা নিশ্চিত ছিল।
এজন্য মুরাত খান পশ্চাৎপসরণরত জার্মান সৈন্যদের সাথে যোগ দেন এবং ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বার্লিনে এসে পৌঁছান। সেখানে তার ঠাঁই হয় একটি শরণার্থী শিবিরে। ১৯৪৫ সালের মে মাসে সোভিয়েত ও পোলিশ সৈন্যরা বার্লিনে প্রবেশ করে এবং ৯ মে জার্মানি মিত্রপক্ষের নিকট আত্মসমর্পণ করে। মুরাত খান জার্মানির সোভিয়েত–দখলকৃত অংশ থেকে পালিয়ে মার্কিন–অধিকৃত অংশের মিটেনওয়াল্ডে চলে যান। সেখানে ১৯৪৬ সালে তিনি হামিদা আকমুত নামক তুর্কি–বংশোদ্ভূত একজন নারীকে বিয়ে করেন। প্রায় ৪ বছর তারা মিউনিখ শহরে অবস্থান করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের পরবর্তী পরিস্থিতিতে মুরাত খানের পক্ষে আর তার জন্মভূমি দাগেস্তানে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এমতাবস্থায় তিনি চাইলে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রে থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানে চলে যাওয়ার। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান তখন মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র। এজন্য মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মুরাত খান পাকিস্তানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তদুপরি, তার স্ত্রীরও পিতার দিক থেকে পাকিস্তানে কিছু আত্মীয়–স্বজন ছিল।
১৯৫০ সালে মুরাত খান তার পরিবারসহ পাকিস্তানে চলে আসেন এবং পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর শহরে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম অস্ত্র কারখানা ‘ওয়াহ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি’ স্থাপিত হয় এবং মুরাত খান এটির নির্মাণ ও বিস্তৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এরপর তিনি লাহোরে ফিরে আসেন এবং ‘পাকিস্তান ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টে’ একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা (বিশেষ স্থপতি) হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি সেখানে ‘পরামর্শদাতা স্থপতি’ হন এবং ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন এবং তার বাসভবনের বর্ধিত অংশে ‘ইল্লেরি মুরাত খান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ নামে একটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
মুরাত খান পাকিস্তানকে তাঁর দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং পাকিস্তানি জীবনধারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। অত্যন্ত পরিশ্রমী ও নিবেদিতপ্রাণ এই স্থপতি ও প্রকৌশলীর নির্মিত কীর্তি ছড়িয়ে আছে সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে।
স্থাপত্য সম্পর্কে মুরাত খানের কিছু নিজস্ব মতামত ছিল। তাঁর ব্যক্তিগত মত ছিল, প্রতিটি স্থানীয় সংস্থার নিজস্ব স্থপতি থাকা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান পৌরসভাগুলোর নিজস্ব স্থপতি আছে এবং পাকিস্তানেও অনুরূপ ব্যবস্থা মোতায়েন করার জন্য মুরাত খান পাকিস্তানি সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সরকার এই পরামর্শ গ্রহণ করে নি।
স্থাপত্যরীতি সম্পর্কেও মুরাত খানের স্বতন্ত্র মতামত ছিল। তাঁর মতে, উত্তর–পশ্চিম আফ্রিকা থেকে দূরপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত মুসলিম সম্প্রদায়ের স্থাপত্যরীতিতে আংশিক হলেও সামঞ্জস্য থাকা উচিত। এছাড়া মুসলিম স্থাপত্যরীতির ভিত্তিতে পাকিস্তানের একটি নিজস্ব জাতীয় স্থাপত্যরীতি গড়ে তোলা উচিত বলেও তিনি মনে করতেন।
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুলতান শহরে অবস্থিত নিশতার মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন নিশতার হাসপাতাল নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধান করেছিলেন মুরাত খান। পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং পাঞ্জাব প্রদেশের প্রাক্তন গভর্নর সর্দার আব্দুর রব নিশতারের নাম বহনকারী এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পাকিস্তানের সবচেয়ে পুরাতন মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সিহালা শহরে অবস্থিত ‘পাঞ্জাব পুলিশ কলেজ সিহালা’র নকশা প্রণয়নও করেছিলেন মুরাত খান। ১৯৫৯ সালে নির্মিত এই কলেজটি পাকিস্তানের বৃহত্তম ও সবচেয়ে পুরনো পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থিত ফর্ম্যান খ্রিস্টান কলেজের সিনক্লেয়ার হল, খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের মানশেরা শহরে অবস্থিত মানশেরা মানসিক হাসপাতাল এবং পাঞ্জাব প্রদেশের ফয়সালাবাদ শহরে অবস্থিত টেক্সটাইল কলেজের নকশাও মুরাত খানের করা। ১৯৫৯ সালে নির্মিত ৬০,০০০ দর্শক ধারণ করতে সক্ষম পাকিস্তানের তৎকালীন বৃহত্তম স্টেডিয়াম ‘লাহোর স্টেডিয়ামে’র নকশাও করেছিলেন মুরাত খান। উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির অধিকার সমর্থন করলে তাঁর সম্মানে এই স্টডিয়ামটিকে ‘গাদ্দাফি স্টেডিয়াম’ নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে স্টেডিয়ামটির সংস্কারকাজ করার সময় এটির দর্শক ধারণক্ষমতা কমিয়ে ২৭,০০০–এ নিয়ে আসা হয়।
এগুলো ছাড়াও মুরাত খান পাকিস্তানের আনাচে কানাচে অসংখ্য ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় অবদান হচ্ছে ‘মিনার–এ–পাকিস্তান’ স্থাপনাটির নকশা প্রণয়ন, যেটি পাকিস্তানের জাতীয় প্রতীক হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে।
১৯৫০–এর দশকের শেষদিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান পাকিস্তানের সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ নিখিল–ভারত মুসলিম লীগ লাহোরের যে স্থানটিতে ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ পেশ করেছিল, সেই স্থানটিতে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৬০ সালের ২৩ মার্চ সেই স্থানে, অর্থাৎ লাহোরের ইকবাল পার্কে, পাঞ্জাবের গভর্নর আখতার হুসেইন ‘মিনার–এ–পাকিস্তানে’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
১৯৬৩ সালে আইয়ুব খান তাঁর কার্যালয়ে মুরাত খানকে ডেকে পাঠান এবং পাকিস্তানের এই জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দায়িত্ব তাঁর ওপরে অর্পণ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, আইয়ুব একটি ঝর্ণা কলম তাঁর ডেস্কের ওপরে খাড়াভাবে রেখে মুরাত খানকে নির্দেশ দেন, ‘ঠিক এই আকৃতির একটি মিনার নির্মাণ করো!’
মুরাত খান উৎসাহের সঙ্গে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর ওপরে এই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে বলে নিজেকে সম্মানিত বিবেচনা করেছিলেন। এই কাজের জন্য পাকিস্তানি সরকার তাঁকে আড়াই লক্ষ পাকিস্তানি রুপি বেতন দিয়েছিল, কিন্তু মুরাত খান তার থেকে এক রুপিও নেন নি। তিনি এর পুরোটাই মিনার–এ–পাকিস্তান নির্মাণের জন্য যে ফান্ড গঠন করা হয়েছিল সেটিতে দান করে দেন।
প্রায় এক বছর ধরে মুরাত খান এই মিনারটি নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা করতে থাকেন এবং অবশেষে তাঁর প্রণীত তিনটি নকশা থেকে একটিকে বাছাই করা হয়, যদিও নকশাটিতে দুইটি ছোট্ট পরিবর্তন আনা হয়। মিনারটির ওপরে একটি গম্বুজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যেটি মুরাত খানের নকশায় ছিল না। আর মিনারটির নিচে বেজমেন্টে মুরাত খান যে সম্মেলন কক্ষ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন, অর্থাভাবের কারণে সেটি পরিত্যক্ত হয়।
মুরাত খানের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানি সরকার তাঁকে ‘তমঘা–ই–ইমতিয়াজ’ পদক প্রদান করে। মিনার–এ–পাকিস্তান নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় ৮ বছর। ১৯৬৮ সালের ৩১ অক্টোবর এটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। মিনারটি নির্মাণে ব্যয় হয় মোট ৭৫ লক্ষ পাকিস্তানি রুপি।
মুরাত খান এই স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণকে ব্যক্তিগত দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং এটি নির্মাণকাজ চলাকালে তিনি প্রায়ই সেখানে গিয়ে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত সামগ্রীর মান ও কাজের গুণগত মান পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতেন। এজন্যও তিনি কোনো ধরনের পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন নি। বরং মিনারটির নির্মাণের জন্য গঠিত ফান্ডে তিনি প্রায় ৩ লক্ষ পাকিস্তানি রুপি দান করেন।
নিঃস্বার্থ আদর্শবান ব্যক্তিদের জীবনে যেরকম দুর্ভোগ নেমে আসে, মুরাত খানের জীবনেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মিনার–এ–পাকিস্তানের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ার পর একে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার মাত্র কিছুদিন আগে মিনার নির্মাণ কমিটির সভাপতির সঙ্গে মুরাত খানের বিরোধ দেখা দেয় এবং তিনি এই কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। তার সহকর্মীদের অনেকেই দাবি করেন যে, মুরাত খান নয়, তারাই মিনার–এ–পাকিস্তান এর নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। এই দাবিটি ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কারণ তাদের কারোরই মুরাত খানের মতো স্থাপত্য ও প্রকৌশল সংক্রান্ত বিপুল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছিল না।
শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানি সরকারও মুরাত খানকে তার অবদানের উপযুক্ত স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৬৩ সালে প্রদত্ত পদকটি ছাড়া তাকে আর কোনো পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। এমনকি যে মিনারটি নির্মাণে তিনি প্রায় এক দশক আত্মনিয়োগ করেন, সেখানেও মিনারটির স্থপতির কোনো নাম রাখা হয়নি।
১৯৭০ সালের ১৫ অক্টোবর লাহোরে মুরাত খান হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। লাহোরের মিসরি শাহ কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও পাঁচ কন্যাসন্তানকে পাকিস্তানি সরকার কোনো ধরনের সহায়তা প্রদান করেনি। পাকিস্তানি জনসাধারণের বারংবার দাবি করা সত্ত্বেও মিনার–এ–পাকিস্তানেও তার নাম খোদাই করা হয়নি।
পাকিস্তানি সরকারের এরকম আচরণের কারণ ব্যাখ্যা করা কঠিন। দেশপ্রেমিক জনসাধারণের প্রতি সরকারের নিরুৎসাহ মনোভাব, আমলাতান্ত্রিক অকর্মণ্যতা, কিংবা মুরাত খান যে বিদেশি ছিলেন সেই বিষয়টি – এগুলোকে মুরাত খানের প্রতি পাকিস্তানি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণের জন্য সচেতন পাকিস্তানিরা দায়ী করে, যদিও প্রকৃত কারণ আজও অজ্ঞাত। কিন্তু এখনও পাকিস্তানি নাগরিক শ্রেণীর একটি ক্ষুদ্র অংশ পাকিস্তানের প্রতি মুরাত খানের অবদানের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য পাকিস্তানি সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে।