জনগণের নেতা হয়ে ওঠা সহজ নয়। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর জেল-জুলুম সহ্য করে কেউ কেউ জনগণের নেতা হন। সংগ্রামের পথ ধরে অনেক সময় সাফল্য আসে, নেতা হয়ে উঠেন ক্ষমতার অধিকারী। জনগণ নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটুকু তুলে দেয় সেই নেতার কাঁধে। রবার্ট মুগাবে তেমনই একজন নেতা, যিনি তার দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। লড়াই করে আদায় করেছেন জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা। জনগণ তার কাঁধে দেশ পরিচালনা করার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল। বিপ্লবী রাজনীতিক থেকে হয়েছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি। তবে বিতর্ক আছে তার নেতৃত্ব নিয়ে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি তার দেশকে একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন।
রবার্ট মুগাবের পুরো নাম রবার্ট গ্যাব্রিয়েল মুগাবে। ১৯২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি তৎকালীন দক্ষিণ রোডেশিয়ার (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) কুতামা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সময়ে রোডেশিয়া ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল, যা পরিচালিত হত সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ সরকার দ্বারা।
গ্রামের এক কাঠমিস্ত্রী পিতা গ্যাব্রিয়েল মাতিবিরি এবং মা বোনার তৃতীয় সন্তান মুগাবে। মা কাজ করতেন স্থানীয় জ্যাজুয়েট মিশনে ধর্মীয় শিক্ষিকা হিসেবে।
মুগাবে যখন খুব ছোট তখন তার বাবা দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজ করতে যান। তিনি সেখানে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এর ফলে মুগাবের মাকে একা চার সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব নিতে হয়। সংসার চালানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মুগাবে তাদের গৃহপালিত গরুর দেখাশোনা করে সংসারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতেন। এছাড়াও তিনি নানা ধরনের ছোট ছোট কাজ করে পরিবারের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করেন।
তৎকালে দক্ষিণ রোডেশিয়ায় সাধারণত শিশুরা তেমন একটা শিক্ষার সুযোগ পেত না। মুগাবেকে সেখানে ভাগ্যবানই বলতে হবে, কারণ তিনি স্থানীয় জ্যাজুয়েট বিদ্যালয়ে সেই বিদ্যালয়ের পরিচালক ফাদার ও’ হিয়ার সরাসরি তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করেন। ফাদার ও’ হিয়া মুগাবেকে শেখান, সব মানুষের সমান আচরণ পাওয়ার অধিকার আছে এবং সবারই শিক্ষাগ্রহণ করে তাদের নিজ নিজ সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
দক্ষিণ রোডেশিয়ার বিভিন্ন মিশন বিদ্যালয়ে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তিনি নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যান। পরবর্তীতে মুগাবে একটি রোমান ক্যাথলিক মিশন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ নেন।
১৯৫১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ইউনিভার্সিটি কলেজ অব ফোর্ট হেয়ার থেকে মুগাবে ইতিহাস এবং ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীনই তিনি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি ঘানায় শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এবং এই সময় তিনি নিজেকে মার্ক্সবাদী হিসেবে দাবী করেন। এসময় ঘানা সরকারের সবার জন্য সমান শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যকে তিনি সমর্থন করেন।
১৯৬০ সালে মুগাবে রোডেশিয়ায় নিজের শহরে ফিরে আসেন এবং সেখানে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন টের পান। তিনি দেখতে পান নতুন ঔপনিবেশিক সরকার হাজারো কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করে দিয়েছে এবং একই সাথে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু জনসংখ্যার বিরাট বিস্ফোরণ ঘটেছে। সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গদের শাসনকার্য পরিচালনার অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় কৃষ্ণাঙ্গ জনগণ তীব্র বিরোধিতায় ফেটে পড়ে। দেশে সহিংস আন্দোলন গড়ে ওঠে। মুগাবে নিজেও সরকারের এই ধরনের সিদ্ধান্তে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হন।
১৯৬০ সালের জুলাই মাসে সলসবেরির হারারে টাউন হলে প্রায় সাত হাজার মানুষের প্রতিবাদ সভায় তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হন। সরকারবিরোধী নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা এ সমাবেশে মিলিত হন। পুলিশের হুমকির মুখে থাকা সত্ত্বেও সভায় মুগাবে আন্দোলনকারীদের বলেন কীভাবে ঘানা মার্ক্সবাদ গ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
এর এক সপ্তাহ পরেই তিনি ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। ঘানার মডেল অনুসরণ করে তিনি খুব দ্রুত যুবকদের নিয়ে একটি সশস্ত্র দল গঠন করে রোডেশিয়ার স্বাধীনতার বার্তা ছড়ানোর নির্দেশ দেন। ১৯৬১ সালের শেষভাগে সরকার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু এই দলের সদস্যরা রোডেশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এর ধারাবাহিকতায় প্রায় সাড়ে চার লাখ সদস্য নিয়ে জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান পিপলস ইউনিয়ন (ZAPU) নামক একটি সংগঠনের জন্ম হয়।
জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান পিপলস ইউনিয়নের ব্যর্থতায় হতাশ হয়ে ১৯৬১ সালের এপ্রিলে মুগাবে প্রকাশ্যে গেরিলা যুদ্ধ শুরুর কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “আমরা এ দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছি এবং আমরা এই বিশৃংখলা আর চলতে দেব না।”
১৯৬৩ সালে মুগাবে এবং তার অন্যান্য সহযোদ্ধা মিলে তাদের নিজস্ব একটি প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এর নাম দেয়া হয় জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (ZANU)। এর কার্যক্রম চলে তানযিনিয়া থেকে। সেই বছরই তিনি দেশে ফিরলে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে হাওয়াহাওয়া কারাগারে নিয়ে যায়। এক দশক তিনি বিনা বিচারে কারান্তরীন থাকেন। এর ভেতরে তাকে বিভিন্ন কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়।
কারাগারে থাকাবস্থায়ই তিনি ব্রিটিশ শাসন থেকে রোডেশিয়াকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে গোপনে যোগাযোগ করা শুরু করেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আয়ান স্মিথ, যিনি কথা দিয়েছিলেন সত্যিকার অর্থে রোডেশিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন, তিনিও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার পক্ষে যুক্তি দেয়া শুরু করেন। অবশ্য ১৯৭৪ সালে তিনি মুগাবেকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে জাম্বিয়াতে কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেন। কিন্তু মুগাবে তার পরিবর্তে দক্ষিণ রোডেশিয়ায় পালিয়ে এসে গেরিলা বাহিনী গঠন করে লড়াই শুরু করেন যা পুরো সত্তর দশকব্যাপী চলে।
১৯৭৯ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আয়ান স্মিথ মুগাবের সাথে একটি সমঝোতার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা সত্ত্বেও কোনো সমাধানে পৌঁছুতে না পেরে দক্ষিণ রোডেশিয়াকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।
১৯৮০ সালে দক্ষিণ রোডেশিয়া ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন জিম্বাবুয়ে নামে আত্মপ্রকাশ করে। মুগাবের সংগ্রাম সাফল্যলাভ করে।
জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের ব্যানারে নির্বাচন করে মুগাবে প্রথমবারের মতো স্বাধীন জিম্বাবুয়ের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি আর জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের মধ্যে বিরোধের সূচনা হয়।
১৯৮৫ সালে আবার মুগাবে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে দুই দলের মধ্যে একটি সমঝোতার সৃষ্টি হয় এবং তারা একটি অভিন্ন দলে মিলিত হন। দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে একসাথে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
এর এক সপ্তাহের মধ্যেই মুগাবে জিম্বাবুয়ের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগলাভ করেন। তার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং পুনরুদ্ধার করা।
১৯৯৬ সালের দিকে জিম্বাবুয়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে মুগাবের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, শ্বেতাঙ্গদের জমি কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই বাজেয়াপ্ত করা, জিম্বাবুয়েকে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা ইত্যাদি কারণ তাকে স্বাধীন জিম্বাবুয়ের নায়ক থেকে ধীরে ধীরে খলনায়কে পরিণত করে।
বিতর্কিত রাজনৈতিক কৌশল তার সাফল্যের জয়গাঁথা ম্লান করে ফেলে। জনগণের মধ্যে অসন্তোষের মাত্রা বাড়তে থাকে। ২০০২ সালের নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ উঠে। যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে তিনি ২০০৫ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সহিংসতা আর দূর্নীতির আশ্রয় নেন।
মার্চ ২০০৮ সালে যখন তিনি প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মরগান চাংগিরাইর কাছে হেরে যান, তখন তিনি ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান এবং ভোট পুনর্গণনার দাবী জানান।
মুগাবের এহেন আচরণে জিম্বাবুয়েতে আবারো সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পরে মরগান আর মুগাবে একটি ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তির মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছান।
২০১৩ সালে ৮৯ বছর বয়সে মুগাবের উত্তরসুরি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ২০১৪ সালে মুগাবের স্ত্রী গ্রেস মুগাবে নিজেকে মুগাবের উত্তরসুরি হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন, কিন্তু জিম্বাবুয়ের সেনাপ্রধান বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে।
নভেম্বর ২০১৭ এর এক বিকালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং মুগাবেকে গৃহবন্দী করা হয়। সাধারণ জনগণ তাকে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। সেই বছর ২২ নভেম্বর মুগাবে পার্লামেন্টের জয়েন্ট সেশনে পদত্যাগ করেন। অবসান হয় তার দীর্ঘ ৩৭ বছরের শাসনের।
এরপর মুগাবে নীরবে হাঁটতে থাকেন মৃত্যুর দিকে। একদা শক্ত হাতে দেশ চালানো এ নেতা ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
মুগাবের শুরুটা ছিল জনপ্রিয় নেতা হিসেবে, কিন্তু ক্ষমতার অন্ধ প্রকোষ্ঠে কোথায় যেন সেই জনপ্রিয়তা হারিয়ে তিনি পরিণত হয়েছিলেন একনায়কে। যে জনগণের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন যৌবনে, তারাই তার বার্ধক্যে স্বৈরাচারীর তকমা এঁটে বিদায় জানায়।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘জীবনী’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/