বিল্পবী পুরুষরা প্রকৃতপক্ষে অন্যদের চেয়ে আলাদা নয়। পুরুষদের মাঝে যারা নিতান্তই পাতি তারা নারীর শরীর কেনে পয়সা দিয়ে আর প্রতিবাদের তুবড়ি ছোটানো পুরুষরা নারীকে ভোগ করে তথাকথিত নীতির বিনিময়ে।
নারীদের মাঝে একাত্মতা তাদের পরিবর্তনের জন্য আবশ্যিক। নতুন যুগের সূচনা হবে এই একাত্মবোধের হাত ধরেই যার মাধ্যমে কেবল নারীই নয়, পুরুষের অবস্থারও উন্নয়ন ঘটবে।
জীবন সবসময়ই কঠিন। সত্যিকার অর্থে তারাই বেঁচে থাকে যারা নিজের জীবনের চেয়েও অধিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পারে।
কথাগুলো একজন মিশরীয় নারীবাদীর। পেশায় তিনি ছিলেন চিকিৎসক, মনোরোগ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তবে পেশাগত পরিচয় ছাপিয়ে বিশ্বের দরবার তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন আরব বিশ্বের নারী মুক্তির পথিকৃৎ হিসেবে। নারীর রাজনৈতিক এবং যৌন অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জীবনের প্রায় পুরোটা ব্যয় করা এই লেখকের নাম- নাওয়াল আস সাদাবি।
বিশ্বের বেশ কিছু খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন তিনি। ১৯৫৫ সালে মিশরের কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৫ থেকে শুরু করে পরবর্তী এক দশকে তিনি তার অসাধারণ পেশাগত জীবন চালিয়ে যান। দশ বছরের এই পরিক্রমায় তিনি কাজ করেন একাধিক জায়গায়। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়, মিশরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করে অবশেষে তিনি ১৯৬৫ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্যের উপর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৬৮ সালে সাদাবির উদ্যোগে চালু হয় হেলথ ম্যাগাজিন যেটি কয়েক বছরের মধ্যেই মিশর সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৯৭২ সালে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক বহিষ্কৃত হন। চমৎকার এবং সম্মানজনক এই পেশা দায়িত্ব থেকে তাকে পদচ্যুত করার কারণ ছিল তারই লেখা বই, আল-মার আহ ওয়া আল-জিন্স (ওম্যান অ্যান্ড সেক্স)। ১৯৭২-৭৪ সাল অবধি তিনি কায়রোর আইন শামস বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৮২ সালে সাদাবির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় আরব ওম্যানস সলিডারিটি অ্যাসোসিয়েশন। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব প্রকাশনা ছিল আল-নুন যার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন স্বয়ং সাদাবি। প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি হিসেবেও তিনি বেশ কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। সহ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আরব অ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটসের। কায়রোর সুপ্রিম কাউন্সিল ফর আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসের সাথে তিনি লেখক হিসেবেও যুক্ত ছিলেন। হেলথ এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন এবং ইজিপশিয়ান ওম্যান রাইটার্স অ্যাসোশিয়েশন সংগঠন দু’টিও যাত্রা শুরু করে সাদাবির হাত ধরেই।
বাক স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং আন্ত সংস্কৃতি বোঝাপড়া রক্ষার জন্য তিনি স্টিগ ড্যাগারম্যান প্রাইজ অর্জন করেন। সুইডিশ এই পুরস্কারটি তার প্রাপ্তির খাতায় যোগ হয় ২০১১ সালে। ভ্রিজে ইউনিভার্সিটেইট ব্রাসেল (বেলজিয়াম), ইউনিভার্সিটে লিব্রে ডে ব্রাক্সেলেস (বেলজিয়াম) এবং ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অভ মেক্সিকো তাকে তিনটি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ২০০৪ সালে কাউন্সিল অভ ইউরোপ তাকে নর্থ সাউথ পুরস্কারে ভূষিত করেন। অব্যবহিত পরের বছরেই তিনি বেলজিয়ামে অর্জন করেন ইনানা ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ।
তার প্রথম নন ফিকশন বই ওম্যান অ্যান্ড সেক্স। মিশরে প্রথম প্রকাশের পর বইটি টানা প্রায় দুই দশক যাবত নিষিদ্ধ ছিল। এরপর ১৯৭২ সালে আবার প্রকাশিত হলে সেটিই সাদাবির চাকরীচ্যুত হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বইটিতে নারীর খৎনা সম্পর্কে সাদাবি বিশদ এবং খোলামেলা আলোচনা করেন। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বর্তমান সময়েও মেয়েদের খৎনার রীতি প্রচলিত আছে। ইংরেজিতে একে বলা হয় ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন বা সংক্ষেপে এফজিএম।
বিশ্বজুড়ে পুরুষদের খৎনার বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সুবিধা থাকলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যপারটি চূড়ান্ত পর্যায়ের বীভৎস, অমানবিক এবং সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। নারীদের সম্ভ্রম রক্ষার উদ্ভট দোহাই দিয়ে বিভিন্ন দেশে এই চর্চাটি এখনও বহাল রয়েছে। মেয়েদের খৎনার চারটি প্রকারভেদ থাকলেও সবচেয়ে প্রচলিতটি হচ্ছে ভগাঙ্কুর বা ক্লাইটোরিস ছিন্নকরণ। শারীরিক সম্পর্কে নারীদের তৃপ্তির প্রধানতম উৎসস্থল ভগাঙ্কুর ছিন্ন করার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে যৌন সম্পর্কে নারীদের আনন্দ লাভের বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়।
সাদাবি কেন এই বিষয়টি নিয়ে কোনো রাখঢাক না রেখেই কথা বললেন তার বইয়ে? কারণ মিশরে মেয়েদের খৎনার বিষয়টি অতি সাধারণ বললেও কম হবে। ২০০৫ সালে ইউনিসেফ কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপ মোতাবেক মিশরের ৯৭% মেয়েদের খৎনা হয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই বইটির লেখক সাদাবির নিজেরই খৎনা হয়েছিল ৬ বছর বয়সে।
১৯৮০ সালে নাওয়াল আস সাদাবির বই, দ্য হিডেন ফেস অভ ইভ প্রকাশিত হয়। আরব সমাজে নারীর সত্যিকারের ভূমিকা, পর্দা প্রথা, বহুগামিতা, লিঙ্গ বৈষম্য ইত্যাদি নানা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় এই বইটিতে যা কি না মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। এই বইটির কারণেই সরকার তাকে টানা তিন মাস কারারুদ্ধ করে রাখে। কারাজীবনের অসহনীয় কষ্টের দিনকে কেন্দ্র করে তিনি রচনা করেন আরেক অবিস্মরণীয় বই- মেমোয়ার্স ফ্রম ওম্যানস প্রিজন। রাষ্ট্রযন্ত্রের দমন-পীড়নের প্রতি নারীরা কতটা নির্লিপ্ত, নিশ্চুপ, ভাবাবেগশুন্য সেটিই এই বইয়ের মূল কথা।
১৯৯১ সালে আরব ওম্যানস সলিডারিটি অ্যাসোসিয়েশন, গালফ যুদ্ধের বিরোধিতা করায় মিশরের সরকার দারুণ চটে যায়। সরকারের রোষানলে পড়ে এই সংগঠনটির সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই দেশ ত্যাগ করেন সাদাবি। ১৯৯২ সালে মিশর থেকে পালিয়ে যান তিনি এবং পরবর্তী দশক কাটান পশ্চিমের বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে।
২০০২ সালে ইসলামি ভাবধারায় বিশ্বাসী এক আইনজীবীর সহযোগিতায় স্বামীর সাথে সাদাবির বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। তবে এই বিচ্ছেদের ঘটনাটি প্রথাগত ছিল না বরং সাদাবির দিক থেকে জোরপূর্বক ছিল। ২০০৮ সালে সারা পৃথিবীতে ইসলাম শিক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ আল আজহার ইউনিভার্সিটি তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননা এবং স্বধর্মত্যাগের অভিযোগ আনে। মামলায় সাদাবিই জয়ী হন।
ফিকশন কিংবা নন ফিকশন, লেখালেখির দু’ ধারাতেই সাদাবি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন নারীর খৎনাকে। যদিও লিঙ্গ বৈষম্য, পুরুষতান্ত্রিকতা, যৌনতা, নারী মুক্তি, ধর্ম ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন ৫০ টিরও বেশি বই। নারীমুক্তির অন্যতম অন্তরায় হিসেবে তিনি দেখেন ছদ্ম নারীবাদীদেরকে যারা পদ, ক্ষমতা, অর্থ, খ্যাতির লোভে নারীবাদকে ব্যবহার করেন। মিশরের রাষ্ট্রপতিদের নিয়ে কথা বলার সময় তিনি তাদের জীবনসঙ্গিনীদের দিকে আলোকপাত করেন। ইজিপশিয়ান ওম্যানস ইউনিয়ন ধ্বংস করার সম্পূর্ণ দায় তিনি চাপান জেহান সাদাত কিংবা সুজান মোবারকের মতো পটের বিবি সেজে বসে থাকা নারীদের ওপর।
শেষ করব সংগ্রামী, সাহসী, বুক চিতিয়ে লড়াই করতে জানা নারীর দৃষ্টিতে নারীবাদ মূলত কী তা জেনে। নারীবাদকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন,
নারীদের যাবতীয় সমস্যা নিয়ে কথা বলাই নারীবাদের প্রধানতম উদ্দেশ্য। নারীবাদ সামাজিক, রাজনৈতিক, যৌনতা সকল পর্যায়েই ন্যায়বিচারের কথা বলে। চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান সবকিছুর সাথেই নারীবাদ কোনো না কোনোভাবে জড়িত। মোদ্দা কথা হলো, নারীর জীবনে বৈষম্য, বঞ্চনা, নির্যাতন ইত্যাদির সমাধানে নারীবাদ একটি অবশ্য আলোচ্য বিষয়।
নাওয়াল আস-সাদাবি-এর “শূন্য বিন্দুতে নারী” বইটি কিনতে পারেন রকমারি থেকে।