১৯ জুন, ১৯৮১। স্কুল শেষে বাসায় ফিরছিলেন শিক্ষিকা নমিতা মুখোপাধ্যায়। কলকাতার দক্ষিণ অ্যাভিনিউয়ে ছয় তলার এক ফ্লাটে ডাক্তার স্বামীর সাথে থাকতেন তিনি। পেশাগত কারণে তার স্বামী বেশ কিছুদিন ধরেই মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। কিন্তু বাসায় ঢোকার সাথে সাথে নমিতা যা দেখলেন তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। বাসায় গিয়ে আবিষ্কার করলেন স্বামীর গলায় ফাঁস দেয়া ঝুলন্ত লাশ! মানসিক যাতনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল তার স্বামী সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। সাথে ছিল সুইসাইড নোট, “হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর জন্য আর অপেক্ষা করতে পারলাম না”। নিজের আবিষ্কারের কারণে কর্মস্থল থেকে শুরু করে রাষ্ট্র সকল জায়গায় অপমানিত হওয়া ডাক্তার ও বিজ্ঞানী সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিজের হাতেই নিজের জীবনের ইতি টেনে দেন। বেঁচে থাকলে হয়তো নোবেল পুরষ্কারটাও তার পাওয়া হতো! অমিত প্রতিভাধর অভিমানী এই বিজ্ঞানীর কথাই আজ পাঠকের সামনে তুলে ধরব।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩১ সালের ১৬ জানুয়ারি ভারতের বিহারের (বর্তমান ঝাড়খন্ড) হাজারিবাগে। কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে তিনি ফিজিওলজিতে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৮ সালে রিপ্রোডাকটিভ ফিজিওলজিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব এডিনবোরো থেকে দ্বিতীয় ডক্টরেট ডিগ্রি নেন রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রায়োনলজির উপর। বিদেশে গবেষণা আর চাকরির লোভ ছেড়ে তিনি ফিরে যান দেশে, কলকাতাতেই। কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে শুরু করেন কর্মজীবন। গবেষণার প্রতি টানের কারণে প্রচলিত ডাক্তারি প্র্যাকটিস বলতে গেলে করতেনই না। স্বল্প সম্পদ আর সুযোগেই তিনি তার গবেষণার কাজ এগিয়ে নিয়েছেন। আর তার গবেষণাটিও ছিল যুগান্তকারী একটি বিষয় নিয়েই- ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন।
ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা টেস্টটিউব বেবি নিঃসন্তান দম্পত্তিদের জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিঃসন্তান দম্পত্তিরাও আজ টেস্টটিউব পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তানের মুখে ‘মা’, ‘বাবা’ ডাক শুনতে পাচ্ছেন। অথচ আমাদের বেশিরভাগেরই অজানা যে টেস্টটিউব বেবির সফল গবেষণা করেছিলেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী! ১৯৭৮ সালে রবার্ট এডওয়ার্ডসের গবেষণার ফল হিসেবে জন্ম হয় লুইস ব্রাউনের, পৃথিবীর সর্বপ্রথম টেস্ট টিউব শিশুর। এর মাত্র ৬৭ দিন পর ৩ অক্টোবর ভারতে জন্ম নেয় পৃথিবীর দ্বিতীয় টেস্টটিউব শিশু- দুর্গা, পৃথিবীর দ্বিতীয় আর ভারতের প্রথম টেস্টটিউব শিশু। ভারতের এক নিঃসন্তান দম্পত্তি দেখা পান তাদের সন্তানের মুখ। ২০১০ সালে রবার্ট এডওয়ার্ডস তার আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেলেও আবিষ্কারের পর নিজের দেশেই অবহেলা আর অপমানের মুখোমুখি হতে হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে।
যেকোনো আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি পাবার একমাত্র বৈধ উপায় হচ্ছে কোনো জার্নালে পাবলিশ করা। এতে পুরো কাজটি পৃথিবীর সকলকে জানানো যায় আর পুরো কাজের কৃতিত্ব চুরি যাবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু ডক্টর সুভাষ যখন তার কাজটি পাবলিশ করতে চাইলেন বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো স্থানীয় প্রশাসন। যুগান্তকারী এই আবিষ্কারের খবর স্থানীয় পত্রিকার পাশাপাশি বিদেশেও কিছু জায়গায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু গবেষণা নিয়ে মেতে থাকা ডক্টর সুভাষ তার সহকর্মীদের ঈর্ষার কথা কল্পনাও করতে পারেননি। ডক্টর সুভাষকে যেখানে মাথায় নিয়ে নাচার কথা তখন তার আবিষ্কারকে হেয় করার জন্য গঠিত হয় এক প্রহসনের তদন্ত কমিটি!
একজন রেডিওফিজিওলজিস্টকে প্রধান করে গঠন করা হয় প্রজনন সম্পর্কিত গবেষণার তদন্ত কমিটি! সরকার আর লোকজনের মুখে একটি কথাই ছিল, “আমেরিকা যে কাজ করতে পারেনি, সে কাজ কীভাবে কলকাতায় করা সম্ভব হলো?” পদে পদে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে অপমান করা হতে থাকে। আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আবিষ্কারের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয় নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি। তাদের তদন্তে ডক্টর সুভাষের কাজকে ভুয়া হিসেবে দাবী করা হয়! এমনকি বিদেশ থেকে ডক্টর সুভাষকে তার আবিষ্কারের ব্যাপারে কনফারেন্সে যোগ দেবার আমন্ত্রণ দেয়া হলেও সরকার কনফারেন্সে যোগ দেবার ব্যাপারে কড়াকড়ি নিয়ম জারি করে। জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ণ তাদের খরচে ডক্টর সুভাষকে আমন্ত্রণা জানানো হয় তার আবিষ্কার নিয়ে কথা বলার জন্য। সরকার তাকে সেখানে যাবার অনুমতি তো দেয়নি, বরং তার বিদেশ যাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে!
তদন্তের পর ডক্টর সুভাষকে বদলি করা হয় বাঙ্কুরা মেডিকেল কলেজে। ১৯৮০ সালে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে তাকে বদলি করা হয় আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হসপিটালে। এভাবে বারবার জায়গা বদলের ফলে গবেষণা পুরোপুরি থেমে যায় ডক্টর সুভাষের। তবে তাকে সবচেয়ে বড় অপমান করা হয় তার আত্মহত্যার মাত্র কিছুদিন আগে। ১৯৮১ সালের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাকে বদলি করা হয় চক্ষু বিষয়ক এক ইনস্টিটিউটে, ইলেক্ট্রো-ফিজিওলজির প্রফেসর হিসেবে। অথচ পিএইচডি ডিগ্রি কিংবা গবেষণা দুটোই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে। আর এই অপমানের ভার বইতে না পেরেই ১৯ জুন আত্মহত্যা করেন প্রতিভাধর এই বিজ্ঞানী।
শেষের গল্পটা একটু ভিন্ন। অনেক দেরিতে হলেও নিজ দেশসহ পুরো পৃথিবীতেই স্বীকৃতি পেয়েছেন এই বিজ্ঞানী। সেটার গল্পটাও বেশ চমকপ্রদ। ১৯৮৬ সালের ১৬ আগস্ট ভারতেরই আরেক বিজ্ঞানী টি. সি. আনন্দ কুমারের গবেষণার ফলে জন্ম নেয় আরেক টেস্ট টিউব শিশু হর্ষবর্ধন রেডি। ভারত সরকার আনন্দ কুমারকেই ভারতের প্রথম টেস্টটিউব শিশু নিয়ে সফলতার স্বীকৃতি হয়। তবে সবকিছু পাল্টে যায় ১৯৯৭ সালে, যখন আনন্দ কুমার কলকাতায় যান এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে।
কলকাতায় আনন্দ কুমারের হাতে আসে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নিগৃহীত কাজের বিভিন্ন ডকুমেন্ট। সেই ডকুমেন্টগুলো দেখে আর দুর্গার পরিবারের সাথে কথা বলে আনন্দ কুমার বুঝতে পারেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই ভারতে টেস্ট টিউব শিশু নিয়ে গবেষণার প্রথম সফল ব্যক্তি। দীর্ঘদিনের অবহেলা আর অপমানের পর আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা পায় ডক্টর সুভাষের গবেষণা। আনন্দ কুমারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের প্রথম সফল টেস্টটিউব শিশুর গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আনন্দ কুমার নিজের মাথা থেকে সাফল্যের এই মুকুটটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে দিতে একটুও দ্বিধা করেননি। আনন্দ কুমারের ভাষায়,
ডক্টর সুভাষকে অবশ্যই ভারতে প্রথম সফল টেস্টটিউব শিশু আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিতে হবে। তার আবিষ্কারের তুলনায় অন্যগুলো একেবারেই ছোট।
আনন্দ কুমার ১৯৭৮ সালে গঠিত সেই তদন্ত কমিটির কড়া সমালোচনা করেছেন তার লেখায়। প্রহসনের সেই তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন একজন রেডিওফিজিওলজিস্ট আগেই বলা হয়েছে। অন্য সদস্যরা ছিলেন একজন গায়নোকলজিস্ট, একজন নিউরোফিজিসিস্ট ও একজন ফিজিওলজিস্ট। আনন্দ কুমারের দাবী অনুযায়ী এই চার সদস্যের তদন্ত কমিটির কারোরই আধুনিক প্রজননবিদ্যা বিষয়ক গবেষণা নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না, যার ফল ভোগ করতে হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে।
নিজের ২৫তম জন্মদিনে সবার সামনে আসেন দুর্গা- যার পুরো নাম কানুপ্রিয়া আগারওয়াল। তিনি নিজেকে ভারতের টেস্টটিউব শিশু গবেষণার ‘পোস্টার গার্ল’ হিসেবে দেখতে চান না বলেই জানান। বরং তার জন্মের পেছনে অবদান রাখা একজন ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানীর অবদানের স্বীকৃতিকেই সাফল্য হিসেবে মনে করেন। জন্মের পর তার ও পরিবারের সামাজিক লাঞ্চনার কথাও তিনি জানান।
প্রায়ই শোনা যায়, পশ্চিমারা নাকি হিংসার বসে ভারতবর্ষের বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দিতে চায় না! অথচ নিজের দেশে, নিজের শহরে কী এক নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সেটা একবারও বলা হয় না। উল্টো যে পশ্চিমাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আমরা খুশি হই তারাই তাকে বারবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, কিন্তু তিনি যেতে পারেননি তার দেশের আমলাতন্ত্র আর ঈর্ষান্বিত সহকর্মীদের জন্য। আমেরিকা কিংবা ইউরোপের আগেই স্বল্প রসদে কালজয়ী গবেষণাও যে সম্ভব সেটা অনেকেই মানতে পারেন না। দেরিতে হলেও ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন, এটাই স্বান্তনা। শুধু নিজের সাফল্যটা উপভোগ করার ভাগ্য তার হয়নি, তার আগেই অভিমান করে চলে গিয়েছেন সব কিছুর উর্ধ্বে।