Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি: একজন রাজনীতির বিজ্ঞানী

“It is better to be feared than loved, if you cannot be both.”
– Nicolo Machiavelli

রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করবেন দেশ ও দশের জন্য। তাদের প্রতিটি কাজ হবে নীতি-নৈতিকতার দৃষ্টান্ত। এমনটাই তো হওয়া উচিৎ। কিন্তু নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি তা মানতে নারাজ। তিনি বলেছেন, “রাজনীতিতে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই!” হ্যাঁ, ইতালির রেনেসাঁর সময়ের এই কূটনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, মানবতাবাদী, লেখক এবং দার্শনিক বিশ্বাস করতেন, রাজনীতিতে নৈতিকতা বলতে কিছু নেই। কিন্তু তাই বলে তিনি কি অনৈতিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির পক্ষপাতী ছিলেন? অবশ্যই না! তবে নৈতিকতার স্থান না রেখেই কীভাবে তিনি রাজনীতিকে জনকল্যাণমুখী করার দর্শন লিখে গেছেন তার অমর গ্রন্থ ‘দ্য প্রিন্স’-এ, সে ব্যাপারে জানতে যেতে হবে একটু গভীরে। জানতে হবে তার জীবন, মতাদর্শ ও দর্শনের খুঁটিনাটি।

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (১৪৫৯-১৫২৭ খ্রিস্টাব্দ); source: biography.com

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি ১৪৫৯ সালের ৩ মে ইতালির ফ্লোরেন্সে এক অ্যাটর্নির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময়টা ইতালিতে এক টালমাটাল অবস্থা চলছিল। ঘনঘন সরকার পরিবর্তন, পোপদের সাথে সাধারণ জনগণের ক্ষোভ আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে ইতালির অবস্থা তখন বেশ নাজুক। এমন পরিস্থিতিতে জন্ম নেয়া ম্যাকিয়াভেলি স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে বেড়ে ওঠেন। তিনি ল্যাটিন ব্যাকরণ এবং ক্লাসিক ও অলংকারশাস্ত্র (রেটরিক) পড়ালেখা করেন। ফ্লোরেন্স তখনকার সময়ের গ্রীক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হলেও তিনি গ্রীক পড়েছিলেন কিনা, তা নিয়ে ইতিহাসবিদগণের মাঝে রয়েছে বিতর্ক। ১৪৯৪ সালে ইতালিতে ষাট বছরের ‘হাউজ অব মেডিসি’র শাসনের অবসান ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র পুনরায় চালু হয়। এর চার বছর পরই ২৯ বছর বয়সী ম্যাকিয়াভেলি ফ্লোরেন্সের সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি প্রাথমিকভাবে ‘লিবার্টি অ্যান্ড পিস’ এর সেক্রেটারি হিসেবে কাজ শুরু করলেও কিছুকাল পর সামরিক ও পররাষ্ট্র বিভাগের একজন কার্যনির্বাহী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৫০২ সালে তিনি ম্যারিয়েট্টা করসিনি নাম্নী এক রমণীকে বিয়ে করেন।

সিভিল সার্ভিসই মূলত ম্যাকিয়াভেলিকে একজন দার্শনিকে পরিণত করে। তিনি তার ১৪ বছরের সরকারি কর্মজীবনে ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে বহু কূটনৈতিক মিশনে গিয়েছেন এবং দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। এসব কূটনৈতিক মিশনের বাস্তব অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে তার দর্শনে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে সামরিক বাহিনীর কার্যনির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন তিনি সামরিক বাহিনীর সাথে অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়েন। ১৫০৬ সালের কুখ্যাত ‘সামরিক অধ্যাদেশ’ এর জন্য ম্যাকিয়াভেলিকেই দায়ী করা হয়। তাছাড়া, দায়িত্ব পালনকালে ম্যাকিয়াভেলি নয়টি অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনী একরকম নিজ প্রচেষ্টায় গঠন করেন। ১৫১২ সালে যখন নানামুখী চাপে ফ্লোরেন্টাইন সরকারের অবস্থা টালমাটাল এবং চারদিকে যখন মেডিসি বংশের ক্ষমতা পুনর্দখলের রব উঠেছে, তখন ম্যাকিয়াভেলি আক্রমণ প্রতিহত করতে ১২ হাজার সৈন্য প্রস্তুত করেন। কিন্তু তার সদ্য গঠন করা আনকোরা সেনাবাহিনী তাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ ও দক্ষ মেডিসি সমর্থক বাহিনীর সাথে পারবে কেন?

ফলে যা হবার তা-ই হলো। রিপাবলিকানরা পরাজিত হলো আর মেডিসিরা পুনরায় ক্ষমতায় বসলো। ম্যাকিয়াভেলিকে প্রাথমিকভাবে বন্দী করা হলো। বেশিদিন বন্দী না রাখলেও মেডিসিরা ম্যাকিয়াভেলির উপর যথেষ্ট অত্যাচার চালায়। জেল থেকে মুক্তি দিলেও ফ্লোরেন্স থেকে নির্বাসিত করা হয় তাকে। তিনি চলে যান স্যান্ট আন্দ্রিয়া শহরে। সেখানে পরিবারের সাথে ১৩ বছর অরাজনৈতিক জীবন কাটানোর পর ১৫২৫ সালে মেডিসিরা ম্যাকিয়াভেলিকে সরকারে যোগদান করার আহ্বান জানায়। ম্যাকিয়াভেলি সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফ্লোরেন্সে ফিরে গিয়ে সরকারি কাজে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যই বটে, ম্যাকিয়াভেলি চাকরিতে যোগ দেবার মাত্র দু’বছরের মাথায় মেডিসিরা ক্ষমতা হারায়। এবার রিপাবলিকানরা এসে আজীবন রিপাবলিকান রাজনীতি করা ম্যাকিয়াভেলিকে চাকরিচ্যুত করে। সে বছরই, অর্থাৎ ১৫২৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন ম্যাকিয়াভেলি। চার্চে পূর্ণ মর্যাদায় তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। ‘চার্চ অব ক্রস’-এ তাকে সমাহিত করা হয়। সমাধিতে তার সম্মানস্বরূপ ল্যাটিন ভাষায় খোদাই করা আছে, “কোনো প্রশংসাই এই মহান ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট নয়!”

ম্যাকিয়াভেলির সমাধিতে ল্যাটিন ভাষায় প্রশংসাসূচক এই বাক্যটি লেখা আছে; source: commons.wikimedia.org

ভালো পিতা ও স্বামী হবার পাশাপাশি ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন একজন কঠোর সত্যনিষ্ঠ ও কর্তব্যপরায়ণ মানুষ। তিনি মনেপ্রাণে রিপাবলিকান হলেও ফ্লোরেন্সের উন্নতিই তার মূলনীতি ছিল। অন্যদিকে তিনি একজন চমৎকার সাহিত্যিক ছিলেন এবং তার গদ্য লেখার হাত ছিল জাদুকরি। ‘ম্যানড্রাগোলা’ তার বিখ্যাত ব্যাঙ্গাত্মক নাটক। অন্যদিকে, প্রায়োগিক অর্থে তিনি একজন দার্শনিকও নন। তার কোনো ট্রিটিই মানুষ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে ব্যাখ্যায় উদ্ভাসিত নয়। তবে তার লেখায় বিদ্যমান পদ্ধতিগত বিশ্লেষণের সমন্বয় যেকোনো পাঠকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে বাধ্য। তিনি মূলত একটি সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক পদ্ধতির অবতারণা করতে চেয়েছিলেন। তিনি রাজনীতিকে একেবারে ভিন্নরূপে দেখেছেন এবং কীভাবে ক্ষমতায় আরোহণ ও ক্ষমতায় থেকে সমাজের উপকার করা যায় সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।

ম্যাকিয়াভেলির দর্শন কাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত, সে বিষয়ে ইতিহাসবিদরা অনুমান করেন যে তিনি মূল ধারার দার্শনিকদের চেয়ে বরং ক্লাসিক্যাল লেখকদের লেখায় বেশি প্রভাবিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে লিভি, প্লুটার্ক, ট্যাকিটাস, জেনোফোন, পলিবিয়াসের নাম চলে আসে সবার আগে। তাছাড়াও তিনি প্রভাবিত হয়েছেন অ্যারিস্টটল, প্লেটো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, সিসেরো প্রভৃতি দার্শনিকের দর্শন দ্বারা। অন্যদিকে তার রাজনৈতিক কর্মজীবন তার কাজকে প্রভাবিত করেছে এটা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি রাজনৈতিক সাফল্যকে পন্থার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিতেন। দ্য প্রিন্স ও ডিসকোর্সেসে তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সমাজের ভালোর জন্য সাফল্য খুঁজে পেতে যেকোনো পন্থা অবলম্বনে উৎসাহিত করেছেন। আর তার এই দর্শনের পেছনে রয়েছে মানুষের প্রকৃতি সম্বন্ধে তার তীক্ষ্ণ ও সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পর্যবেক্ষণ। তিনি মানুষকে দেখেছেন চিরন্তন অপরিবর্তনীয় চরিত্র হিসেবে। মানুষের  মধ্যে লোভ, স্বার্থপরতা, প্রতারণা- এসব বৈশিষ্ট্যকে ম্যাকিয়াভেলি দেখেছেন সহজাত বৈশিষ্ট্য হিসেবে। বরং তার মতে, মানুষের এই নেতিবাচক স্বভাবগুলো সর্বদা তাদের ভালো কাজের উদ্যমকে দমিয়ে রাখে না। এই নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলোকেই যদি যথাযথরূপে পরিচালিত করা যায়, তাহলে বরং সামাজিক উন্নয়নের পথ আরো সহজ হয়ে ওঠে!

গ্রীক দার্শনিক, ইতিহাসবিদ পলিবিয়াস; source: haikudeck.com

মানুষের সহজাত স্বভাব কী? ম্যাকিয়াভেলিকে এই প্রশ্ন করলে তিনি বলবেন- অসীম চাওয়া, আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা আর অদূরদর্শিতা। ফলে, ম্যাকিয়াভেলির ‘মানুষ’ সামাজিকভাবে খুবই বেমানান মনে হতে পারে। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, মানুষের এই নেতিবাচক কিন্তু সহজাত বৈশিষ্ট্যগুলোকেই যদি সঠিক পথে পরিচালিত করা যায়, তাহলে তা সামষ্টিক কল্যাণে কাজে লাগবে। সেজন্য চাই একজন প্রজ্ঞাবান নেতা, যিনি মানুষের স্বার্থপরতা আর আত্মকেন্দ্রিকতাকেই কাজে লাগিয়ে সামাজিক সহযোগিতা গড়ে তুলবেন। একজন যথার্থ নেতার নিকট মানুষের শঠতা হচ্ছে কাঁচামালের মতো, যা তিনি যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবহারযোগ্য পণ্যে রূপান্তর করবেন। অন্যদিকে সমাজকে ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন মানুষের সবচেয়ে বড় বিদ্যালয়। সমাজের যে কাঠামোতে মানুষ বেড়ে ওঠে, সে কাঠামো মানুষকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করে। তবে কোনো মানুষই পুরোপুরি সামাজিক নয়, আবার একদম প্রাকৃতিকও নয়।

ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স; source: Amazon.com

রাজনৈতিক দার্শনিকগণ সর্বদাই রাজনীতিবিদদের নৈতিক বোধ উন্নত করার প্রতি জোর দিয়ে থাকেন। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, রাজনীতিবিদদের নৈতিকতা বলতে কিছু থাকার প্রয়োজন নেই। বরং তাদের প্রধান কাজ হবে তাদের সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ঠিক রাখা এবং জনকল্যাণমূলক কাজ করা। এই কল্যাণ সাধনে একজন রাজনীতিবিদের যদি কোনো অনৈতিক পন্থাও অবলম্বন করতে হয়, তা-ও তিনি করবেন তার জনগণের ভালোর জন্য। কেননা, ম্যাকিয়াভেলির নিকট পন্থার চেয়ে ফলাফল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের ব্যক্তিগত নৈতিকতা তার দেশের ‘অনৈতিক’ উপায়ে নিশ্চিত করা নিরাপত্তার উপরই নির্ভর করে। তাই বলে এই নয় যে ম্যাকিয়াভেলি মানুষের নৈতিকতার কোনো মূল্য দিচ্ছেন না। তিনি বরং নৈতিকতাকে প্রথাগতভাবে না দেখে সামাজিক কাঠামোর ছাঁচে ফেলে দেখার চেষ্টা করেছেন। একজন ব্যক্তি, যার বাড়ি-গাড়ি আছে, তার দৃষ্টিতে মসজিদে জুতা চুরি একটি জঘন্য অপরাধ। কারণ একজোড়া জুতা তার নিকট প্রায় মূল্যহীন। কিন্তু তিনি নিজ ক্ষেত্রে হয়তো আরো অনেক বড় দুর্নীতি করছেন, যা নিয়ে নৈতিক-অনৈতিক সাতপাঁচ ভাবার সময় তিনি পান না। অন্যদিকে সেই চোরের কাছেও একইভাবে এই জুতা চুরি খুবই সামান্য ব্যাপার। কারণ সে জানে, সমাজের উপর মহলে অনেক বড় বড় চুরি সংঘটিত হচ্ছে। ম্যাকিয়াভেলি নিজেও একজন কঠোর নীতিবান মানুষ ছিলেন। তিনি আমৃত্যু বিশ্বাসী খ্রিস্টান ছিলেন, কিন্তু চার্চকে তিনি কড়া ভাষায় সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তার এই সমালোচনা অবশ্যই ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত ছিল না, বরং চার্চের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিল। তার মতে, অনৈতিক পন্থায় কেবল তখন যেতে হবে, যখন তা সামষ্টিক ভালোর জন্য প্রয়োজন।

ক্লাসিক্যাল দার্শনিকেরা মনে করতেন, দ্বন্দ্ব হচ্ছে সমাজসৃষ্ট এবং তা কোনোরূপেই প্রাকৃতিক হতে পারে না। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে গিয়ে দাবি করেন যে দ্বন্দ্বই হচ্ছে একটি সমাজের সার্বজনীন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই দ্বন্দ্ব চিরন্তন, যা সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ আর শ্রমজীবী নিচুতলার মানুষের মধ্যে চলে এসেছে। আর এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ হিসেবে ম্যাকিয়াভেলি মার্ক্সের মতো অর্থনীতিকে বেছে নেননি। তার মতে, দ্বন্দ্বের মূল কারণ হচ্ছে ক্ষমতার মোহ। সভ্যতার শুরু থেকে সিংহভাগ মানুষই নতি স্বীকারের বিনিময়ে নিজেদের ও নিজেদের সম্পত্তির নিরাপত্তা খোঁজে। অন্যদিকে মুষ্টিমেয় মানুষ তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাসন করে আর ভোগ করে অসীম ক্ষমতা। ‘ন্যাচার অব ম্যান’ এর লেখক গ্রীক দার্শনিক পলিবাসের দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে ম্যাকিয়াভেলি দ্বন্দ্বকে সমাজের অগ্রসরতার জন্য উপকারী বলে মনে করেন। এক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলি রিপাবলিকান রোমের উদাহরণ টেনে স্বাস্থকর দ্বন্দ্বের ব্যাখ্যা করেন। অন্যদিকে তার ‘হিস্টোরি অব ফ্লোরেন্স’ বইয়ে ফ্লোরেন্সকে আখ্যা দেন দুর্নীতির রাষ্ট্র হিসেবে।

ডিসকোর্সেস; source: Amazon UK

ম্যাকিয়াভেলির মতে, মানুষের স্বাভাবিক হীন চরিত্রকে ‘সামষ্টিক ভালো’তে পরিণত করার সবচেয়ে ভালো হাতিয়ার হচ্ছে রাষ্ট্র। দ্য প্রিন্স এবং ডিসকোর্সেসে তিনি শাসকের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের দু’রকম শ্রেণীবিভাগ করেছেন: রাজতন্ত্র এবং প্রজাতন্ত্র। রাজতন্ত্র আবার নানারকম হতে পারে। যেমন- সীমাবদ্ধ (ফ্রান্সে ১৮ শতকের শেষ ভাগে), সার্বভৌম (তুরস্ক) কিংবা স্বৈরাচারী (প্রাচীন সিরাকিউজ)। প্রজাতন্ত্র আবার ভারসাম্যপূর্ণ (রোম) কিংবা সার্বজনীন (এথেন্স) হতে পারে। ভারসাম্যপূর্ণ প্রজাতন্ত্রকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে: অভিজাত (ভেনিস) এবং গণতন্ত্র (রোম)। তবে এ দুয়ের মধ্যে ম্যাকিয়াভেলি খুঁজে পেয়েছেন আরো দুটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থা, রাজ্যশাসন বা কয়েকজন নির্দিষ্ট উঁচু স্তরের লোক দ্বারা দেশ শাসন এবং গণভোটীয় রাজতন্ত্র। এর বাইরেও ক্ষমতা দখলের পদ্ধতির ভিত্তিতে ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন: রাজ্যসীমানা বৃদ্ধিপ্রবণ রাষ্ট্র (রোম), বহিঃআক্রমণ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে সংরক্ষণশীল রাষ্ট্র (স্পার্টা), দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র (ফ্লোরেন্স) এবং নৈতিক রাষ্ট্র (রোমান রিপাবলিক)।

আর্ট অব ওয়ার; source: Amazon.ca

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি সামরিক সক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে একটি সফল সরকারের অবশ্যই একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি নাগরিককে অপর নাগরিকের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর। তার মতে, সে রাষ্ট্রই সফল যার নাগরিকগণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে তাদের প্রতি কোনো অন্যায় হতে পারে না কিংবা হলেও তারা তার সঠিক বিচার পাবে। ম্যাকিয়াভেলি তার ‘আর্ট অব ওয়ার’ বইয়ে কীরকম সামরিক ব্যবস্থাকে আদর্শ মনে করেন তার একটি পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন। তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে একরকম যুদ্ধশাস্ত্রের সাথেই তুলনা করেছেন। তিনি নিজে রাজনীতিতে জড়িত থাকাকালীন একজন সামরিক কর্মকর্তার মতোই বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেছেন এবং ভেবেছেন। তার এই রাজনৈতিক মতাদর্শ খুব স্বাভাবিকভাবেই সামরিক ভাবাদর্শে প্রভাবিত। সামরিক বাহিনীর মধ্যে যে শৃঙ্খলা বিদ্যমান, তা-ই তিনি রাজনীতিতে আনয়ন করতে চাইতেন। তিনি মনে করতেন, রাজনীতির অধিকাংশ দিকই হচ্ছে ষড়যন্ত্রমূলক, যা সামরিক কায়দায় সর্বোচ্চ গোপনীয়তা এবং প্রস্তুতির সাথে সমাধান করতে হবে। এসব বিষয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ম্যাকিয়াভেলি ‘জেনারেল থিওরি অব কন্সপিরেসি’ রচনা করেছেন, এক্ষেত্রে কোনো সামরিক তাত্ত্বিকের বাইরে প্রথম ব্যক্তি তিনিই।

ম্যাকিয়াভেলি শুধু রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিক উপায়ে সমাধান করেই দমে যাননি, তিনি রাজনৈতিক আর সামরিক নেতার মধ্যেও সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। একজন সামরিক নেতা যেভাবে তার সৈন্যদেরকে প্রশিক্ষণ দেন, শৃঙ্খলিত করেন, যুদ্ধক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিচালিত করার মতো সৃজনশীল কাজ করেন, একজন রাজনৈতিক নেতাও একইরূপে দেশ পরিচালনা করেন। অন্যদিকে, তার মতে, একটি দেশের বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হয় দুটি উপায়ে- হয় কূটনীতি, নয় যুদ্ধ। ম্যাকিয়াভেলির মতে, কূটনৈতিক সক্ষমতা যত বেশিই হোক না কেন, যুদ্ধ আবশ্যক এবং অনিবার্য। কারণ মানুষের অন্তর্নিহিত প্রকৃতিতে রয়েছে দ্বন্দ্ব এবং দ্বন্দ্ব যুদ্ধ ডেকে আনবেই। সেক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলির পরামর্শ হচ্ছে যখন অবস্থা শান্তিপূর্ণ, তখনই একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করে রাখতে হবে। কারণ, আজ অথবা কাল, যুদ্ধ আসবেই।

ম্যাকিয়াভেলির মূল রাজনৈতিক দর্শন; source: 21st Century Wire

ম্যাকিয়াভেলির প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তার খ্যাতির চেয়ে কুখ্যাতি, আর আলোচনার চেয়ে সমালোচনা হয়েছে বেশি। তার পরিচিতির প্রায় পুরোটাই তার অমর কীর্তি ‘দ্য প্রিন্স’ এর জন্য। আবার তার সমালোচনার অধিকাংশই তার রাজনৈতিক ফায়দা বিষয়ক তত্ত্বের জন্য। যে তত্ত্বে তিনি বলেছেন, সামষ্টিক ভালোর জন্য কোনো কাজ করতে গেলে নৈতিক-অনৈতিক বিবেচনার প্রয়োজন নেই। তথাপি পশ্চিমা রাজনৈতিক দার্শনিকদের মধ্যে তার অবস্থান একেবারে উপরের দিকে রাখতে সকলেই বাধ্য। তবে সাম্প্রতিককালে তাকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করা হয়েছে। তাকে বলা হচ্ছে একজন ‘রাজনীতির বিজ্ঞানী’! আবার অনেকেই তাকে প্রথম উদারনৈতিক কিংবা প্রগতিশীল রাজনৈতিক দার্শনিকও বলছেন। তার আরেকটি বড় সাফল্য হচ্ছে তার সামরিক দর্শন। তবে সাম্প্রতিককালে, কী রাজনৈতিক দর্শন, কী সামরিক ভাবনা, উভয় ক্ষেত্রেই ম্যাকিয়াভেলিকে বলা হচ্ছে অতুলনীয়। তিনি কখনোই তার দর্শনে আদর্শের উপরে অনৈতিকতার স্থান দেননি। তার জন্য একটি আদর্শ শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনই ছিল প্রধান লক্ষ্য। তার রাজনৈতিক ও সামরিক মতাদর্শ পড়লেই বরং আমরা বুঝতে পারি আজকের সময়ে তার মতাদর্শ কতটা জরুরি। কেউই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়, ম্যাকিয়াভেলিও নন। কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তাবিদ কিংবা দার্শনিক হিসেবে তিনি অনুপম তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ফিচার ছবিঃ Prezi

Related Articles