রাধাবিনোদ পালকে কয়জন বাংলাদেশি চেনেন? দেশে তো আরো হাজার হাজার বিচারক আছে, আগেও ছিলেন, ভবিষ্যতেও হবেন। তাকে মনে রাখার কী আছে? নিজ দেশে ভিখ না পাওয়া এই যোগী আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত। ২০০৭ সালে জাপানের প্রধান মন্ত্রী শিঞ্জো আবে এসেছিলেন ভারত সফরে। পার্লামেন্টে বক্তব্য রাখার সময় তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছিলেন রাধাবিনোদ পালকে। স্বয়ং কলকাতায় রাধাবিনোদ পালের বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করে এসেছেন তার ৮০ বছরের পুত্রের সাথে।
‘টোকিয়ো ট্রায়াল’ নামের নেটফ্লিক্সের মিনিসিরিজের বদৌলতে ‘রাধাবিনোদ পাল’ নামটা হারিয়ে যেতে যেতেও যায়নি। এখানে রাধাবিনোদ পালের ভূমিকায় অভিনয় করছেন ইরফান খান।
কে এই রাধাবিনোদ পাল?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাপান আত্মসমর্পণ করলো। অক্ষশক্তির এই পরাজয়ের ইতিহাস মিত্রশক্তিই দ্বারা লিখত। আমরা জানি, ইতিহাস সর্বদা বিজয়ীর হাতে লেখা হয়। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মতোই শুরু হয়ে গেল টোকিয়ো ট্রায়াল। মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক ডগলাস ম্যাক তার উপর অর্পিত ক্ষমতার প্রয়োগ করে দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। জাপানের যেসকল সামরিক নেতা জাপানের সমরবাদের উত্থানের সাথে জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করা করা হয়।
এই বিচারে সাতজন শীর্ষস্থানীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড, ১৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দুই জনকে যথাক্রমে ২০ ও সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ট্রাইব্যুনালের ১১ জন বিচারেকের একজন ছিলেন রাধাবিনোদ পাল। বাকি ১০ জন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও ফিলিপাইনের ছিলেন।
রাধাবিনোদ পালকে রাখার প্রধান দুটো কারণ ছিল। প্রথমত, তিনি উপমহাদেশের একজন বিজ্ঞ ও নামকরা বিচারক ছিলেন তখনকার দিনে। মিত্রশক্তির এই ট্রাইব্যুনালে অনুন্নত এশিয়ার একজন বাঙালী বিচারককে রেখে বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা দাবী করা সহজ হতো। দ্বিতীয়ত, উন্নত বিশ্বের নীতিনির্ধারকেরা ভাবতে পারেনি রাধাবিনোদ সজ্ঞানে তাদের মতামতের বিরুদ্ধে যেতে পারেন। কিন্তু নিরীহ ভেবে বসা এই বাঙালীর তেজস্বীতা বুঝতে তাদের দেরি হয়নি।
রাধাবিনোদ পালের জন্ম ১৮৭৬ সালে, কুষ্টিয়া জেলার সলিমপুর গ্রামে। ছেলেবেলা থেকেই তিনি বিভিন্ন পরীক্ষায় মেধার প্রমাণ রাখেন। ১৯০৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। পড়বেন গণিতশাস্ত্র নিয়ে। ১৯০৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এরপর কিছুদিন এলাহাবাদে গিয়ে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিসে কেরানীর চাকরি করেছিলেন। বিএল ডিগ্রী পাওয়ার পর চাকরি নিলেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। গণিতের শিক্ষকতা করার পাশাপাশি ময়মনসিংহ কোর্টে ওকালতির চর্চাও চলছিল সমান তালে।
১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে এলএলএম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন। এবার পালা উচ্চস্তরের আইন চর্চার। শিক্ষকতা ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে সেখানকার হাইকোর্টে আইনব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। আইনচর্চার তুলনায় রাধাবিনোদ পালকে বোধহয় বেশি টানত বিশ্লেষণ। তিনি চেয়েছিলেন আইন বিশারদ হতে। আইন তার কাছে শুধু পেশা ছিল না। তাহলে হাইকোর্টে আইন চর্চার সুযোগ পেয়েই থেমে যেতেন। ১৯২৪ সালে আইনে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করলেন তিনি। যারা বলছিল, আইন চর্চার সুযোগ পেয়ে শিক্ষকতার মহান ব্রতকে ছেড়ে গেলেন রাধাবিনোদ, তাদের মুখে ছাই দিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ল কলেজে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত আইনের অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি।
রাধাবিনোদ পাল আন্তর্জাতিক আইন সংস্থাগুলোর সদস্যপদ লাভ করেন। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক দিক নয়, তার ন্যায় বিচারের সুখ্যাতিও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। তখনও ভারতে ইংরেজ শাসন চলছে। তার মাঝেই ১৯৪১ সালে তিনি ভারত সরকারের আইন উপদেষ্টা, তারপর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এরপর ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন। তখন ১৯৪৬ সাল, কাজের চাপ কি নুইয়ে ফেলেছিল রাধাবিনোদ পালকে? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। ফিরে এলেন বাংলাদেশে, শেকড়ের তরে। সলিমপুরের মাটির ঘ্রাণেই বাকিটা জীবন শান্তিতে কাটাতে চান। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম।
দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল তাকে বিচারক হিসেবে চাইছে। সেখানে ১১ জনের একজন হয়ে যাবেন তিনি। আন্তর্জাতিক অপরাধের ন্যায় বিচার করবেন। কিন্তু টোকিও পৌঁছে তার ভুল ভাঙল। তাকে মেধাবী যোগ্য বিচারক হিসেবে এখানে আনা হয়নি। বরং অবহেলিত দেশের ক্ষুদ্র প্রতিনিধি হিসেবে বিচারকদের প্যানেলে একটা সমতা রক্ষার জন্য আনা হয়েছে। সেখানে রাধাবিনোদ কী মতামত দেন তা কারোর কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল আলাদা একটি হোটেলে। বাকি ১০ জনের জন্য ছিল ভিন্ন ব্যবস্থা।
বিচারের সময় চলে এলে রাধাবিনোদ ভিন্ন মত পোষণ করলেন। জাপান যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধচলাকালে যে কম অপরাধ ঘটায়নি তা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু দোষ শুধু জাপানের একার ছিল না। নাগাসাকি, হিরোশিমাতে বোমাবাজি করে মানবতার অপমান না করলেও জাপান আত্মসমর্পণ করতো। এইসব যুদ্ধাপরাধের জন্য, হাজার হাজার নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য এই শক্তিশালী দেশগুলোরও তাহলে শাস্তি পাওনা আছে। তার এই কথায় ফুঁসে উঠল প্যানেল। তাদের ধারণা, ভারতীয় উপমহাদেশে পাশ্চাত্যের আগ্রাসন বিরোধী এই বাঙালি নিতান্তই মিত্রশক্তি বিদ্বেষী।
অভিযোগগুলোর তিনটি ভাগ ছিল- এ, বি ও সি। এ শ্রেণীর অভিযোগ ছিল শান্তিবিরোধী অপরাধ। বি আর সি শ্রেণীতে ছিল প্রচলিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। রাধাবিনোদ পাল ট্রাইব্যুনালকে মনে করিয়ে দিলেন এ এবং সি শ্রেণীর অভিযোগ কার্যকর হবে না। কারণ জাপান যখন যুদ্ধে যায় তখনও আন্তর্জাতিক আইনে এমন কোনো আইন অন্তর্ভুক্ত ছিল না, যদি আইনই না থাকে, তাহলে জাপান আইন কিভাবে ভাঙল? পুরো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে রাধাবিনোদ লিখলেন তার ঐতিহাসিক রায়। যার কিয়দংশ প্রকাশিত হয়েছে।
ধারণা করা হয়, এই রায় ছিল ১,২৩৫ পৃষ্ঠার। তিনি লিখেছিলেন জাপান তার অধিকৃত ভূমিতে যা করেছে তা ন্যাক্কারজনক, কিন্তু যে লোকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ যোগাড় করতে পারেনি ট্রাইব্যুনাল। তিনি তার রায়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন, অভিযুক্তদের করা অপরাধ যুক্তরাষ্ট্রের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে করা অপরাধের চেয়েও বেশি ঘৃণ্য কিনা। যুদ্ধচলাকালে ব্রিটিশ ও আমেরিকান বিমানবাহিনী শত্রুদেশের সাধারণ নাগরিকদের সর্বোচ্চ মৃত্যু নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কারে ব্যস্ত ছিল।
রাধাবিনোদ জাপানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বলে ভাববার অবসর নেই জাপান যা করেছিল, তিনি তার পক্ষে ছিলেন। বর্তমান সময়ে, জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিজের আগ্রাসী ভূমিকা লুকাতে রাধাবিনোদ পালের রায়কে ব্যবহার করে। তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এই ঘটনায় খুশি হতেন না। ১৯৫২ সালে হিরোশিমায় এক বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি বলেন, “ জাপান যদি আবারো সমরবাদের উত্থান চায়, তবে তা হবে, এইখানে, এই হিরোশিমায় শায়িত নিরীহ মানুষদের আত্মার প্রতি চরম অসম্মান।”
তার রায় এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, ফরাসী আর ডাচ বিচারকেরা তা থেকে প্রভাবিত হয়ে কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থানে সরে আসেন। তবে মিত্রশক্তির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তারা নিজেদের রায়ে জাপানি অফিসারদের শাস্তি চাইতে ভোলেননি। রাধাবিনোদ পালের মূল রায়টির কিছু অংশ অনেক বছর পর জাপান সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয় এই শর্তে যে, তারা ট্রাইব্যুনালের রায় মেনে নেবে।
বিচারকার্য শেষ হতে হতে ১৯৪৮ সাল চলে এল। ভারত তখন আর কারো উপনিবেশ নয়। রাধাবিনোদ পালও তখন ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্ত একজন মানুষ। ট্রাইব্যুনালের আশা ছিল দরিদ্র উপনিবেশের বাসিন্দা হয়তো কোনোরকম উচ্চবাচ্চ্য ছাড়াই বাকিদের রায়ের অনুরূপ রায় দেবে। কিন্তু তার রায় দেখে মুখ বাঁকিয়ে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, “ওসব নিরপেক্ষতা একজন পরাধীন মানুষের শক্তিশালী দেশের সাথে ঈর্ষা ছাড়া কিছু নয়”।
স্বাধীন দেশে ফিরে এলেন রাধাবিনোদ। তার দেশেও তখন চলছে স্বাধীনতা উত্তর অরাজকতা। তার অবসর নেওয়া আর হয়ে উঠল না। ১৯৫৮ সালে জাতিসংঘের আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। জাপানেও গিয়েছেন বেশ কয়েকবার। ১৯৬৬ সালে জাপানের সম্রাট তাকে জাপানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতীয় সম্মান ‘প্রথম শ্রেণীর পবিত্র রত্ন’ তে ভূষিত করা করলেন। ১৯৬৭ সালে কলকাতার বাড়িতে চিরতরে অবসর গ্রহণ করেন রাধাবিনোদ পাল। তার সম্মানে ইয়াসুকুনি মঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে।
এই মহান বীর, যিনি অকুতোভয় কন্ঠে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে একা লড়ে গেছেন, তিনি নিজ জাতির কাছে পর্যাপ্ত সম্মানটুকু পাননি। কুষ্টিয়ায় তার ভিটেবাড়ি এখন অরক্ষিত। তার নাম উল্লেখ করা হয়নি কোনো পাঠ্যবইয়ে। যে ব্যক্তি শক্তিশালী দেশের সাথে সুসম্পর্কের প্রলোভন ভুলে নিজের মতো চলেছেন দিব্যি, আমাদের স্মৃতিতে তাকে ধরে রেখেছি কিনা এতটুকু নিয়ে অভিমান করার মতো তিনি নন নিশ্চয়ই। কিন্তু একজন বাঙালি হিসেবে, একজন বাংলাদেশি হিসেবে আপনি আমি তার মত মানুষগুলোকে মনে রাখার ছোট্ট দায়িত্বটার কতটুকু পালন করেছি?
ফিচার ইমেজ – Wikimedia Commons