চোখে কালো চশমা, স্কিনি ব্ল্যাক জিন্স, পায়ে ট্রেইনার বুট আর দাড়িতে নেই কোনো পাকার চিহ্ন। বলছি দ্য বিটলস ব্যান্ডের ড্রামার রিঙ্গো স্টারের কথা, এখনও যেন যৌবন আর সাবলীল আচরণে ভরপুর তিনি। কিছুদিন আগে চেলসিতে তার ৪৮ বছর বয়সী পুত্রের সাথে দেখা গেলে ৭৫ বছর বয়সী বাবা রিঙ্গোকে যেন তাঁর পুত্র জ্যাসন স্টারকির ভাই মনে হচ্ছিল। কোনো চেষ্টা ছাড়াই এই স্টাইলিশ ভূষণ তাকে আলাদা আর অসংখ্য ফ্যানের ভালবাসার পাত্র করে রেখেছে আজও। যদিও তিনি মিডিয়া বা সাক্ষাৎকার থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করেন।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
তার আসল নাম রিচার্ড স্টারকি। বিটলসের এই বিখ্যাত ড্রামার জুলাই ৭, ১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডের লিভারপুলে। তিনি তার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও অসাধারণ সঙ্গীত প্রতিভার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন খুব দ্রুতই। বিখ্যাত রক ব্যান্ড দ্য বিটলসের ড্রামার হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ গীতিকার এবং গায়কও বটে। ‘উইথ অ্যা লিটল হেল্প ফ্রম ফ্রেন্ডস’ তার গাওয়া গান এবং লিখেছিলেন আরেকটি গ্রুভী গান ‘অক্টোপাস গার্ডেন’। সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক, গীতিকার, এমনকি অভিনেতা রিঙ্গোর জীবনের শুরুটা খুব একটি সুখকর ছিল না। তাঁর মা তাকে অসম্ভব ভালবাসত, কিন্তু বাবার সংসার জীবনের প্রতি আগ্রহ ছিল না। রিঙ্গোর বয়স যখন মাত্র চার, তখনই তাঁর বাবা-মাকে আলাদা হয়ে যেতে হয়। পরবর্তীতে আর কখনও বাবা-ছেলের সাক্ষাত হয়নি বললেই চলে। তাঁর মা বহুদিন ‘ক্লিনিং ওম্যান’ এবং পরবর্তীতে ‘বারমেইড’ হিসেবে চাকরি করেন, একমাত্র পুত্র ও তার নিজের কোনোরকম ভরণপোষণ করার জন্য।
ছয় বছর বয়সে রিঙ্গোর জীবনে আসে আরেক দুঃসময়। প্রথমে অ্যাপেনডেক্টমিতে আক্রান্ত হয়ে পরে তা পেরিটোনিটিসে পরিণত হয়। বাধ্য হয়ে তাঁকে একটি স্থানীয় শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
দীর্ঘ ১২ মাস হাসপাতালে থাকার পর সুস্থ হলেও স্কুলের দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েছিলেন অনেক। তবুও একজন প্রাইভেট টিউটরের সাহায্যে পড়ালেখা চলিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। এটি তার জীবনের একটি অতি কষ্টময় অধ্যায়ও বলা যায়, কারণ পরবর্তী দুই বছর তাকে থাকতে হয়েছিল স্যানিটেরিয়ামে। আবার তাঁর সঙ্গীত জীবনে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তও ছিল এই সময়েই। স্যানিটেরিয়ামের স্টাফরা সবসময়ে চেষ্টা করতেন মনমরা অসুস্থ বাচ্চাদেরকে ব্যান্ড গঠনে উৎসাহিত করতে এবং এখানেই কিশোর রিঙ্গো প্রথম পরিচিত হন পারকিউশনের সাথে। একটি কাঠের ম্যালেট দিয়ে তাঁর বিছানার পাশের ক্যাবিনেটে ড্রামস্ট্রোকের মতো আঘাত করে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন কিশোর রিঙ্গো। তখন থেকেই তাঁর ড্রামসের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়।
১৯৫৩ সালে তাঁর মা আবার বিয়ে করেন। রিঙ্গোর সৎ বাবা প্রথম থেকেই তাকে মিউজিকের জন্য খুবই উৎসাহিত করেন। ১৯৫৫ সালে স্যানিটেরিয়াম থেকে ছাড়া পাবার পর বিভিন্ন চাকরি নেয়ার চেষ্টা করেন রিঙ্গো। স্কুলে ফেরত যাওয়া আর হলো না, কারণ দীর্ঘ তিন বছরের ব্যাধিতে পড়ালেখায় যে ব্যঘাত ঘটেছিল, সেটা পূরণ করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কোনো চাকরিই মনঃপুত হয়নি। কিন্তু ঘটনাক্রমে তাঁর একজন সহকর্মীর সাহায্যে পরিচিত হন স্কিফল মিউজিকের সাথে। স্কিফল একধরনের সঙ্গীত, যা বাজানো হয় ঘরে থাকা সরঞ্জামাদি দিয়ে (অর্থাৎ যেসব সঙ্গীতপ্রেমীর জন্য আসল বাদ্যযন্ত্র কেনা সামর্থ্যের বাইরে)। রিঙ্গো এ গ্রুপটির সাথে নিয়মিত বাজানো শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালের বড়দিনে রিঙ্গো তাঁর জীবনের প্রথম ড্রামকীট পান।
এর কয়েক বছর পরই তিনি একটি আসল ব্যান্ডে যুক্ত হন, ব্যান্ডটি ছিল ররি স্ট্রোম এবং দ্য হারিকেন্স এবং তখনই রিঙ্গো স্টার নামটি দিয়ে নিজের পরিচয় দেয়া শুরু করেন। তাঁর হাতের আংটিগুলোকে তিনি তাঁর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য মনে করতেন, যেগুলো এখনও তাকে বিশেষ আকর্ষণীয় ভঙ্গি এনে দেয়। এছাড়াও এই নাম দেয়ার আরেকটি কারণ ছিল কান্ট্রি এবং ওয়েস্টার্ন মিউজিকের প্রতি তাঁর অভাবনীয় আগ্রহ। তাঁর ড্রাম সোলোগুলোকে বলা হয় ‘স্টার ড্রাম’। এই ব্যান্ডটি ধীরে ধীরে পরিচিতি পেতে থাকে। হামবুর্গে একটি ট্যুরে গেলে একটি নতুন গ্রুপের সাথে তাদের প্রথম সাক্ষাত হয়, গ্রুপটির নাম ছিল দ্য বিটলস। বিটলসে তখন গ্রুপ মেম্বার ছিলেন জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি, জর্জ হ্যারিসন, স্টুয়ার্ট সুটক্লিফ এবং পিট বেস্ট। ১৯৬০ এর অক্টোবরে স্টার একটি ট্র্যাক ব্যাকিং হারিকেন্স গায়ক লু ওয়াটার্স, জন লেনন, পল ম্যাককার্টনী এবং জর্জ হ্যারিসনের সাথে বাজান।
দ্য বিটলস
১৯৬২ সালে রিঙ্গো স্টার অফিসিয়ালভাবে বিটলস ব্যান্ডে যোগ দেন। তাঁর ব্যান্ডে প্রবেশের কারণে পিট বেস্টকে ব্যান্ড ছাড়তে হয়। লিভারপুলের ক্যাভারন ক্লাবে তাঁদের প্রথম গিগের পর পিট বেস্টের ফ্যানবেজ তাঁকে নিয়ে তুমুল সমালোচনা করে, এমনকি স্টারের চোখে আঘাত করে তাকে আহত করে দেয়। পরবর্তীতে বিটলসের ফ্যানরা রিঙ্গোর বাজানো এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের কারণে একসময়ে তাঁকেও ভালবেসে ফেলে এবং তিনি বিটলসে নিয়মিত ও অতি গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হন।
তখন জর্জ মার্টিন ছিলেন বিটলসের প্রোডিউসার। তিনি ড্রামসবাদক হিসেবে রিঙ্গোর উপর ভরসা করতে পারছিলেন না। তাই প্রথমে তাঁকে ড্রামসের বদলে ট্যামবোরিন বাজানোর দায়িত্ব দেন। স্টার এসময়ে ভেবেছিলেন, তাঁকে ব্যান্ড থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু তাঁর ফ্যানবেজ বৃদ্ধি, গ্রুপের অন্য সবার সাথে সখ্যতা আর ড্রাম বাজানোতে অসাধারণ পারদর্শী হওয়ায় তাঁকে বাদ দেয়া আসলে সম্পূর্ণই অপ্রাসঙ্গিক ছিল। ১৯৬৩ সালে ‘প্লিজ, প্লিজ মি’ অ্যালবামটি পপজগতে সাড়া ফেলে দেয়। রিঙ্গো এই অ্যালবামের ‘বয়েজ’ গানটিতে লিড ভোকাল হিসেবে অংশ নেন। লেনন এবং ম্যাককার্টনি মূলত প্রশংসিত ছিলেন তাঁদের লিরিক লিখনীর প্রতিভার কারণে, অপরদিকে রিঙ্গোর শক্তিশালী ড্রামিং স্কিলের পরও তিনি ছিলেন বেশ আন্ডাররেটেড। তাছাড়া সম্পূর্ণ ব্যান্ডের সৃষ্টিশীলতা ধরে রাখাতে সবসময়ে তিনি ছিলেন এগিয়ে।
ব্যান্ড চালানোর ক্ষেত্রে গ্রুপে যেসব মতবিরোধ ঘটতো, রিঙ্গো তাঁর বিচক্ষণতা দিয়ে সেসব সমাধানের চেষ্টা করতেন। ১৯৬৬ সালের আগস্টে বিটলস ট্যুর করা থামিয়ে দেয়, স্যান ফ্র্যান্সিস্কোর ক্যান্ডেলস্টিক পার্কে তাঁদের শেষ শো করে। এরপর ১৯৬৮ সালে দ্য বিটলস (‘দ্য হোয়াইট অ্যালবাম’ নামে পরিচিত) এর ‘ডোন্ট পাস মি বাই’ ট্র্যাকটিতেও রিঙ্গো অংশগ্রহন করেছিলেন। একসময়ে ব্যান্ডের অন্য তিনজন সদস্য একসাথে কাজ করা শুরু করলে রিঙ্গোর নিজেকে একা মনে হতে থাকে। যখন তিনি লক্ষ্য করলেন একাধিকবার তাকে রেকর্ডিং সেশনে ডাকা হয়নি, তখন তিনি ব্যান্ড ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর সবার অনেক ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক টেলিগ্রামের পর তিনি আবার এলেও যে সুর কেটে গেছে তা আর জোড়া লাগেনি। ১৯৬৯ সালে জন লেনন ব্যান্ড ছাড়ার ঘোষণা দেন, কিন্তু তা আনুষ্ঠানিক ছিল না। ১৯৭০ সালে পল ম্যাককার্টনি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যান্ড ছাড়ার ঘোষণা দেন। এভাবেই ভেঙে যায় বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ব্যান্ডগুলোর একটি।
সোলো ক্যারিয়ার
বিটলস ভেঙে যাওয়ার পর রিঙ্গো তার সোলো ক্যারিয়ার শুরু করেন। প্রথম অ্যালবাম ‘সেন্টিমেন্টাল জার্নি’ (১৯৭০), যাতে ছিল টিন প্যান অ্যালি টিউনের কালেকশন। এরপর ১৯৭১ এ কান্ট্রি মিউজিক অ্যালবাম ‘ব্যুক্যু অফ ব্লুজ’ রিলিজ করেন। তিনি পরবর্তীতে জন লেনন, ইয়োকো ওনো এবং জর্জ হ্যারিসনের সাথেও কাজ করেছেন। হ্যারিসন এবং রিঙ্গো ‘ইট ডোন্ট কাম ইজি’ গানটি একসাথেই লিখেছিলেন ‘রিঙ্গো’ অ্যালবামটির জন্য। এই অ্যালবামটি বিলবোর্ডের ১ নম্বর হিট হয়েছিল এবং এটি ছিল তার বেস্টসেলিং সোলো রেকর্ড।
১৯৬৯ সালে ‘দ্য ম্যাজিক ক্রিশ্চিয়ান’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি পিট সেলারসের সাথে। রিঙ্গো অভিনীত আরও কিছু সিনেমা হলো ২০০ মোটেলস (১৯৭১), দ্যাট উইল বি দ্য ডে (১৯৭৩), সন অফ ড্রাকুলা (১৯৭৪) ও কেভম্যান (১৯৮০)।
সিনেমা পরিচালনার চেষ্টা করেছিলেন টি.রেক্স ব্যান্ড নিয়ে ‘বর্ন টু বুগি’ নামে একটি ডকুমেন্টারির জন্য। পরবর্তীতে নিজ রেকর্ড লেবেল প্রতিষ্ঠা করলেও প্রচুর মদ্যপান ও মাদক গ্রহণের কারণে তা চালিয়ে যেতে পারেননি। একসময় এই আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সোলো অ্যালবাম রিলিজ করলেও ব্যবসাসফল হয়নি বেশিরভাগই। অ্যালবামগুলোর মধ্যে আছে লিভারপুল ৮ (২০০৮), হোয়াই নট (২০১০), রিঙ্গো (২০১২) ও পোস্টকার্ডস এন্ড প্যারাডাইজ (২০১৫)।
২০১৩ সালে তিনি বিটলসের কিছু অপ্রকাশিত ছবি বের করে তার ফটোগ্রাফির প্রতিভাও প্রকার করেন। তিনি বলেছিলেন, এই ছবির অ্যালবামটি তার আত্মজীবনী লেখা হলে তার চাইতেও স্পষ্ট গল্প বহন করে।
ব্যক্তিগত জীবন
রিঙ্গো স্টার দুবার বিয়ে করেছিলেন। মরিন কক্সের সাথে ১৯৬৫-৭৫ পর্যন্ত একসাথে থাকাকালীন তাদের তিন সন্তানের জন্ম হয়- জ্যাক, জেসন এবং লি। জ্যাক তার বাবার মতোই সফল ড্রামার হয়ে দ্য হু এবং ওয়াসিস ব্যান্ডের জন্য বাজিয়েছেন। কক্স ১৯৯৪ সালে মৃত্যুশয্যায় গেলে স্টার তার পাশেই ছিলেন।
১৯৮১-তে বারবারা বাকের সাথে বিয়ের পর তারা একসাথে মদ্যপান ত্যাগ করেন এবং এখন পর্যন্ত একসাথেই আছেন। বিটলসের অন্যান্য সদস্যদের সাথে রিঙ্গোও ১৯৬৫ সালে এমবিই পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৮ সালে প্রিন্স উইলিয়াম তাকে নাইট সম্মানে ভূষিত করেন। রিঙ্গো বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এবং সফল ড্রামার, যার সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানেও টপ টেন ড্রামারের তালিকায় রয়েছে তাঁর নাম। অন্য সকল শিল্পীর জন্য তিনি অনুপ্রেরণা এবং একইসাথে ড্রামার হিসেবে অন্যতম জনপ্রিয়।
ফিচার ইমেজ- beatlesarchive.com