যক্ষ্মা; ভয়ংকর একটি শব্দ। প্রমিত চিকিৎসাব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এক ভয়ংকর শব্দ। শুধু শুধু রোগ বাঁধাতে কে চায়, বলুন! একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গেই যক্ষ্মার প্রতিষেধক প্রদান করার নিয়ম, এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত নির্ধারিত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। “যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই, এ কথাটির ভিত্তি নাই”, খুবই শ্রুতিমধুর এক প্রচারণা, যা এখনো বিদ্যমান। যক্ষ্মার জন্য ব্যবহৃত ওষুধটিকে চিকিৎসাশাস্ত্র আলাদা করে সরিয়ে রেখেছে, কেবলমাত্র যক্ষ্মাতেই যেন এর ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে যখন রোগের জীবাণুতত্ত্ব নতুন নতুন সমৃদ্ধ হয়ে উঠছিল, যক্ষ্মার কারণ হিসেবে কোনো জীবাণু দায়ী কি না, তা নিয়েই সন্দিহান ছিলেন চিকিৎসকেড়া। যক্ষ্মার জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া Mycobacterium tuberculosis অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার মতো প্রাণিদেহে বিচরণ করে না। শত বছর পূর্বে ঠিক এ কারণেই বারংবার ব্যাকটেরিয়াটি থেকে যাচ্ছিল গবেষকদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সকলেই হাল ছেড়ে দিলেও এর সুরাহা না করা পর্যন্ত সুস্থির হয়ে বসতে পারছিলেন না একজন রবার্ট কচ।
সেসময়ে অণুবীক্ষণযন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া দেখার জন্য এক বিশেষ ধরনের রঞ্জন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হতো। গবেষণায় কোনো কূল-কিনারা করতে না পেরে শেষতক রবার্ট কচ এ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেই সন্দিহান হয়ে ওঠেন, তাই যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়াকে খুঁজতে তিনি প্রণয়ন করেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রঞ্জন পদ্ধতি; যা বর্তমানে ব্যবহৃত প্রক্রিয়াটির ভিত্তিস্বরূপ। তিনি প্রমাণ করে দেখান যে, যক্ষ্মার জন্য দায়ী ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াটি হলো Mycobacterium tuberculosis। শুধু তা-ই নয়, সে সময়ে তিনি অ্যানথ্রাক্স, কলেরা নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেন। এই দু’টো রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াদ্বয়ও সফলভাবে চিহ্নিত করেন তিনি।
জার্মানির ক্লসথাল শহরে ১৮৪৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন রবার্ট কচ। তার বাবা স্থানীয় এক রূপার খনিতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই নিজে নিজে পত্রিকা পড়তে শিখে সকলকে তাক্ লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। স্থানীয় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা অবস্থাতেই তিনি টের পান যে, জীববিজ্ঞানের প্রতি তার মাঝে কাজ করছে আলাদা এক মোহ। সে মোহ থেকেই তিনি উচ্চতর পড়াশোনা করেন চিকিৎসাশাস্ত্রে।
ছাত্রাবস্থাতেই জরায়ুর স্নায়বিক কার্যক্রম গবেষণায় পুরষ্কৃত হয়ে সুযোগ ঘটে চিকিৎসাশাস্ত্রের আরেক মহারথী রুডলফ ভারশো’র সান্নিধ্যে আসবার। ১৮৬৬ সালে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে হ্যামবার্গের জেনেরাল হাসপাতালে সহকারী চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবনের শুরু করেন। পরবর্তী বছরেই রবার্ট কচ বিয়ে করেন, তার জীবনের প্রথম অণুবীক্ষণযন্ত্রটি ছিল সহধর্মিণীর দেওয়া উপহার।
বিভিন্ন স্থানে কিছুকাল চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, একইসাথে প্রস্তুতি নিতে থাকেন বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার নিয়োগের পরীক্ষার জন্য। উক্ত পরীক্ষায় পাশ করে ১৮৭০ সালে তিনি স্বেচ্ছায় তৎকালীন ফ্রাংকো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে যোগদান করেন একজন চিকিৎসক হিসেবে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি চলে আসেন বর্তমান পোল্যান্ডের উলস্টেইন শহরে, প্রায় আট বছর সেখানে তিনি বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে জীবাণুতত্ত্বটি তখনো বিজ্ঞানমহলে অনিশ্চিত ছিলো। রবার্টের অ্যানাটমি শিক্ষক জ্যাকব হেনলি সজোরে একটি রোগ সংক্রমণের কারণ হিসেবে জীবাণুর আক্রমণ রয়েছে বলে দাবি করে আসছিলেন। উলস্টেইন শহরে দায়িত্বরত অবস্থাতেই রবার্ট সিদ্ধান্ত নেন, তার শিক্ষকের এই মতবাদ খতিয়ে দেখা যাক্।
সেসময়ে শত শত গৃহপালিত পশু অ্যানথ্রাক্স নামক একটি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছিল। একই সময়ে এই রোগে শতাধিক মানুষের মৃত্যুও পর্যবেক্ষণ করেন রবার্ট। তিনি দেখতে পান যে, আক্রান্ত প্রাণির রক্তে একধরনের লম্বাটে জীবাণুর উপস্থিতি রয়েছে, যা সুস্থ মানুষের রক্তে সাধারণত থাকে না। পরীক্ষা করে দেখেন যে, অসুস্থ প্রাণির রক্ত সুস্থ প্রাণিতে প্রবেশ করানো হলে, সুস্থ প্রাণীটিও অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হচ্ছে।
তিনি একে একে ইঁদুর, খরগোশ, কুকুর, পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণীতে একই পরীক্ষা করে দেখতে পান, এরা প্রত্যেকে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে অল্প সময়ের মাঝেই মারা যাচ্ছে। এই প্রাণীগুলোর কয়েক প্রজন্মের মাঝেও পরীক্ষা করে একই ফল পান তিনি। প্রতিক্ষেত্রে জীবাণুটির দেখা পেলেও, তাদের দৈর্ঘ্যে ভিন্নতা দেখতে পেয়ে তিনি ধারণা করেন, জীবন্ত ব্যাকটেরিয়াগুলো ধীরে ধীরে লম্বাকার ধারণ করার মাধ্যমে বিভাজন প্রক্রিয়ায় প্রজনন সম্পন্ন করছে। কিন্তু তিনি ততদিনে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন, অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের জন্য প্রাণীর রক্তে এই লম্বাকৃতির জীবাণুর উপস্থিতি প্রয়োজন। তিনি যা বুঝতে পারেননি, তা হলো, আক্রান্ত প্রাণীর রক্ত কিছুদিন দেহের বাইরে রেখে দিলে, ব্যাকটেরিয়াগুলো সুস্থ প্রাণীকে সংক্রমণের শক্তি হারিয়ে ফেলে; কিন্তু একই ব্যাকটেরিয়া মাটির উপর বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে সক্ষম, সুস্থ প্রাণীকে সংক্রমণ করতেও সক্ষম।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই রবার্ট সিদ্ধান্ত নেন, তিনি প্রাণিদেহের বাইরে কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার আচরণ পর্যবেক্ষণ করবেন। এমন কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টির ধারণাটি আজও অণুজীববিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যবহৃত হয়। রবার্টের সৃষ্ট কৃত্রিম পরিবেশে তিনি দেখতে পান যে, ব্যাকটেরিয়াগুলো গোলাকার ধারণ করছে অল্প সময়ের মধ্যেই। এই গোলাকার ব্যাকটেরিয়াগুলো রক্ত বা উপযুক্ত পরিবেশে গিয়ে আবারো লম্বাটে ব্যাকটেরিয়ার জন্ম দিচ্ছে। এ থেকেই রবার্ট ধারণা করেন যে, প্রতিকূল পরিবেশে গিয়ে ব্যাকটেরিয়াগুলো স্পোর গঠন করছে, যা তাপ-চাপ কোনোকিছুতেই সংবেদনশীল নয়। অনুকূল পরিবেশ পেলেই স্পোর ভেঙে ব্যাকটেরিয়া বেরিয়ে আসছে এবং সংক্রমণশীল হয়ে উঠছে। আর এভাবেই স্পোর সৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে বছরের পর বছর ব্যাকটেরিয়াগুলো সংক্রমণশীল হয়ে অবস্থানে সক্ষম।
রোগের জীবাণুতত্ত্ব যখন অনিশ্চিতভাবে বিজ্ঞানীমহলের আলোচনায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, রবার্ট কচ প্রথমবারের মতো প্রমাণ করে দেখান যে, অ্যানথ্রাক্স রোগের জন্য নির্দিষ্ট একটি ব্যাকটেরিয়াই দায়ী। এই ব্যাকটেরিয়ার জীবনচক্র নিয়ে রচিত গবেষণাপত্রটি পড়ে তৎকালীন খ্যাতিমান জার্মান উদ্ভিদবিদ ফার্দিনান্দ কন এতটাই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি রবার্টকে আমন্ত্রণ জানান গবেষণাপত্রটি ফার্দিনান্দের জার্নালে প্রকাশের জন্য।
শত বছর পূর্বেকার অণুবীক্ষণযন্ত্রগুলো এখনকার মতো এত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ছিলো না। অণুবীক্ষণযন্ত্রে আলোর স্বল্পতা ছিল, তার উপর কাঁচের স্লাইডের উপর তরল মাধ্যমে চলনশীল স্বচ্ছ ব্যাকটেরিয়ার নড়া-চড়ার দরুন স্পষ্ট দেখাও যেত না। এসমস্ত সমস্যার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করেছিলেন রবার্ট কচ, বিভিন্ন রঞ্জনপদার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়াগুলো আরো স্পষ্ট করে তোলেন অণুবীক্ষণযন্ত্রের লেন্সে। এই সমাধানগুলো আজও গবেষণায় ব্যবহার করেন অণুজীববিজ্ঞানীরা। ১৮৭৭ সালে রবার্ট কচ-ই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ব্যাকটেরিয়ার ছবি প্রকাশ করেন।
পরবর্তী সময়ে ১৮৮০ সালে, তৎকালীন সরকারের আমন্ত্রণে তিনি পুনরায় বার্লিনে ফিরে আসেন, ইমপেরিয়াল হেলথ অফিসে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এখানেই তিনি প্রথাগত অণুবীক্ষণ পদ্ধতির আরো উন্নতিতে কাজ শুরু করেন। ব্যাকটেরিয়া জীবনচক্র আরো নিশ্চিতভাবে পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে ‘পিওর কালচার’ করতে শুরু করেন। তখনকার সময়ে যে ‘পিওর কালচার’ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, তা বেশ সময়সাপেক্ষ। তাই রবার্ট কচ ভিন্ন পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ নতুন এক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। অণুজীববিজ্ঞানে এই পদ্ধতিটি একটি মাইলফলক হিসেবে আজও ব্যবহৃত হয়। রবার্ট কচ গবেষণায় এ-ও দেখতে পান যে, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থকে জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার সম্ভব। এসমস্ত গবেষণার উপর প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিকে চিহ্নিত করা হয় ‘ব্যাকটেরিয়াতত্ত্বের বাইবেল’ হিসেবে।
এ সাফল্যে রবার্ট কচের দুই সহকর্মীর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ওয়াল্টার হেস্ এরই মাঝে রবার্টকে দেখান যে, সামুদ্রিক শৈবাল হতে এমন একটি পদার্থ তৈরি করা সম্ভব, যার অনেক উচ্চমাত্রার গলনাঙ্ক রয়েছে; এর নাম অ্যাগার। একে ‘পিওর কালচার’-এ ব্যাকটেরিয়ার পুষ্টিদানকারী হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। যেহেতু উচ্চ গলনাঙ্ক রয়েছে, সহজে গলে তরল হবারও সম্ভাবনা নেই। অপর সহকর্মী, জুলিয়াস পেট্রি এক বিশেষ ধরনের অগভীর, ঢাকনাযুক্ত পাত্র তৈরি করেন, যেখানে ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ পিওর কালচার রাখা যেতে পারে, অন্যকিছু দ্বারা দূষণেরও সম্ভাবনা নেই এতে। এটি এখনো পেট্রি ডিশ নামে পরিচিত।
প্রথম পর্বে আমরা জানলাম, রবার্ট কচের মূর্তিমান সকল গবেষণা সম্পর্কে। তার উদ্ভাবিত প্রতিটি প্রক্রিয়া আজও সফলতার সাথে অণুজীববিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যবহৃত হয়। আবার রবার্ট কচের গবেষণাফল হতে অনুপ্রাণিত হয়েও নানাজনের হাত ধরে অণুজীববিজ্ঞান ধীরে ধীরে সাফল্যমণ্ডিত হয়ে গড়ে উঠেছে। পরবর্তী পর্বে আমরা, সে সমস্ত গবেষণা ও যক্ষ্মা রোগে রবার্ট কচের সাফল্য নিয়ে বিস্তারিত জানব।