পাগলাটে এক দরিদ্র চিত্রশিল্পী নিজের পেটে গুলি চালিয়ে দিলেন ১৮৯০ সালের কোনো এক বিকেলে, উত্তর ফ্রান্সের এক গ্রামে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু তখনই হয়নি। গুলি চালাবার পর ঘরে গিয়ে দিব্যি ধূমপান করলেন, কিন্তু ৩০ ঘণ্টার মাথায় পাড়ি জমালেন পরপারে। ঘুণাক্ষরেও তিনি জানলেন না, তাঁর মৃত্যুর পর অখ্যাত থেকে পরম পূজনীয় চিত্রকরের কাতারে নাম উঠে যাবে তাঁর। ভিনসেন্ট ভ্যান গখের নাম চিত্রশিল্পের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আজীবন। এই মেধাবী চিত্রকরকে নিয়েই আজকের এই সংক্ষিপ্ত আয়োজন।
সবার আগে তাঁর নামের উচ্চারণের ব্যাপারে পরিষ্কার হয়ে নিতে হবে। তিনি ছিলেন ডাচ শিল্পী। তাই শুরুতে তাঁর নামের ডাচ উচ্চারণটা জেনে নেয়া যাক। ডাচরা তাঁকে ডাকেন ভান খখ (vun KHOKH) বা ফন খখ (fun KHOKH) বলে। তবে উচ্চারণটা এতই কঠিন যে আমরা তো দূরের কথা, বাকি ইউরোপীয়রাও করতে পারেন না অনেক সময়। ব্রিটিশ উচ্চারণ কিংবা আমেরিকান উচ্চারণটাই বেশি চলে পৃথিবীতে এখন। এ লেখায় আমরা ব্রিটিশ উচ্চারণ ভ্যান গখ (van GOKH) ব্যবহার করব। তবে কোনটা যে মার্কিন আর কোনটা যে ব্রিটিশ উচ্চারণ তা আলাদা করে বলবার উপায় নেই। ভ্যান গৌ নামখানাও বেশ চলে আমেরিকায়, ভ্যান গখের পাশাপাশি। তবে ভ্যান গগ বলাটা চলে না।
দক্ষিণ নেদারল্যান্ডের নর্থ ব্রাবান্ট প্রদেশে এক ক্যাথলিক প্রধান অঞ্চলের রিফর্মড পরিবারে ১৮৫৩ সালের ৩০ মার্চ ভিনসেন্ট ভ্যান গখের জন্ম। বাবা থিওডোরাস ছিলেন চার্চের একজন মিনিস্টার, আর মায়ের নাম ছিল অ্যানা কর্নেলিয়া। ভিনসেন্টের নাম রাখা হয় তাঁর দাদার নামে, অবশ্য জন্মের আগেই প্রাণ হারানো তাঁর এক বছর আগের ভাইয়ের নামও তা-ই ছিল। চার বছর পর তাঁর ভাই থিওর জন্ম হয়। এছাড়াও তাঁর আরো এক ভাই আর তিন বোন হয়েছিল। কিন্তু থিও আর উইলহেলমিনা নামের এক বোন ছাড়া আর কারো সাথে তাঁর খাতির ছিল না পরে। বাবার বেতন কম হলেও চার্চ থেকে ভালো বাড়ি, কাজের মেয়ে, দুজন রাঁধুনি, একজন মালি, এমনকি ঘোড়ার গাড়িও দেয়া হয়েছিল তাঁকে। খারাপ যাচ্ছিল না জীবন!
ছোটবেলায় চিন্তাশীল ছিলেন ভিনসেন্ট। তাঁর মা আর গভর্নেস তাঁকে ছোট থাকতে পড়ান, এরপর ১৮৬০ সালে তাঁকে গ্রামের স্কুলে পাঠানো হয়। ১৮৬৪ সালে আরেকটি স্কুলে তাঁকে পড়তে পাঠানো হলে তাঁর সেখানে নিজেকে একা অনুভব হয়, তাই তিনি ফিরে আসতে চান, কিন্তু তার বদলে তাঁকে তাঁর পরিবার ১৮৬৬ সালে আরেক স্কুলে পাঠিয়ে দেয়। সেখানেও তিনি অসুখী ছিলেন, খুবই অসুখী।
সেই ছোট বয়স থেকেই চিত্রকলার ব্যাপারে তাঁর ছিল খুবই আগ্রহ। তাঁর মা-ই তাঁকে আঁকতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাঁর ছোট বয়সের ছবির দেখাও মেলে।
১৮৬৯ সালে ভিনসেন্ট হেগ শহরে চাকরি পান চাচার খাতিরে। চাকরিটা ছিল আর্ট ডিলারের। ট্রেনিং শেষ হবার পর তাঁকে তাঁর কোম্পানির লন্ডন শাখায় পাঠানো হয়। এ সময়টা ছিল ভিনসেন্টের জন্য খুবই আনন্দের। মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই তিনি তাঁর বাবার চাইতেও বেশি কামাই করছিলেন! তাঁর ভাই থিওর স্ত্রী পরে বলেছিলেন, সে বছরটা ছিল ভিনসেন্টের জীবনের সেরা বছর।
তাঁর জীবনে সে বছর একপক্ষীয় প্রেম এলো। তাঁর বাড়িওয়ালার মেয়ের প্রেমে পড়ে যান তিনি। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে প্রস্তাব দেয়া মাত্রই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে বসে ইউজিন (Eugénie) নামের মেয়েটি। কারণ তাঁর আগেই বাগদান করা ছিল গোপনে আরেক ভাড়াটিয়ার সাথে। এ ঘটনার পর ভিনসেন্ট একা হয়ে যান, ধার্মিক বনে যান। বাবা আর চাচার চেষ্টায় তাঁর প্যারিসে বদলি হয়ে যায় ১৮৭৫ সালে। তাঁর খারাপ সময় শুরু হয় তখনই। কোম্পানির সাথে বনিবনা হচ্ছিল না বিধায় এক বছরের মাথায় চাকরি খোয়ান তিনি।
১৮৭৬ সালের এপ্রিলে ইংল্যান্ডের র্যামসগেটে অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এক বোর্ডিং স্কুলে। এ চাকরিও তাঁর ভালো চলেনি, এরপর তিনি মেথডিস্ট চার্চের মিনিস্টারের সহকারী হিসেবে যোগ দিলেন।
১৮৭৬ সালে তিনি বড়দিন উপলক্ষ্যে বাড়িতে এসে ছয় মাস থেকে গেলেন। চাকরি নিলেন এক বইয়ের দোকানে। অসুখী সময়টা জুড়ে তিনি বাইবেলের অনুবাদ করতেন ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ আর জার্মান ভাষায়। খুব ধার্মিক হয়ে যান, নিরামিষাশীও।
ধর্মের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে ১৮৭৭ সালে তাঁর পরিবার তাঁকে অ্যামস্টারডাম পাঠিয়ে দেয়। সেখানে ধর্মতত্ত্ববিদ জোহানেস স্ট্রাইকারের সাথে তিনি থাকবেন, সম্পর্কে তিনি তাঁর চাচা। সেখানের অ্যামস্টারডাম ইউনিভার্সিটিতে তিনি ধর্মতত্ত্বে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন, কিন্তু ফেল করে বসেন। হতাশ হয়ে তিনি চাচার ঘর ছেড়ে দিলেন ১৮৭৮ সালের জুলাই মাসে। ব্রাসেলসের কাছে তিনি প্রটেস্টান্ট মিশনারি স্কুলে তিন মাসের কোর্স করেন, এবং ঠিক ধরেছেন, তিনি সেটাতেও ফেল করেন।
১৮৭৯ সালের জানুয়ারিতে মিশনারিতে যোগ দেন ভিনসেন্ট বেলজিয়ামে। তিনি তাঁর আরামের বাসস্থান দিয়ে দেন এক উদ্বাস্তু লোককে মহত্ত্ব প্রদর্শন করতে গিয়ে। এরপর নিজে থাকতে শুরু করলেন এক ছোট কুড়েঘরে, ঘুমাতেন খড়ের ওপর। এসব দেখবার পর চার্চ কর্তৃপক্ষ তাঁকে বহিষ্কার করে। এরপর তিনি ৭৫ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে ব্রাসেলসে যান। বাবা-মায়ের চাপে ফিরে যান বাসায়। ১৮৮০ সালের মার্চ পর্যন্ত সেখানে ছিলেন তিনি। এই বেকার অবস্থা তাঁর বাবা-মার মোটেও পছন্দ হচ্ছিল না। তাঁর বাবা তো পুরাই হতাশ হয়ে যান, বলে বসেন যে, তাঁর ছেলেকে পাগলাগারদে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসা দরকার।
১৮৮০ সালের আগস্ট মাসে তিনি ক্যুমেতে ফিরে আসেন এবং এক খনি কর্মীর রুমমেট হন। তখনই আশপাশের মানুষ আর দৃশ্য তাকে আকৃষ্ট করতে শুরু করে। ছোট ভাই থিওর পরামর্শ অনুযায়ী তিনি সেগুলো তাঁর ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করতে শুরু করলেন। পরের বছর ব্রাসেলসে ডাচ শিল্পী উইলেম রোলফস এর কাছে পড়াশোনা করতে যান। তিনি যদিও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা পছন্দ করতেন না, তা-ও ভর্তি হয়ে যান একাদেমি রয়ালে দে বোজ আর্টসে।
১৮৮১ সালের এপ্রিলে বাবা-মার কাছে ফেরত গেলেন ভিনসেন্ট। প্রায়ই তিনি প্রতিবেশীদের ছবি আঁকতেন। আগস্ট মাসে এক বিধবা খালাত বোন করনেলিয়া তাদের বাড়িতে আসেন নিজের আট বছরের ছেলেকে নিয়ে। ভিনসেন্ট সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাঁর থেকে সাত বছরের বড় সেই খালাত বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। করনেলিয়া অবশ্য সাথে সাথেই ‘না, কখনো না’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। নভেম্বর মাসে করনেলিয়া যখন তাঁর সাথে দেখা করতেই অস্বীকৃতি জানালেন, তখন তিনি কুপি বাতির আগুনের ওপরে নিজের বাম হাত রেখে তিনি বলে বসেন, “সে দেখুক আমি কতক্ষণ আগুনের ওপর হাত রাখতে পারি।” এরপর কী হয়েছিল তাঁর মনে নেই, সম্ভবত তাঁর খালু ফুঁ দিয়ে আগুন নিভিয়ে দেন। পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয় যে, এ বিয়ে কখনো হবে না, কারণ ভিনসেন্ট বেকার।
ভিনসেন্ট তাঁর আরেক কাজিন অ্যান্টন মভের সাথে খাতির করলেন, মভ ছিলেন চিত্রশিল্পী। কিন্তু শীঘ্রই তাদের ঝগড়া হলো। কারণ, ভিনসেন্ট রাস্তা থেকে ধরে আনতেন মডেলদের, তাদের ছবি আঁকতেন- এটা মভের সহ্য হত না। জুন মাসে ভিনসেন্টের গনোরিয়া রোগ হলো এবং হাসপাতালে তাকে তিন সপ্তাহ কাটাতে হয়। ছাড়া পেয়ে থিওর কাছ থেকে টাকা ধার করে তৈলচিত্রের রঙ কেনেন। তাঁর আঁকা সুন্দর ছবি দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন।
১৮৮২ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে ভিনসেন্টের দেখা হয় ক্লাসিনা মারিয়া হুরনিক নামের এক অ্যালকোহলিক পতিতার সাথে। তাঁর পাঁচ বছরের ছোট এক মেয়ে ছিল। আগের দু’সন্তান মারা গিয়েছিল। তাঁর সাথে বাসাতে সেই পতিতা মারিয়া বসবাস শুরু করেন, তবে ভিনসেন্ট জানতেন না যে মারিয়া গর্ভবতী। জুন মাসে মারিয়া জন্ম দেয় উইলেম নামের এক ছেলের। ভিনসেন্টের পরিবার যখন তাঁর বাসায় পতিতার অবস্থান এবং তাদের সম্পর্কের বিস্তারিত জানতে পারে, তখন চাপ দেয়া শুরু করে মারিয়াদের ত্যাগ করতে। ভিনসেন্ট প্রথমে সেটা মেনে নেননি। কিন্তু ১৮৮৩ সালের শেষ দিকে তিনি আসলেই তাদের ত্যাগ করেন। অর্থাভাবে মারিয়া আবার পতিতাবৃত্তি শুরু করল। নিজের মেয়েকে মায়ের কাছে, আর ছেলেকে ভাইয়ের কাছে দিয়ে আসল। অনেক পরে ভিনসেন্ট যখন উইলেম নামের ছেলেটিকে দেখতে যান তখন তার বয়স ১২ বছর। ছেলের মামা ভিনসেন্টকে চাপ দেন যেন তিনি মারিয়াকে বিয়ে করেন, কারণ মামার ধারণা ছিল উইলেম ভিনসেন্টের ছেলে। অবশ্য সেটা অসম্ভব ছিল, কারণ যখন উইলেম মারিয়ার গর্ভে আসে, তখন ভিনসেন্টের সাথে দেখাই হয়নি মারিয়ার। মারিয়া ১৯০৪ সালে নদীতে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে।
১৮৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একাকিত্ব সইতে না পেরে বাবা-মায়ের কাছে আবার ফিরে যান ভিনসেন্ট। এরপর চলে যান ন্যুনেনে। সেখানে থাকাকালীন তিনি অনেক আঁকাআঁকি করতেন। খুব দ্রুত তিনি স্কেচ করে ফেলতেন জিনিসপাতি। ১৮৮৪ সালের আগস্টে প্রতিবেশীর মেয়ে মার্গো বেগেম্যান তাঁর প্রেমে পড়ে, তিনিও সাড়া দেন। তাঁরা বিয়ে করতে চাইলেও কোনো পরিবার মেনে নেয়নি। মেয়েটি ওষুধের ওভারডোজ নিয়ে আত্মহত্যা করতে যায়, ভিনসেন্ট তাকে কাছের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে দেন।
১৮৮৫ সালের ২৬ মার্চ ভিনসেন্টের বাবা মারা যান হার্ট অ্যাটাকে। ন্যুনেনে থাকাকালীন তিনি প্রায় ২০০ ছবি আঁকেন। প্যারিসের এক ডিলার তাঁর ছবি দেখে আগ্রহ পান। মে মাসে তিনি পট্যাটো ইটার্স নামের প্রথম বড় চিত্রকর্ম শেষ করেন, এরপর একটি সিরিজও করেন ‘পিজ্যান্ট ক্যারেক্টার স্টাডিস’ নামে। এই দরিদ্র মডেলরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে সিটিং দিয়ে যেত ছবি আঁকার জন্য। হেগ শহরে আগস্ট মাসে প্রথমবারের মতো তাঁর প্রদর্শনী হল। কিন্তু সমস্যা হলো, সেপ্টেম্বর মাসে এক মেয়ে গর্ভবতী বলে জানা যায়, অভিযোগ ওঠে ভিনসেন্ট তাকে গর্ভবতী করেছেন যখন মেয়েটি সিটিং দিতে গিয়েছিল। তখন গ্রামের যাজকরা নিষেধ করে দেয় সবাইকে সিটিং দেয়া থেকে।
নভেম্বর মাসে তিনি অ্যান্টওয়ার্পে চলে যান। সেখানে দোতলার ওপরে একটা রুম ভাড়া নিয়ে খুব দরিদ্রভাবে বাস করতে লাগলেন। জানুয়ারিতে তিনি পেইন্টিং এর ক্লাসে ভর্তি হন। খুব কম খেতে পারতেন তিনি। বাঁচানো টাকা তিনি ব্যয় করতেন পেইন্টিং এর সরঞ্জাম কিনতে আর মডেলদের বেতন দিতে। ১৮৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে থিওকে তিনি লিখেন, গত নয় মাসে তিনি মাত্র ছয় বার ভালো খেতে পেয়েছেন। তিনি খুব মদ্যপান করা শুরু করলেন আবার। এ কারণে তাঁকে ফেব্রুয়ারি আর মার্চ মাসের দিকে হাসপাতালে কাটাতে হয়। তাঁর সিফিলিসও হয়েছিল।
তবে ফলাফল আশানুরূপ করছিলেন তিনি তাঁর কোর্সে। তাঁকে দেয়া হলো ভেনাস অফ মাইলো আঁকতে, আর তিনি এঁকে বসলেন এক নগ্ন মহিলার ছবি, তা-ও আবার অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গবিহীন। ভ্যান গখসহ ১৭ জন ছাত্রকে কোর্স আবার নিতে হলো। অপ্রমাণিত গুজব ছিল যে, তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
১৮৮৬ সালের মার্চে তিনি প্যারিসে চলে যান, ভাই থিওর সাথে থাকতে লাগলেন। সেখানে তিনি অসংখ্য ছবি আঁকেন। তবে বছরের শেষ নাগাদ দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া বেধে গেল। থিও সহ্য করতে পারছিলেন না ভিনসেন্টকে। ১৮৮৭ সালের শুরুতে ঝগড়া মিটে গেল।
১৮৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি প্যারিস ত্যাগ করলেন। দুই বছরে তিনি ২০০টির মতো ছবি এঁকেছিলেন। তাঁর স্টুডিওতে থিও কেবল একবারই পা মাড়িয়েছিলেন, তা-ও ভিনসেন্ট প্যারিস ত্যাগ করবার কয়েক ঘণ্টা আগে।
প্যারিস থেকে ভিনসেন্ট চলে গেলেন Arles শহরে। এখানে তিনি দুশো পেইন্টিং ও একশ জলছবি আঁকেন। ১৮৮৮ সালের ১ মে তিনি মাসিক ১৫ ফ্রাঁঁ ভাড়াতে একটি ঘরে ওঠেন। সেটিকে স্টুডিও বানাতে চেয়েছিলেন তিনি। নিজের একটা গ্যালারি হোক এটা ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষা।
ফ্রেঞ্চ শিল্পী পল গগেন (Paul Gauguin) এরকম সময়ে তাঁর বন্ধু হয়ে ওঠেন। তারা দুজন একসাথে ১৮৮৮ সালের ডিসেম্বরে মঁপেলিয়ে যান। সেখানে তাদের সম্পর্কে চির ধরে। ওদিকে থিও ভাবছিলেন এই দুই বন্ধু বুঝি তাঁর থেকে টাকা মেরে খাচ্ছে। ভিনসেন্ট বুঝতে পারেন যে গগেন তাঁকে ত্যাগ করবেন। কিন্তু বৃষ্টির কারণে বের হতে পারছিলেন না গগেন। মালামাল নিয়ে বের না হলেও, একটু হাঁটতে বের হয়েছিলেন গগেন, তখন গগেনের মতে, ভিনসেন্ট হাতে রেজর নিয়ে তাঁর দিকে দৌড়ে গেলেন। এরপর কী হয়েছিল সেটা অস্পষ্ট। কিন্তু ঘরে ফিরে ভিনসেন্টকে অশরীরী কণ্ঠস্বর অনেক কথা শোনায় এবং একপর্যায়ে তিনি রেজর দিয়ে নিজের বাম কান কেটে ফেলেন। নিজেই নিজের ক্ষত ব্যান্ডেজ করে ফেলেন আবার, অবশ্য কাগজ দিয়ে। এরপর নিজের কানটা পতিতালয়ে দুই বন্ধু নিয়মিত যে পতিতার কাছে গমন করতেন তাঁকে দিয়ে আসেন প্যাকেজে করে। পরদিন ভিন্সেন্ট নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালে, অজ্ঞান অবস্থা থেকে জাগ্রত হয়ে। কানটা কী করে যেন হাসপাতালে ডেলিভার করা হয়। ভিনসেন্ট পরে বললেন, তাঁর কোনো ধারণা নেই আগের দিন কী ঘটেছে। ২৪ ডিসেম্বর প্রেয়সীকে বিয়ের প্রস্তাব করে বসেই থিও রাতের ট্রেনে চেপে বসেন ভাইকে দেখতে যেতে, গগেনের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে। চিকিৎসা চলাকালীন ভিনসেন্ট সারাক্ষণ গগেন গগেন করতেন। গগেন এলাকা ত্যাগ করেন, এবং আর কোনোদিন ভিনসেন্টের ছায়া মারাননি।
সুস্থ হবার পর ভিনসেন্ট প্রায়ই অনেক দৃষ্টিভ্রমের মুখোমুখি হতেন। ভাইয়ের বিয়েতে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। ১৮৮৯ সালের মে মাসে তিনি নিজেই মানসিক চিকিৎসালয়ে ভর্তি হন। এরপরের দিনগুলো তাঁর একদম ভালো যায়নি। যে ডাক্তার তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন তাঁকে তিনি পেইন্টিং উপহার দেন, কিন্তু তিনি ছবি পছন্দ করতেন না বিধায় সেই পেইন্টিং দিয়ে মুরগির খামারের দরজা ঠিক করলেন, পরে দান খয়রাত করে দিলেন। সেই পেইন্টিংটা ২০১৬ সালে খুঁজে পাওয়া যায় এবং ৫০ মিলিয়ন ডলার দাম ওঠে।
১৮৯০ সালের জুলাই মাসে তিনি বাস করছিলেন ওভেরসিরওয়াজ-এ (Auvers-sur-Oise), অর্থাৎ প্যারিসের উত্তর-পশ্চিম কোণে। সেখানে দুটো পেইন্টিং আঁকেন- Daubigny’s Garden। এটাই সম্ভবত তাঁর শেষ কাজগুলোর একটি ছিল। তিনি অনেকগুলো চিঠি লিখেছিলেন এ সময়, যেগুলো সংরক্ষিত আছে।
১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই যে সরাইখানায় ভিনসেন্ট থাকছিলেন সেখানে সকালের নাস্তা সেরে বের হয়ে গেলেন ভিনসেন্ট। কিন্তু অভ্যাসবশত সন্ধ্যায় তিনি না ফিরলে সরাইখানার মানুষজন দুশ্চিন্তা করতে থাকেন। রাত ৯টার দিকে তিনি ফেরেন, পেটে হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন। সরাইখানার মালিকের ১৩ বছরের মেয়ে অ্যাডেলিন ঘটনাটা বর্ণনা করেছিল। অ্যাডেলিনের মা জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা?” তিনি বললেন, “না, কিন্তু আমি…” কষ্ট করে বলেই তিনি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেন। নিজের কক্ষ থেকে অনেক কোঁকানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। অ্যাডেলিনের বাবা গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি অসুস্থ?” তখন ভিনসেন্ট দেখালেন, তাঁর বুকের কাছে ক্ষত, বললেন, “আমি আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিলাম।” তিনি যে যব ক্ষেতে আঁকতে যান সেখানে বিকেল বেলা রিভলভার দিয়ে নিজেকে গুলি করেন এবং অজ্ঞান হয়ে যান। সন্ধ্যার শীতলতায় তাঁর জ্ঞান ফেরে। বন্দুকটা না পেয়ে তিনি সরাইখানায় ফিরে আসেন। (উল্লেখ্য, তিনি নিজের বুকের কাছে ক্ষত দেখান কিন্তু তিনি পেটে গুলি করেছিলেন। এ বর্ণনাটা কিছুটা অসঙ্গতিপূর্ণ)
ডাক্তার এসে ক্ষত বেধে দিয়ে চলে গেলেন। সকালে দুজন সেনা এসে জিজ্ঞেস করলো, ভিনসেন্ট আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছে কিনা। তিনি উত্তর দিলেন, “আমার দেহ- আমার ইচ্ছা যা করার করব। স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করতে গিয়েছি।” টেলিগ্রাম পেয়ে থিও বিকেলে ট্রেনে করে চলে এলেন। এরপর ভিনসেন্ট কোমাতে চলে গেলেন এবং রাত একটার দিকে মারা গেলেন। ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা ছিল যে, তিনি রাত দেড়টায় মারা যান। মারা যাবার আগে তিনি বসে বলেছিলেন, “এই দুঃখ-বেদনা আজীবন থাকবে।”
৩০ জুলাই তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়। তাঁর দেহ তাঁর পেইন্টিং রুমে রাখা হয়, তাঁর দেহের চারপাশে গোল করে তাঁর উপস্থিত শেষ পেইন্টিংগুলো। কাছেই এক টিলার ওপরে হওয়া নতুন কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
তবে, ২০১১ সালে ভিনসেন্টের নতুন এক জীবনীগ্রন্থে বলা হয়, আসলে ভিনসেন্ট আত্মহত্যা করতে পারেন না। গুলিটা যে কোণে ঢুকেছিল সেটা নিজে থেকে করা সম্ভব ছিল না। ভিনসেন্ট সম্ভবত তাঁর হত্যাকারীদের চিনতেন, কিন্তু তিনি ধরে নিয়েছিলেন এই হত্যাটা তাঁর জন্য শান্তিকর হবে, তিনি এই কষ্টের পৃথিবীতে আর বাঁচতে চান না।
তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই থিও অনেক চেষ্টা করেন ভিনসেন্টের কর্মগুলো পরিচিত করার। কিন্তু ছয় মাসের মাথায় তিনিও মারা যান। তখন থিওর বিধবা স্ত্রী জোয়ান ভ্যান গখ-বংগার কাজটা করতে থাকেন। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় ভিনসেন্টের ঘটনা পরিচিতি পায়। আর আজ? আজ ভিনসেন্ট ভ্যান গখের একেকটি ছবির দাম মিলিয়ন মিলিয়ন মার্কিন ডলার! অথচ সে লোকটি দারিদ্র্যে কাটান শেষ জীবন। শেষ না, পুরো জীবনই।
নতুন ডক্টর হু টিভি সিরিজের পঞ্চম সিজনের দশম পর্বের নাম ছিল ‘ভিনসেন্ট এন্ড দ্য ডক্টর‘। ২০১০ সালের ৫ জুন প্রচারিত সে পর্বে ডক্টর তাঁর টারডিসে করে সময় পরিভ্রমণের মাধ্যমে ভিনসেন্ট ভ্যান গখকে নিয়ে আসেন বর্তমান দুনিয়ায়, যেখানে চলছিল ভিনসেন্টের একক প্রদর্শনী। সে দৃশ্য দেখে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি ভিনসেন্ট।
২০১৭ সালে বের হয় ‘Loving Vincent‘ নামের পোলিশ অ্যানিমেশন ফিল্ম। সেখানে ১২৫ জন পেইন্টার ৬৫০০০ ফ্রেম আঁকেন অয়েল পেইন্টিঙে। এবং এই ৬৫০০০ ফ্রেমই হলো এই মুভিটি। বার্লিনে হওয়া ত্রিশতম European Film Awards অনুষ্ঠানে এটি জয় করে নেয় Best Animated Feature Film পুরস্কার। পেয়েছে ৯০তম অস্কারের বেস্ট অ্যানিমেটেড ফিচারের নমিনেশনও। এর কাহিনী আবর্তিত হয় ভিনসেন্টের মৃত্যু নিয়ে।
ভিনসেন্ট ভ্যান গখের চিত্রগুলো নিয়ে অন্য কোনো দিন কথা হবে। পাগলাটে এ চিত্রশিল্পীর জীবনটা দুঃখভরা থাকলেও তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তবে দেখে যেতে পারতেন কত সুখ্যাতি তাঁর। কত কোটি মানুষ পৃথিবী জুড়ে তাঁকে চিত্রশিল্পের গুরু মানে। নিশ্চিতভাবেই নিজের এরকম এক চিত্র প্রদর্শনীতে এসে চোখের কোণ থেকে তাঁর অশ্রু গড়িয়ে পরতো।
ফিচার ইমেজ: Wallpaper Studio