যোগব্যায়াম, অতীন্দ্রিয়বাদ ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখা অন্যতম ব্যক্তি সাধগুরু। সকলের কাছে সাধগুরু নামে পরিচিত হলেও তার প্রকৃত নাম জগদীশ বাসুদেব (বা জাগ্গী বাসুদেব)। ‘সাধগুরু’ শব্দের অর্থ ‘আসল গুরু’। তিনি একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি, সিদ্ধ যোগী এবং অতীন্দ্রিয়বাদী বলে পরিচিত। মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণের জন্য তিনি কাজ করছেন। প্রাচীন যুগের বিজ্ঞানকে এই সময়ের মানুষের কাছে এক অনন্য ক্ষমতায় প্রাসঙ্গিক করে তুলতে, এবং একে জীবনের গভীরতার সাথে একীভূত করতে নিজেকে নিবেদন করেছেন।
সাধগুরুর জন্ম ১৯৫৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভারতের মহীশূরে। তিনি মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এরপর ব্যবসার কাজে মনোনিবেশ করেন। এজন্য ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেছেন। ফলে বিভিন্ন মানুষের সাথে তার দেখা-সাক্ষাৎ, আলোচনা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তার সুযোগ হয়েছে। তিনি জীবনে কীভাবে আধ্যাত্মিকতা লাভ করেছেন তা বক্তৃতা দেয়ার সময় বলেছেন। সেই ঘটনাটি পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে দেয়া হলো।
এক দুপুরে তিনি এক ছোট্ট পাহাড়ের (চামুন্ডি পাহাড়) উপর গিয়ে বসলেন। ঐ সময় পর্যন্ত তিনি আর দশজন মানুষের মতো নিজেকে আলাদা সত্ত্বা হিসেবেই ভাবতেন। কিন্তু ঐদিন প্রথমবার কোনটা তিনি আর কোনটা তিনি নন— সেই বোধ হারিয়ে ফেললেন। নিজের সত্ত্বাকে তিনি সব জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে এমনটা অনুভব করলেন। তার মনে হয়েছিল, পাঁচ-দশ মিনিট হয়তো এমন অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন, ততক্ষণে সাড়ে চার ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। তিনি সেখানেই বসে ছিলেন, তখন সূর্যাস্ত হয়ে গিয়েছে। কথিত আছে, তার জীবনে প্রথমবার চোখে এত পানি এসেছিল যে তার পুরো জামা ভিজে গিয়েছিল।
তিনি নিতান্ত হাসিখুশি লোক ছিলেন। কিন্তু ঐদিন এক অদ্ভুত পরম আনন্দে ফেটে পড়ছিলেন, যা বর্ণনাতীত। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কী ঘটছিল। যখন তিনি এসব তার কাছের বন্ধুদের গিয়ে বললেন, তখন তারা ঠাট্টা-তামাশা শুরু করে। তিনি বুঝলেন, কারো সাথে কথা বলে লাভ নেই। আকাশের দিকে তাকালে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, গাছের দিকে তাকালে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, চোখ বন্ধ করে বসে থাকলেও চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
ছয় সপ্তাহের মধ্যে নাটকীয়ভাবে সবকিছু বদলে গেল। তিনি সময়ের জ্ঞান সম্পূর্ণভাবে হারালেন। পরেরবার ব্যাপারটা যখন আবার ঘটল, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তখন আশেপাশে লোকজন ছিল। তিনি তার পরিবারের সাথে বসে রাতের খাবার খাচ্ছেন। তার মনে হয়েছিল ব্যাপারটা দুই মিনিট হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে সাত ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছিল। তিনি সেখানে বসে ছিলেন সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে।
সময়জ্ঞানের ত্রুটি তারপর অনেকবার হতে থাকলো। তিনি মাঠে বসে আছেন। তার মনে হলো হয়তো আধ-ঘণ্টা বা চল্লিশ মিনিট বসে ছিলেন। কিন্তু তিনি সেখানে ১৩ দিন বসে ছিলেন! ততদিনে তো তার চারপাশে ভিড় জমে গিয়েছে। তিনি দেখেন তার গলায় বিশাল বিশাল মালা ঝুলছে। কেউ জানতে চাইছে তার ব্যবসা কীরকম চলবে, কেউ বলছে তার মেয়েদের বিয়ে কবে হবে, এরকম অযৌক্তিক প্রশ্ন, যা তিনি একেবারেই অপছন্দ করতেন। তখন সবাই বলছে- এই লোক ১৩ দিন বসে রয়েছেন। নিশ্চয়ই সমাধি গিয়েছেন, এটা হয়েছেন, ওটা হয়েছেন; তাকে ছুঁলে এটা হবে, ওটা হবে। তাই লোকে লাফিয়ে পড়ছিল তার উপর।
এ ধরনের অবস্থায় তিনি আগে পড়েননি। আর তিনি বড় হয়েছেন ইউরোপীয় দর্শন পড়ে; কামু, কাফকা, দস্তয়েভস্কি। গানবাজনা ভালোবাসতেন। বিটলস (রক ব্যান্ড) ছিল তার পছন্দের। তার লাইফস্টাইল আর আধ্যাত্মিকতা দুটো আলাদা জগত ছিল। তার ওদিকে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাই এই পরিস্থিতিতে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন।
তখন তিনি জায়গা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। এই সবকিছু থেকে পালিয়ে যেতে চাইছিলেন, কারণ আশেপাশে কী ঘটছিল সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
তিনি মনে করেন- এটা প্রত্যেক মানুষের জন্য সম্ভব। তার মতে, একজন ব্যক্তি মাউন্ট এভারেস্টে চড়লেন কি না, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ হলেন কি না— তার চেয়ে বরং এই পৃথিবীতে তার জীবনের অভিজ্ঞতা অবশ্যই সুখের হওয়া উচিত। চলে যাওয়ার আগে মানুষের অবশ্যই পরমানন্দে বাঁচা উচিত। এটা প্রত্যেকের সাথে হওয়া উচিত। এটা প্রত্যেকের প্রাপ্য, এবং প্রত্যেক মানুষের এটা করার ক্ষমতা রয়েছে।
তার নিজস্ব বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়— একদিন তিনি এক ফিল্ড হকি খেলায় তার বাঁ পায়ের গোড়ালি ভেঙে ফেলেন। তারপর তিনি এক জায়গায় বসে পড়েন। সাংঘাতিক যন্ত্রণা হচ্ছিল। তিনি হাঁপানি রোগী ছিলেন। তাই দফায় দফায় প্রচণ্ড হাঁপানি উঠত। পা ভাঙার কষ্ট, আর শ্বাস নিতে না পারা দুটি একসাথে তার জন্য খুবই মারাত্মক ছিল। আর সেই মুহূর্তে তার মনে হলো- যদি এই দেহের নির্মাতা এর ভেতরেই থাকেন, তাহলে কেন তিনি এটা ভেতর থেকে সারিয়ে তুলতে পারেন না? এটা মনে করেই তিনি বসে পড়লেন একটা নির্দিষ্ট সংকল্প নিয়ে যে, যদি এটা সত্যি হয়, তবে তার অবশ্যই নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারা উচিত। তা না হলে তিনি অবশ্যই সম্পূর্ণ ভুল পথে চলছেন। তারপর তিনি প্রায় এক ঘণ্টার একটু বেশি সময় ধরে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। যখন তিনি উঠলেন, আশ্চর্যজনকভাবে তার হাঁপানি সেরে যায়, এবং আর কোনোদিনও ফিরে আসেনি। তার ভাঙা পা-ও সম্পূর্ণ সেরে ওঠে।
প্রায় এক ঘণ্টার একটু বেশি সময়ের মধ্যে এই অভিজ্ঞতার ফলে তিনি নাকি এমন সব পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া তৈরি করতে শুরু করেন, যার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ নাগাল পেতে পারে দেহতন্ত্রের ক্ষমতা আর বুদ্ধিমত্তার, যা প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু যথাযথ চর্চা, জ্ঞান আর দিকনির্দেশনার অভাবে সেটা অব্যক্তই রয়ে যায়।
মানুষের শরীরের এসব অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা এবং বুদ্ধিমত্তাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় তিনি সেসব প্রক্রিয়া নিয়ে দিক-নির্দেশনা দেন। এতে মানুষ নিজের ভেতর থেকে নিজেকে সারিয়ে তোলার উপায়গুলো জানতে পারে, এবং তার জীবন উপভোগ করতে পারে। মানুষের অভ্যন্তরীণ কল্যাণের জন্য এই উপায়গুলো তিনি সকল মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান।
সাধগুরুর মতে, আমরা যা খাই বা পান করি, তা আমাদের দেহেরই অংশ হয়ে যায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে না। অন্তর্ভুক্তির এই অনুভূতি কোনো মানুষের মাঝে আসলে তিনি সহমর্মিতা, সহানুভূতি, প্রেম-ভালোবাসা এসব কিছু নিজের অস্তিত্ব, দেহ এবং মনের সাথে অনুভব করতে পারবেন, কারণ মানুষকে এভাবে তৈরি করা হয়েছে। তিনি আরো বুঝতে পারবেন এই গুণাবলীগুলো তার দেহ ও মনের সাথে স্বাভাবিকভাবেই জড়িত যথাযথ প্রক্রিয়ার অভাবে ধীরে ধীরে মুছে যেতে শুরু করে।
ঠিক যেমন বাইরের জগতে ভাল থাকার জন্য একটা প্রযুক্তি রয়েছে, আমাদের ভিতরের কল্যাণকে সৃষ্টি করে নেওয়ারও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির একটা সম্পূর্ণ দিক আছে।
– সদগুরু
এছাড়া তার ইনার ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি বই আছে। এই বইতে তিনি দেখিয়েছেন- কীভাবে একজন মানুষ যোগব্যায়াম বা ধ্যানের মাধ্যমে নিজের জীবনের আনন্দ এবং খুশি লাভ করতে পারে। মানুষের শরীর একটি আশ্চর্য কারখানা, এবং ধ্যানের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ শরীরে অনেক কিছুরই পরিবর্তন আনতে পারে। মূলত ইনার ইঞ্জিনিয়ারিং হলো বৈজ্ঞানিক উপায়ে যোগব্যায়ামের মাধ্যমে দৈনন্দিন কার্যক্রম, এবং জীবনে আনন্দ লাভের মাঝে ভারসাম্য তৈরি করা। সাধগুরুর মতে, মানুষের শারীরিক সমস্যাগুলো নিজেদেরই তৈরি, এবং সেসব সমস্যা চাইলে নিজেরাই সারিয়ে তুলতে পারে। তবে এজন্য প্রয়োজন যথাযথ ধ্যান বা যোগব্যায়াম।
তিনি ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটোর শহরের কাছে ইশা ফাউন্ডেশন নামক একটি অলাভজনক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যা সারা বিশ্বে যোগব্যায়ামের বিভিন্ন নিয়ম এবং এর উপকারিতা নিয়ে কাজ করে। এছাড়াও এটি সমাজ, শিক্ষা এবং পরিবেশ নিয়েও কাজ করে। তার লেখা বইগুলো ‘স্বাস্থ্য’, ‘ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও বিশ্বাস’, এবং ‘পরামর্শ, কীভাবে-কী এবং বিবিধ’ ইত্যাদি একাধিক বিভাগে নিউ ইয়র্ক টাইমসের শ্রেষ্ঠ বিক্রয়ের তালিকায় ছিল।
মানুষের শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিষয়েও তিনি বিভিন্ন পরামর্শ দেন। মানুষের শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক উন্নতি সাধনের জন্য তিনি বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা ও পরামর্শ দেন। মানুষের খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনের রীতিনীতি নিয়ে বিভিন্ন উপদেশ তিনি দিয়ে থাকেন। মানুষের শারীরিক, মানসিক, আত্মিকসহ পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বক্তব্য দিয়ে থাকেন। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে তিনি বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেন। এই পৃথিবীতে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকারের পাশাপশি অন্যান্য প্রাণী ও গাছপালা সংরক্ষণের প্রতিও তিনি জোর দেন।
জাতিসংঘের সদর দপ্তর, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম, অস্ট্রেলিয়ান লিডারশিপ রিট্রিট, ভারতীয় অর্থনৈতিক সামিট এবং TED-এ একজন প্রধান বক্তা হিসেবে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন। এছাড়াও তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইয়েল ইউনিভার্সিটি, হোয়ার্টন ইউনিভার্সিটি, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিসহ বিভিন্ন নামকরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি গুগলেও বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের উপর দেয়া তার বক্তৃতাগুলো ইউটিউবে আছে। আগ্রহী পাঠকরা চাইলে বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় সেগুলো উপভোগ করতে পারেন।
আধ্যাত্মিকতার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মানজনক বেসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণ লাভ করেন।
২০১৯ সালে ইন্ডিয়া টুডে-র ৫০ জন শীর্ষ ভারতীয়র তালিকায় তার নাম উঠে আসে। ২০১২ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর ১০০ জন শীর্ষ ভারতীয়র তালিকাতেও ছিলেন সাধগুরু।