নিজস্ব কিছু স্টাইল আর গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজেকে তুলে ধরা এক অভিনেতার নাম সালমান খান। দর্শকদের প্রিয় ‘সাল্লু ভাই’ যেমন তার অভিনয়ের জন্য খ্যাত, একইভাবে নানা সময় নানা অসংলগ্ন কাজের জন্য নিন্দিতও। গুজবের সাথে যেন তার চিরকালের বন্ধুত্ব। রূপালী পর্দায় দেখা মানুষটাকে নিয়ে আজ বেশি কিছু বলব না, আজকে তার পর্দার আড়ালে নায়ক হয়ে ওঠার কথাই আপনাদের জানানো হবে।
মিডিয়া জগতের মানুষ মাত্রই সহজাত কারণে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তাদের দূরত্বটা অনেক। টেলিভিশনের পর্দায় আমরা যতটুকু দেখি বা তাদের সম্পর্কে যতটুকু জানতে পারি, আমাদের জানার পরিধিটা ঠিক তাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। তাদের ব্যক্তিজীবন আমাদের কাছে অনেকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ। শাহরুখ খানের ঠিক পরেই দ্বিতীয় এই খানের রাজত্ব চলে বলিউড জগতে। তিনি তার অভিনয় ও নিজস্ব ধারার নাচের স্টাইলের কারণে সবসময় খবরের শীর্ষে থাকেন।
ব্যক্তিজীবনে যথেষ্ট স্ক্যান্ডালের সাথেও তিনি জড়িত। কখনো বিভিন্ন নায়িকার সাথে প্রেমের খবরে লাইম লাইটে এসেছেন, কখনো কোনো অসংলগ্ন আচরণের কারণে সমালোচনার পাত্র হয়েছেন, কখনো আবার জেলের ঘানিও টেনেছেন কৃতকর্মের কারণে। এত বাকবিতন্ডা সত্ত্বেও তার প্রতি দর্শকদের বা আপামর জনসাধারণের ভালোবাসা কখনো কমেনি। কারণ তিনি ব্যক্তিজীবনে একজন পরম পরোপকারী ব্যক্তি। তার পক্ষে যতটা সম্ভব হয়েছে, তিনি সবসময় সকলের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, সাহায্যকারী বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সহায়তা করেছেন নিভৃতে। বড় মনের অধিকারী না হলে শুধু মানবতার সম্পর্কে থাকা মানুষের পাশে পরম বন্ধু হিসেবে দাঁড়ানোটা বোধহয় খুব একটা সহজ কাজ নয়।
বলিউডের হাতেগোনা কিছু মানুষ আছেন, যাদেরকে আমৃত্যু মনে রাখতে হয় তাদের মানবসেবায় এগিয়ে আসার জন্য। এক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয় সালমান খানের চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন বিয়িং হিউম্যান এর কথা। এটি একটি লাইসেন্সপ্রাপ্ত চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন।
২০০৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠানটির শুভ সূচনা করেন। এই ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জীবনে আশার আলো ফোটানো। এখানে বিশেষত শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। এমন একটি উদ্যোগের ব্যাপারে সালমান খান বলেন, “সৃষ্টিকর্তা আমাকে অনেক দিয়েছেন। এটা আমার সৌভাগ্য। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাই আমারও কিছু মানবিক দায়িত্ব রয়েছে। সমাজের অবহেলিত মানুষদের জন্য কিছু করার চিন্তাভাবনা অনেকদিন যাবতই করছিলাম। অবশেষে বিয়িং হিউম্যান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াসের সূচনা করলাম।” এই ফাউন্ডেশনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২০০৭ সালে মুম্বাইয়ের সিনেম্যাক্সে প্রায় ৫০০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে লাল গালিচা শুভেচ্ছা জানানো হয়েছিল।
তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল কিছু শুভেচ্ছা পুরস্কার। তাদের নিরানন্দ জীবনে ক্ষণিকের জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল কিছু ভালো সময়, যা হয়তো তারা সারাজীবন মনে রাখবে। সালমান খানের এই ফাউন্ডেশনের কার্য পরিচালনার জন্য পুরো অর্থটাই আসে তার নিজস্ব আয় থেকে।
অনেকেই হয়তো জানে না, তিনি একজন ভালো চিত্রশিল্পীও। তার আঁকা ছবিগুলো নিয়ে তিনি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে থাকেন এবং এ থেকে প্রাপ্ত অর্থের পুরোটাই চ্যারিটির জন্য খরচ করেন। এই ছবিগুলো নিয়ে ২০০৯ সালের অক্টোবরে সর্বপ্রথম দুবাইতে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় এবং এতে মানুষের অভাবনীয় রকমের সাড়া পাওয়া যায়।
এখানে উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিস রিসার্চ কাউন্সিল ও ব্রিটিশ অ্যাকাডেমীর যৌথ উদ্যোগে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের স্কুল অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিতে প্রদর্শিত হবে সালমান খানের নতুন কিছু চিত্রকর্ম।
তিনি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের অধীনে বিয়িং হিউম্যানের লোগো সম্পর্কিত বেশ কিছু পণ্য বাজারজাত করা হয়। এই খাত থেকে প্রাপ্ত অর্থও সালমান খান মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেন। প্রথমেই বলা যাক ভারতের মানধানা ইন্ড্রাস্ট্রিজের সাথে চুক্তির কথা। ভারতের টেক্সটাইল ও অ্যাপারেলস কোম্পানীর শীর্ষ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মানধানা ইন্ড্রাস্ট্রিজ অন্যতম। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মণীষ মান্ধানা ও সালমান খানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী তার কোম্পানী বিয়িং হিউম্যানের লোগো সম্বলিত পোশাকের ডিজাইন, প্রস্তুত ও বিক্রয়ের দায়িত্ব বহন করবে।
বিয়িং হিউম্যানের লোগো ব্যবহার করার কারণে নির্দিষ্ট লাইসেন্স ফি এবং বিক্রিত অর্থের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিয়িং হিউম্যান ফাউন্ডেশনে জমা দেবেন। পক্ষান্তরে, তিনিও দেশে-বিদেশে তার কোম্পানীর ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ানোর জন্য সালমান খানের ফাউন্ডেশনের লোগোকে ব্যবহার করবেন।
গীতাঞ্জলি গ্রুপের সিএমডি মেহুল চকসির সাথে বিয়িং হিউম্যানের লোগো সম্বলিত রৌপ্য ও স্বর্ণের মুদ্রা বিক্রয়ের ব্যাপারে একটি চুক্তি সাক্ষর করেন। ভারতীয়দের কাছে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের জিনিস যেমন প্রিয়, ঠিক তেমনি বলিউডের তারকারাও তাদের মনের অনেকটা জুড়ে থাকে। এসকল মুদ্রার ডিজাইন গীতাঞ্জলি গ্রুপের তত্ত্বাবধানেই হয়ে থাকে। প্রতিটি মুদ্রার সাথে সালমান খানের ভক্তদের উদ্দেশে একটি করে শুভেচ্ছাবার্তা থাকে।
ভারতে বহু মানুষ আছে যারা লিউকেমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, অ্যাপ্লাস্টিক এনিমিয়া, কনজেনিটাল ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সহ নানা রোগে ভুগে থাকেন। অস্থিমজ্জা বা বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে তাদেরকে সুস্থতা প্রদান করা সম্ভব। অস্থিমজ্জা দান করার ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে তিনি ম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রি ইন্ডিয়ার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
এছাড়াও বর্তমানে বাজারে বিয়িং হিউম্যানের লোগোযুক্ত কলম ও ঘড়ি পাওয়া যাচ্ছে। এসব খাত থেকে উপার্জিত অর্থের পুরোটাই ব্যয় হয় মানবসেবায়। বিয়িং হিউম্যানের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় সালমান খানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে আরো নতুন কিছু প্রোডাক্টের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তার মানবসেবার কাজকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
সালমান খান বলেন, “দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে তার রোগমুক্তিতে সহায়তা না করাটা একধরনের অন্যায়ের মধ্যে পড়ে”। সমাজ যাদেরকে অবহেলা করে দূরে সরিয়ে দেয়, সালমান খান তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। অর্থ সহায়তার পাশাপাশি তিনি হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের সাথে দেখা করতে যান, তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করেন। বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে তার সক্রিয় উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদস্বরূপ তিনি ‘বাচপান বাঁচাও’ (শৈশব বাঁচাও) আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন। প্রতিটি শিশুর অধিকার রয়েছে তার শৈশব উপভোগ করার।
এ তো গেলো তার ফাউন্ডেশনের কথা। তার সেবামূলক কাজ কি শুধু এই ফাউন্ডেশনকে ঘিরেই? উত্তরটা- একদমই না। তিনি গরীব-দুঃস্থ, অসহায় শিশু, অসুস্থ রোগী, বন্ধু-বান্ধব এককথায় যাকে যেভাবে যতটা সাহায্য করা যায়, সাহায্য করে থাকেন। শিশুদেরকে বাইসাইকেল, উপহার সামগ্রী প্রদান, শিক্ষার ব্যবস্থা করা, ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে কম্বল প্রদানের মাধ্যমে কিছুটা উষ্ণতায় রাত্রিযাপনের সুবিধা করে দেয়া প্রভৃতি কাজ তিনি নীরবে করে যান। শুধু তা-ই নয়, এমনও অনেক বলিউড তারকা আছেন, যাদের পরম বিপদের দিনে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের ব্যক্তিগত বা পেশাক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
রূপালী পর্দার নায়ক সালমান খানের ব্যক্তিজীবনের মানবসেবার দিকটি সকলের কাছে তুলে ধরার ছোট্ট একটি প্রয়াস ছিল এই লেখাটি। আমরা সকলেই হয়ত নিজেদের গন্ডি থেকে ছোট ছোট কিছু অবদান রাখতে পারি মানবসেবায়। হয়ত আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কারোর ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে।