এই যুগের প্রতিভাবান অভিনেতাদের তালিকা তৈরি করলে প্রথম দিকেই তার নাম থাকবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে কোনো পরিচালকের মনস্তাত্ত্বিক কোনো চরিত্রের জন্যে অভিনেতার প্রয়োজন হলে, প্রথমেই তার নামটি তাদের মাথায় আসে। তিনি হচ্ছেন সেই বিখ্যাত টেলিভিশন ড্রামা ‘ব্যান্ড অফ ব্রাদার্স’ দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করা ব্রিটিশ অভিনেতা টম হার্ডি।
ব্যক্তিগত জীবন
ইংলিশ এবং আইরিশ বংশদ্ভুত এই অভিনেতার পুরো নাম এডওয়ার্ড থমাস হার্ডি। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডনের হ্যামারস্মিথে। তার মা এলিজাবেথ অ্যানি একজন চিত্রশিল্পী এবং বাবা চিপস হার্ডি চিত্রনাট্যকার। মা-বাবার খুব আদরের ছেলে ছিলেন টম। শত ব্যস্ততার মাঝেও তারা ছেলের জন্য সময় বের করে নিতেন। কাজ থেকে ফেরার সময় প্রায়ই তার জন্য বই, গানের ক্যাসেট সহ আরও অনেক উপহার নিয়ে আসতেন।
হ্যামারস্মিথে জন্মালেও টম হার্ডির শৈশব আর কৈশোরের পুরোটা কেটেছে লন্ডনের শিন শহরে। পড়াশোনার জন্যে তাকে ভর্তি করা হয় সেখানকারই রিড’স বোর্ডিং স্কুলে। কিন্তু মাত্র তেরো বছর বয়সেই তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন এবং চুরির অপরাধে বোর্ডিং স্কুল থেকে বহিস্কৃত হন। রিড’স থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর নিয়মিত মদ্যপানের পাশাপাশি হেরোইন সেবন করতেও শুরু করেন টম। মদ-গাঁজার প্রতি আসক্তির পাশাপাশি ছোটখাটো অপরাধকর্মেও লিপ্ত হয় পড়েন তিনি। রাস্তাঘাটে মারামারি আর গাড়ি চুরির অপরাধে বেশ কয়বার জেল খাটতেও হয়েছিল তাকে।
তবে অ্যালকোহল আর ড্রাগ দমিয়ে রাখতে পারেনি টম হার্ডির অভিনয়ের বাসনা। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল অভিনেতা হওয়ার, তাই ভর্তি হয়ে যান লন্ডনের রিচমন্ড ড্রামা স্কুলে এবং মাত্র ১৯ বছর বয়সে জিতে নেন ‘দ্য বিগ ব্রেকফাস্ট’ আয়োজিত ‘ফাইন্ড মি অ্যা সুপারমডেল’ প্রতিযোগিতা। কিন্তু অপকর্ম আর পিছু ছাড়ে না তার, আবারও চুরির অপরাধে বহিস্কৃত হন রিচমন্ড স্কুল থেকে। শেষমেশ ভর্তি হন সেন্টার লন্ডনের নামকরা ‘ড্রামা সেন্টারে’। সেখানে তিনি মেথড অ্যাক্টিং নিয়ে পড়াশোনা করেন। তবে খুব বেশিদিন সেখানে কাটাতে হয়নি তাকে, ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরই ডাক পান ‘ব্যান্ড অফ ব্রাদার্স’-এ অভিনয়ের জন্যে। স্কুল ছেড়ে দিয়ে নেমে পড়েন অভিনয়ে।
কিন্তু মাদকাসক্তি ছাড়তে পারছিলেন না তিনি কিছুতেই। মদ্যপান এবং ড্রাগ সেবন সারাহ ওয়ার্ডের সাথে তার তিন বছরের সংসার ভেঙ্গে দেয়। এই আসক্তি তাকে এতই তাড়া করে বেড়াতে লাগলো যে, ২০০৩ সালে টানা কোকেন সেবনের পর লন্ডনের সোহোতে রক্ত ও বমির সাগরে আবিস্কার করা হয় তাকে। এই ঘটনা নিয়ে পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “এটা আমার কাছে একটি শিক্ষা ছিল, মৃত্যু যেন নতুন করে জীবন দিল আমায়।”
বাবা-মায়ের সহায়তায় তিনি ড্রাগ পুনর্বাসনে কেন্দ্রে ভর্তি হন এবং স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য বিশেষজ্ঞ নির্দেশিত ব্যায়াম করতে শুরু করেন। অবশেষে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর তিনি বেশ কিছু টিভি সিরিজ আর সিনেমার চরিত্র হাতে নেন। এমনকি শটগান থিয়েটার নামে নিজেই একটি রেপার্টরি থিয়েটার খুলে বসেন এবং ২০০৩ সালে ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড বেস্ট নিউকামার অ্যাওয়ার্ড’ জেতার পর তিনি নিয়মিত মঞ্চ নাটকে অভিনয় শুরু করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। দুর্দশাময় অতীত জীবন কাটিয়ে তিনি এগোতে শুরু করেন তার সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে।
অভিনয় জীবন
টম হার্ডির পেশাগত অভিনয় জীবন শুরু হয় ২০০০ সালে নির্মিত ‘ব্যান্ড অফ ব্রাদার্স’ টিভি সিরিজে অভিনয়ের মাধ্যমে। সে বছরই ডাক পান বিখ্যাত পরিচালক রিডলি স্কট পরিচালিত ‘ব্ল্যাক হক ডাউন’ সিনেমায় অভিনয় করার জন্য। ২০০২ সালে তিনি অভিনয় করেন ‘স্টার ট্রেক: নেমেসিস’ সিনেমার খলনায়কের চরিত্রে। তিনি রেমন যোদ্ধাদের নেতা প্রাইটর শিঞ্জনের চরিত্রটি রূপায়ন করেন। শুরুর এই তিনটি কাজই তাকে লাইম লাইটে নিয়ে আসার জন্যে যথেষ্ট ছিল। বিশেষ করে ‘ব্যান্ড অফ ব্রাদার্স’ চরিত্রটিই তার অভিনয় জীবনের ভিত শক্ত করেছিল। পরবর্তী কয়েক বছর তিনি একটানা বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ড্রামায় অভিনয় করেন।
টম হার্ডি আলোচনায় আসেন ২০০৮ সালে। বছরের শেষ দিকে মুক্তি পায় তার অভিনীত দুটি সিনেমা। প্রথমটি ছিল পরিচালক গাই রিচি পরিচালিত সিনেমা ‘রক এন রলা’ এবং সেখানে তিনি অভিনয় করেন সমকামী এক সন্ত্রাসীর চরিত্রে। এর ঠিক পরপরই মুক্তি পায় তার অভিনীত ‘ব্রনসন’,যার প্রধান চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি জিতে নেনে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেব ব্রিটিশ ইন্ডিপেনডেন্ট চলচ্চিত্র পুরস্কার।
তবে তার ক্যারিয়ার আরও উজ্জ্বল হয় ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ইনসেপশন’ সিনেমায় অভিনয় করার পর। ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমার মাধ্যমেই তিনি বিশ্বব্যাপী মূলধারার দর্শকদের কাছে পরিচিতি লাভ করেন। সেই সুবাদে পরের বছরই সুযোগ হয় তার ব্যক্তিগত পছন্দের অভিনেতা গ্যারি ওল্ডম্যানের সাথে অভিনয় করার। ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া সেই সিনেমাটির নাম ‘টিঙ্কার টেইলর সোলজার স্পাই’। সেখানে তিনি অভিনয় করেন এক ফিল্ড এজেন্টের চরিত্রে। সেই বছরই তিনি আরও দুটি সিনেমায় অভিনয় করেন। বিশেষ করে ‘ওয়ারিয়র’ সিনেমায় টমি ক্লনটন চরিত্রের জন্যে ‘নেভাডা ক্রিটিকস সোসাইটি’ সেরা অভিনেতার পুরষ্কার দেয় তাকে। সে বছরই অভিনয় জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং চরিত্রটি তার হাতে আসে।
ক্রিস নোলান তার ডার্ক নাইট ট্রিলজির শেষ সিনেমার বেইনের চরিত্রের জন্যে পছন্দ করেন টম হার্ডিকে। কারণ তার দরকার ছিল হার্ডির মতই একজন অভিনেতা, যে চরিত্রের স্বার্থে সবকিছু করতে প্রস্তুত। আগেও নোলানের সাথে কাজ করেছেন তিনি, তাই তাদের মধ্যে বেশ সখ্যতা করে উঠেছিল। সে কারণে সিনেমার স্ক্রিপ্ট না পড়েই টম চরিত্রটি করতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু স্ক্রিপ্টে তাকে বেইনের যে সংস্করণ দেওয়া হয়, এর বাইরে কমিক বইয়ের বেইন সম্পর্কে তার তেমন একটা ধারণা ছিলো না। এ ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“আমি যখন প্রথম বেইনের কথা শুনলাম, তখন অনেকের মতো আমারও তার সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা ছিলো না। তাই নিজেরই চরিত্রটি সম্পর্কে জানার দরকার ছিল। আমি বেইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম, প্রথমেই তার মুখোশ, তার কুস্তির টাইট প্যান্ট আর বিশাল পেশী দেখেই আমার মনে হলো, ‘অ্যা! একি? আমার পক্ষে এই চরিত্রে অভিনয় করা সম্ভব নয়, নোলান ভুল মানুষের কাছে এসেছেন’।”
তবে একেবারে হাল ছেড়ে দেননি টম। তিনি নোলানের সাথে আলোচনা করে তার বেইন সংস্করণের সম্পর্কে ভালো করে ধারণা নেন এবং বেইনের ইতিহাস তলিয়ে নতুন কিছু বের আনা চেষ্টা করেন। টম হার্ডির বেইন সংস্করণ কমিক বইয়ের বেইন চরিত্রের নেপথ্যের কিছু বিবরণ এড়িয়ে যাওয়ায় তিনি মনে করতেন, কমিক ভক্তরা হয়তো তার তুলে ধরা এই নতুন ব্যাপারগুলো মেনে না-ও নিতে পারে। তবে তিনি আশা করেছিলেন যে, সমর্থকরা চরিত্রের তারতম্যটা তলিয়ে দেখবে আর সেটা গ্রহণ করে নেবে।
চরিত্রটির স্বার্থে টমকে প্রায় ত্রিশ পাউন্ডের মতো ওজন বাড়াতে হয়েছিল। ‘দ্য ডার্ক নাইট’ চলচ্চিত্রে জোকার চরিত্রে অভিনয় করার সময় হিথ ল্যাজার যে স্বাধীনতা পেয়েছিলেন, তার তুলনায় টম হার্ডি ঠিক ততোটা পাননি। তবুও চলচ্চিত্রের হাতেগোনা কিছু দৃশ্যের ডায়ালগ ছিল ঠিক ধারণের মুহূর্তেই তৈরি করা। বিশেষ করে একটা দৃশ্যে একটি কিশোর যখন গোথামের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনা করছিল, তখন বেইনের ‘That’s a lovely, lovely voice.’ ডায়লগটি অন সেটে তৈরি করা। তাছাড়া বেইনের কণ্ঠে তিনি একটি ব্যতিক্রম ভাব আনার চেষ্টা করেন। চলচ্চিত্রে টম হার্ডির অভিনয় ছিল প্রশংসনীয়। তিনি তার চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। দর্শক থেকে শুরু করে সমালোচকরাও তার অভিনয়ের প্রশংসা করেন।
২০১৫ সাল তার জীবনে আসে সাফল্যের জোয়ার হয়ে। বছরের শুরুতেই টম অভিনয় করেন কিংবদন্তি ম্যাড ম্যাক্স চরিত্রে। জর্জ মিলার তার পুরনো ম্যাড ম্যাক্স সিরিজ নতুন করে শুরু করেন এবং ম্যাক্স চরিত্রের জন্য বেছে নেন টম হার্ডিকে। এর পরপরই তিনি অভিনয় করেন বার্মিংহামের কুখ্যাত দুই যমজ ভাই রেজি ক্রে/রন ক্রে’র উপর নির্মিত ‘লিজেন্ড’ নামের বায়োগ্রাফি সিনেমায় এবং দ্বিতীয়বারের মতো শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ব্রিটিশ ইন্ডিপেনডেন্ট চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেন।
বছর শেষ হবার আগেই মুক্তি পায় আলেহান্দ্রো গঞ্জালেস ইনারিতু পরিচালিত এডভেঞ্চার সিনেমা ‘দ্য রেভেন্যান্ট’। সেই সিনেমার খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে প্রথমবারের মতো অস্কার মনোনয়ন পান টম হার্ডি। সম্প্রতি আবারও নোলানের সাথে ডানকার্ক সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। সিনেমাটি দর্শক, সমালোচক দুই দলের কাছেই ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। এই বছর তার ‘ট্যাবু’ নামে নতুন একটি টিভি সিরিজ চালু হয়েছে। সেখানে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। ২০১৮ সালে মারভেলের নামকরা এন্টি হিরো ভেনমের চরিত্রে দেখা যায় তাকে।
পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই বেশিরভাগ সিনেমায় তাকে দেখা গেছে হয় ভিলেন নাহয় খল কোনো চরিত্রে অভিনয় করতে। এর পেছনে কিছুটা হলেও প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে তার অতীতের কিছু ঘটনা। এই নিয়ে তিনি নিজেই বলেন,
“এখন আমি একজন অভিনেতা, অপরাধী নই। কিন্তু নিজের অতীতের কারণেই হয়তো আমি নিজেকে তাদের জায়গায় কল্পনা করতে পারি। নিজের দুর্দশাময় অতীত এখন আমার নিরাপদ শিক্ষাস্থল। ব্যাপারটা ভাবতেই দারুণ লাগে।”
বর্তমানে হলিউডের সাথে সম্পৃক্ত ভার্সেটাইল অভিনেতাদের তালিকায় নিঃসন্দেহে নাম থাকবে টম হার্ডির। নায়ক/খলনায়ক দুই ধরনের চরিত্রই তিনি রূপায়ন করতে পারেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।