১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাস, বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ গড়ালো বিশৃঙ্খলায়। যার ফলে জন্ম নেয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অসংখ্য দমন-পীড়নের ঘটনা। অসংখ্য ঘটনা থেকে ঐ দাঙ্গায় গ্রেফতার হওয়া ১৫ বছরের একটি ছেলের গল্পকে আলাদা করে নিচ্ছি। কেন? পড়তে-পড়তে এর উত্তর পাঠকই খুঁজে পাবেন বলে আশা রাখছি।
১৫ বছরের কিশোরটি গ্রেফতার হলো ‘বোম্বে রায়ট’-এ, অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় আদালত তাকে ক্ষমা করে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু কিশোরটির স্মৃতিতে তখনও ভাসছে লকলকে প্রতিহিংসার আগুন, যে আগুনে সে পুড়ে যেতে দেখেছে তার স্বজাতের মানুষকে, যাদের খুন করা হচ্ছিলো ঠাণ্ডা মাথায়। এসবের প্রতিশোধের আশায় তাই এবার কিশোরটির গন্তব্য হলো পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উগ্রপন্থার প্রশিক্ষণ শিবিরে। সেখানে চললো অস্ত্র চালানোর শিক্ষা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কিশোরটি সেখানকার মতাদর্শের সাথে নিজের ধ্যান-ধারণাকে আর মেলাতে পারে না, ফলে নিজের ভুল বুঝতে পেরে পালিয়ে চলে আসে তার আপন স্থানে। কিন্তু এই ভুলের দাগ থেকেই গেলো, আবারও গ্রেফতার করা হলো তাকে, এবার Terrorist and Disruptive Activities (Prevention) Act, সংক্ষেপে TADA-র আওতায় অভিযোগ আনা হলো যে কিশোরটি রাজনীতিবিদ ও শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বালাসাহেব ঠাকরেকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে। লোধি রোডের কুখ্যাত বিশেষ কারাগারে তাকে করা হলো নির্যাতন, জ্যুভেনিল জাস্টিস আইন উক্ত আইনের আওতায় না পড়ায় এবার আর রক্ষা পেলো না সে, ভুয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি তৈরি করা হলো কিশোরটির নামে, যা সে কখনো দেয়ইনি। এই একটিমাত্র প্রমাণের জের ধরে তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়ে গেলো। অবশ্য এর পূর্বেই কিশোরটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো দক্ষিণ এশিয়াতে সর্ববৃহৎ তিহার কেন্দ্রীয় কারাগারে।
“By showing me injustice, he taught me to love. By teaching me what pain and humiliation were all about he awakened my heart to mercy. Through these hardships I learned hard lessons. Fight against prejudice, battle the oppressors, support the underdog.” ― Roy Black
আমেরিকান ক্রিমিনাল ডিফেন্স আইনজীবী রয় ব্ল্যাকের এই কথাগুলোকে জীবনের লক্ষ্য ধরে নিয়ে আইন পেশাকে বেছে নিলেন এক যুবক। যার উদ্দেশ্য এমন অভিযুক্তদের জন্য আইনি লড়াই করা, যাদেরকে আইনেরই ফাঁক-ফোকরের প্যাঁচে ফেলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসবার আর্থিক সাধ্য নেই। যুবকটি বিশেষভাবে বেছে নিলেন রাষ্ট্রে সংঘটিত বিভিন্ন জঙ্গিবাদমূলক তৎপরতায় করা মামলাগুলো, যেগুলোতে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণের পূর্বেই ব্যক্তিটি পুরো সমাজের কাছে অপরাধীতে পরিণত হয়ে যায়। প্রতিরক্ষা আইনজীবী হিসেবে Prevention of Terrorism Act, 2002 (POTA) এর অধীনের মামলাগুলোর বিবাদী পক্ষের উকিল হিসেবে কাজ শুরু করলেন তিনি।
পরবর্তী কথায় যাওয়ার আগে পাঠককে এখন জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে শুরুতে বলা গ্রেফতারকৃত কিশোরটি এবং তারপর উল্লেখ করা তরুণ আইনজীবী আসলে একই মানুষ, যার পরিচয় শাহিদ আজমি। জেলখানার আসামী থেকে আইনজীবী হওয়ার ঘটনা পর্যন্তই হতে পারতো শাহিদ আজমির জীবনের গল্প। কিন্তু শাহিদ আজমি যে ব্যবস্থার ফাঁদে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা থেকে দূরে সরে না গিয়ে বরং তার মধ্যে থেকেই নিজের অবস্থার সম্মুখীন হওয়া নির্দোষদের রক্ষা করার ব্রত নিয়েছিলেন। আর এ ব্রত পালনের সংকল্পে দৃঢ় ছিলেন আমৃত্যু!
তিহারে কারাবাসকালীন সময়ে কিশোর শাহিদ শুরু করলেন পড়ালেখা। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অতিক্রম করলেন কারাগারে থাকাকালীনই। ১৯৯৯ সালে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড পান এবং একই বছরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হন। ২০০১ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন। মুক্তি পাওয়ার এলএলবি পাশ করে তিনি কিছুদিন সহ-সম্পাদকের কাজ করেন একটি দৈনিকে। তারপর মাসে মাত্র দু হাজার টাকা বেতনে প্রতিরক্ষা আইনজীবী মজিদ মেননের অধীনে কাজ শুরু করেন। কিন্তু সেখানে বেশিদিন কাজ করলেন না তিনি, নিজেই স্বাধীনভাবে কাজ করা শুরু করলেন একজন প্রতিরক্ষা আইনজীবী হিসেবে। আর এখান থেকেই একজন আইনজীবী হয়ে উঠলেন নির্দোষ মানুষের ভরসার প্রতীক, শাহিদ আজমি।
অস্বচ্ছল মানুষের কাছ থেকে কোনো ধরনের পারিশ্রমিক না নেওয়া এই আইনজীবী মাত্র সাত বছরের কর্মজীবনে ১৭ জন অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস লাভ করিয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো রাষ্ট্রদোহিতার, জঙ্গিবাদের। ভারতের বিচারব্যবস্থা অনুযায়ী এ ধরনের মামলায় অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস পাওয়ানো অত্যন্ত দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ। ২০০২ সালের ঘাটকোপাড় বাস বোমা-হামলা কেইসে প্রতিরক্ষা আইনজীবী হিসেবে সাফল্যের শুরু হয় তার। Prevention of Terrorism Act (POTA)-এর অধীনে গ্রেফতারকৃত ও প্রধান অভিযুক্ত আরিফ পানওয়ালাকে অব্যাহতি লাভ করান। এর জের ধরে পরবর্তীতে আইনটিও পরিবর্তিত হয়। ৭/১১ মুম্বাই লোকাল ট্রেন বিস্ফোরণ, ২০০৬ এর আওরঙ্গবাদ অস্ত্র জব্দ, ২০০৬-র মালেগাঁও বিস্ফোরণ কেইসগুলোতে অভিযুক্তদের হয়ে আদালতে লড়েন।
২০০৮-র মুম্বাই অ্যাটাক বা ২৬/১১ কেইসে তিনি অভিযুক্ত ফাহিম আনসারিকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য লড়ছিলেন। এরই মধ্যে তাকে বিভিন্নভাবে সম্মুখীন হতে হয়েছে অদৃশ্য রক্তচক্ষুর, পেতে হয়েছে জীবননাশের হুমকি।
কেন তিনি এসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পক্ষ নিচ্ছেন? কেন তিনি অভিযুক্তদের নির্দোষ প্রমাণ করে মুক্ত করে আনছেন? তিনি নিজে এসব জঙ্গিবাদ সমর্থন করেন না তো? এ কথাও তো শোনা যায় যে, তিহার কারাগারে তার সাথে খাতির হয়েছিলো ভারত বিমান হাইজ্যাকে জড়িত জঙ্গি ওমার শেখ এবং মাসউদ আজহারের। তিনি নিজেও তো এক সময় গিয়েছিলেন ঐ অন্ধকার পথেই, এজন্যই কি?
এসব কোনো প্রশ্নের ধার ধারতেন না তিনি, তিনি শুধু মনে করতেন,
“Jurm karnewaale aur jurm sehnewaale dono ka koi mazhab nahin hota”, (ইংরেজি ফন্টে হিন্দি ভাষার একটি লাইন)
অর্থাৎ, অত্যাচার যে করে আর যে সহ্য করে তাদের কারোই কোনো ধর্ম থাকতে পারে না।
৭/১১ মুম্বাই লোকাল ট্রেন বিস্ফোরণ, ২০০৬-র মালেগাঁও বিস্ফোরণ কেইসগুলোতে প্রতিরক্ষা আইনজীবী হিসেবে কাজ করার জন্য তার পেছনে কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক জঙ্গিসংস্থার যোগাযোগ রয়েছে কিনা বা তিনি কোনো আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন কিনা, এটিও খতিয়ে দেখা হয়েছিলো, কিন্তু তার সাথে এ ধরনের কোনো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২০১০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি, সন্ধ্যাবেলা শাহিদ আজমি সারাদিনের কাজকর্ম ঐদিনের মতো শেষ করে ঘরে ফিরলেন, তার মা রেহানা আজমি ছেলের জন্য চা এনে রাখলেন, শাহিদ আইনজীবীর কালো পোশাক ছেড়ে বসতে না বসতেই ফোন এলো চেম্বার থেকে; ক্লায়েন্ট কল, যেতে হবে, অফিস সহকারীকে বললেন তাদের পরদিন আসতে বলতে। নাহ, কী একটা জরুরি দরকার, যেতেই হবে। চায়ে চুমুক না দিয়েই তড়িঘড়ি করে দিলেন ছুট তার কর্মস্থল মুম্বাইয়ের কুড়লায়, ট্যাক্সিমেন কলোনিতে। মা’কে বলে গেলেন “আম্মি, এইতো আসছি!” বললেন ঠিকই, কিন্তু আর ফিরতে পারলেন না, চেম্বারে ঢুকতে না ঢুকতেই পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে বুক বরাবর দু’টি গুলি বিঁধলো, আরো কিছু ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে পালিয়ে গেলো এখনো শাস্তি না পাওয়া হত্যাকারীরা। শাহিদের ঠাট্টার ছলে বলা কথাই ফলে গেলো! তিনি প্রায় সময়েই বলতেন বন্দুকের গুলিতেই নাকি তার মৃত্যু হবে।
শাহিদ আজমির মৃত্যুর কিছুদিন পরই ২৬/১১ কেইসটিতে ফাহিম আনসারির বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে তাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়, পরপারে চলে গিয়েও শাহিদ আজমি আবারও আরো একটি নির্দোষ প্রাণ ঠিকই রক্ষা করে দিয়ে গেলেন। মাত্র ৩২ বছরে জীবন প্রদীপ নিভে গেলো ঠিকই, কিন্তু নির্দোষ কতগুলো প্রাণ বাঁচিয়ে আইন-ব্যবস্থার অন্ধকার দিকে যে দ্যুতি তিনি ছড়িয়ে গেলেন, তা উজ্জীবিত করবে আরো অনেক তরুণকে। শাহিদের ভাই খালিদও অনুসরণ করছেন ভাইয়ের দেখানো পথই। আইনজীবী হয়েছেন, ভাইয়ের মতোই অসহায়দের জন্য লড়াই করছেন, সেইসাথে লড়াই চলছে ভাইয়ের হত্যার বিচারেরও।
শাহিদ আজমির জীবন কাহিনী নিয়ে বলিউডের চলচ্চিত্র পরিচালক হানসাল মেহতা বানিয়েছেন সিনেমা, ‘শাহিদ’। তার ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করে রাজকুমার রাও জিতে নিয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার।
শাহিদ আজমি চলে গেছেন, রেখে গেছেন আইনি লড়াইয়ের অনন্য দৃষ্টান্ত। স্পর্শকাতর মামলাগুলোতে ক্ষেত্রবিশেষে মুম্বাই পুলিশের তদন্তের ফাঁক-ফোকর, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ভূয়া প্রমাণাদি তার সওয়াল-জবাবের পারদর্শিতার ফলে যেভাবে বেরিয়ে আসতো, এর ফলে তিনি একটি মহলের বিরাগভাজন হন বলে ধারণা করা হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, আইনি প্রক্রিয়াতে ন্যায় পাওয়া সময়সাপেক্ষ বটে কিন্তু অসম্ভব নয়। নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ব্যক্তির ধর্ম-বর্ণ পরিচয় কিংবা অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার প্রতিবাদ করে গেছেন। বারবার তিনি বলে গেছেন যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তিনিও, অন্য কোনো কিছুর পক্ষে বা বিপক্ষে না, কিন্তু সন্ত্রাসবাদে যুক্ত থাকার মিথ্যা অভিযোগে, বিনা প্রমাণে; বিচারে, বছরের পর বছর জেলখানায় বন্দি হয়ে যে দরিদ্র স্বল্প-শিক্ষিত মানুষেরা, তিনি তাদের ন্যায়ের জন্য লড়ছেন।
কিন্তু শাহিদ আজমির জন্য ন্যায় কে আনবেন?
Featured image: thebigindianpicture.com