উত্তর দিনাজপুরের থানাশহর রায়গঞ্জ। সময়টা ১৯৩৬ সাল, ভারতবর্ষে ইংরেজদের শাসনামল চলছে। রায়গঞ্জের উকিলপাড়ায় কাঁচা-পাকা দালানের বাড়ি। সাথে আছে পুকুর, বাড়ির লাগোয়া খেতে সবজি আর চারদিক ঘিরে আছে গাছগাছালি। একটু দূরেই ঝিল দেখা যায়। গ্রাম বাংলার রেশ কাটিয়ে না ওঠা ছোট মফস্বলে বেড়ে উঠেছেন বালক ‘শওকত আলী’। শিশুদের জীবনে শহুরে আবেশ নেই, ধরাবাঁধা বয়সে স্কুলে যাওয়ার বালাই নেই। হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্ধা সহ নানা ধরনের খেলাধুলার সাথে মিতালী করেই কেটে যায় সারাটা দিন। তবে একদম ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির মাঝে অনেকটা নিমগ্ন থাকতেই ভালোবাসতেন শওকত আলী। অনুসন্ধানী চোখ নিয়ে প্রকৃতিকে অনেক কাছ থেকে দেখার এই সুযোগ তাকে জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক হয়ে উঠার পথে নিঃসন্দেহে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে।
বাবা খোরশেদ আলী সরকার সক্রিয়ভাবে কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তবে পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। বাড়িতে ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতি নিয়ে বেশ ভালোই আলোচনা হতো। বাড়ি জুড়ে বইয়েরও অভাব ছিলো না। রাজনীতি তো বটেই, সাহিত্য কিংবা কবিতা সব বইয়েরই ভালো একটা সংগ্রহ ছিলো খোরশেদ আলীর। বাড়িতে রাখা হতো সাহিত্য পত্রিকাও। শওকত আলীর মা সালেমা খাতুনেরও পড়ালেখার ঝোঁক ছিলো। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পড়ালেখাটাকে অনেক দূর নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে ভাটা পড়ে। তবে একদম করতে পারেননি বললেও ভুল হবে। হুগলি থেকে ডিপ্লোমা করেছিলেন সালেমা খাতুন। স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। মায়ের কাছ থেকে তাই পড়ার আগ্রহটা বেশ ভালো রকমই পেতেন। বাবা কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেও মা ছিলেন মুসলীম লীগের সমর্থক। কিন্তু তার মা-ও তাকে ছেড়ে বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। ১৯৪৯ সালে শওকত আলী যখন ক্লাস এইটে, তার মা ধরাধাম ত্যাগ করেন। একা শওকত বইয়ে ডুবে থাকা বাবাকে দেখে ভাবতেন দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার এই উপায়টা তাকে আরো ভালোভাবে শিখতে হবে। বইয়ের রাজ্যে তিনিও ডুব দিলেন।
রায়গঞ্জ করোনেশান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হলেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। ছাত্রাবস্থায় বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন শওকত আলী। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা ধরনের আন্দোলন সংগ্রামের সাথে। ফলে জেলেও যেতে হয়েছে থাকে। জেলে যাওয়ায় জীবনকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। মানুষের জীবনের সাথে সংগ্রাম, দুঃখ আর আর তাই জেলে বসেও পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। এই কলেজ থেকেই আই.এ এবং বি.এ পাশ করেছেন।
এর মাঝে ভারতের রাজনীতিতে এসেছে গুণগত পরিবর্তন। ভারতবর্ষ এখন শুধু আর একটিমাত্র রাষ্ট্র নেই। জন্ম নিয়েছে পাকিস্তান নামের আরেকটি রাষ্ট্র। ১৯৫২ সাল, দেশভাগের পরপরই পূর্ব বাংলায় স্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শওকত আলীর বাবা। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেও বাঙালি মুসলমানেরা নানাভাবে তাদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলো। নতুন দেশ পাকিস্তানের জন্মের সাথে সাথে সাধারণ বাঙালি মুসলমানেরা স্বপ্ন সাজাতে থাকেন, নতুন দেশে মিলবে তাদের প্রাপ্য সব অধিকার। অনেকটা সেই আশা বুকে নিয়েই খোরশেদ আলী সরকার দিনাজপুর চলে এলেন। দিনাজপুরে বাড়ি কিনে স্থায়ী হয়ে গেলেন। শওকত আলীর স্মৃতিঘেরা সেই রায়গঞ্জ তখন কাঁটাতারের অন্য পাশে। বেদখল হয়ে গেছে তাদের সেই সবুজে ঘেরা বাড়িটি। দেশভাগের দাঙ্গা-হাঙ্গামাও তরুণ শওকত আলীর মনে বেশ দাগ কাটে। এই বাস্তব অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে ১৯৮৯ সালে লিখেছেন ‘ওয়ারিশ’ উপন্যাস। যেখানে তিনি সুনিপুণভাবে ব্রিটিশ শাসনামল, দেশভাগ আর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরেছেন।
বাবা ছিলেন হোমিও চিকিৎসক, তাই প্রথম জীবনে তিনিও চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায় মানবিক বিভাগ নিয়েই পড়াশোনা করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আই.এ এবং বি.এ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলায় এম.এ পড়ার জন্য।
পড়াশোনার মাঝপথে এসেই বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষের সাথে সম্পৃক্ত হতে সাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম। যে বাংলাকে ধারণ করে সাহিত্যজগতে গল্প বোনা শুরু করেছিলেন, সেই বাংলার উপর আঘাত তিনি মেনে নিতে পারেননি। পাকিস্তানী শাসকদের বাঙালিদের উপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ‘উর্দু’ চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে নেমে আসেন রাজপথে। ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে স্ফুরণ জাগ্রত হয়, তাকে নিয়ে অনেক দূর হেঁটেছেন শওকত আলী। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক শাসনের বিরোধী হয়েও রাজপথে আন্দোলন করেছেন। ১৯৫৪-র ৯২ (ক) ধারা জারি করা হলে গ্রেফতার হয়েছিলেন শওকত আলী, ফরহাদ মজহার আর হাজি মোহাম্মদ দানেশের মতো রাজপথে সক্রিয় ব্যক্তিরা। আর এই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনেকটাই উঠে এসেছে তার লেখায়। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে পরম মমতায় তুলে এনেছেন শওকত আলী।
শওকত আলীর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের একটি হলো ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস দিয়ে বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নেন শওকত আলী। অনেক পাঠক এই উপন্যাসটিকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে আখ্যা দিলেও শওকত আলীর মতে,
“ঐতিহাসিক একটি সময় বা পর্যায়কে নিয়ে লেখা হয়েছে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। এই উপন্যাসে কোনো সময় বা ঘটনার প্রামাণিক কোনো কিছুকে উপস্থাপন করা হয়নি। কাহিনী ও ইতিহাস যখন পড়তাম, তখন আমার মনে অনেক জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হতো। যেমন লক্ষণ সেন। রাতের খাবার না খেয়েই লক্ষণ সেন পালিয়ে গেল। বখতিয়ার খিলজি কিন্তু তখনও বাগেরহাট সীমানায় আসেননি। এই যে ইতিহাসের এসব ঘটনা—আমাকে খুব ভাবায়। সেই সাথে আমার মনে জাগে—ইতিহাসের এই পালাবদল—এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? এসব ভাবতে ভাবতেই ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লেখার চিন্তা হয়।”
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ নামকরণ নিয়ে শওকত আলী বরাবরই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। মূলত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এক কালের বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে যখন নতুন কালের সূচনা হচ্ছে, সে অন্তবর্তী সময়কেই বলা হয় প্রদোষকাল। এই অঞ্চলে যখন হিন্দু শাসনের শেষে মুসলিম শাসনের সূচনা হচ্ছে, ঠিক সেই সময় নিয়ে এই উপন্যাস। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, উপন্যাসে সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে বড় হয়েছে এই সময়ে সাধারণ মানুষ কী ভাবছে এই নিয়ে। একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে নতুন ধর্ম, নতুন চিন্তা ও বদলে যাওয়া শাসকদেরকে কেন্দ্র করে সাধারণ কিছু জীবন ঘুরপাক খাচ্ছে ইতিহাসের কালস্রোতে। উঠে এসেছে প্রান্তিক মানুষের গল্প। ‘বসন্তদাস’, ‘লীলাবতী’, ‘ছায়াবতী’রা প্রত্যকেই সাধারণ মানুষের স্বার্থক রূপক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছেন। উপন্যাসের একদম শেষে ‘শ্যামাঙ্গ’কে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। আরো ভালো করে বলতে গেলে, ঐ সময়ের সমাজ আর সভ্যতার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে হেরে গেছে এই মৃৎশিল্পী। তাই এই উপন্যাস শেষ করে সাধারণ মানুষের করুণ আকুতি তীব্র হয়ে ধরা দেয় পাঠকের কাছে। অকপট চিত্তে শওকত আলীও স্বীকার করে গেছেন, এই ‘মৃত্তিকালগ্ন মানুষ‘ আজীবন তাকে মোহের মতো টেনেছে।
সেই মোহ ধরানো মৃত্তিকালগ্ন মানুষগুলোই তো ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করেছে, এদের মধ্যেই উন্মেষ ঘটেছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার ক্রান্তিলগ্ন পাড়ি দিয়ে আশায় বুক বেঁধেছে একটি সুন্দর নাগরিক জীবনের। আর এই ব্যাপারটিকে শওকত আলী তার বিখ্যাত ত্রয়ী উপন্যাস ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কাল স্রোত’ ও ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ এ তুলে ধরেছেন। এই ত্রয়ীর জন্য তাকে ভূষিত করা হয়েছে ‘ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারে’। এই তিন কালজয়ী উপন্যাসের ব্যাপারে শওকত আলীর ভাষ্য অনেকটা এরকম,
“ষাটের দশকের মানুষের মধ্যে চিন্তা-ভাবনার যে পরিবর্তন আসছে, সেটাই ‘দক্ষিণায়নের দিন’, যার মানে হচ্ছে শীতকাল আসছে। ‘কুলায় কাল স্রোত’ হচ্ছে পরিবর্তন যেখানে আঘাত করছে। আর ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ হচ্ছে নতুন সময়টি আসার একেবারে আগের সময়টি। মূলত ষাটের দশকে আমাদের মধ্যবিত্ত এবং সমগ্র সমাজব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসে। নতুন একটা চিন্তা-চেতনা দ্বারা আলোড়িত হয় পুরো সমাজ। ধ্যান-ধারণা চাল-চলন জীবনব্যবস্থায় একটি পরিবর্তনের সুর বেজে ওঠে।”
কর্মজীবনে পেয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো বন্ধুদের। জগন্নাথ কলেজে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর শওকত আলী একসঙ্গে শিক্ষকতাও করেছেন। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ আর ‘খোয়াবনামা’র কারিগরকে দেখেছেন, শিখেছেন। স্বাধীনতার পরে বাংলা সাহিত্যকে হাতে ধরে অনেকদূর নিয়ে যাওয়ার যে মঞ্চ তৈরি হয়েছিলো, সেখানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই দুজন। টিকাটুলীর ‘বিরতি ভিলা’র নিচের তলার একটি ঘরে থাকতেন ইলিয়াস। শওকত আলীও তার জীবনের শেষভাগটি কাটিয়ে দিয়েছেন একই ঘরে।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, শওকত আলী আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্মদিনটিও একই দিনে, ১২ ফেব্রুয়ারি। বয়সে ইলিয়াসের চেয়ে বছর সাতেকের বড় ছিলেন শওকত আলী। কিন্তু ১৯৯৭ সালে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অকালপ্রয়াণে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন শওকত আলী।
শওকত আলীও চলে গেলেন ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি। নিভৃতচারী এই মানুষটি চলে যাওয়ার শেষ জীবনে আরো বেশি অন্তর্মুখী হয়ে উঠেছিলেন। চারদিকে সাহিত্যসভা, বইমেলা, লেখক আড্ডা থেকে অনেকদূরের দ্বীপে নির্বাসিত করেছিলেন নিজেকে। কিন্তু কেন? উত্তরটা অনেকটা এভাবেই দিয়ে গেলেন,
“অপ্রয়োজনে অনেক শব্দ খরচ করতে ভালো লাগে না। আমার জীবনীশক্তি ফুরিয়ে গেছে, যদি আরও একটু শক্তি থাকতো তবে কিছু কিছু মানুষের কথা লিখতাম, বাকি রয়ে গেলো।”
তবে আক্ষেপ থাকলেও কম লেখেননি বাংলা সাহিত্যের প্রদোষকালের এই প্রাকৃতজন। বাংলা সাহিত্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগিয়ে রচনা করে গেছেন ‘পিঙ্গল আকাশ’, ‘অপেক্ষা’, ‘গন্তব্যে অতঃপর’, ‘উত্তরের খেপ’, ‘অবশেষে প্রপাত’, ‘জননী ও জাতিকা’, ‘জোড় বিজোড়’। স্বীকৃতি হিসেবে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’, ‘হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার’, ‘অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘আলাওল সাহিত্য পুরষ্কার’, ‘একুশে পদক’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে এই সাহিত্যিককে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সম্মান ‘ভালোবাসা’ নিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
ফিচার ইমেজ: banglatribune.com